হারাম ও হালালের মধ্য সন্দেহের তৃতীয় স্থানঃ

সন্দেহের তৃতীয় স্থানঃ

        যে কারণে কোন বস্তু হালাল হয় তার মধ্যে গুনাহর কিছু থাকা এবং তা' ঐ সম্পর্কিত জিনিসের মধ্যে বা তার পরিণতির মধ্যে বা তার অগ্রবর্তী জিনিসের মধ্যে বা তার বিনিময় জিনিসের মধ্যে নিহিত থাকা। এরূপ অবস্থায় ঐ গুনাহ এমন গুরতর কিছু নয় যাতে তার ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি বাতিল হতে পারে অথবা তার কারবার হালাল হওয়া অশুদ্ধ করে। উল্লিখিত চারটি অবস্থার দৃষ্টান্ত নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

(১) তদসম্পর্কিত বস্তুর মধ্যে গুনাহঃ

        জুমার দিন আযানের সময় ক্রয়-বিক্রয় করা, অন্যায়ভাবে ছুরি বা চাকু আত্মসাৎ করে তদ্বারা যবেহ করা, জোরপূর্বক কেড়ে লওয়া কুঠারীর দ্বারা কাষ্ঠ কাটা এবং অন্যের বিক্রয়ের উপর বিক্রয় করা ইত্যাদি। উল্লিখিত নিন্দনীয় কাজ চুক্তির মধ্যে থাকলে তাতে চুক্তি হারাম হয় না বা বাতিলও হয় না তবে তা' থেকে বিরত হওয়া সতর্কতা বা পরহেজগারী। যা এভাবে অর্জন করা হয়, তাকে হারাম হওয়ার হুকুম দেয়া যায় না। এটাকে সন্দেহের পর্যায়েও ফেলা যায় না। কেননা যেখানে বিষয়টা জানা থাকে, সন্দেহের স্থান সেটাকেই বলা যায়। কিন্তু এখানে ছুরি বা চাকু জোরপূর্বক গ্রহণ করে অন্যের অস্ত্রদ্বারা যবেহ করার কথা জানা আছে এবং যবেহের জন্তু হালাল হওয়ার কথাও জানা আছে। যদি বল যে, এই প্রকার অর্জিত বস্তু মাকরূহ বরং তা' হারাম হওয়ারও সন্দেহ হয়। সুতরাং একে সন্দেহজনক বস্তু বলা জায়েয এবং এর মাকরূহ নামকরণ করা ন্যায়সঙ্গত। এর উত্তর হল, জেনে রাখবে, মাকরূহর তিনটি স্তর আছে; যথাঃ (ক) যা হারামের নিকটবর্তী, তা' ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক (খ) যা অমূলক ধারণামাত্র বা শয়তানের কুমন্ত্রণার ন্যায়, তা' ত্যাগ করবে এবং (গ) যা এই দু' সীমার নিকটবর্তী যেমন জোরপূর্বক গৃহীত কুকুর দ্বারা শিকার করা, জোরপূর্বক গৃহীত ছুরি দ্বারা যবেহ করার মাকরূহ থেকে জঘন্যতর। এরূপ কুকুরের শিকার শিকারীর হবে, না কুকুরের মালিকের হবে, তা' নিয়ে ওলামাদের মতভেদ আছে। এটা কোন মুমিন জোরপূর্বক দখল করত। তাতে বীজ বপন করে শস্য উৎপাদন করার ন্যায়। এখানে বীজের মালিক শস্য পাবে না। যমিনের মালিক পাবে, এ প্রশ্ন দেখা দেয়। যদি যমিনের মালিক পায়, তবে তা' হারামের নিকটবর্তী হয়, কেননা ঐ শস্যের বীজের মালিক সে নয়, কিন্তু কিয়াস অনুযায়ী যমিনের হকও নষ্ট করা যায় না। যেমন জোরপূর্বক গৃহীত চাকি দ্বারা গম পিষলে ব্য ভদ্রপভাবে গৃহীত জাল দ্বারা মৎস্য শিকার করলে বা তদ্রূপ গৃহীত কুঠার দ্বারা কাঠ কাটলে, ঐ গম, জাল বা কুঠারের মালিকের হক নষ্ট করা যায় না, যদিও তা' মাকরহ। জোরপূর্বক অন্নদ্বারা নিজের প্রাণী যবেহ করা নিম্নতম মাকরূহ। জুমআর আযানের সময়ে ক্রয়-বিক্রয় করাও তদ্রূপ মাকরূহ, তবে কারও কারও মতে ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি তখন ফাসেদ হয় কিন্তু বাতিল হয় না। আযানের পর শুক্রবার দিন ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করা ওয়াজিব। এ সময় ক্রয়- বিক্রয় করা জুমআর নামাযের প্রতি অবজ্ঞাস্বরূপ বলে তা' ফাসেদ হয়।

        বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তি হতে কিছু দ্রব্য ক্রয় করল। তারপর সে জানতে পারল যে, বিক্রেতা ঐ বস্তু জুমআর দিন ক্রয় করেছিল। তখন সে এই ভয়ে ঐ বস্তু বিক্রেতাকে ফিরিয়ে দিল যে, হয়ত সে তা' জুমআর দিন আযানের সময় ক্রয় করে থাকবে। এটা সন্দেহের চরম পর্যায় এবং অমূলক ধারণা। এরই বশবর্তী হয়ে সে ঐ বস্তু ফিরিয়ে দিয়েছিল। এ ধরনের সততা বা পরহেজগারী উত্তম হলেও তাতে বাড়াবাড়ি বা সীমাতিক্রমের দোষ আছে। প্রত্যেক কাজেরই একটা সীমা থাকে। তা' অতিক্রম করতে গেলেই কোন না কোন দোষ ঘটে। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সীমাতিক্রমকারীদের জন্য ধ্বংস (অনিবার্য)। এরূপ অতিরিক্ততা থেকে সতর্ক থাকবে। যদিও তা' তেমন অনিষ্টের কারণ নয়, তবু অন্যান্য লোক ধারণা করতে পারে যে, এরূপ অতিরিক্ততা আবশ্যক। অধিকাংশ লোকের বেলায়ই প্রমাণ হয়ে গেছে যে, প্রথম প্রথম তারা ধর্মপথ নিজেদের উপর খুবই সংকীর্ণ করে নিয়েছিল। তারপর যখন তারা হতাশাগ্রস্ত হল তখন তারা সে নীতি ত্যাগ করল। যে সব লোক হালাল জিনিস সম্পর্কে কু ধারণা করে এবং তার প্রতি অমূলক সন্দেহ পোষণ করে, এভাবে যে দুনিয়ার সব মাল হারাম। তারা হালাল ও হারামের মধ্যকার পার্থক্য উঠিয়ে দেয়। এটা ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।

