স্বামীর কর্তব্যসমূহ পর্ব-৪



         (৯ ) নবম কর্তব্যঃ এটা এই যে, স্বামীস্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য দেখা গেলে এবং তা' আর দূর হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে একজন স্বামীর পক্ষ থেকে এবং আর একজন স্ত্রীর পক্ষ থেকে উভয়ের মধ্যে আপোস করার জন্য হাকীম নিযুক্ত করবে। যদি উভয়ের মনে মীমাংসার ইচ্ছে থাকে তবে আল্লাহতায়ালা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন। একবার হযরত ওমর (রাঃ) কোন স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বিবাদ মীমাংসার জন্য জনৈক বিচারক পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সে তাদের নিষাদ মীমাংসা না করে দিয়েই প্রত্যাবর্তন করলে হযরত ওমর (রাঃ) তাকে বেত্রাঘাত করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা বলেন, "যদি তারা নিজেদের মধ্যে মীমাংসার ইচ্ছে করে তাহলে তিনি তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন"। হযরত ওমর (রাঃ) যাকে মীমাংসা না করার জন্য বেত্রাঘাত করেছিলেন, সে লোকটি এবার নিয়ত ঠিক করে আবার তথায় চলে গেল এবং উভয়ের মধ্যে চেষ্টা যত্ন করে মীমাংসা করে দিল। স্বামী নিশ্চয়ই স্ত্রীর তত্ত্বাবধানকারী। সে স্ত্রীকে আদব শিক্ষা দেবে এবং ধর্মকর্ম করার জন্য বাধ্য করবে। যদি সে নামায না পড়ে তাহলে তাকে নামায পড়ার জন্য রাজী করাবে; এবং তাকে আস্তে আস্তে আদব-কায়দা শিক্ষা দেবে। প্রথমতঃ তাকে উপদেশ দেবে, সতর্ক করবে এবং ভয় দেখাবে। তাতে যদি ফল না হয় তাহলে তাকে শয্যা থেকে পৃথক করবে। এক হতে তিন রাত্রি পর্যন্ত এরূপ করবে। তাতেও কোন ফল দেখা না গেলে তাকে মৃদু প্রহার করবে। তবে তাকে শারীরিক ক্লেশ দেবে না। কোন স্থানে জখম করবে না। রক্ত প্রবাহিত করবে না। মুখমন্ডলেও প্রহার করবে না। কেউ হুযুরে পাক (দঃ)কে জিজ্ঞেস করেছিল, স্বামীর উপর স্ত্রীর কি দাবী দাওয়া আছে? তিনি বললেন, স্বামী আহার করলে স্ত্রীকেও আহার করাবে, স্বামী বস্ত্র পরিধান করলে স্ত্রীকেও বস্ত্র দান করবে, স্ত্রীর মুখমন্ডলকে বিকৃত করবে না। প্রহারের প্রয়োজন দেখা দিলে জখম না করে তাকে সামান্য প্রহার করবে। নিজের রাত্রি যাপনের গৃহ ব্যতীত তাকে অন্য কোথাও থাকতে দেবে না। দ্বীনের কাজের জন্য তার উপর রাগ করবে এবং প্রয়োজনে দশদিন বা বিশদিন অথবা ত্রিশদিন পর্যন্তও এ অবস্থা থাকলে তাকে ত্যাগ করে নিজে অন্যত্র থাকবে। হুযুরে পাক (দঃ) একবার তা-ই করেছিলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত জয়নব (রাঃ) এর নিকট উপহার পাঠালে হযরত জয়নব। (রাঃ) তা' হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট ফেরত পাঠালেন। হুযুরে পাক (দঃ) যে স্ত্রীর গৃহে ছিলেন তিনি তাকে বললেন, আপনার প্রেরিত উপহার আপনার নিকট ফেরত পাঠিয়ে জয়নব আপনার অপমান করেছেন এবং হেয় করেছেন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা আমাকে হেয় করাতে আল্লাহর নিকট অতি ঘৃণিত হয়েছ। তারপর তিনি তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত সবারই নিকট থেকে পৃথক থাকলেন। একমাস পর তিনি তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন।

