হজ্জ্বের পালনের কর্তব্য সমূহ

     কর্তব্য সমূহ (প্রথম কর্তব্য)

        হজ্জ্বোপলক্ষে গৃহ হতে বের হয়ে এহরাম বাঁধার পূর্ব পর্যন্ত আটটি কাজ করা সুন্নত। (১) সফর শুরু করার পূর্বে তাওবাহ করবে। অন্যের হক অন্যায়ভাবে দখল করে থাকলে তা' প্রত্যার্পণ করবে। ঋণ পরিশোধ করে দেবে। যার ভরণপোষণ সফরকারীর যিম্মায়, সফর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত তাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করবে। নিজের কাছে কারও আমানত থাকলে তা' তার কাছে সঁপে দেবে। তারপর নিজের যাতায়াত এবং সফরের খরচের জন্য প্রয়োজনীয় হালাল অর্থ সাথে করে নেবে। সম্ভব হলে কিছু অতিরিক্ত মালও সাথে রাখবে, যাতে গরীব মিসকীনকে দান খয়রাত করা যায় এবং কোন অবাঞ্ছিত সঙ্কট বা সমস্যা দেখা দিলে তা' থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। সফরে যাত্রা করার পূর্বে কিছু দান-খয়রাত করবে।

        (২) কোন নেক্কার, সৎ, হিতাকাঙ্খী এবং সুসম্পর্ক বিশিষ্ট সফরকারী অনুসন্ধান করবে যাতে পথে ও বিদেশে তার থেকে সাহায্য ও উপকার লাভ করা যায়। যাত্রাকালে পিতা-মাতা, ভাই-ভগ্নি, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিদায় নেবে, তাদের প্রত্যেকের কাছে দোয়া প্রার্থনা করবে। "আস্তাওদাল্লাহা দ্বীনাকা অ আমানাতাকা অ খাওয়াতীমা আমালিকা" অর্থাৎ আমি তোমার ধর্ম, তোমার আমানত এবং তোমার কর্মের ফল আল্লাহরহজ্জ্বের নিয়তকারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা এই দোয়াটি পাঠ করতে বলেছেনঃ "ফী হিফজিল্লাহি অ কানা ফিহী অ যাওয়্যাদাকাল্লাহুত্তাত্ত্বওয়া অ জান্নাবাকার রিদা অ গাফারা যামবাকা অ অজ্জাহা লিল খাইরি আইনামা তাওয়াজ্জাহতা" অর্থাৎ আল্লাহর হেফাজাত ও আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। আল্লাহ্ তোমাকে পরহেজগারীর পাথেয় দিন। তোমাকে ধ্বংস থেকে বাঁচিয়ে রাখুন, তোমার গুনাহ মার্জনা করুন আর তুমি যেদিকেই যাওনা কেন, তোমাকে মঙ্গলের সম্মুখীন করুন।

        (৩) গৃহ হতে রওয়ানা হওয়া কালে দু'রাকাত নামায পড়বে। এর প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা ইখলাছ এবং দ্বিতীয় রাকাতেও সূরা ইখলাছ পড়বে। নামায শেষে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে এরূপ মুনাজাত করবে: হে মাবুদ। আমার এ সফরে তুমিই আমার সাথী, আমার মাল-সামান , সন্তান-সন্ততি পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-এগানার জন্য তুমিই আমার স্থলবর্তী। তুমি আমাকে ও তাদেরকে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করো। হে মাবুদ। আমার এ সফরে তোমার নিকট নেকী ও পরহেজগারী কামনা করছি। আমি যেন তোমার সন্তুষ্টিজনক কাজ করতে পারি, যাতে তুমি খুশী হও। হে মাবুদ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করি, তুমি আমার এ সফরের দূরত্ব লাঘব করে দাও। সফরকে আমার জন্য সহজসাধ্য করে দাও। তুমি প্রবাসে আমার দৈহিক, মানসিক, আর্থিক এবং দ্বীনী নিরাপত্তা রক্ষা করো। আর তোমার পবিত্র খানায়ে কা'বা ও হযরত রাসূলে করীম (দঃ)-এর পাক রওজাহ আমার যিয়ারাত নছীব কর। হে মাবুদ। আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি সফরের কষ্ট থেকে, দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করা হতে এবং পরিবার-পরিজন, ধন-দৌলত এবং সন্তান-সন্ততিকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখা থেকে তত্ত্বাবধানে গ্রহণ কর। আমাকে ও তাদেরকে তোমার নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করোনা এবং আমার ও তাদের উপর তোমার প্রদত্ত আরাম ও শান্তি অক্ষুন্ন রাখ।

