হজ্জ্বের কার্যাবলীর আভ্যন্তরীণ রীতি-নীতি
হজ্জ্বের ব্যাপারে আভ্যন্তরীণ কতিপয় রীতি-নীতি আছে। সেগুলো ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করছি।
(১) হজ্জ্ব উপলক্ষে যে অর্থাদি ব্যয় করা হবে, তা' নিখুঁৎ হালাল হতে হবে। আর এখন যে কোন ব্যবসা বাণিজ্য হতে পৃথক থাকতে হবে, যাতে আল্লাহর দিক থেকে চিন্তা ভাবনা অন্য দিকমুখী হয়ে যেতে না পারে; বরং মন শুধু আল্লাহর যিকির লিপ্ত এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর দিকে আকৃষ্ট হতে হবে। এক হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, শেষ যমানায় মানুষ কেবল চারটি উদ্দেশ্য নিয়ে হজ্জ্ব করতে যাবে। যেমনঃ
(ক) রাজা-বাদশাহ ও শাসনকর্তাগণ যাবে দেশ পর্যটন ও ভ্রমণ বিলাস সমাপন উদ্দেশ্যে। (খ) ধনীগণ যাবে ব্যবসা-বাণিজ্যমূলক লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য। (গ) ফকীর ও অভাবী লোকেরা যাবে ভিক্ষাবৃত্তির লক্ষ্যে এবং (ঘ) আলিমগণ যাবে সুনাম ও সুখ্যাতি লাভের আশায়।
অত্র হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলো হজ্জ্ব সফরের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে, যা হজ্জ্বের ফজীলতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অর্থাৎ এসব লক্ষ্য নিয়ে হজ্জ্ব করায় কোন ফজীলতই হাছিল হবে না। যারা এসব উদ্দেশ্য নিয়ে হজ্জ্ব করে, হাজীগণ যে বিশেষ লোকদের তালিকাভুক্ত থাকে, তাদের নাম সে দফতরে লিখিত হবে না। যারা মজুরী নিয়ে অন্যের পক্ষ থেকে হজ্জ্ব আদায় করে দেয়, তা' তাদের আখেরাতের কাজে দুনিয়া অন্বেষণ ছাড়া আর কিছু নয়। মুত্তাকী লোকেরা এরূপ কাজকে অতীব ঘৃণা করেন। হাঁ তবে যদি কেউ মক্কায় বসবাস করার খেয়ালে নিজের আর্থিক অনটন হেতু সেখানে পৌঁছার খরচ বাবত অন্যের থেকে কিছু অর্থ নেয়, তবে তা' তেমন দোষণীয় নয়। মোটকথা, আখেরাতকে সামনে রেখে তাঁর দ্বারা দুনিয়া লাভের উপায় করবে না; বরং দুনিয়াকে আখেরাত হাছিলের উপায় করা চাই। অন্যের পক্ষ থেকে হজ্জ্ব করার ক্ষেত্রে যিয়ারাতে কা'রা ও মুসলমান ভ্রাতার ফরজ আদায়ের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার নিয়ত করতে হবে। এই মর্মেই হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা এক হজ্জ্বের কারণে তিনজন লোক বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। যথাঃ- (১) যে হজ্জ্বের অছিয়ত করে (২) যে হজ্জকে জারী করে এবং (৩) যে তার ভ্রাতার পক্ষ থেকে হজ্জ্ব আদায় করে। আমরা অবশ্য একথা বলছি না যে, যে ব্যক্তি নিজের হজ্ব আদায় করে নেয়, তার জন্য অন্যের হজ্জ্বের মজুরী গ্রহণ করা নাজায়েয; বরং আমরা বলছি যে, মজুরী না নেয়া উত্তম। এ কাজকে একটা ব্যবসা বা পেশা হিসেবে অবলম্বন করা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ আখেরাতের কারণে দুনিয়া দিয়ে দেন কিন্তু দুনিয়ার