        ১০) দশম কর্তব্যঃ স্ত্রীসহবাসের নিয়মাবলী জানা। সহবাসের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। তারপর প্রথম সূরা ইখলাস পাঠ করতঃ তাকবীর ও তাহলীল পড়বে এবং বলবে মহান ও উচ্চ আল্লাহর নামে। অতঃপর পাঠ করবে, "আল্লাহুম্মাজআলহা যুররিইয়্যাতান ত্বাইয়্যিবাতান ইন কুন্তা ক্বাদারতা আন্ তা খরুজ যালিকা মিন ছুলবী" অর্থাৎ হে মাবুদ! যদি তুমি আমার পৃষ্ঠদেশ হতে শুক্র নির্গত কর তবে তা' উত্তম সন্তানরূপে পরিণত করবে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর নিকট আসে সে যেন বলে, "আল্লাহুম্মা জান্নিবনিশ শাইত্বানা অজান্নিবিশ শাইত্বানা মা রাযাক্বতানা" অর্থাৎ হে মাবুদ! আমাকে শয়তান হতে বাঁচাও এবং আমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছ তাও শয়তান থেকে বাঁচিয়ে রাখ। এ দোয়াটির ফল হল, যদি তোমাদের সহবাসের ফলে কোন সন্তান হয়, শয়তান তাকে অনিষ্ট করতে পারে না। যখন শুক্র নির্গত হওয়ার উপক্রম হয় তখন রসনা সঞ্চালন ব্যতীত যে, হযরত বেলাল (রাঃ) ও সোহাইব (রাঃ) মরুবাসীদের এক পরিবারের নিকট এলে তারা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? হযরত বেলাল (রাঃ) বললেন, আমি বেলাল এবং ইনি আমার ভ্রাতা সোহাইব। আমরা পথভ্রষ্ট ছিলাম। আল্লাহ আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন। আমরা যা (গোলাম) ছিলাম আল্লাহ আমাদেরকে মুক্ত করেছেন। আমরা দরিদ্র ছিলাম আল্লাহ আমাদেরকে স্বচ্ছল করেছেন। যদি আমাদের নিকট তোমাদের কন্যা বিবাহ দাও তাহলে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আর যদি আমাদেরকে ফিরিয়ে দাও তবে আল্লাহ পবিত্র। তারা বলল; বরং আপনারা বিবাহ করুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তখন সোহাইব (রাঃ) হযরত বেলালকে বললেন, যদি তুমি হুযুরে পাক (দঃ)এর সহিত আমাদের সাক্ষাৎ ও খেদমতের কথা উল্লেখ করতে, তাহলে উত্তম হত। হযরত বেলাল (রাঃ) বললেন, তুমি চুপ থাক। আমি সত্য কথাই বলেছি। রূপের প্রবঞ্চনা দেখে নিয়ে দূর করা উত্তম এবং স্বভাবের প্রবঞ্চনা গুণ দেকে দূর করা চাই। এজন্যই বিবাহের পূর্বে দেখে শুনে লওয়া দরকার।

         পাত্রীর রূপ ও স্বভাব-চরিত্র এমন লোকের নিকট অনুসন্ধান করা উচিত, যে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন, সত্যবাদী এবং প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিষয়ে জাত এবং যে তার প্রতি অনুরক্ত নয়, যে তার অতিরিক্ত প্রশংসা করবে না। আবার হিংসার বশবর্তী হয়ে