        (৪) গৃহ দরজার নিকটবর্তী হয়ে এরূপ প্রার্থনা করবেঃ আল্লাহর নামে শুরু করছি, আল্লাহর উপর ভরসা করছি। আল্লাহ ব্যতীত কারও কোন শক্তি বা সামর্থ্য নেই। হে মাবুদ! যেন আমি পথভ্রষ্ট না হই বা কাউকে পথভ্রষ্ট না করি। যেন আমি পদস্খলিত না হই বা কারও পদস্খলন না করি, যেন আমি অত্যাচারিত না হই বা কাউকে অত্যাচার না করি। যেন আমি কারও মূর্খতার শিকার না হই বা আমিও কারও প্রতি মুর্খতা- সুলভ কাজ না করি। হে মাবুদ। আমার বের হওয়ার উদ্দেশ্য যেন রিয়া, অহঙ্কার এবং সুখ্যাতি অর্জন না হয় বরং তোমার সন্তুষ্টি লাভ, অসন্তষ্টির ভীতি, তোমার নির্দেশ পালন, তোমার নবীর (দঃ) সুন্নত আদায় এবং তোমার দীদার হাছিল উদ্দেশ্য হয়। পথচলা কালে প্রার্থনা করবেঃ হে মাবুদ। আমি তোমারই সাহায্যে চলেছি, তোমারই উপর নির্ভর করছি, আমি তোমাকেই আঁকরে ধরেছি। তুমিই আমার আশা ও ভরসা। অতএব তুমি আমাকে হেফাজাত করে। তা' থেকে যা চলার পথে আমার সামনে আসে আর যে ব্যাপারে আমি পূর্ণ অক্ষম এবং যে বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা বরং তুমি সর্বাপেক্ষা অধিক অবগত। হে মাশদ। তোমার গুণাবলীর প্রশংসা মহান। তুমি ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই। হে মাবুদ!

        ৫) যানবাহনে আরোহণ কালে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করবেঃ 

         বিসমিল্লাহি অ বিল্লাহি আল্লাহু আকবারু তাওয়াক্কালতু আলাল্লাাহি অ লাহাওলা অলা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়িাল আজীমি মা শাআল্লাহু কানা অমা লাম ইয়াশাউ লাম ইয়াকুন সুবহানাল্লাযী সাখরা লানা হাযা অমা কুন্না লাহু মুকুরিনীন অ ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনকালিন, আল্লাহুম্মা ইন্নী অজ্জাহতু অজহিয়া ইলাইকা অফাওয়াদ্বতু আমরী কুল্লাহু ইলাইকা অ তাওয়াক্কালতু ফী জামীই উমূরী আলাইকা আনতা হাসবী অ নি'মাল অকীল। অর্থাৎ আল্লাহ এবং আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ মহান। আমি আল্লাহর উপর নির্ভর করছি। সুউচ্চ মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কারও শক্তি ও সামর্থ্য নেই। আল্লাহ যা চান, তা-ই হয়ে যায়। আর তিনি যা চান না তা' হয় না। তিনি পবিত্র, তিনি এ (ব্যহন) কে আমাদের আয়ত্ত করে দিয়েছেন। আমরা একে আয়ত্ত করতে সক্ষম হতাম না। নিশ্চয় আমরা আমাদের প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করব। হে মাবুদ। আমি তোমার দিকে মুখ ফিরিয়েছি। আমার সমস্ত বিষয় তোমাকে সঁপে দিয়েছি। তুমিই আমার জন্য যথেষ্ট এবং উত্তম কাজ আঞ্জামকারী। বাহনের উপর সুস্থির ভাবে আসন গ্রহণের পর সাত বার পড়বেঃ " সুবহানাল্লাহি অলহামদু লিল্লাহি অ লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার" অর্থাৎ আল্লাহ পবিত্র, সব প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার। আল্লাহ ব্যতীত কেউ উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান। আরও পড়বেঃ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে এ পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি পথ না দেখালে আমরা পথের সন্ধান পেতাম না। হে মাবুদ! তুমিই বাহনে আরোহণ করিয়েছ। আর সকল ব্যাপারে তোমার নিকটই সাহায্য চাওয়া হয়।