কারণে কখনও আখেরাত দেন না। মজুরী গ্রহণ করা জায়েয হওয়ার প্রকৃত অবস্থা কি, তার উদাহরণ রয়েছে হাদীসের মধ্যে। যেমন বর্ণিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ করেও মজুরী গ্রহণ করে সে হযরত মুসা (আঃ) এর জননীর মত। তিনি নিজ শিশুকে স্তন্যদান করে তাঁর বিনিময় গ্রহণ করতেন। অতএব যে ব্যক্তি হজ্জ্বের বদলে মজুরী গ্রহণের ব্যাপারে হযরত মুসার (আঃ) মাতার মত হয়, তার কথা ভিন্ন। অর্থাৎ হজ্জ্ব এবং খানায় কা'বার যিয়ারাতে সক্ষম হওয়ার উদ্দেশ্যেই মজুরী নেবে, মজুরী পাওয়ার লক্ষ্যে হজ্জ্ব করবে না। যেমন হযরত মুসার (আঃ) মাতার উদ্দেশ্য ছিল নিজ সন্তানকে দুধ পান করানো আর নিজের অবস্থাটাও মানুষের কাছে গোপন রাখা।
(২) হজ্জ্ব গমনের পথে বিধর্মীদেরকে কোন রূপ অর্থাদি অর্পণ করবে না। এভাবে অর্থসম্পদ অর্জিত করেই তারা মক্কায় ধনী ও প্রভাবশালী রূপে গণ্য হয়ে যায়। এরাই পথের মধ্যে বসে খানায় কা'বার হজ্জ থেকে মানুষকে বাধা দিয়ে থাকে। এদেরকে অর্থাদি দেয়ার অর্থ তাদের অন্যায় ও জুলুমের সাহায্য করা ও তাদের অন্যায়ের উপকরণাদি দিয়ে তাদের কাজের সহযোগিতা করা। একারণেই এদেরকে এরূপ অর্থ দেয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য উপায় অন্বেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। যদি তা' বের করা না যায়, তবে কোন কোন আলিমদের উক্তি অনুযায়ী নফল হজ্ব পরিত্যাগ করে পথিমধ্য থেকে ফিরে আসা এ জালিমদেরকে অন্যায় কাজে সাহায্য করার চেয়ে অধিকতর উত্তম। এটা একটা নবোদঘাটিত বেদয়াত বটে। 'এটা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়ার মধ্যে ক্ষতি এই যে, তদ্বারা এ জুলুম একটা সাধারণ প্রচলনের রূপ নেবে। জনৈক আলিম ঠিক কথাই বলেছেন যে, "এ অর্থ জোর জবরদস্তিমূলক ভাবে আদায় করা হয়, এতে দাতার কি দোষ?” একথা বলে কেউ রেহাই পাবে না কেননা গৃহে থাকলে বা পথ থেকে ফিরে এলে কেউ জুলুম করে অর্থ নেবে না। এ অত্যাচারীগণ যাকে সচ্ছল দেখে, তার কাছ থেকে বেশী আদায় করে। অসচ্ছল বা ফকীরের বেশে দেখলে তার কাছে কেউ চায় না। অতএব বুঝা যাচ্ছে যে, এ ক্লেশকর অবস্থাটা নিজেই সৃষ্টি করে নেয়।
(৩) রসদ ও পাথেয় বেশী পরিমাণে সাথে নেবে। যেন কৃপণতা ও অপব্যয় ব্যতিরেকে মধ্যমাবস্থায় মনের খুশীতে দান খয়রাত ও ব্যায় করতে পারে। অপব্যয় বা বৃথা খরচের অর্থ আমার মতে অত্যুৎকৃষ্ট খানা খাওয়া ও অত্যধিক বিলাসিতা করা। অধিক দান খয়রাত করা অপব্যয় নয়। এক বুযর্গ বলেছেন, অপব্যয়ে কোন মঙ্গল নেই, আর বেশী দান খয়রাতে অমিতব্যয়িতা নেই। হজ্জ্বের পথে পাথেয় দান খয়রাত করা আর আল্লাহর পথে ব্যয় করা একই কথা। এতে এক দেরহাম সাত শ দেরহামের বরাবর হয়ে থাকে। হয়রত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন যে, হজ্জ্বের সফরে উত্তম পাথেয় সঙ্গে থাকাও দানশীলতার শামিল। হাজীদের মধ্যে উত্তম