        মনে মনে বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি (এক ফোঁটা) পানি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। কোন কোন ছাহাবী এ সময় তাকবীর বলতেন। এমন কি গৃহের অন্যান্য অধিবাসীগণ তা' শুনতে পেত। কিবলার সম্মান রক্ষার জন্য কিবলামুখী হয়ে সহবাস না করা ভাল। সহবাস কালে নিজের এবং স্ত্রীর উভয়ের শরীর বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে নেবে। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর মস্তকও আবৃত করতেন, স্বর বন্ধ করতেন এবং স্ত্রীকে বলতেন, তুমি শান্তি লাভ কর। হাদীস শরীফে আছে, তোমাদের কেউ যেন সহবাস করতে এসে সহসা গর্দভের মত পতিত না হয়; বরং সে যেন প্রথমে প্রেমসূচক কিছু কথাবার্তা বলে এবং পরস্পর চুম্বন আদান- প্রদান করে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীর উপর ইতর জন্তুর ন্যায় হঠাৎ পতিত না হয়। বরং সে যেন সঙ্গমের পূর্বে দূত প্রেরণ করে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ দূত কি? তিনি বললেন, চুম্বন এবং প্রেমালাপ। তিনি আরও বলেছেন, তিনটি বিষয়ে পুরুষের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। প্রথমতঃ যে যাকে ভালবাসে তার সহিত সাক্ষাৎ হলে তার অবস্থা ও স্বাস্থ্যের কথা তার কাছে জিজ্ঞেস না করে উভয়ে পৃথক হওয়া। দ্বিতীয়তঃ কেউ তাকে সম্মান করলে সেই সম্মান তাকে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত বা কারও কোন উপকার না করা পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন করা। তৃতীয়তঃ কোন লোক তার দাসী বা স্ত্রীর নিকট গমন করে তার সাথে কথাবার্তা বা চুম্বন ইত্যাদির পূর্বেই সঙ্গম শুরু করা; এবং স্ত্রীর লাভ করার পূর্বেই নিজের শুক্র রোধ করতে অসমর্থ হওয়া।

          চান্দ্র মাসের প্রথম, মধ্যম এবং শেষ তারিখে সঙ্গম করা মাকরূহ। কথিত আছে যে, শয়তান এ সব রাত্রে সঙ্গম স্থানে উপস্থিত হয় এবং এ সব রাত্রে সব শয়তান একত্র হয়। হযরত আলী (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) উল্লিখিত রাত্রিগুলোতে সঙ্গম করা মাকরূহ বলেছেন। বহু আলিম জুমআর দিনে ও রাত্রে সঙ্গম করা মুস্তাহাব বলেছেন। তা' নিম্ন হাদীসের ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বর্ণনা করেছেন। যথাঃ আল্লাহ ঐ লোকের উপর রহম করুন যে নিজে গোসল করে এবং স্ত্রীকে গোসল করায়। যখন পুরুষের বীর্যপাত হয়, সে যেন তার স্ত্রীর উপয় থেকে নেমে আসতে একটু বিলম্ব করে যে পর্যন্ত না তার স্ত্রীর বীর্যপাত হয়। কেননা সাধারণতঃ স্ত্রীর বীর্যপাত কিছুটা বিলম্বে ঘটে। যখন স্ত্রীর কামোত্তেজনা বৃদ্ধি পায় তখন তার নিকট থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া তার পক্ষে বড়ই কষ্টদায়ক। উভয়ের বীর্য স্বাভাবিক ভাবে এক সময় নির্ণত না হওয়ার ফলে উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিতে পারে। পুরুষের বীর্য সাধারণতঃ পূর্বেই নির্গত হয়। কিন্তু যদি উভয়ের বীর্য একসাথে নির্গত হয় তাহলে তা' স্ত্রীর পক্ষে খুবই আরামদায়ক হয়। মোটকথা স্ত্রীর বীর্য নির্গত হওয়ার পর স্বামী তার থেকে পৃথক হবে। যুবক স্বামীর পক্ষে চারদিন পর পর একবার স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করাই ন্যায়সঙ্গত। যদি কোন পুরুষের চারজন স্ত্রী থাকে তখন এই নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত বিলম্ব করা উত্তম। স্ত্রীর চরিত্র রক্ষার জন্য