হালাল ও হারামের পরহেজগারীর শ্রেণীবিভাগ

 হালাল ও হারামের পরহেজগারীর শ্রেণীবিভাগ 

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, হালাল ও হারামের বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ফিকাহর কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। দ্বীনের পথের পথিকগণ তার দীর্ঘ অবয়ব দেখে মনে করে যে, তাদের জন্য এমন খাদ্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হোক, যা ফতোয়ার মাধ্যমে হালাল হওয়া জানা যায় এবং তারা সে খাদ্য ব্যতীত অন্য খাদ্য ভক্ষণ না করে। তবে তারা যে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য সুনির্দিষ্ট করতে চায় তাদের হালাল ও হারামের সম্যক জ্ঞান রাখা দরকার। তা' আমরা ফিকাহর কিতাবে উল্লেখ করেছি। এখন এখানে আমি তার বিভিন্ন শ্রেণীভেদের কথা আলোচনা করব। কোন বস্তু স্বভাবতঃই হারাম বা নিষিদ্ধ এবং কোন কোন বস্তু উপার্জনের দিক থেকে সিদ্ধ নয়। স্বাভাবতঃই যে সব দ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ তা' হল, মদ ও শূকরের মাংস ইত্যাদি। এর বিশ্লেষণ এই যে, ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত ভক্ষণযোগ্য দ্রব্যগুলো তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত। যথাঃ (১) খনিজদ্রব্য। যেমন লবণ ও মৃত্তিকাজাত দ্রব্যাদি। (২) উদ্ভিদজাত দ্রব্য এবং (৩) প্রাণীজাত দ্রব্য।

        (১) খনিজ দ্রব্য মৃত্তিকারই বিভিন্ন অংশ বা প্রকার। মাটি থেকে যা উদাত হয় তা' ভক্ষণ করা হারাম নয়। অবশ্য ক্ষতিকর হলে তা' ভক্ষণযোগ্য নয়। কেননা তার মধ্যে বিষের প্রভাব থাকতে পারে। এরূপ ক্ষতিকর খাদ্য ভক্ষণ করা নিষিদ্ধ। মাটি ভক্ষণ করা যার অভ্যাস তার উপর তা' হারাম নয়। তবে তাতে অনিষ্ট হলে তা' ভক্ষণ করা সিদ্ধ নয়। আমার কথা এই যে, মাটি ভক্ষণ করা যায় না একারণেই তা' হারাম নয় কেননা যদি মাটির কিছু অংশ কোন তরল খাদ্য বা পানির মধ্যে পতিত হয় তাতে সে খাদ্য হারাম হয় না।

         (২) উদ্ভিদ হারাম নয়। তবে যা ভক্ষণে জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায় বা জীবনাবসান ঘটে বা স্বাস্থ্য নষ্ট করে তা' হারাম। জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্টকারী দ্রব্য মদ এবং নেশার জিনিস। আর যা জীবন হরণ করে তা' হল বিষ এবং যা স্বাস্থ্য নষ্ট করে তা' হল অসময় ওষুধ সেবন। মোটকথা উপরোক্ত জিনিসগুলো অনিষ্টকর এবং হারাম। কিন্তু মদ ও নেশার দ্রব্য সামান্য হলেও তার স্বাভাবিক দোষের জন্য হারাম। এগুলো নেশা উৎপাদন না করলেও হারাম। তার প্রথম কারণ হল, এগুলোর মূলের মধ্যেই নাপাকী নিহিত। আর দ্বিতীয় কারণ হল, এগুলো ভয়ানক উত্তেজক। অবশ্য এর পরিমাণ অতি নগণ্য হলে এবং তা' অন্য জিনিসের সাথে মিশ্রিত হলে এর অনিষ্ট করার গুণ দূর হয়ে গেলে এগুলো হারাম হয় না। (৩) প্রাণী দু'শ্রেণীতে বিভক্ত। (ক) একশ্রেণী ভক্ষণযোগ্য আর একশ্রেণী ভক্ষণযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আহারের বর্ণনায় পাওয়া যাবে। এখানে তা' উল্লেখ করলে অলোচনা দীর্ঘায়িত হবে। বিশেষ বিশেষ বন্য পশু এবং জলজ ও স্থলজ প্রাণীর মধ্যে যেসব প্রাণী ভক্ষণযোগ্য তা' শরীয়ত অনুযায়ী যবের করলে তার মাংস হালাল হয়। তার মধ্যে আবার কতগুলো শর্ত রয়েছে, যেমন যবেহকারী, যবেহকরার অস্ত্র এবং যবেহের প্রাণী সম্পর্কিত কতগুলো বাধ্যবাধকতা এবং রীতি-নীতি রয়েছে, সে বিষয়গুলো পালন করতে হবে। বিষয়টি শিকারের বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে। যা শরীয়ত অনুসারে যবেহ করা হয় না বা যা' মৃত, তা' ভক্ষণ করা হারাম। মৃত প্রাণীর মধ্যে দু'টো শ্রেণী এমন, যা' মৃত হলেও হারাম নয়। তা' হল মৎস্য এবং পঙ্গপাল। উল্লিখিত বিষয়ের মর্মানুযায়ী খাদ্যশস্য এবং ফলের মধ্যকার কীট বা পোকা, যা থেকে সতর্ক হওয়া সম্ভব নয়, যদি সেগুলো পৃথক করা হয়, তবে তার হুকুম মধুমক্ষিকা, বিষ্ণু ইত্যাদির হুকুমের অনুরূপ, যার কোন শ্বাস-প্রশ্বাস নেই তা' হারাম হওয়ার কোন কারণ নেই, যদি তাতে কোন নাপাকী না থাকে। নাপাকী থাকলে অবশ্য হারাম হবে। অধিক সংখ্যক লোকের রুচিবিরুদ্ধ কোন হালাল খাদ্যও মাকরূহ হবে। যেমন কারও ব্যবহৃত পানি পান করা মাকরূহ হয়। এগুলো নাপাকীর জন্য মাকরুহ হয় না বরং রুচিবিরুদ্ধ হওয়ার কারণে মাকরুহ হয়। খাদ্যশস্যের মধ্যে পোকার মৃত্যু হলে বিশুদ্ধ মতে তা' অপবিত্র হয় না। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মক্ষিকা পতিত হলে তা' ডুবিয়ে দেবে। কখনও কখনও গরম খাদ্যের মধ্যে মাছি পড়ে মরে যায়। যদি পিপীলিকা কোন খাদ্যের পাত্রে পড়ে, তবে সে খাদ্য ফেলে দেবে না। কেননা তার শরীর নাপাক নয়। যে বস্তু অন্য বস্তুকে নাপাক করে, তা-ই হারাম। এ বিষয়টিও লক্ষ্যণীয় বৈ কি। এজন্যই আমরা বলি যে, যদি মৃত লোকের এক দানা পরিমাণ অংশও খাদ্যের পাত্রে পড়ে তবে সমস্ত খাদ্য হারাম হবে। তবে এ তার নাপাকীর জন্য নয়। কেননা মানুষ মৃত্যু দ্বারা বিশুদ্ধ মতে অপবিত্র হয় না; বরং মানুষের সম্মানের জন্য তার মাংস হারাম করা হয়েছে, অপবিত্রতার জন্য নয়।