        (৬) যানবাহন থেকে অবতরণের ব্যাপারে বিধান হল, সূর্যের তেজ প্রখর না হওয়া পর্যন্ত বাহনের উপর হতে অবতরণ করবে না। রাত্রিকালে অধিক পথ অতিক্রম করবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেনঃ শেষরাত্রে পথ চল। রাত্রে পথ চলার মত দিনে চলা যায় না। রাত্রে নিদ্রা কম যাওয়া চাই যাতে বেশী পথ চলা যায়। যখন মনযিল নয়নগোচর হবে,

         তখন আল্লাহর নিকট এই দোয়া করবেঃ হে মাবুদ। সাত আসমান এবং সেই সব বস্তুর, যেগুলোর উপর সাত আসমানের ছায়া প্রতিফলিত হয়; এবং প্রতিপালক সপ্ত তবক যমিনের এবং সেই বস্তুর যাদেরকে সপ্তস্তর যমিন বহন করছে এবং প্রতিপালক শয়তানের এবং তাদের, যাদেরকে শয়তান পথভ্রষ্ট করেছে এবং প্রতিপালক বায়ুর এবং সেই সব বস্তুর, যেগুলোকে বায়ু উড়িয়ে নেয় এবং প্রতিপালক সাগরের এবং সেই সব বস্তুর, যেগুলোকে সাগর বয়ে নিয়ে যায়, আমি তোমার সকাশে এই মনযিলের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর এর অধিবাসীদেরও হিত কামনা করছি। হে মাবুদ! আমি তোমার নিকট এই মনযিলের অকল্যাণ থেকে ও মনযিলের সব কিছুর অকল্যাণ থেকে পানাহ চাচ্ছি। তার মধ্যে যাকিছু ক্ষতিকর এবং অকল্যাণকর আছে, তা' সব আমাথেকে দূর করে দাও। মনখিলে পৌঁছে তথায় অবতরণ করে দু' রাকাত নামায পড়বে। তারপর এ দোয়াটি পাঠ করবেঃআল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকালিমাতিল্লাতি তাম্মাতিল্লাতী লা ইয়ুজাওয়্যিয় হুন্না বাররুন অলা  ফাজিরুম মিন শাররি মা খুলিকা" অর্থাৎ হে মাবুদ! আমি আল্লাহর পূর্ণ কালেমার দ্বারা যা কোন সৎ ও অসৎ অতিক্রম করতে পারে না--সৃষ্টির ক্ষতি-লোকসান থেকে পানাহ চাচ্ছি। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এলে পড়বেঃ

        হে দুনিয়া। আমার প্রভু ও তোমার প্রভু আল্লাহ তায়ালা। আমি আল্লাহর দরবারে তোমার ও তোমার মধ্যকার সবকিছু থেকে আশ্রয় চাচ্ছি আর তোমার উপর যা বিচরণ করছে, তা' থেকেও, আমি পানাহ চাচ্ছি আল্লাহর কাছে প্রত্যেক হিংস্র জন্তু, সাপ, অজগর এবং বিচ্ছুর অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।