প্রয়োজনবোধে এ থেকে অধিক বা অল্প সঙ্গম করা যেতে পারে। কেননা স্ত্রীর চরিত্র রক্ষা করা স্বামীর পক্ষে বাধ্যতামূলক। অনেক সময় সঙ্গমের নিয়ম-কানুন রক্ষিত হয় না। কেননা তা' পালন করা খুবই কষ্টকর। যথা: স্ত্রীলোকের হায়েজের সময়। এ সময় সঙ্গম করা পরিষ্কার হারাম বা নিষিদ্ধ। হায়েজ শেষ হওয়ার পর গোসল করার পূর্বে সঙ্গম করবে না। কেননা তা' কুরআনে পাকের নির্দেশানুযায়ী হারাম। কারও কারও মতে এরূপ সঙ্গমে সন্তানের দুষ্ট ব্যাধি হতে পারে। হায়েজ নিফাসের সময় সঙ্গম ব্যতীত স্ত্রীর অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উপভোগ করা জায়েয আছে। শুধুমাত্র স্ত্রী-অঙ্গ ব্যতীত অন্য অঙ্গে সঙ্গম করবে না। ঋতুবতী স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করলে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই অনিষ্ট হয়। তাছাড়া স্ত্রী-অঙ্গ ব্যতীত অন্য অঙ্গে সঙ্গম করলে স্ত্রীর যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এটাও সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ফা'তু হারছাকুম আন্না শিতুম অর্থাৎ যখনই ইচ্ছে কর তোমাদের ক্ষেতের নিকট আস। স্ত্রীর হাতে পুরুষাঙ্গ স্পর্শ কিংবা ঘর্ষণ ঘটিয়ে বীর্যপাত করানো এবং স্ত্রীর পায়জামার নিচেকার কোন অঙ্গে সঙ্গম ব্যতীত তা' উপভোগ করা হায়েজ-নিফাসকালে জায়েয আছে। নাভির নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত হায়েজ অবস্থায় নারীর জন্য একটি কাপড় রাখা উচিত এবং এটাই নারীর জন্য হায়েজকালীন পালনীয় নিয়ম। ঋতুবতী স্ত্রীর হাতে আহার করা বা তার সাথে শয়ন করা নিষিদ্ধ নয়; বরং এ অবস্থায়ও স্বামীর পক্ষে স্ত্রীর শয্যা ত্যাগ করা উচিত নয়।

         একবার সঙ্গমের পর পুনরায় সঙ্গমের ইচ্ছে হলে, পুরুষাঙ্গ ধৌত করে নিবে। যদি প্রথমবারের সঙ্গমে বীর্যপাত হয়, তাহলে পুরুষাঙ্গ ধৌত না করে বা মূত্র ত্যাগ না করে দ্বিতীয়বার সঙ্গম করবে না। রাত্রির প্রথমভাগে প্রথম সঙ্গম করা হলে পবিত্র না হয়ে বা নিদ্রা না গিয়ে দ্বিতীয় বার সঙ্গম করা মাকরহ। যদি এ অবস্থায় নিদ্রা বা আহারের ইচ্ছে হয়, তা'হলে প্রথম নামাযের অজুর ন্যায় অজু করে নিবে, ইহা সুন্নত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেউ অপবিত্র হয়ে কি নিদ্রা যেতে পারে? তিনি বললেন, হাঁ, যদি অজু করে নেয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) অপবিত্রাবস্থায় নিদ্রা যেতেন না এবং পানি স্পর্শ করতেন না।

        যখনই তোমরা শয্যায় গমন করবে তার উপরিভাগটা পরিষ্কার করে নিবে। কেননা অনেক অনিষ্টকর বস্তু পড়ে থাকতে পারে। স্ত্রীসহবাসের পর ক্ষৌরকার্য করা, নখ কর্তন করা, গুপ্তাঙ্গ পরিষ্কার করা, রক্ত বের করা অথবা শরীরের অভ্যন্তর থেকে কোন কিছু বহির্গত করা উচিত নয়।