         প্রাণীর মাংস ভক্ষণঃ কোন হালাল প্রাণীকে শরীয়ত অনুযায়ী যবেহ করা হলেও তার শরীরের সর্বাংশই ভক্ষণ করা হালাল হয় না; বরং তার (প্রবাহিত) রক্ত এবং যা তার অপবিত্রতার সঙ্গে জড়িত বা যুক্ত, তা' হারাম। কিন্তু মূলতঃ তা' হারাম নয়। উল্লেখ্য যে, মূলতঃ অপবিত্র দ্রব্য ভক্ষণ করাই হারাম। 

        উদ্ভিদের মধ্যে যা' নেশার সঞ্চার করে, তা' হারাম কিন্তু যা' নেশার সঞ্চার করে না বা জ্ঞান বিলুপ্ত করে না, তা' হারাম নয়। কেননা তা' অপবিত্রও নয়। ভাং খাওয়া হারাম নয়, কেননা ভাং নেশা সঞ্চারক নয় এবং মূলতঃ অপবিত্রও নয়। যে সব বস্তু উপার্জনের দিক থেকে হারাম, সেগুলোর আলোচনা দীর্ঘ হওয়া দরকার। কেননা তাতে বহু বিষয় রয়েছে। উপার্জন প্রথমতঃ দু' প্রকার। এক প্রকার হল, যা' মালিকের ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয় যে বস্তু গ্রহণ করা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, যা আপনা-আপনি হাতে আসে। তার ওয়ারিসী হক।

        উদাহরণ হল, মীরাস বা মালিকের ইচ্ছেয় যা' হাতে আসে, তা' দু' প্রকার। এক প্রকার হল, যা' অজানা মালিকের থেকে হাতে আসে, যেমন ভূগর্ভস্থ খনিজ দ্রব্য। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, যা' স্বয়ং মালিক থেকে গ্রহণ করা হয় তা-ও আবার দু' প্রকার। এক প্রকার হল, যা' মালিকের কাছ থেকে জোরপূর্বক লওয়া হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, যা তার থেকে অনুমতিক্রমে লওয়া হয়। তা-ও দু' প্রকার। এক প্রকার হল, যা' মালিকের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান থেকে বের হয়ে যায়। যেমন চতুষ্পদ জড়। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, যা' মালিকের নিকট থেকে গ্রহণ করায় অন্যের স্বত্ব থাকে। যেমন ধনীদের যাকাত, ফিতরাহ এবং অন্যান্য আর্থিক বিষয়। মালিকের অনুমতিক্রমে যা' গ্রহণ করা হয়, তা'-ও দু' প্রকার। তার এক প্রকার হল, যা' কোন কিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করা হয় না। যেমন হেবা, অছিয়ত ইত্যাদি। মোটকথা উপার্জনের দ্রব্যকে সর্বমোট ছ'ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথাঃ

        (১) যে সব দ্রব্যের মালিক নেই তার মালিক হওয়া, খনিজদ্রব্য বা ভূগর্ভস্থ গুপ্তধন লাভ করা অনুর্বর যমিন উর্বরা করে নেয়া, শিকার করা, জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করা, নদী থেকে পানি গ্রহণ করা ইত্যাদি। উল্লিখিত দ্রব্যগুলো গ্রহণ করা সিদ্ধ তবে শর্ত হল, যদি কোন ব্যক্তি তার মালিক বা স্বত্ববান না হয় এরূপ অবস্থায় এগুলো গ্রহণকারী এর মালিক বা স্বত্বাধিকারী হবে।

         (২) যে বস্তুসমূহ জোরপূর্বক গ্রহণ করা হয় এবং যা' নিষিদ্ধ নয়। যেমন মোফত দ্রব্য যথাঃ বিনা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) এবং যোদ্ধাদের গ্রহণ করার পর অবশিষ্ট সম্পদ, যাহা সমস্ত মুসলমানের জন্য হালাল। তা' থেকে এক-পঞ্চমাংশ বের করে স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে ন্যায়ভাবে বণ্টন করা হয়। যে সব কাফিরের সাথে নিরাপত্তার চুক্তি থাকে তাদের থেকে তা' গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। অন্যত্র এর কারণ আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 

        (৩) যা' মলিকের নিষেধ সত্ত্বেও জোরপূর্বক লওয়ার অধিকার আছে তা' যেভাবে গ্রহণ করা যায়। মালিকের সম্মতি ব্যতিরেকেই তা' এভাবে গ্রহণ করা হালাল। তবে শর্ত হল, তা' গ্রহণ করার যোগ্য ব্যক্তি হতে হবে। এর উদাহরণ হল, যখন কারও উপর পূর্ণ এক বছর অতীত হলে মালের যাকাত ওয়াজিব হয়ে যায়, তখন তার থেকে তা' জোরপূর্বক ও তার অনুমতি ব্যতিরেকে আদায় করে নেয়া যায়। অবশ্য এভাবে আদায় করার অধিকার সবার নেই। এর অধিকার আছে শুধু বাদশাহ, কাজী বা হুকুমত কর্তৃক অধিকারপ্রাপ্ত কর্মচারি বা কর্তৃপক্ষের।

         (৪) যে সব দ্রব্য মালিকের সম্মতিক্রমে কোনকিছুর বিনিময়ে লওয়া হয়, তা' হালাল। এক্ষেত্রে বিনিময় চুক্তি এবং প্রস্তাব ও সম্মতির শর্তগুলো পালন করতে হবে। অন্যায় এবং অযৌক্তিক শর্ত পরিত্যাগ করে শরীয়তসম্মত শর্তগুলো বজায় রাখতে হবে। ওগুলোর বর্ণনা ক্রয়-বিক্রয় এবং অন্যান্য অনুচ্ছেদে পেশ করব। 

        (৫) বিনিময় ব্যতিরেকে সম্মতিক্রমে যা' গ্রহণ করা হয়, তা' হালাল--যদি চুক্তির শর্ত এবং অন্যান্য শর্ত পালন করা হয়। যেমন হেবা, অছিয়ত ইত্যাদি।

        (৬) যে সব দ্রব্য আপনা থেকে হাতে আসে, যেমন ওয়ারিসী স্বত্ব, তা' হালাল। তবে শর্ত এইযে, যদি তা' হালাল পন্থায় হাতে আসে। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির অছিয়ত পালন করতে হবে। একাধিক ওয়ারিস থাকলে তাদের মধ্যে ন্যায়ভাবে মীরাস বণ্টিত হতে হবে। তাছাড়া হজ্ব, যাকাত এবং কোনরূপ কাফফারার ব্যয় যিম্মায় থাকলে তা' আদায় করার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা-ই ওয়ারিসদের জন্য হালাল হবে। অছিয়ত এবং ফারায়েজের অনুচ্ছেেেদ তা' বর্ণিত

            উপরে যা' বর্ণিত হল, তা-ই হালাল ও হারামের মূলকথা। ধর্মপথের পথিকদের জানা চাই যে, উপার্জন যদি এক উপায়ে না হয় বরং বিভিন্ন পথে উপাজর্ন হয়, তা' হলে হারাম থেকে রক্ষ। পাওয়া বড়ই কঠিন; সুতরাং জীবিকা উপার্জন শরীয়তসম্মত বিধি-বিধানের দিকে দৃষ্টি রাখা একান্ত আবশ্যক। উপার্জনের সিদ্ধপথ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে আলিমদের নিকট থেকে তা' জেনে নেয়া কর্তব্য। অনভিজ্ঞ অবস্থায় উপার্জনের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। বে-আমল আলিমদেরকে যেরূপ বলা হয়, তোমরা ইলমকে কেন বেকার ফেলে রেখেছ? তদ্রূপ মূর্খ ব্যক্তিকেও বলা হবে যে, তুমি মূর্খতা নিয়ে কেন কাজে লেগে গেছ? বিদ্যা শিখলে না কেন। একথা তো পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইলম শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

Post a Comment

0 Comments