        (২) পরিণতির মধ্যে গুনাহঃ তা' হল সমস্ত অপব্যয় যা গুনাহর দিকে পথ প্রদর্শন করে। তার দৃষ্টান্ত মদ প্রস্তুতকারীর নিকট আঙ্গুর বিক্রয় করা, বালকদের সাথে যারা মেশামেশি করে তাদের নিকট বালক দাস বিক্রয় করা, ডাকাতের নিকট অস্ত্র বিক্রয় করা, উলামাদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ আছে যে, এগুলোর মূল্য গ্রহণ করা জায়েয কি নাজায়েয। অনুমান বা কিয়াস এই যে, ক্রেতাদের সাথে চুক্তি করলে ওগুলোর মূল্য জায়েয এবং হালাল। কিন্তু চুক্তিকারী বিক্রেতা গুনাহগার হবে। যেরূপ যবেহর প্রাণী হালাল হলেও জোরপূর্বক গৃহীত ছুরি দ্বারা যবেহ করা গুনাহ এবং গুনাহকারীর সাহায্য করাও গুনাহ। তজ্জন্য উক্ত জিনিসের মূল্য গ্রহণ করা অত্যধিক মাকরূহ। তবে হারাম নয়। তা' থেকে বিরত থাকা উত্তম পরহেজগারী। মদখোর থেকে আঙ্গুর ক্রয় করা এবং মদখোরের নিকট আঙ্গুর বিক্রয় করার মধ্যেও পার্থক্য আছে। তদ্রূপ যোদ্ধার নিকট অস্ত্রশস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় করা ও তার নিকট থেকে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করার মধ্যেও প্রভেদ আছে। অশান্তির সময় অস্ত্রশস্ত্র বিক্রয় করা পূর্বযুগের বুযর্গগণ মাকরূহ বলেছেন। কেননা হয়ত তা' কোন শান্তি ভঙ্গকারী বা অত্যাচারীর হস্তে পৌঁছাতে পারে। প্রথম শ্রেণীর পরহেজগারী থেকেও এই পরহেজগারী উচ্চ পর্যায়ের। যা নিম্নস্তরের মাকরূহ তা' কুমন্ত্রণার নিকটবর্তী। কোন কোন আলিম বলেন যে, কৃষকদের নিকট চাষের যন্ত্রপাতি বিক্রয় করা জায়েয নেই। কেননা সে তদ্বারা শস্য উৎপাদন করবে এবং সেই শস্য অত্যাচারীর হাতে পড়ে তার শরীর বৃদ্ধি করবে। এটা একেবারেই শয়তানের কুমন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সীমা অতিক্রম করা সম্বন্ধে হুযুরে পাক (দঃ) নিষেধ করেছেন, মূর্খ আবিদগণই এরূপ প্রচার করে বেদআত প্রবর্তন করে। অথচ হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, (মূর্খ) আবিদের উপর আলিমের ফজীলত আমার সাধারণ ছাহাবীদের উপর আমার ফজীলতের ন্যায়। যারা সীমাতিক্রমকারী তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাদের ইহ জীবনের চেষ্টা ব্যর্থ হবে। যদিও তারা ভাবে যে উত্তম কার্যই তারা করছে।

        মোটকথা পরহেজগারী বা সতর্কতার অতি সূক্ষ্ম তত্ত্বে আলিমের সংস্রব ও উপদেশ ব্যতীত লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। কেননা মানুষের প্রবর্তিত বিষয়ের উপকার থেকে অপকারই অধিক। হযরত সা'দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর আঙ্গুরের বাগিচা এই ভয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন যে, তদ্বারা মদ প্রস্তুতকারীগণ মদ তৈরী করবে। এর কারণ আমার বোধগম্য নয়। হয়ত এরূপ কার্য করার অন্য কোন কারণও থাকতে পারে। যিনি এত উচ্চস্তরের ছাহাবী ছিলেন তাঁর দ্বারা এরূপ কার্য সংঘটিত হওয়া আমার বিবেক সাক্ষ্য দেয় না। যদি এরূপ করা জায়েয হত তাহলে ব্যভিচারের ভয়ে পুরুষাঙ্গ কর্তন করা বা মিথ্যে কথা বলার ভয়ে জিহ্বা কেটে ফেলে দেয়া জায়েয হত।

        (৩) আগ্রবর্তী বিষয়ের মধ্যে গুনাহঃ এর মধ্যে গুনাহ হওয়ার তিনটি স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর এর মধ্যে সবচেয়ে নিন্দনীয় গুনাহ ঐ কার্যে যার চিহ্ন বাকী থেকে যায়। যেমন যে বকরী জোরপূর্বক অর্জনকৃত তৃণ বা ঘাস খায় অথবা হারাম চারণভূমিতে চড়ে, তার মাংস ভক্ষণ করা গুনাহর কার্য। কেননা তার মাংস রক্ত ইত্যাদি ঐ ঘাসের দ্বারাই বর্ধিত হয়েছে। এ থেকে আত্মরক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। যদিও তা' ওয়াজিব নয়। পূর্বকালের বুযর্গদের অনেকেই এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। হযরত আবু আবদুল্লাহ তুসী (রহঃ) এর একটি বকরী ছিল। তিনি তার দুগ্ধ পান করতেন। প্রত্যহ তিনি বকরীটিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে নিজে নামাযে লিপ্ত হতেন। একদা বকরীটি কোন এক আঙ্গুরের বাগিচায় ঢুকে আঙ্গুর খেতে লাগল। তিনি তা' দেখতে পেয়ে বকরীটিকে ঐ বাগানের মধ্যে রেখে দিয়ে চলে এলেন। ওটিকে আর গ্রহণ করা হালাল মনে করলেন না।