        আজলের বর্ণনাঃ সঙ্গমের ক্ষেত্রে আর একটি নিয়ম এই যে, বীর্য বাইরে না ফেলে তা' স্ত্রীর ডিম্বকোষে ফেলা উচিত। হুযুরে পাক (দঃ)ও তাই বলেছেন। ওলামায়ে কিরামদের মধ্যে আজল অর্থাৎ বীর্যপাত যথাস্থানে না করে বাইরে করা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। এ সম্পর্কে চারটি মতের উপর ভিত্তি করে চারটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। একদল আলিম একে সর্বাবস্থায় হালাল বলেছেন। অন্যদল একে সর্বাবস্থায় হারাম বলেছেন। আর একদল স্ত্রীর সম্মতিক্রমে একে হালাল বলেছেন। সম্মতি ব্যতীত হালাল বলেন নি। এইদল বলেন, আজল ব্যতীত স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া হারাম। কেউ কেউ বলেন যে, স্বাধীন স্ত্রী ব্যতীত দাসীর সহিত আজল করা হালাল। আমাদের নিকট বিশুদ্ধ মত হল, আজল প্রথা হালাল। এক কারণে এটা মাকরুহ হয়। সে কারণ হল, এর দ্বারা ফজীলত ত্যাগ করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কেউ মসজিদের মধ্যে বেকার অবস্থায় বসে থাকলে এবং নামায বা যিকির-আযকারে রত না থাকলে তা' মাকরূহ হয়। অথবা মক্কার স্থায়ী অধিবাসীর পক্ষে প্রত্যেক বছর হজ্জ না করলে মাকরূহ হয়। একথার মর্ম এই যে, যে কাজের যে উদ্দেশ্য থাকে তা' পুরা না করলে তা' মাকরূহ বৈ কি। সন্তান জন্মদানে ফজীলত রয়েছে। আজল দ্বারা সে ফজীলত ত্যাগ করা হয়। হুযুরে পাক (দঃ)এর নিম্নোক্ত হাদীসে তা' প্রমাণিত। যেমন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করলে তার জন্য একটি সন্তান জন্মদানের ছওয়াব লিখিত হয় এবং তা' এমন সন্তান যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করে। হুযুরে পাক (দঃ) ফজীলতের উদ্দেশ্যে একথা বলেছেন। কেননা এরূপ সন্তানের ন্যায় যদি সন্তান জন্মে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের কারণ হওয়ার ছওয়াব তার নছীব হবে। যদিও আল্লাহতায়ালা সন্তানের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং জিহাদের জন্য ইচ্ছে ও শক্তিদাতা। তবু যে ব্যক্তি এর মুখ্য কারণ তার ছওয়াব সে নিশ্চয়ই পেয়ে থাকে। বলার অপেক্ষা করে না যে, সঙ্গম করে ডিম্বকোষের মধ্যে বীর্য নিক্ষেপ করলেই সে ছওয়াব সম্ভব হয়।

        আজল প্রথা হারাম নয় অর্থাৎ হালাল বলে আমরা যে মত পোষণ করছি তার কারণ হল, এটা কুরআন থেকে কিয়াস করে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও এই সম্বন্ধে কুরআনে পাক কোন স্পষ্ট আয়াত নেই এবং এমন আয়াতও নেই যা থেকে এ বিষয়টি নিখুঁতভাবে অনুমান করা যায়। তবু এটা হালাল হওয়ার এমন একটি বিষয় রয়েছে যা থেকে আজল অনুমান করা যায়। তা' হল, বিবাহ একেবারেই পরিত্যাগ করা অথবা বিবাহের পরে সঙ্গম পরিত্যাগ করা অথবা সঙ্গমের পরে বীর্যপাত না করা হারাম নয়। এসকল কাজ দ্বারা অধিক ফজীলত ত্যাগ করা হয় বটে, কিন্তু কাজগুলো নিষিদ্ধ নয়। উল্লিখিত তিনটি বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই। কেননা, সন্তান তখন জন্ম হয় যখন শুক্র ডিম্বকোষে পতিত হয়। তার পূর্বে চারটি অবস্থা হয়। যথাঃ (১) বিবাহ করা, (২) তারপর সঙ্গম করা, (৩) সঙ্গমের পর বীর্যপাতে ধৈর্য ধারণ করা এবং (৪) ডিম্বকোষে বীর্য যথাযথভাবে স্থিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ অবস্থায় থাকা। এর মধ্যে কতক অবস্থা কতক