হালাল ও হারামের কারণের মধ্যে সন্দেহ

  হালাল ও হারামের কারণের মধ্যে সন্দেহ


        এ সন্দেহ দু' প্রকার। যদি দু' বিশ্বাসই এক সমান হয় অথবা তন্মধ্যে একটি বিশ্বাস অপরটি হতে দুর্বল হয় তাহলে দেখতে হবে যদি দুটোই সমান হয় তাহলে তার যে বিধান প্রথম থেকে জানা আছে তাই বলবৎ থাকবে। সন্দেহের কারণে অন্য বিধান দেয়া যাবে না বরং পূর্ব বিধান ঠিক রাখা হবে। আর যদি কোন প্রবল প্রমাণ হতে উদ্ভূত হওয়ার কারণে কোন বিশ্বাস প্রাধান্য লাভ করে তবে সেই বিশ্বাসের পক্ষেই শরীয়তের বিধান যাবে। অবশ্য দৃষ্টান্ত এবং প্রমাণ ব্যতীত এ বিতর্ক পরিষ্কার করা যাবে না। বিষয়টিকে আমরা চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করব।

        প্রথম শ্রেণী: কোন বস্তু পূর্ব থেকেই হারাম বলে জানা আছে। কিন্তু তা' হালাল হওয়ার পক্ষে সন্দেহের কারণ ঘটল। এই প্রকার সন্দেহ পরিত্যাগ করা ওয়াজিব এবং এ সন্দেহের দিকে অগ্রসর হওয়া হারাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, শিকারী কর্তৃক কোন প্রাণী আহত হয়ে পানিতে পতিত হওয়ার পর তাকে মৃত উঠান হলে এবং পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে বা শিকারী কর্তৃক আহত হওয়ার কারণে মারা গেল, তা' জানা না গেলে তার মাংস ভক্ষণ করা হারাম। কেননা এর মূলই হারাম। তবে যদি তা' নির্দিষ্ট পন্থায় মারা যায় এবং পথে কোন সন্দেহ উপস্থিত হয় তখন নিশ্চিত বিশ্বাসের সামনে সন্দেহ টিকবে না। যেমন মল-মূত্রে, নামাযের রাকাতে এবং ইত্যাকার বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস সন্দেহের জন্য ত্যাগ করা যায় না। এ কথার সমর্থনে হুযুরে পাক (দঃ) এর হাদীস রয়েছে, তিনি আদী বিন হাতেম (রাঃ) কে বলেছিলেন, ওটা ভক্ষণ করো না। হয়ত তোমার কুকুর ওটাকে আমাদের জন্য হত্যা করে নি। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট যখন কোন কিছু আনা হত এবং তাঁর সে সম্বন্ধে সন্দেহ হত যে, তা' যাকাত কি উপহার। তিনি তা' না জানা পর্যন্ত সে বিষয় জিজ্ঞেস করতেন। এক বর্ণনায় আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এক রাত্রে জাগ্রত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। আপনি কি জাগ্রত আছেন? তিনি বললেন, হাঁ। আমি একটি খেজুর দেখে যাকাতের খেজুর মনে করে ভয় করছিলাম। অন্য বর্ণনায় আছে, খেজুরটি ভক্ষণ করেছিলাম, তারপর ওটা যাকাতের খেজুর হতে পারে মনে করে ভয় করলাম। জনৈক ছাহাবী বর্ণনা করেছেন, আমরা একবার সফরে হুযুরে পাক (দঃ)এর সঙ্গে ছিলাম। আমাদের ক্ষুধ্য বোধ হলে আমরা একস্থানে অবতরণ করলাম। সেখানে অনেক টিকটিকি ছিল। আমরা তা' একটি পাত্রে চড়িয়ে রন্ধন করতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, বনু ইস্রাঈলের একটি দলের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমি ভয় করছি, যেন আমাদেরও কোন দলের তদ্রূপ না হয়। আমাদের ব্যঞ্জন সবারই জন্য যথেষ্ট হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে, না, আল্লাহতায়ালা কারও আকৃতি পরিবর্তন করছেন না। প্রথম দিকে ঐ খাদ্য নিষিদ্ধ ছিল। কেননা তার মূল হারাম ছিল এবং তিনি তা' হালালভাবে যবেহ করার ব্যাপারেও সন্দিহান ছিলেন।