        যদি বল, হযরত ওমর (রাঃ) এর পুত্রদ্বয় আবদুল্লাহ এবং ওবায়দুল্লাহ একটি উট খরিদ করে চারণভূমিতে ছেড়ে দিলেন; এবং তাতে উটটি হৃষ্ট-পুষ্ট হল। হযরত ওমর (রাঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি উষ্ট্রটিকে চারণভূমিতে ছেড়ে দিতে? তারা বললেন, জীহা। তখন তিনি ঐ উটটির অর্ধেক মাংস ঘাসের মালিককে দিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি ওটাকে তাদের জন্য হারাম করেন নি। যদি হযরত ওমর (রাঃ) ঐরূপ করে থাকেন তাহলে আপনার বর্ণিত উপরোক্ত বিষয়ের তাৎপর্য কি?

        এ কথার উত্তর এই যে, আমাদের কথা হল, ব্যাপারটি তদ্রূপ নয়। খাস ভক্ষণের পরই তা' নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু গোশত শরীয়ত মতে নতুন বর্ধিত হয়। ঘাসের মালিকের গোশতের মধ্যে কোন অংশ নেই। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) ঘাসের মূল্য বারত উটের অর্ধেক মাংস ঘাসের মালিককে দিয়ে দিলেন।

        মধ্যম স্তর: বাশার বিন হারেছ থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি অত্যাচারী লোক কর্তৃক খননকৃত খালের পানি ব্যবহার করতেন না। অন্য একজন বুযর্গ ব্যক্তি আঙ্গুর ভক্ষণ করতেন না। কেননা আঙ্গুরের বাগানে এমন পানি সিঞ্চন করা হয়েছে যে ঐ অত্যাচারীর খননকৃত খাল থেকে ত্য' প্রবাহিত হয়ে আসত। এগুলো আরও উচ্চস্তরের পরহেজগারী। অন্য একজন বুযর্গ বাদশাহর নির্মিত পথিমধ্যকার পান্থশালায় আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকতেন। তা' থেকেও উচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা অবম্বন ছিল হযরত যুননূন মিসরী (রহঃ) এর। যিনি সম্পূর্ণ হালাল রুজী থেকেও বিরত ছিলেন, একারণে যে, তা' কারাগারের জনৈক প্রহরী মারফত তার কাছে পৌঁছেছিল।

        তৃতীয় স্তর: এটা কুমন্ত্রণার নিকটবর্তী এবং তা' হালাল দ্রব্য থেকে বিরত থাকা এবং তা' গুনাহগারের হস্ত মারফত চলে আসা। তা' হারাম ভক্ষণের ন্যায় গুনাহর কাজ নয়। যে ব্যক্তি সেই খাদ্য পৌঁছে দেয় তার শক্তি হারাম রুজী ও ব্যভিচার দ্বারা বর্ধিত। যদি হালাল খাদ্য কাফিরের হস্ত দ্বারা পৌঁছে তা' হতে বিরত থাকা শয়তানের কুমন্ত্রণা। এটা হারাম ভক্ষণের বিপরীত। কেননা খাদ্য বহনের সাথে কুফরীর কোন সম্পর্ক নেই। যদি একাজই নিষিদ্ধ হয় তা'হলে মিথ্যুক, নিন্দুক এবং এ শ্রেণীর যে কোন লোকের মাধ্যমে খাদ্য বহন করা নিষিদ্ধ হবে। এটা অত্যধিক বাড়াবাড়ি এবং সীমাতিক্রম করার নামান্তর; বরং সতর্কতা অবলম্বনের ক্ষেত্রে কেবল এ বিষয়ের দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে, যেদিকে হযরত যুননূন মিসরী (রহঃ) বা বাশার হাফী (রহঃ) লক্ষ্য রেখেছিলেন, কোন অহংকারী ব্যক্তির তৈরী পানির পাত্রে যদি পানি পান করা নিষিদ্ধ হয়, তা'হলে যে ব্যক্তি মানুষকে প্রহার করে বা তিরস্কার করে তার সাথে কারবার করা নিষিদ্ধ হবে। এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা ও অমূলক ধারণা।