অবস্থার নিকটবর্তী। চতুর্থ বিষয়টি হতে বিরত থাকা, তৃতীয় বিষয়টি হতে বিরত থাকার মত এবং দ্বিতীয় বিষয়টি হতে বিরত থাকা প্রথম বিষয়টি হতে বিরত থাকার ন্যায়। তবে এ সকল থেকে বিরত থাকা গর্ভপাত করা বা সন্তান জীবিত প্রথিত করার অনুরূপ নয়। কেননা, এর দ্বারা বর্তমান অস্তিত্ব বা জীবনের বিষয় গুনাহ করা হয়। জীবনের অস্তিত্ব আসার কয়েকটি স্তর রয়েছে। তার প্রথম স্তর হল ডিম্বকোষে শুক্র পতিত হয়ে তা' স্ত্রীলোকের বীর্যের সহিত মিশ্রিত হয়ে যাওয়া এবং জীবনের জন্য উপলক্ষ হওয়া। এতদুভয়ের সংমিশ্রণ হয়ে গেলে তা' বিনষ্ট করা গুনাহর কার্য। তারপর যদি তা' রক্তপিণ্ড হয় এবং তা' মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়ে যায় তা'হলে তা' নষ্ট করা আরও বড় গুনাহর কাজ। তারপর যখন ঐ মাংসপিণ্ডের মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়া হয় এবং প্রাণী সৃষ্টি সঠিকরূপ ধারণ করে তখন তা' নষ্ট করা পূর্বাপেক্ষাও অধিক বড় গুনাহ। উল্লেখ্য যে, এই ঘৃণিত গুনাহর শেষ সীমা তখন হয়, যখন সন্তান জীবন্তরূপে জন্মগ্রহণ করে এবং তা' নষ্ট করা হয়।

        আমরা প্রাণের প্রথম কারণ ডিম্বকোষের মধ্যে শুক্র পতিত হওয়াকে বলেছি। স্বামীর নিকট থেকে শুধু বীর্য নির্গত হওয়ার কথা বলি নি। কেননা সন্তান শুধু পুরুষের বীর্য হতেই সৃষ্টি হয় না; বরং স্বামী ও স্ত্রীর বীর্য একত্র হলে তারপর সন্তান সৃষ্টি হয়। তদুপরি স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই বীর্য অথবা স্বামীর বীর্য স্ত্রীর হায়েজের রক্তের সহিত একত্র হওয়া আবশ্যকীয় দেহতত্ত্ববিদগণ বলেন যে, হায়েজের রক্ত দ্বারা আল্লাহর অসীম কুদরতবলে রক্তপিণ্ডের সৃষ্টি ঘটে। ঐ রক্ত দুগ্ধের মত। পুরুষের শুক্র হায়েজের রক্তের সহিত মিশ্রিত হলে তা' জমাট বাঁধার কারণ ঘটে। যেমন কোন কোন বস্তু দুগ্ধে মিশালে তা' জমাট বেঁধে দধি হয়ে যায়। যদি কোন লোক কোন প্রস্তাব করে কিন্তু তা' কবুল হওয়ার পূর্বেই সে চলে যায়, তাহলে সে চুক্তি ভঙ্গের জন্য দোষী হবে না; বরং যখনই প্রস্তাব ও কবুল একত্র হয় তখনই তা' চুক্তিরূপে গণ্য হয়। তারপর প্রস্তাবক চলে গেলে চুক্তি ভঙ্গ করা হয় এবং তা' দোষণীয়রূপে গণ্য হয়। পুরুষের বীর্য এবং স্ত্রীলোকের বীর্য প্রস্তাব ও কবুলের অনুরূপ। শুধু পুরুষের বীর্যও সন্তান জন্মদানে সক্ষম নয় এবং শুধু স্ত্রীলোকের বীর্যই সন্তান জন্মদান করতে পারে না। প্রথমটি প্রস্তাবসদৃশ এবং দ্বিতীয়টি কবুলতুল্য। এদুটো একত্র হলে যেরূপ চুক্তিরূপে সাব্যস্ত হয় এবং তার পূর্বে যেরূপ চুক্তি ভঙ্গের গুনাহ হয় না, তদ্রুপ উভয় বীর্য একত্র হওয়ার পূর্বে একজনের বীর্য বাইরে ফেললে গুনাহর কার্য হয় না।