        দ্বিতীয় শ্রেণীঃ কোন দ্রব্য হালাল হলেও হারাম হওয়ার সন্দেহ করা। এ দ্রব্য মূলতঃ হালাল এবং তার জন্য নির্দিষ্ট বিধানও রয়েছে। তার উদাহরণ হল, দু'জন লোক দু'জন স্ত্রীলোককে বিবাহ করার কিছুদিন পর একদিন দেখল যে, তাদের মস্তকের উপর দিয়ে একটি পাখী উড়ে গেল। তখন লোক দুটোর মধ্যে একজন বলল, পাখীটি কাক হলে আমার স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। অন্যজন বলল, যদি কাক না হয়ে থাকে, তবে আমার স্ত্রী তালাক হয়েছে। এখন ঐ পাখীটা কাক না অন্য কোন পাখী, সে ব্যাপারে উভয়ের সন্দেহ হল। এমতাবস্থায় তন্মধ্যে কোন একজনের বেলায় তার স্ত্রী তালাক হওয়ার ফতোয়া দেয়া যায় না, আবার তাদের উভয়কেও ত্যাগ করা যায় না। তবে তালাক হওয়ার কারণে তাদেরকে ত্যাগ কর। পরহেজগারী। মাকহুল (রহঃ) তাদেরকে ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত শা'বী (রহঃ) বলেছেন, দু'ব্যক্তি বিবাদ করলে তাদেরকে ত্যাগ করা উচিত। একব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে বলল, তুমি বড় হিংসুটে। অন্য ব্যক্তি বলল, তার তিন তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী আমাদেরকে হিংসা করেছে। অন্যজন বলল, হাঁ। এর মধ্যে কে অধিক হিংসুটে তা' নির্ধারণ করা কষ্টকর। এমতক্ষেত্রে যদি পরহেজগারীকে ধরে রাখার ইচ্ছে হয়, তাহলে তাদেরকে ত্যাগ করা শুদ্ধ। দৃঢ় বিশ্বাসকে শুধু সন্দেহ দ্বারা ত্যাগ করা যায় না। এই তার অর্থ।

তৃতীয় শ্রেণী: কোন একটি দ্রব্য মূলতঃ হারাম কিন্তু তার উপর এমন কারণ সৃষ্টি হয়, যার প্রাবল্য বা প্রভাবের কারণে তা' হালাল হয়ে যায়, এটা সন্দেহের ব্যাপারে পরিণত হয়ে হাস্যল হওয়াই অধিক প্রবল হয়। তখন তার বিধান নিম্নরূপ। যদি সে প্রবল ধারণা শরীয়তসম্মত হয় এবং বিশ্বাসযোগ্যও হয় তখন এটা হালাল হয়। তবে তা' ত্যাগ করা পরহেজগারীর শামিল। যেমন কোন জন্তুকে তীর নিক্ষেপ করার পর তা' অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর তাকে মৃতাবস্থায় পাওয়া গেল এবং শরীরে তীরের চিহ্ন ব্যতীত অন্য কোন চিহ্নও দেখা গেল না। হতে পারে ওটা চোট খেয়ে পড়ে গিয়ে মারা গেছে বা অন্য কোনরূপে তার মৃত্যু হয়েছে। যদি অন্য কোন  তার বাজারে প্রচলন ছিল। কিন্তু তজ্জন্য খোদ হুযুরে পাক (দঃ) বা তাঁর ছাহাবাগণ কেউই উন্ড স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা গ্রহণ করা ত্যাগ করেন নি। তাদের সবারই কারবার এসব মুদ্রার আদান, প্রদান দ্বারাই হত। সারা দুনিয়ার লোক গুনাহ ত্যাগ করলে দুনিয়া সুখ-শান্তির