তিনিই, যার নিয়ত সর্বাপেক্ষা খাঁটি, ব্যয় সর্বাপেক্ষা পবিত্র, বিশ্বাস সর্বোত্তম। হুযুরে পাক (দঃ)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, মাররুর হজ্জ্ব কি? তিনি জবাবে বললেনঃ "আল হাজ্জ্বল মাবরূরু লাইসা লাহু জাযায়ান ইল্লাল জান্নাতু ফাক্বীলা ইয়া রাসূলাল্লাহি মা বিররুল হাজ্বি ফাক্বালা তায়্যিবুল কালামি অএতুআমুত্বাআমি" অর্থাৎ মাবরুর হজ্জ্বের প্রতিদান বেহেশত ব্যতীত কিছুই নয়। কেউ আরজ করল, মাবরুর হজ্জ্ব কি? তিনি বললেন, উত্তম কথা বলা এবং খানা খাওয়ানো।
(৪) হজ্জ্ব যাত্রা করে অশ্লীল কাজ, অপকর্ম এবং কলহ কোন্দল থেকে পরহেজ করবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করছেনঃ "ফালা রাফাছা অলা ফুস্কা অলা জিদালা ফিল হাজ্বি" অর্থাৎ রাফাছ ( অশ্লীলতা), ফুসূক অপকর্ম) এবং জিন্দাল (কলহ-বিবাদ) হজ্জ্বের মধ্যে নেই। উল্লেখ্য যে, রাফাছের মধ্যে যে কোন রকম অনর্থক কথাবার্তাও শামিল। নারীদেরে সাথে আলাপালোচনা করা। মেলামিশা এবং সঙ্গমের আনুষঙ্গিক বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত। কেননা তাঁর দ্বারা সঙ্গমের সম্ভাবনা দেখা দেয়, যা হচ্ছে সিদ্ধ নয় এবং এরূপ নিষিদ্ধ কাজের আগ্রহ ও সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী বিষয়ও সিদ্ধ নয়। ফুসুকের অর্থ আল্লাহর আনুগত্য ও বাধ্যতার বিপরীত অবস্থা, তা' যেভাবেই হোকনা কেন। জিন্দাল বলা হয় কারও সাথে ঝগড়া বিবাদ, মনোমালিন্য বা হযরত সুফিয়ান বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়াকে।
ছাওরী(রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ্বের মধ্যে নির্লজ্জ বাক্যোচ্চারণ করে, তার হজ্ব কলুষিত হয়ে যায়। হুযুরে পাক (দঃ) উত্তম কথা বলা ও আহার করানোকে হচ্ছে মাবরুর অর্থাৎ মকবুল হজ্জ্ব বলেছেন। পরস্পর বাদানুবাদ করাও উত্তম কথার বিপরীত। অতএব হজ্জ্বের পথে সঙ্গী সাথীদের বা খাদেম-পরিচারকদের কোন কাজে অহেতুক আপত্তি করা বা নাখোশ হওয়া উচিত নয়; বরং সবার সাথে বিনীত ভাবে থাকা চাই। বিশেষ ভাবে সচ্চরিত্রতা অবলম্বন করবে। আর জেনে রাখবে, শুধু মানুষকে কষ্ট না দেয়াই সচ্চরিত্রতা নয়; বরং কেউ ক্লেশ প্রদান করলে তা' নীরবে সহ্য করাই হল সচ্চরিত্রতা। কারও কারও মতে সফরকে সফর বলার কারণ হল, সফর মানুষের আসল চরিত্রকে প্রকাশ করে দেয়। এজন্যই এক ব্যক্তি যখন হযরত ওমর (রাঃ) এর কাছে বলল যে, সে অমুক ব্যক্তিকে চেনে, তখন তিনি বললেন যে, তুমি কি তার সাথে কখনও সফর করেছ? সে বলল, না, তা' কখনও করি নি। তখন হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তবে আমার মতে তুমি তাকে চেন না। কেননা সফরেই মানুষের আসল চরিত্রের পরিচয় জানা যায়।
(৫) পদব্রজে হজ্জ গমন করা অধিকতর উত্তম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) মৃত্যুর পূর্বে নিজ পুত্রদেরকে অছিয়ত করেছিলেন, পুত্রগণ! তোমরা পদব্রজে হজ্জ আদায় করবে। কেননা পদব্রজে হজ্জ আদায়কারী প্রতি পদক্ষেপে হেরেমের নেকীগুলো থেকে সাতশ করে নেকী লাভ করে। কেউ জিজ্ঞেস করল, হেরেমের নেকীগুলো কি? তিনি বললেন, এক এক নেকী এক এক লাখ নেকীর সমান। হজ্জ্বের কর্মগুলোর মধ্যে অন্য পথ অপেক্ষা মক্কা থেকে আরাফাত পর্যন্ত পথ পদব্রেজে চলা অধিক উত্তম'। যদি পদব্রজে চলার সাথে নিজ গৃহ থেকেই এহরামও বেঁধে নেয়, তবে বর্ণিত আছে যে. এ হল হজ্জুকে পূর্ণ করে নেয়া। আল্লাহ তায়ালা এরূপ আদেশই করেছেন। যথাঃ
"অ আতিমুল হাজ্জা অল উমরাতা লিল্লাহি" অর্থাৎ হজ্জ্ব ও ওমরাহকে আল্লাহর জন্য পূর্ণ কর। হযরত ওমর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যা এরূপই করেছেন। কোন কোন আলিমের মতে সওয়ার হয়ে হজ্জ্ব করতে যাওয়া উত্তম। কেননা এতে অর্থ ব্যয় হয় এবং মন প্রশস্ত হয়। পক্ষান্তরে নিজের কষ্টও কম হয়। আর এতে নিরাপত্তা এবং হজ্জ্ব পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। গভীর ভাবে তলিয়ে দেখলে এ ধারণা পূর্বের উক্তির বিপরীত নয়, অতএব যার পক্ষে পদব্রজে চলা সহজ, তার জন্য পায়ে হেঁটে যাওয়াই উত্তম আর যদি কেউ পায়ে হাঁটার কারণে বেশী দুর্বল এবং শ্রান্ত হয়ে পড়ে বা হজ্জ্বের কোন ক্রিয়া কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে হলে তার জন্য সওয়ার হয়ে হজ্জ করা উত্তম। কেউ কোন আলিমের কাছে জিজ্ঞেস করল যে, ওমরাহ আদায় করতে পদব্রজে যাওয়া ভাল না এক দেরহাম দিয়ে একটি গাধা ভাড়া করে নেয়া ভাল? আলিম জবাব দিলেন, যদি এক দেরহাম খরচ করা তার কাছে খারাপ লাগে, তবে গাধা ভাড়া করে যাওয়াই তার পক্ষে উত্তম। আর যদি তার কাছে ধনীদের মত পায়ে হেঁটে যাওয়া খুব ক্লেশকর মনে হয়, তবে তার জন্য পায়ে হেঁটে যাওয়াই উত্তম।
সাহেব এক্ষেত্রে যে দৃষ্টিকোণ থেকে জবাব দিয়েছেন, তা' হল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সুদৃঢ় থাকা। নফসের খাহেশ যা চায় তার বিপ্লীত করাতেই মঙ্গল নিহিত। মূলতঃ এ দিকটিরও গুরুত্ব রয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে পদব্রজে যাওয়াই উত্তম। এমতাবস্থায় বাহনে যে টাকা ব্যয় হত, সে টাকা দান করবে। আর যদি পায়হাঁটা ও দান করার কষ্ট পছন্দ না করে, তবে তার জন্য আলিম বর্ণিত পূর্বোক্ত পন্থা অবলম্বন করাই উত্তম।
(৬) জীর্ণ শীর্ণতা, আলু-থালু কেশ-বেশ এবং ধূলা ধূসরিত চেহারায় থাকবে। সাজ গোজ করবে না। বিলাসিতা ও ধনাঢ্যতার প্রতি আগ্রহ ও আসক্তি দেখাবে না। যাতে করে তুমি গর্বিত ও আরামপ্রিয়দের দপ্তরভুক্ত হয়ে যাও এবং ফকীর মিসকীন ও সৎকর্মশীলদের কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়। কেনন। হুযুরে পাক (দঃ) এক হাদীসে বিমর্ষ বদনে থাকা ও পদব্রজে চলার আদেশ করেছেন এবং আলস্য ও বিলাসিতাকে খারাপ বলেছেন। আর এক হাদীসে আছে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন। বিমর্ষ চেহারা, আলু থালু কেশ বেশ ও ধূলাধূসরিত ব্যক্তিই হল হাজী। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার গৃহের যিয়ারাতকারীদের প্রতি লক্ষ্য কর, যারা গভীর গিরিপথ দিয়ে মলিন বদন এবং ধূলা ধূসরিত বেশে চলে আসছে। অন্য আয়াতে রয়েছে, "চুম্মা লিয়াকুস্থ তাফাছাহুম" অর্থাৎ অতঃপর তারা তাদের ধূলা ময়লা মিটিয়ে দিক।