        যদি বলা হয়, আজল বা বাইরে বীর্যপাত গুনাহ না হলেও মাকরূহ। কেননা এর উদ্দেশ্য সন্তান উৎপাদন না করা এবং এটা মন্দ ও গুপ্ত শিরেকীর অন্তর্গত। এর উত্তর এই যে, আজলের পাঁচটি উদ্দেশ্য থাকে। প্রথমতঃ দাসীদের সম্পর্কে এরূপ শর্ত থাকে যে, দাসীদের সন্তান হলেই তারা দাসত্ব হতে মুক্তি পাবে এবং তখন তারা নিজেদের কর্তব্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করবে। এমতাবস্থায় বীর্য বাইরে ফেলে দেয়া নিষিদ্ধ নয়। দ্বিতীয়তঃ স্ত্রীর স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য বজায় রাখা। তার দেহ হৃষ্ট-পুষ্ট থাকা। তাকে সদা-সর্বদা উপভোগ করা। তার সর্বদা সুস্থ শরীর নিয়ে জীবন যাপন করা। এসকল উদ্দেশ্যে বীর্য বাইরে ফেলে নষ্ট করলে তা' নিষিদ্ধ নয়, তৃতীয়ত, অধিক সন্তান প্রতিরোধ কল্পে আজল করা দোষণীয় নয়। সন্তানদের জন্য উপার্জনের কষ্টের ভয়ে এবং হারাম রুজি অর্জনের ভয়ে আজল করা নিষিদ্ধ নয়। কম ব্যয় করা দ্বীনের জন্য উপকার। আল্লাহতায়ালা সকল প্রাণীকে রিজিক দেয়ার যে আশ্বাস দিয়েছেন তার উপর বিশ্বাস ও নির্ভরতা অধিক ফজীলত এবং কামালিয়াতের অন্তর্গত। আল্লাহ বলেন, "ওয়ামা মিন দাব্বাতিন ফিল আরদ্বি ইল্লা আলাল্লাহি রিযকুহা" অর্থাৎ দুনিয়াতে এমন কোন প্রাণী নেই যার রিজিক আল্লাহর উপর নয়। তবে সর্বোচ্চ দরজা ও ফজীলত ত্যাগ করলে কোন গুনাহ হয় না; যেমন, দুনিয়ার কাজের ফলাফলের দিকে লক্ষ্য করা, ধন-দৌলত হিফাজত করা এবং তা' সঞ্চয় করে রাখা পূর্ণ 'তাওয়াক্কুল' বা নির্ভরতার পরিপন্থী হলেও তা' নিষিদ্ধ নয়। চতুর্থতঃ কন্যাসন্তান জন্মের ভয় করে এবং তাদেরকে বিবাহ দেয়ার কষ্ট চিন্তা করে আজল করা। অবশ্য এটা গুনাহর কার্য। প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবদের মাঝে প্রথা ছিল কন্যাসন্তানদেরকে জীবিত প্রথিত করা, তা' নিষেধ করা হয়েছিল। উপরোক্ত নিয়তে যদি বিবাহ না করা হয় বা সঙ্গম ত্যাগ করা হয় তখন নিশ্চয়ই সে উদ্দেশ্য মন্দ। তজ্জন্য গুনাহগার হতে হবে। বীর্য বাইরে ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যও যদি এরূপ হয় তাহলে তাও গুনাহর কাজ হবে। হুযুরে পাক (দঃ) এর সুন্নতের মধ্যে দোষ বের করা অত্যন্ত মন্দ। পঞ্চমতঃ স্ত্রীলোকের নিজের সম্মান রক্ষার্থে, সদা- সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার উদ্দেশ্যে এবং নিফাস ও সন্তান পালন ইত্যাদি থেকে বাঁচার নিয়তে ডিম্বকোষে বীর্য গ্রহণ না করা খারেজী সম্প্রদায়ের নারীদের অভ্যাস। তারা অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে এবং হায়েজকালীন নামাযের কাজা আদায় করে আর মলত্যাগের পর বিবস্ত্র হয়। এসকল অভ্যাস বেদআত এবং সুন্নতের বিপরীত। হযরত আয়েশা (রাঃ) যখন বছরা আগমন করেছিলেন তখন এদের একজন মহিলা তাঁর সহিত দেখা করতে চাইলেন, তিনি অনুমতি দেন নি।

         যদি প্রশ্ন করা হয় যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "মান তারাকান নিকাহা মাখাফাতা ইয়ালিন ফালাইছা মিন্না" অর্থাৎ যে ব্যক্তি সন্তান জন্মের ভয়ে বিবাহ ত্যাগ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। এর উত্তর হল, আজল করা বিবাহ না করার ন্যায় এবং আমাদের দলভুক্ত নয় একথার অর্থ আমাদের সুন্নত ও পথ সম্বন্ধে সে একমত না হলেও আমাদের সুন্নত উত্তম। যদি বলা হয় যে, হযরত রাসূলে করীম (দঃ) বলেছেন, "আজল প্রথার মধ্যে গুপ্তহত্যা আছে এবং তিনি তখনই এ আয়াত