        বকরী হারাম ঘাস খাওয়ার কারণে যদি তার মাংস ভক্ষণ করা নিষিদ্ধ হয়, তা'হলে কারাকর্তৃপক্ষের হাতে খাদ্য ভক্ষণ করাও অধিক হারাম। কেননা তার শক্তি সেই খাদ্য নিয়ে যায় কিন্তু বকরী নিজেই বিচরণ করে। এটা কুমন্ত্রণা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এ কথা প্রকাশ্য আলিমদের ফতোয়া বহির্ভূত। ফকীহর ফতোয়া প্রথম শ্রেণীর হারাম সম্বন্ধেই সীমাবদ্ধ। যা সাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু সন্দেহজনক বস্তু নেককার এবং খোদাভীরু লোকদেরই বিষয়ীভূত। এই সন্দেহজনক বিষয়ে হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমার বিবেকের নিকট ফতোয়া তলব কর। তিনি আরও বলেছেন, দিলের দ্বিধাদ্বন্দুই গুনাহ। দ্বীনের পথের পথিকদের হৃদয়ে যে সন্দেহ উপস্থিত হয় তাতে দিলে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তা' অনিষ্ট ঘটায় এবং তাতে হৃদয়ের প্রতি অত্যাচার করা হয়। যদি আল্লাহর নির্ধারিত হারামের দিকে সে অগ্রসর হয় এবং সে তা' হালাল বলে জানে তবে তার হৃদয় কঠিন হয়ে যায়। যদি সে প্রকাশ্য আলিমদের ফতোয়া অনুযায়ী হালালের দিকে অগ্রসর হয় এবং হৃদয় মধ্যে খটকা দেখা দেয় তা' তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তদ্রূপ যদি কেউ মনে করে, অজুর পানি দ্বারা তিনবার ধৌত করার পরেও হয়ত পানি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করে নি এটা তার অমূলক ধারণা হবে।

        (৪) বিনিময়ের বস্তুর মধ্যে গুনাহ। এর মধ্যেও কয়েকটি স্তর আছে। (ক) সর্বোচ্চ স্তরঃ এই স্তরে নিন্দনীয় বিষয় তীব্র, কেননা কোন বন্ধু বাকীতে ক্রয় করে তার মূল্য অত্যাচারলব্ধ অর্থের দ্বারা বা হারাম জিনিস দ্বারা দেয়া হয়। যদি বিক্রেতা স্বেচ্ছায় মূল্য হস্তগত হওয়ার পূর্বে কোন খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় করে, মূল্য গ্রহণের পূর্বে তা' ভক্ষণ করা হালাল। সবারই মতে মূল্য গ্রহণের পূর্বে তার ভক্ষণ করা ওয়াজিব নয়; এবং তা' পরহেজগারীরও অন্তর্গত নয়। হারাম ভক্ষণ করে মূল্য দেয়া তা' না দেয়ারই অনুরূপ। আর যদি তা' আদায় না করা হয় তাহলে তা' বিক্রেতার হক হয়। অর্থাৎ মূল্যের দায়িত্ব তার উপর বর্তে। তবে সে জিনিস হারাম হয় না। তারপর হারাম দ্রব্য হতে মূল্য দেয়ার পর যদি বিক্রেতা তাকে হারাম মাল দেয় তখন ক্রেতা যিম্মামুক্ত হয়ে যায়। তার উপর শরীয়ত মতে এই গুনাহ থাকে যে সে হারাম মুদ্রা ব্যয় করেছে; এবং বুঝেছে মূল্য হালাল, এমতক্ষেত্রে ক্রেতা মুক্ত হবে না। কেননা সে জেনেশুনে এই গুনাহ করে থাকে। যদি সে খুশী মনে তাকে তা' না দেয় অথবা সে তা' গ্রহণ করে, তার ভক্ষণ হারাম হয়ে যায়। চাই মূল্য প্রদানের পূর্বে ভক্ষণ করুক অথবা পরে ভক্ষণ করুক।

        মধ্যম স্তর: বিনিময়ের দ্রব্য হারাম ও অত্যাচারলব্ধ না হওয়া; কিন্তু তন্যধ্যে কোন গুনাহর সন্দেহ করা যেমন মূল্যের বিনিময়ে আঙ্গুর এমন ব্যক্তিকে দেয়া যে মদ পান করে বা মূল্যের বিনিময়ে চোর-ডাকাতকে অস্ত্রশস্ত্র দেয়। যে ক্রেতা বাকীতে কোন দ্রব্য ক্রয় করে তার তা' হারাম না হলেও মাকরূহ হয়। এই শ্রেণীর মধ্যেও বিভিন্ন স্তর আছে। তা' গুনাহর পরিমাণ অনুযায়ীই মূল্য গৃহীতার উপর বর্তে। বিনিময় দ্রব্য হারাম হলে তা' প্রদান করাও হারাম। যদি হারাম হওয়ার প্রবল সন্দেহ হয় তা' দেয়া মাকরূহ। তজ্জন্য সিঙ্গার উপার্জন নিষেধ করা হয়েছিল। তা' শুধু আমলের জন্যই হালাল করা হয়েছে। প্রাণীহত্যা যদিও মূলতঃ হারাম আবশ্যকতার জন্য তা' হালাল করা হয়েছে। এই আবশ্যকতা নির্ধারণ করা বড়ই কঠিন। অনেক সময়ই যা আমরা উপকার বলে মনে করি তা' অপকার এবং আল্লাহর নিকট হারাম হয়ে যায়।

        সর্বনিম্ন স্তরঃ এটা হল কুমন্ত্রণাকারীদের স্তর। যেমন কোন লোক শপথ করে যে তার মাতার লওয়া সূতোর তৈরী বস্ত্র সে পরিধান করবে না। তখন সে তার সূতো বিক্রয় করে তদ্বারা বস্ত্র ক্রয় করে তা' পরিধান করল। এটা নিন্দনীয় নয়। এ থেকে বিরত থাকা শয়তানের কুমন্ত্রণা। হযরত মুগীরাহ ইবনে শো'বাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এটা জায়েয নেই। তিনি প্রমাণস্বরূপ হুযুরে পাক (দঃ) এর হাদীস উদ্ধৃত করে যেমন ইহুদীদের উপর আল্লাহ লা'নত করেছেন। তারা মদ হারাম করলেও তা' বিক্রয় করে তার মূল্য নিজদের কাজে লাগাত। এটা তাদের ভ্রান্ত নীতি। কেননা যখন মদ বিক্রয় করা হারাম, শরীয়ত মতে তা' বিক্রয়কৃত মূল্য গ্রহণ করাও জায়েয নয়। হারাম দ্রব্যের মূল্যও হারাম। এর দৃষ্টান্ত এই, একটি নাসী এক ব্যক্তির দখলে এল। কিন্তু দাসীটি ছিল তার দুধভগ্নি। লোকটি তার দাসীকে অন্য একটি দাসীর সঙ্গে বিনিময় করে নিল। এখন সেই বেগানা দাসীকে বিবাহ না করা অমূলক ধারণা। এসব স্তরের পার্থক্য অনেক। তা' তিন চারটি স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কিন্তু ওগুলোর উদ্দেশ্য মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া। যদি বল হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দশ দেরহামে একখানি কাপড় ক্রয় করে এবং তার মধ্যে এক দেরহামও হারাম থাকে তবে যে পর্যন্ত সেই কাপড় তার পরিধানে থাকে সে পর্যন্ত তার নামায কবুল হবে না। তারপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর কর্ণে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে বললেন, দু' কর্ণ ভারী হোক আমি যদি এই কথা না শুনতাম। এ কথার উত্তর এই, উক্ত হাদীসে নগদ ক্রয়ের কথা উল্লেখ আছে। বাকী ক্রয়ের কথা নয়। যা বাকীতে ক্রয় করা হয় তার অধিকাংশই আমি হারাম বলেছি। তার মধ্যে এমন হারাম আছে যা করার কারণে নামায কবুল হয় না।

Post a Comment

0 Comments