        (৭) পথ চলার সময়ে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করবে। দিবাভাগে কাফেলাথেকে একাকী কোথাও ভ্রমণে যাবে না। কারণ এতে একাকী ডাকু-তস্কর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবার ভয় এবং কাফেলা হারিয়ে ফেলার আশংকা রয়েছে। রাত্রিতে নিদ্রা কালে হুঁশিয়ার এবং সতর্ক থাকবে। রাতের প্রথম প্রহরে নিদ্রা গেলে হাত প্রসারিত রাখবে। রাতের শেষ প্রহরে নিদ্রা গেলে হাত উপরে তুলে রাখবে এবং হাতের তালুতে মাথা রেখে শয়ন করবে। হুযুরে পাক (দঃ) এভাবেই শয়ন করতেন এবং নিদ্রা যেতেন। কেননা এর ব্যতিক্রমে গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়ার আশংকা থাকে। যার ফলে ভোরে নিদ্রার মধ্যেই সূর্যোদয় হয়ে ফজরের নামায বরবাদ হয়ে যেতে পারে। এ ভাবে নামায নষ্ট হওয়াটা হচ্ছে ছওয়াব অপেক্ষা অধিক গুরুতর। কাফেলায় লোক দুজন হলে একই সাথে দুজনেই নিদ্রা না গিয়ে একজন ঘুমাবে ও অন্যজন জেগে পাহারায় থাকবে। এটা সুন্নত তরীকা। দিনে বা রাত্রে কোন শত্রু বা হিংস্র শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার জন্যে আয়াতুল কুরসী, কালেমায় শাহাদাত, সূরা ইখলাছ এবং সূরা ফালাক, সূরা নাস পাঠ করবে। সবশেষে আল্লাহর কাছে এইরূপ দোয়া করবেঃ আল্লাহর নামে, আল্লাহ যা চান, তাই হবে। আল্লাহ ব্যতীত আর কারও কোন শক্তি বা সামর্থ্য নেই। আল্লাহই যথেষ্ট, আমি আল্লাহর উপরই নির্ভর করলাম। আল্লাহ যা চান, তাই হবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারুর মঙ্গল করার সাধ্য নেই। আল্লাহ ব্যতীত অন্য অন্যকারুরই মন্দ দূর করার সাধ্য নেই। তাই আল্লাহ-ই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি প্রার্থনা করছি সেই আল্লাহর দরবারে, যাঁর কোন দিন সমাপ্তি নেই, যাঁর কোন দিনই মৃত্যু হবে না। হে মাবুদ। তুমি তোমার এমন চোখের দৃষ্টির দ্বারা আমাদের খবর রাখ যে চোখ কখনও নিদ্রাভিভূত বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় না। হে মাবুদ। তুমি আমাদেরকে তোমার এমন কুদরত দ্বারা আশ্রয় দান কর, যার কোন তুলনা নেই। তুমিই আমার নির্ভর এবং আশ্রয়স্থল। হে মাবুদ! তুমি অনুগ্রহপূর্বক তোমার বান্দাদের দিল, দয়া ও সহানুভূতি আমার দিকে ফিরিয়ে দাও। নিশ্চয়ই তুমি পরম করুণাময়। 

        (৮) পথিমধ্যে কোন উঁচু স্থানে আরোহণ করলে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে এ দোয়াটি পড়বেঃ"আল্লাহুম্মা লাকাশ শারফু আ'লা কুল্লি শারফিন অলাকাল হামদু আলা কুল্লি হাল" অর্থাৎ হে, মাবুদ! সব গৌরবের উপরে তোমার গৌরব এবং তোমার প্রশংসা সর্বস্থলে, যখন কোন নিম্নভূমিতে অবতরণ করবে, তখন সুবহানাল্লাহ পাঠ করবে। যখন সফরে মনেকোনরূপ ভয়ভীতির সঞ্চার হবে, তখন এই দোয়াটি পড়বেঃ "সুবহানাল্লাহিল মালিকিল কুদ্দুসি রাব্বিল মালায়িকাতি অর কহি জাল্লালাতিস সামাওয়াতি বিল ইযযাতি অল জাবারুতি" অর্থৎ মহান বাদশাহ আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যিনি ফিরেশতাকুল এবং জিব্রাইলের প্রতিপলিক। যার ইযযত এবং প্রতাপে আকাশমন্ডলী সমাচ্ছন্ন।

Post a Comment

0 Comments