পড়লেন, "যখন জীবন্ত প্রথিত সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, কোন অপরাধে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে? আর যদি বল যে এটা ছহীহ বুখারী শরীফে আছে। তার উত্তর এই যে, আজল হালাল হওয়া সম্বন্ধে ছহীহ হাদীস রয়েছে। হুযুরে পাক (সঃ) এর হাদীসে যে গুপ্তহত্যার কথা আছে সে কথা অনুসারেই এটা গুপ্ত শিরক। এটা নিন্দনীয় বা মাকরূহ, কিন্তু হারাম নয়। যদি প্রশ্ন কর যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বাণী অনুযায়ী আজল ক্ষুদ্র জীবন্ত হত্যা। কেননা একাজ অস্তিত্বকে নষ্ট করে দেয়। এর উত্তর এই যে, আমার মতে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)এর একথা অনুমান মাত্র। তিনি প্রাণকে দৃঢ় বিশ্বাস করে এই কথা বলেছেন। এ একটি দুর্বল অনুমান। এজন্যই হযরত আলী (রাঃ) অনুমানকে অস্বীকার করে বলেছেন, সাতটি পর্যায়ের পর প্রাণ অস্তিত্বে আসে। তিনি অত্র আয়াত পাঠ করলেন। যথাঃ "আমি মানুষকে ঠনঠনে কর্দম থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে শুক্ররূপে উত্তম স্থানে স্থাপন করেছি। তারপর শুক্রকে রক্তপিণ্ডে পরিণত করেছি। তারপর রক্তপিণ্ডকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি। তারপর হাড়কে মাংসদ্বারা সজ্জিত করেছি। তারপর তাকে অন্য প্রকার সৃষ্টিতে পরিণত করেছি। অর্থাৎ তার ভিতর আমি দেহ বা আত্মা ফুঁকে দিয়েছি। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। যথাঃ "যখন জীবন্ত প্রথিত সন্তানকে জিজ্ঞেস করা হবে কী দোষে তাকে হত্যা করা হয়েছে?"

        আমি কিয়াসের ভিত্তিতে যা বর্ণনা করলাম, তা' দ্বারা তোমার নিকট প্রকাশ পাবে যে, আমার ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)এর মধ্যে অর্থের সূক্ষ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে পার্থক্য রয়েছে। ছহীহ বুখারী এবং মুসলিম শরীফে হাদীস রয়েছে যে, হযরত জাবের (রাঃ) বলেছেন, আমরা হুযুরে পাক (দঃ) এর যমানায় আজল করতাম এবং পবিত্র কুরআনও তখন অবতীর্ণ হতেছিল। আমাদের এ খবর হুযুরে পাক (দঃ)এর কর্ণগোচর হলে তিনি আমাদেরকে তা' থেকে নিষেধ করেন নি। আরেক হাদীসে আছে যে, হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি হযরত রাসূলে করীম (দঃ)এর নিকট এসে বলল, আমার একটি দাসী আছে। সে আমাদের খেদমত করে এবং খেজুর বৃক্ষে পানি দেয়, আমি তার সাথে সঙ্গম করি কিন্তু তার গর্ত হওয়া আমি পছন্দ করি না। একথা শুনে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তবে ইচ্ছে হলে তার সাথে আজল কর, কিন্তু যা তাকদীরে রয়েছে তা' অবধারিত। লোকটি যতদিন আল্লাহর ইচ্ছে ছিল ততদিন অপেক্ষা করে তারপর হুযুরে পাক (দঃ)এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার উক্ত দাসীটির গর্ভ সঞ্চার হয়েছে। শুনে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, আমি ত পূর্বেই বলেছিলাম যা তারতাকদীরে আছে তা' অবশ্যই হবে। উল্লিখিত বর্ণনাসমূহ ছহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments