স্বামীর কর্তব্যসমূহ পর্ব-২

 স্বামীর  কর্তব্যসমূহ পর্ব-২

        চতুর্থ কর্তব্যঃ পুরুষ নিজের উত্তম স্বভাব, মধুর আচরণ এবং স্ত্রীর মন তোষণ করতে গিয়ে এমন ভাবে সীমাতিক্রম করবে না যাতে স্ত্রীর চরিত্র নষ্ট হওয়ার অবস্থ্য ঘটে এবং তার সামনে নিজের কোন ওজনই না থাকে; এবং এক্ষেত্রে সীমা ও স্বাভাবিকতা রক্ষা করে চলতে হবে। অতএব স্ত্রীর মধ্যে কোন মন্দ কাজ দেখলে তাকে কিছু না বলে এমনি ছেড়ে দেবে না। অন্যায়ের প্রতি কখনও রাজী থাকবে না এবং তা' প্রশ্রয় দেবে না; বরং খেলাফে শরীয়ত কিছু দেখামাত্র নিজের অসন্তুষ্টি এবং বিরক্তি প্রকাশ করবে। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজেকে এমন ভাবে স্ত্রীর অনুরক্ত করে নেয় যে, সে যা বলে তা-ই পালন করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাকে অন্ধ বানিয়ে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন যে, স্ত্রীলোকের মতের খেলাফ কাজ করবে। কেননা তাতেই কল্যাণ নিহিত। জ্ঞানীগণ বলেছেন, স্ত্রীলোকদের থেকে পরামর্শ নাও। কিন্তু তার বিপরীত কাজ কর। হাদীস শরীফে আছে, স্ত্রীদের গোলাম ধ্বংস হয়ে যাক। এরূপ বলার কারণ হল, যখন পুরুষ স্ত্রীলোকের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে, তখন সে তার দাসে পরিণত হয়। তারপর তার ধ্বংসের কারণ এই যে, আল্লাহতায়ালা পুরুষ (স্বামী) কে স্ত্রীলোকের মালিক বানিয়েছিলেন কিন্তু সে তার বিপরীত কাজ করে নিজেকে স্ত্রীলোকের দাসে পরিণত করেছে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "আররিজালু কাওয়্যামূনা আলান নিসায়ি" অর্থাৎ পুরুষগণ স্ত্রীলোকদের উপর প্রবল- প্রভাবশালী। তাছাড়া স্বামীকে স্ত্রীর সরদার এবং মুনীবও বলা হয়েছে। মোটকথা নফসে আম্মারাহর বাগডোর এতটুকু ঢিলে করে দিলে তার কু-চাল অত্যধিক বেড়ে যাবে। যদি তার লাগাম তুমি একেবারেই ছেড়ে দাও, তাহলে সে তোমাকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবে। আর যদি তুমি তা' শক্ত হাতে ধরে রাখ, তবে সে তোমার নিকট কাবু থাকবে। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, তিনটি জিনিস এমন, যদি তুমি তাদেরকে সম্মান দাও, তবে তা' তোমাকে অসম্মান এবং অপমান করবে। আর যদি তুমি তাদেরকে জব্দ করে রাখ, তাহলে তারা তোমার তাজীম করবে। এদের মধ্যে প্রথমটি হল, স্ত্রীলোক। এ কথার মর্ম হল, যদি তুমি তার সাথে সর্বদা নরম ব্যবহার এবং সদাচরণ প্রদর্শন করতে থাক, কখনও কঠোর আচরণ না কর, কখনও তার সাথে শক্ত কথা না বল, তবে সে তোমার মাথায় চড়ে বসবে।