আগার হয়ে যেতে পারে কিন্তু তা' অসম্ভব। সুতরাং যা' দুনিয়া সম্বন্ধে প্রযোজ্য তা' যে কোন শহর সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। হাঁ, যদি তা' কোন নির্দিষ্ট লোকের মধ্যে প্রচলিত থাকে তবে তা' ত্যাগ করা সম্ভব এবং এই ত্যাগ করা পরহেজগারী। অন্যথায় তা' ত্যাগ করা বা ত্যাগ করার চেষ্টা পাওয়া শুধু কুমন্ত্রণা ব্যতীত আর কিছু নয়। যখন কোন ব্যাপারে তোমার সন্দেহ হয়, তখন তার মীমাংসার ব্যাপারে তোমার বিবেককে প্রশ্ন করবে। কেননা গুনাহ অন্তরের ইতস্ততঃতা। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) হযরত ওয়াবেছা (রাঃ) কে বলেছিলেন, তোমার দিলের নিকট ফতোয়া চাও।

        প্রথম স্থানের চার শ্রেণীর বিষয়ের মধ্যে যা উল্লেখ করেছি তার মধ্যে হালাল হারাম ও সন্দেহজনক বস্তু এসে পড়ে। ফতোয়াদাতা অনুমানের উপরে ফতোয়া দেয়। কিন্তু ফতোয়াপ্রার্থীর উচিত তার বিবেককে জিজ্ঞেস করে তার থেকে ফতোয়া গ্রহণ করা। হৃদয়ের মধ্যে কোন বিষয়ে সংশয় উপস্থিত হলে বিবেকই সব চাইতে উত্তম ফতোয়া দিতে পারে কিন্তু মুফতীর ফতোয়া তাকে আখেরাতে মুক্তি দিতে পারবে না। কেননা মুফতী সাধারণতঃ প্রকাশ্য বিষয়ে প্রমাণ লয়ে ফতোয়া দেয় কিন্তু গুপ্ত বিষয়ে একমাত্র আল্লাহতায়ালাই সবিশেষ জ্ঞাত। তৃতীয় শ্রেণীঃ অনির্দিষ্ট সংখ্যক হারামের সাথে অনির্দিষ্ট সংখ্যক হালাল মিশে যাওয়া। কোন কোন ব্যক্তি এরূপ তর্ক করতে পারে যে, নির্দিষ্ট সংখ্যক হারামের সাথে নির্দিষ্ট হালাল মিশলে যে ফতোয়া দেয়া যায় (অর্থাৎ হারাম হয়ে যায়) তদ্রূপ অনির্দিষ্ট সংখ্যক হারামের সাথে অনির্দিষ্ট সংখ্যক হালাল মিশলে তাও হারাম হবে না কেন? কিন্তু আমাদের মত এর বিপরীত অর্থাৎ আমাদের মতে এই সংমিশ্রণে কোন বস্তু হারাম হয় না। তার মধ্যে হারাম ও হালাল হওয়ার সন্দেহ দুটোই থাকে। যদি ঐ দ্রব্যের মধ্যে হারামের কোন চিহ্ন থাকে তা' হারাম হবে আর যদি তার মধ্যে হারামের কোন চিহ্ন না থাকে তবে সে বস্তু ত্যাগ করা পরহেজগারী বটে, কিন্তু তা' গ্রহণ কর। হালাল। এরূপ খাদ্যদ্রব্য কেউ ভক্ষণ করলে সে গুনাহগার হবে না। অত্যাচারী বাদশাহর হাত থেকে সে দ্রব্য গ্রহণ করার একটি চিহ্ন। আরও অনেক চিহ্ন আছে তা' হুযুরে পাক (দঃ) এর সুন্নত এবং কিয়াস দ্বারা প্রতিষ্ঠা হয়। সুন্নত সম্বন্ধে এটা হুযুরে পাক (দঃ) এর যমানায় বা খোলাফায়ে রাশেদীনের যমানায় ছিল না। কেননা মদের মূল্য এবং সুদের মুদ্রা যিম্মীদের হাত থেকে গৃহীত হয়ে তা' অন্যান্য হালাল মালের সঙ্গে মিশে যেত। গনিমতের ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গের মালও হালাল মালের সঙ্গে একত্র হত। যখন হুযুরে পাক (দঃ) সুদ হারাম করলেন তখন তিনি বললেন, প্রথম যে সুদ আমি ক্ষমা করে দেব তা' আব্বাসের সুদ। যেমন মদ পান প্রথমে সবাই ত্যাগ করে নি তেমনি অন্য সব গুনাহও তারা প্রথমে ত্যাগ করে নি। বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এর কোন এক ছাহাবী মদ ক্রয় করে আনলে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, তোমার উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ। ঐ ব্যক্তিই প্রথম মদ ক্রয়ের প্রথা প্রথম প্রবর্তন করেছিল। তার এভাবে মদ ক্রয় করার কারণ এই ছিল যে, অনেক ছাহাবীই জানতেন না যে, মদের ক্রয়-বিক্রয় ও তার মূল্য গ্রহণ মদ হারামের সঙ্গেই হারাম হয়ে গেছে। অয়ারে পাক (দঃ) বলেছেন, অমুক ব্যক্তি যে জুব্বা আত্মসাৎ করেছে তা' তাকে দোযখে টেনে আনবে। এক ব্যক্তি নিহত হলে লোকজন তার মাল তালাস করে তার মধ্যে ইয়াহুদীদের একটি যুला পেল। তার মূল্য দু' দেরহামের কম ছিল এবং সে তা' আত্মসাৎ করেছিল। তদ্রূপ অন্তরে পাক (দঃ)এর ছাহাবীগণ বহু অত্যাচারী শাসকদের আমলে বসবাস করেছিলেন। এজিদের সেনাদল তিনদিন পর্যন্ত মদীনা পৃষ্ঠন করেছিল। তবু একজন ছাহাবীও ঐ লুণ্ঠনের কারণে মদীনায় ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ করেন নি। কেউ কেউ পৃষ্ঠনের মাল বাজারে বিক্রয় হলে পরহেজগারীর কারণে তারা ঐ বাজারের কোন মাল উপভোগ করতে রাজী হন নি; কিন্তু অধিকাংশ ছাহাবী তা' উপভোগে বিরত হন নি। মোটকথা যা পূর্ববর্তীগণ হারাম করেন নি তা' যে হারাম করে, সে নির্বোধ। সে সময় হারাম দ্রব্য হালাল দ্রব্যের তুলনায় কম ছিল; কিন্তু আমাদের সমানায় হারাম মাল ও ধনদৌলত অনেক বেশী। এখন তাহলে কি ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয হবে না? আমি বলব যে, ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম হবে না। তবে তা' ত্যাগ করা পরহেজগারীর শামিল বৈ কি। এ যুগের পরহেজগারী পূর্ব যুগের পরহেজগারী থেকে অধিক মর্যাদাপূর্ণ। যারা ধারণা করে যে, দুনিয়ার অধিকাংশ মালই হারাম তারা ভ্রান্ত। হারাম মালের সংখ্যা অধিক হতে পারে কিন্তু তা' অধিকাংশ নয়। যেমন যখন বলা হয় যে, এ গ্রামে অনেক লোক পীড়িত বা গ্রামে অনেক মুসাফির বা অনেক সৈন্য আছে। তাতে এ কথা বুঝা যাবে না যে, গ্রামের অধিকাংশ লোকই পীড়িত বা মুসাফির বা সৈন্য। সংসারে অত্যাচারী লোকের সংখ্যা অনেক কিন্তু অধিকাংশ লোকেই অত্যাচারী নয়। উল্লিখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, অনেক এবং অধিকাংশ এ দুটো শব্দের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য অনেক। অধিকাংশ হারাম ও অশুদ্ধ এরূপ মন্তব্যকারীর দৃষ্টিভঙ্গি এই যে, দুনিয়ায় অনেক লোক অত্যাচারী, অনেকেই সুদখোর, হারাম দ্রব্যের ব্যবসাদার এবং অনেকেই ইসলামের প্রথম হতে এ পর্যন্ত হারাম ভক্ষণকারী। প্রথম মন্তব্য অশুদ্ধ কেনন। অত্যাচারী অনেক হতে পারে, অধিকাংশ নয়। দ্বিতীয় মন্তব্যও অশুদ্ধ। কেননা সুদখোর ও হারাম ব্যবসাদার অনেক হতে পারে অধিকাংশ নয়। তৃতীয় মন্তব্যের উত্তর এই, খনি, উদ্ভিদ, প্রাণী ইত্যাদি থেকে ধন-দৌলত অর্জিত হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণী বংশ পরম্পরায় বর্ধিত হয়। যদি কোন বকরীর প্রতি লক্ষ্য, কর দেখবে যে, তার প্রত্যেক বছর অন্ততঃ একটি বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে। সে হিসেবে হুযুরে পাক (দঃ) এর যমানা থেকে আজ পর্যন্ত (অর্থাৎ ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর সময় পর্যন্ত) পাঁচশ' বাচ্চার জন্ম হতে পারে। তন্মধ্যে নিশ্চয়ই কয়েকটি বকরী বলপূর্বক গ্রহণ করা হয়েছে বা অন্যায়ভাবে হস্তান্তরিত হয়েছে। এজন্য সমস্ত বকরীর ক্রয়-বিক্রয় অশুদ্ধ হতে পারে না। তদ্রূপ উক্ত মন্তব্য খাদ্যশস্য ও ফলমূল সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। খাদ্যশস্যে ও ফল-মূলাদির হাজার হাজার রকম বা প্রকার আছে। নিশ্চয়ই তা' সবই হালাল উপায়ে অর্জিত নয়। তজ্জন্য সমস্ত ফল-মূলাদিরই ক্রয়-বিক্রয় হারাম হতে পারে না। স্বর্ণ ও রৌপোর খনি অনেক সময় অত্যাচারী বাদশাহর কর্তৃত্বাধীন থাকে। তজ্জন্য মানুষ স্বর্ণ ও রৌপ্য স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারে না। বাদশাহ ও তার কর্মচারীগণ দরিদ্রদেরকে তা' ধনি হতে বের করার জন্য নিযুক্ত করে। তারপর অন্যায়ভাবে তা' তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার হারাম হয় না।

        রাস্তায় নাপাকী না থাকলে তার উপর নামায পড়া যায়। কেননা রাস্তার মাটি পবিত্র। তদ্রূপ মুশরিকদের পাত্রে অজু করা যায় এবং কবরস্থানে নামায পড়া যায়। হুযুরে পাক (দঃ) একদিম মুশরিকদের পাত্রে এবং হযরত ওমর (রাঃ) খৃষ্টানদের পাত্রে অজু করেছিলেন। যদিও সে পাত্রে তারা মদ ও শূকরের মাংস রাখত। কিন্তু হুযুর (দঃ) এবং হযরত ওমর (রাঃ) তাদের পাত্রে কোন নাপাকী দেখতে পান নি বলেই তা' পবিত্র বলে মনে করেছিলেন। ছাহাবায় কিরাম কখনও নগ্নপদে আবার কখনও বা জুতা পরিহিতাবস্থায়ও ভ্রমণ করতেন। তারা কখনও কখনও জুতাসহ নামায পড়তেন। মাটির উপর বসতেন। দরকার ব্যতীতও সড়কের উপর নগ্নপদে হাঁটতেন। যদিও তার উপর কুকুর, ঘোড়া ও অন্যান্য প্রাণী মল-মূত্র ত্যাগ করত। একথা ভেবো না যে, তখন রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য ধোয়া-মোছা করা বা ঝাড় দেয়া হত। কেননা এটা অসম্ভব ব্যাপর। অবশ্য তাঁরা প্রকাশ্য নাপাকী হতে সতর্ক হতেন। ছাহাবীগণ হাম্মামখানায় প্রবেশ করে হাউজের পানি দ্বারা অজু করতেন। যদিও তাতে সামান্য পানিই থাকত, যদিও তাতে অনবরত অনেক হস্তই নিমজ্জিত হত। যদি খৃষ্টানদের পাত্রে অজু করা জায়েয হয় তাহলে তাতে পানি পান করাও জায়েয। যেখানে নাপাকী থেকে পাক হওয়া ওয়াজিব, শুধু সেখানেই তারা সতর্কতা অবলম্বন করতেন। আর যা ওয়াজিব নয় সেটাকে তারা উপেক্ষা করতেন। তারা হালাল বস্তুর মধ্যে যা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতেন সেটা তাদের পরহেজগারীর জন্য করা হত এবং প্রয়োজনে সন্দেহের বস্তুর মধ্যে পতিত হওয়ার ভয়ে সন্দেহমুক্ত বস্তু থেকে বিরত থাকতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পূর্ণ হালাল বস্তুও এড়িয়ে চলতেন। কেননা তাঁদের মনে এ ভয় ছিল যে, কোন ক্রমেই যেন তাঁদের দ্বীন নষ্ট না হয়। এরূপ বর্ণিত আছে যে, এই শ্রেণীর জনৈক বুযর্গ ব্যক্তি সমুদ্রের পানি দ্বারাও অজু করতে বিরত থাকতেন যদিও তা' নিঃসন্দেহে পবিত্র। রাত এক টাক

        যখন সমস্ত বস্তুই কারণবশতঃ হারাম হয়ে যায় তখন একইভাবে সমস্ত বস্তুই আবার হালালও হয়ে যেতে পারে। অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষের অবস্থাও পাঁচ প্রকার হতে পারে। যেমন (১) সব মানুষই খাদ্যাভাবের জন্য মৃত্যুবরণ করে, অথবা (২) প্রয়োজন পরিমাণ দ্রব্য উপভোগ করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন কাটিয়ে দেয়, অথবা (৩) চুরি, ডাকাতি করে বা জুলুম অত্যাচার করে বা মালিকের বিনানুমতিতে জিনিসপত্র গ্রহণ করে এবং হালাল ও হারামের পার্থক্য না করে আবশ্যক পরিমাণ হস্তগত করে নেয়, অথবা (৪) শরীয়তের শর্তসমূহ পালন করে বহু মালে সন্তুষ্ট থাকে, অথবা (৫) শরীয়তের শর্তাবলী পালন করে, আবশ্যক পরিমাণ দ্রব্যে খুশী থাকে।

        প্রথম ও দ্বিতীয় বিতর্ক অশুদ্ধ। কেননা মানুষ দুর্বল হলে মৃত্যু ঘটে, দুর্বলতায় বা অবস্থার অবনতিক্রমে দুনিয়াও ধ্বংস হয়। দুনিয়ার অনিষ্টে দ্বীনেরও অনিষ্ট ঘটে। যেহেতু দুনিয়। আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। তৃতীয় বিতর্ক আবশ্যকীয় পরিমাণ পর্যন্ত থাকলেই তাকে যথেষ্ট মনে করা এবং তার অতিরিক্ত গ্রহণ না করা। মাল অর্জনের উপায়ের প্রতি লক্ষ্য না রাখা এবং হালাল ও হারামের মধ্যে ব্যবধান না করা। চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা এবং এই শ্রেণীর উপায়ে উপার্জনের হালাল রুজীর সঙ্গে একই প্রকার মনে করা। যারা এরূপ মন্তব্য করে তাদের জন্য শরীয়তের দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। তার ফলে তারা নানারূপ বাদ-বিসম্বাদে, অত্যাচার, চুরি, ডাকাতি এবং এই প্রকার অন্যান্য মন্দ কাজে অগ্রসর হতে থাকে। তাদেরকে সতর্ক করা সম্ভবপর হয় না। কেননা তারা উত্তর দেয় আমরা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করি না। অন্যের নিকট যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে তাদেরও তা' রাখার অধিকার নেই। আমাদের ক্ষেত্রে তা' গ্রহণ করা হারাম হলে তাদের বেলায়ও তা' হারাম হবে। তাদের যেমন খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন আমাদেরও তদ্রূপ তার প্রয়োজন আছে। আর যদি আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করে থাকি তা' আমরা এমন লোকের নিকট হতে গ্রহণ করি যাদের নিকট তা' আবশ্যক পরিমাণের অতিরিক্ত আছে। তাদের নিকট থেকে অতিরিক্ত মাল জোরপূর্বক গ্রহণ করা দরকার যেন তাদের মাল প্রয়োজনের সমান হয়ে যায়। যদি তাদের এই মন্তব্য প্রচলিত হয় তাহলে শাসন-শৃংখলা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হবে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারীগণ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। এ কারণে এই মন্তব্যও বাতুল ও অশুদ্ধ। চতুর্থ বিতর্কে বলা হয় যে, যার দখলে যে বস্তু আছে তার তা' রাখার অধিকার আছে। তার নিকট থেকে জোরপূর্বক বা চুরি করে তা' গ্রহণ করা জায়েয নেই; বরং যদি গ্রহণ করতে হয় তার সম্মতি নিয়ে গ্রহণ করা চাই এবং সেই সম্মতি শরীয়তেরই পন্থানুযায়ী হতে হবে। কেননা শরীয়ত মানুষের হিতাহিতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। এটা জায়েয, কিন্তু এতে অন্যান্যেরও বিধিগতভাবে হক রয়েছে। পঞ্চম বিতর্ক-দখলকারীদের নিকট হতে শরীয়ত বিধিমতে দখলীয় মাল উদ্ধার করা এবং আবশ্যক পরিমাণ মাল তাদের নিকট রাখা আখেরাতের পথিকদের জন্য এটাই উত্তম পন্থা এবং এটা পরহেজগারীর জন্য ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য এই পন্থা বাধ্যতামূলক করার কোন কারণ নেই এবং এরূপ ফতোয়াও দেয়া যায় না। কেননা তাহলে অত্যাচারীদের হস্ত আবশ্যকীয় পরিমাণের অতিরিক্ত মালের প্রতি প্রসারিত হবে; এবং চোর ও ডাকাতগণ প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। অধিক শক্তিমান লোকেরা তখন লুট-তরাজ শুরু করে দেবে। সুযোগ পেলেই সে অন্যের মাল আত্মসাৎ করবে এবং বলবে যে, কারও মালের স্বত্ব শুধু তার আবশ্যকীয় পরিমাণ পর্যন্ত। আমি যেহেতু নিঃস্ব সেহেতু তার অতিরিক্ত মালে আমার স্বত্ব রয়েছে। এজন্যই আমি তা' গ্রহণ করেছি। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষের উপর কর্তব্য এই যে, জোরপূর্বক দখলকারীর দখলে যে মাল পাওয়া যাবে তা' তার নিকট থেকে উদ্ধার করে ঐ মালে যাদের আবশ্যকতা আছে তাদেরকে দিয়ে দেয়া এবং এভাবেই তাদের দৈনন্দিন, মাসিক বা বাৎসরিক আবশ্যকতা পূর্ণ করা।

        এই প্রকার মন্তব্য পালন করতে গেলে বিবিধ প্রকার অসুবিধা আছে এবং এতে মালেরও ক্ষরিত সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের শাসনকর্তা যদি এই ব্যবস্থা অধিকাংশ লোকের ক্ষেত্রে অবলম্বন করে সে তাতে সফল হবে না। বরং তা' তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কেননা ফল-মূল ও খাদ্যশস্য যা শাসনকর্তার দখলে অতিরিক্ত থাকে তখন তা' তার সমুদ্র গর্তে ফেলে দিতে হবে বা যে কোনভাবে তাকে তা' ত্যাগ করতে হবে। কেননা খাদ্যশস্য বা ফলমূল এত বেশী হতে পারে যে, সারা দুনিয়ার লোক তা' ভক্ষণ করলেও তা' থেকে উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। যেহেতু করুণাময় আল্লাহতায়াল মানুষের বা অন্যান্য জীব-জন্তুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য ও ফল-মূল প্রদান করেন। এরূপ ব্যবস্থায় হজ্জ, যাকাত এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য কর্তব্য যা ধনীদের সাথে সম্পৃক্ত তা' সবার দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাবে। কেননা তখন মানুষের নিকট আবশ্যকীয় পরিমাণ ব্যতীত আর কিছু থাকবে না। এটা নিতান্তই যুক্তিহীন মন্তব্য।

        আমি বলব যে, এই প্রকার সমাজ ব্যবস্থার সময় যদি কোন নবী আবির্ভূত হন তাঁর উপর উত্ত ব্যবস্থা কার্যকরী হওয়া ওয়াজিব হবে। কার দখলে কি মাল রয়েছে সে তার সম্মতি নিয়ে বা অন্য যে কোন প্রকারে তার হিসেব লয়ে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করবে এবং এই নিয়ম প্রবর্তন করবে যে, ব্যক্তিগত দখলের মাল যেন হালাল হয়। এই মাল গ্রহণের সময় তার নিকট হালাল-হারামের কোন পার্থক্য থাকবে না। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য নবী প্রেরিত হবে। সবার নিকট থেকে আবশ্যকীয় পারিমাণের অতিরিক্ত ধন-দৌলত গ্রহণ করলে তাদের সম্পূর্ণ মঙ্গল ও কল্যাণসাধন করা হয় বলা হবে। যদি নবীর জন্ম মঙ্গলের জন্য না হয় তাহলে উক্ত ব্যাপার প্রবর্তন করা ওয়াজিবও হবে না। স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই যদি এমন এক কারণ সৃষ্টি করতে পারেন যদ্বারা দুনিয়ার সমস্ত বস্তু হালাল হয়ে যায়, তাহলে তখন দুনিয়াও ধ্বংস হবে এবং দ্বীনের মধ্যেও গোমরাহী বা ভ্রষ্টতার সৃষ্টি হবে। তিনি যাকে ইচ্ছে পথ দেখান, যাকে ইচ্ছে পথভ্রষ্ট করেন, যাকে ইচ্ছে মৃত করেন, যাকে ইচ্ছে জীবিত করেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা এই নিয়ম প্রবর্তন করেছেন যে, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলসাধনের জন্য তিনি দুনিয়ায় নবী পাঠাবেন। তারা দুনিয়ায় এসে মানুষের মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর ব্যবস্থাসমূহ প্রবর্তন করে গেছেন। উল্লিখিত মন্তব্যানুযায়ী আমাদের কোন নববিধান প্রবর্তনের আবশ্যকতা নেই।

        হযরত ঈসা (আঃ)এর প্রায় দুশ' বছর পর হযরত রাসূলে করীম (দঃ) কে প্রেরণ করা হয়েছিল। দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তাই তিনি রেখে গিয়েছেন। হযরত ঈসা (আঃ) এর সময় গুনাহ বিস্তারলাভ করেছিল এবং সে যমানার লোকদের অর্জিত অধিকাংশ ধন- সম্পদ হারাম ছিল। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) পূর্ব যমানার হারাম মাফ করে দিয়েছিলেন। যারা অত্যাচারপূর্বক ধন-দৌলত হস্তগত করেছিল, তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। যে জিনিসকে শরীয়ত হারাম বলে বিধান দিয়েছে, কোন রাসূলের আগমনেই তা' হালাল হবে না বা যে ব্যক্তির দখলে থাকায় যা হারাম হয়, সে তা' ফেলে দিলেও হালাল হবে না। যিম্মীগণ যদি শরাবের মূল্য বা সুদের মাল কাউকে দেয় এবং সে তা' শরাবের মূল্য বা সুদের মাল বলে জানতে পারে তা তার জন্য গ্রহণ ক্রা জায়েজ নয়।

Post a Comment

0 Comments