'তাফাছ' শব্দটির অর্থ হল চুল আলু-থালু এবং ধূলা ধূসরিত হওয়া। আর তা' মিটিয়ে দেয়ার অর্থ হল কেশ মুন্ডন করা, মোছ এবং নখ কাটা। হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর সেনাধ্যক্ষদের কাছে ফরমান পাঠিয়েছিলেন যে, তোমরা পুরাতন পোশাক পরো ও কষ্ট ক্লেশে সহনশীলতার অভ্যাস গড়ে তোল। কেউ বলেছেন যে, ইয়ামেনবাসীরা হাজীদের সৌন্দর্য। কেননা তারা হজ্জ্ব করতে এসে শীর্ণ বিমর্ষ ধূলি-ধূসরিত এবং পূর্ব যুগের বুযর্গদের ন্যায় চরিত্রবান। হাজীদের লাল পোশাক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। খ্যাতি, যশঃ প্রচারের ক্রিয়াকলাপ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এক হাদীসে আছে, একবার হুযুরে পাক (দঃ) সফরে থাকা কালে তাঁর কতিপয় সহচর একদা উট থেকে নেমে ওগুলোকে চরাতে লাগলেন। হুযুর (দঃ) দেখলেন, উটগুলোর গদিতে লাল রংয়ের চাদর বিছানো। তিনি সহচরদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, লাল রং সম্ভবতঃ তোমাদের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। রাবী বলেন যে, হুযুর (দঃ) এর বক্তব্য শুনে আমরা সবাই গিয়ে উটের পিঠ থেকে লাল চাদরগুলো নামিয়ে আনলাম। যার ফলে দু'একটি উট এদিক সেদিক চলেও গেল।
(৭) হচ্ছে কুরবানী ওয়াজিব না হলেও নৈকট্য লাভের নিয়তে জন্তু যবেহ করবে। আর এজন্য সুস্থ নিরোগ এবং মোটা তাজা জন্তু সংগ্রহের চেষ্টা করবে। নফল কুরবানী হলে তাঁর গোশত থেকে নিজেও খেতে পারবে কিন্তু ওয়াজিব কুরবানী হলে খেতে পারবে না। "অমাই ইয়ুজাজজিম শাআয়িরাল্লাহি" (অর্থাৎ যে আল্লাহর নিদর্শন সমূহের সম্মান করে) এ আয়াতের য্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেন যে, আল্লাহর নিদর্শন সমূহের সম্মান করার অর্থ হল, উৎকৃষ্ট এবং হৃষ্ট পুষ্ট জন্তু কুরবানী করা।
কোনরূপ কষ্ট ও অসুবিধা না হলে কুরবানীর জন্তু মীকাত থেকেই সাথে নিয়ে যাওয়া উত্তম। কুরবানীর পশু দাম করার চেষ্টা করবে না। প্রাচীন কালের বুযর্গগণ ক্রয় করা কালে কম মূলো তিনটি বস্তু অধিক মূল্যে ক্রয় করতেন। । । ঐ বস্তু হল (১) হজে জবাহ করা জন্তু। (২) কুরবানীর জন্তু এবং (৩) গোলাম। কারণ এই যে, এগুলোর মধ্যে সেটিই উত্তম ও উৎকৃষ্ট যার মূল্য অধিক। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর পিতা হযরত ওমর (রাঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একবার হে হজেদু যবেহ করার জন্য একটি অত্যুৎকৃষ্ট ও মূল্যবান উষ্ট্র সংগ্রহ করেন। লোকগণ সেটি তাঁর কাছ থেকে তিনশত আশরাফীর বিনিময়ে ক্রয় করতে চাইলে তিনি হুযুরে পাক (দঃ) এর কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। আপনি অনুমতি দিলে আমি এটি বিক্রয় করে এর মূল্য দ্বারা অনেকগুলো উট কিনে নিতাম। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, না। যবেহের জন্য এটিই পাঠিয়ে দাও। কেননা উৎকৃষ্ট একটি বস্তু অনেকগুলো নিকৃষ্ট বস্তু হতেও শ্রেয়। সমসাময়িক যুগে তিনশ আশরাফী দ্বারা ত্রিশটি উট ক্রয় করা যেত। এতে গোশত অধিক হত সন্দেহ নেই। কিন্তু কুরবানীর ক্ষেত্রে গোশতই মূল বিষয় নয়; বরং মূল বিষয় হল, নফলকে কৃপণতার দোষ থেকে পবিত্র করা এবং তাকে আল্লাহর জন্য সম্মান দ্বারা সুশোভিত করা। কেননা আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেনঃ "লাইয়ানালাল্লাহা লুহুমুহা অলা দিমায়ুহা অলাকিইইয়ানালুহুকুওয়া মিনকুম" অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে কুরবানীর গোশত পৌছে না' বরং তাঁর কাছে পৌছে তোমাদের তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ভয়। অধিক মূল্যে জন্তু ক্রয়দ্বারা এ উদ্দেশ্য সাধিত হয়। চাই জন্তুর সংখ্যা বেশী বা কমই হোকনা কেন। এক প্রশ্নের উত্তরে হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছিলেন, মকবুল হজ্ব হল, সজোরে লাব্বাইক বলা ও উটনী কুরবানী করা। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহর দরবারে মানুষের কোন আমল যবেহ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় নয়। উক্ত কুরবানী রোজ কিয়ামতে তার শিং এবং খুর সহ উপস্থিত হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে একটি মর্তব্য হাছিল হয়ে যায়। অতএব এরদ্বারা তোমরা মনে মনে খুশী হয়ে যাও। অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তোমাদের জন্য কুরবানীর পশুর চামড়ার প্রতিটি পশমের বদলে ছওয়াব রয়েছে এবং তার রক্তের প্রতিটি ফোঁটার বদলে নেকী রয়ে গেছে। এগুলো পাল্লায় তুলে ওযন দেয়া হবে। অতএব তোমরা সুসংবাদ লাভ কর।
(৯) হজ্জ্বে কুরবানী এবং দান খয়রাত সন্তুষ্ট চিত্তে আদায় করতে হবে। একই ভাবে কোনরূপ ক্ষতি লোকসান অথবা আর্থিক অথবা দৈহিক বিপদ আপদকে খুশীমনে বরণ করে নেবে। এ হল হজ্জ্ব কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজ্জ্বের পথে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন হলে তাতে এমন ছওয়াব অর্জিত হয়, যেমন আল্লাহর পথে এক দেরহাম ব্যয় করলে তাতে দশ দেরহামের সমান ছওয়াব হাছিল হয়।
বর্ণিত আছে যে, মকবুল হজ্জ্বের অন্যতম লক্ষণ হল, পূর্বে যে সকল গুনাহ করত, হজ্জ্বের পর সেগুলো না করা। সৎকর্মশীলদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করা এবং রং তামাসা ও নিরর্থক মজলিসের বদলে আল্লাহর যিকিরের বৈঠকে শরীক হওয়া।
0 Comments