        কথিত আছে যে, আরবের স্ত্রীলোকগণ তাদের কন্যাদেরকে নিজ নিজ স্বামীর চরিত্র পরীক্ষার জন্য এভাবে উপায় শিখায়। কন্যার মাতা কন্যাকে বলেঃ স্বামীর উপর কর্তৃত্ব চালনা করার পূর্বে তাকে পরীক্ষা করে নেবে। প্রথম তার বল্লমের ধার ভোতা করে দেবে। যদি সে তাতে নীরব থাকে, তাহলে তার ঢালের উপর রেখে গোশত কাটবে। যদি দেখ, তাতেও সে কিছু বলছে না, তাহলে তার তরবারী দ্বারা হাড় খন্ড করবে। যদি তখনও সে নীরব থাকে, তাহলে মনে করবে যে, সে তোমার নিকট গর্ধভ তুল্য। তখন তার পিঠে গদি ফেলে তার উপর আরোহণ করবে। সার কথা এই যে, আসমান ও যমিন এদুটো শুধু ন্যায়নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের বদৌলতে স্থির এবং স্থিত রয়েছে। যদি যথার্থতার সামান্য মাত্র ব্যতিক্রম হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে আসমান ও যমিনের অবস্থা উল্টে যাবে (অর্থাৎ স্থানভ্রষ্ট হয়ে ও ভেঙ্গে চুড়ে একাকার হয়ে যাবে)। এজন্যই জ্ঞানীদের কর্তব্য স্ত্রীদের সাথে সহযোগিতায় ও বিরোধিতায় মধ্যম পথ অবলম্বন করবে এবং প্রত্যেক ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি লক্ষ্য রাখবে। তাহলে তাদের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। কেননা তাদের মন্দ ব্যাপার প্রকাশ্য এবং তাদের চারিত্রিক কদর্যতা ও বুদ্ধির স্বল্পতা প্রকট। হাঁ তবে তাদের এ ব্যাপারগুলো হরণ-পূরণ হবে, যদি তাদের সহিত একদিকে কোমল আচরণ এবং অন্যদিকে তাদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়।

        বিজ্ঞবর লোকমান হাকীম একবার তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন, হে বৎস। কু-নারী থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। কেননা সে তোমাকে বার্দ্ধক্য আগমনের পূর্বেই বৃদ্ধ করে ফেলবে। আর তুমি কুচরিত্রা-নারী থেকে বহু দূরে থাকবে। কেননা সে তোমাকে কস্মিনকালেও কোন ভাল কাজ করতে দিতে চাইবে না। আর তুমি উত্তম চরিত্রবতী নারীকে সদা ভয় এবং শ্রদ্ধা করে চলবে। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) বলেছেন, তোমরা তিনটি আপদ থেকে আল্লাহর দরবারে আশ্রয় চাও। তিনি উক্ত আপদত্রয়ের মধ্যে বদকারিণী স্ত্রীলোককে অন্যতমা বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা তারা পুরুষকে বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বেই বৃদ্ধ করে ফেলে। বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন নারীর নিকট যাবে, সে তোমাকে ভর্ৎসনা করবে, আর যখন তুমি তার থেকে দূরে থাকবে, তখন সে তোমার আমানতে খেয়ানত করবে। হুযুরে পাক (দঃ) যখন জীবনের শেষ লগ্নে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন, এমনকি দাঁড়িয়ে নামায পড়ার শক্তি রহিত হল, তখন তিনি এরশাদ করলেন, তোমরা আবুবকরকে বল, সে নামায পড়িয়ে দিক। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমার পিতা অত্যন্ত কোমল হৃদয়। তিনি যখন আপনার স্থান খালি দেখবেন, তখন তিনি অস্থির এবং বে-দিশে হয়ে পড়বেন। তিনি নামায পড়াতে পারবেন না। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি যে, আবুবকরের নামাযের ইমামতে অমত প্রকাশ করছ, এটা ত হক ব্যাপারের বদলে নাহক ব্যক্তিগত ব্যাপারকে গুরুত্ব প্রদান করা।

        স্ত্রীলোকদের মধ্যে সাধারণতঃ দুটো বস্তু থাকে। একটি অসততা এবং দ্বিতীয়টি দুর্বলতা। অসততার প্রতিকার শাসন দ্বারা সম্ভব হয় এবং দুর্বলতার প্রতিকার প্রবোধ, সান্ত্বনা, উৎসাহ এবং প্রেরণার দ্বারা হয়ে থাকে। যেমন নাকি কোন চিকিৎসক রুগীর মধ্যে যে রোগ দেখে তার চিকিৎসা করে, ঠিক তদ্রুপ মানুষের উচিত স্ত্রীলোকদের প্রকৃতি ও স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। তারপর তার সাথে তার প্রকৃতি এবং স্বভাব অনুযায়ী আচরণ ও ব্যবহার করা। এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

        (৫) পঞ্চম কর্তব্যঃ স্ত্রীলোকদের যে সকল কার্যে কোন প্রকার অহিত এবং অকল্যাণের সম্ভাবনা থাকে প্রথম থেকেই সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া চাই। এক্ষেত্রে কোনরূপ অবহেলা বা অসর্কতার অবকাশ নেই। আর একটি বিষয় হল, নারীদের কার্যকলাপ এবং স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অযথা কুধারণা এবং তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধানের অত্যধিক বাড়াবাড়ি করবে না। হুযুরে পাক (দঃ) নারীদের গোপনীয় কাজ কারবার সম্পর্কে অন্বেষণের পদক্ষেপ নেয়াকে নিষেধ করেছেন। এক বর্ণনায় আছে, হুযুরে পাক (দঃ) কোন স্বামীকে তার স্ত্রীর নিকট হঠাৎ অতর্কিতভাবে উপস্থিত হতে নিষেধ করেছেন। একবার হুযুর (দঃ) সঙ্গী-সাথী নিয়ে বাইরে থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে সবাইকে লক্ষ্য করে এরশাদ করলেন, তোমরা আজ রাত্রেই। কেউ তার স্ত্রীর কাছে উপস্থিত হয়ো না। কিন্তু দুজন লোক হুযুরে পাক (দঃ)এর নিষেধ বাকোর  প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের নিজ নিজ স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন এবং দুজনই গৃহে গিয়ে কোন অবাঞ্ছিত ব্যাপার দেখতে পেলেন।

        পুরুষের জন্য নিজের এবং তার স্ত্রীর গাইরাত অর্থাৎ সম্ভ্রমের প্রতি লক্ষ্য রাখা অবশ্য কর্তব্য। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, তোমরা কি তোমাদের স্ত্রীদেরকে এরূপ স্বাধীনতা দিয়ে দাও যে, তারা শহরের বাজারে গিয়ে কাফির মুশরিকদের গা ঘেঁষে চলবে। আল্লাহ তোমাদের সে ব্যক্তির অনিষ্ট করুন, যার মধ্যে গাইরাত নেই। হুযুরে পাক (দঃ) বলেন যে, আমি সম্ভব রক্ষাকারী ব্যক্তি এবং সম্ভ্রমকে পছন্দ করি। যে ব্যক্তি সম্ভ্রমশূন্য এবং সম্ভ্রমের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না সে অন্তঃসারশূন্য।

        গাইরাত অর্থাৎ সম্ভ্রম সম্পর্কে কখনও কখনও সতর্কতা অবলম্বন না করলেও চলে। যেমন যখন কোন লোকের কাছে কেউ 'গমন না করে এবং সে নিজেও কোন জনপদে বা লোকজনের কাছে বের না হয়। হযরত ফাতেমা (রাঃ)এর কাছে একদা হুযুরে পাক (দঃ) প্রশ্ন করেছিলেন, মাঃ তুমি বল ত নারীদের জন্য কোন জিনিস উত্তম? তিনি জবাবে বললেন, তা' হল কোন স্ত্রীলোকের কোন বেগানা পুরুষকে না দেখা এবং কোন বেগানা পুরুষদেরও তাকে না দেখা। কন্যার কথা শুনে হুযুরে পাক (দঃ) আনন্দে উৎফুল্ল হলেন এবং কন্যা ফাতেমা (রাঃ)কে তিনি স্বীয় বুকের সাথে মিলালেন এবং বললেন, ধ্রুব সত্যি যে, সন্তান তার পিতারই অনুরূপ হয়ে থাকে। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর গৃহের দেয়ালের সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যাতে তারা উকি দিয়ে বেগানা পুরুষ না দেখতে পারে। হযরত মুআয (রাঃ) নিজ স্ত্রীদেরকে বেগানা পুরুষদের প্রতি উকি দিতে দেখে শান্তি প্রদান করেছিলেন। তিনি একবার দেখলেন, তাঁর এক স্ত্রী একটি সেব ফলের অর্ধাংশ খেয়ে বাকি অংশ তাঁর গোলামকে দিয়ে দিলেন। এজন্যও তিনি তাঁর স্ত্রীকে সাজা দিয়েছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, স্ত্রীলোকদেরকে বেশী উত্তম পোশাক দিও না। কেননা, তারা গৃহাভ্যন্তরে থাকবে। একথা তিনি এজন্য বলেছিলেন যে, স্ত্রীলোকেরা মামুলি এবং যেন তেন পোশাক পরিহিত থাকলে তাদের ঘরের বাইরে যাওয়ার আগ্রহ কমে যাবে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, তোমরা নিজ নিজ স্ত্রীদের ঘরের মধ্যে থাকার অভ্যাস সৃষ্টি কর। তিনি প্রথম স্ত্রীলোকদেরকে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন কিন্তু এ যুগে শুধু মাত্র বৃদ্ধা স্ত্রীলোক ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে ঐ অনুমতি না থাকা উত্তম; বরং ছাহাবায়ে কিরামের যুগেও এটাই ছওয়াবের নিকটবর্তী ছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, যদি হুযুরে পাক (দঃ) জানতে পারতেন, পরবর্তীকালে স্ত্রীলোকেরা কিসব কান্ড ঘটাবে, তাহলে তিনি কস্মিনকালেও স্ত্রীলোকদেরকে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। হুযুরে পাক (দঃ) ঈদের দিনও স্ত্রীলোকদেরকে বিশেষভাবে ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন; কিন্তু শর্ত ছিল, নিজ নিজ স্বামীর অনুমতিক্রমে ঘরের বাইরে যেতে হবে। এ যুগেও সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোকের জন্য ঈদের দিন স্বামীর অনুমতিক্রমে ঘরের বাইরে যাওয়। মুবাহ অর্থাৎ সিদ্ধ। কিন্তু বাইরে না যাওয়ার মধ্যেই পরহেজগারী নিহিত। স্ত্রীলোকদের উচিত কোন বিশেষ প্রয়োজন বা আবশ্যকতা ব্যতীত বাইরে না যাওয়া। কেননা, খেল-তামাশা অথবা অনাবশ্যক কাজের জন্য স্ত্রীলোকের বাইরে যাওয়া শারাফাত অর্থাৎ আভিজাত্যের হানিকর এবং কখনও কখনও এর দ্বারা ফেতনা-ফাসাদও সৃষ্টি হতে পারে। হাঁ তবে একান্তই যদি নারীদের বাইরে যেতে হয়, তবে পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই চোখের দৃষ্টি অবনত করে চলতে হবে। অবশ্য আমি একথা বলছি না যে, নারীদের কাছে পুরুষের অঙ্গ সতরে আওরাতরূপে গণ্য। যেভাবে নারীদের অঙ্গ পুরুষের কাছে সতরে আওরাতরূপে গণ্য। তবে পুরুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যেগুলো নারীর চোখে পতিত হলে ফেতনা-ফাসাদের আশংকা থাকে সেগুলো নারীর জন্য দেখা নিশ্চয়ই হারাম বা নিষিদ্ধ। আর যে অঙ্গসমূহ দেখায় ফেতনা- ফাসাদের কোন সম্ভাবনা নেই তা' দেখা নারীর জন্য নিষিদ্ধ নয়।

Post a Comment

0 Comments