বিবাহ সম্পর্কিত নিয়মাবলী
বিবাহ বন্ধনের কতিপয় শর্ত ও নিয়ম আছে। পুরুষের জন্য নারী হালাল হওয়ার চারটি শর্ত রয়েছে। যথা
(১) অলীর অনুমতি। নাবালেগ পাত্র ও নাবালেগা পাত্রীর বিবাহে অলী বা অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন। তা' না হলে বিবাহ জায়েয হবে না। যে পক্ষের অভিভাবক না থাকে তার অভিভাবক স্বয়ং স্থানীয় প্রশাসক বা তার প্রতিনিধি।
(২) বালেগা কন্যার সম্মতি অত্যাবশ্যক, চাই সে কুমারী হোক অথবা বিধবা। কন্যার পিতা বা দাদা ব্যতীত অন্যান্যগণও এ অবস্থায় তাকে বিবাহ দিতে পারে।
(৩) অন্যূন দুজন বালেগ ও ধার্মিক সাক্ষী থাকা আবশ্যক। এরূপ সাক্ষী ব্যতীত বিবাহ শুদ্ধ হবে না। তারা কন্যার সম্মতিসূচক উক্তি স্পষ্ট কথায় বিবাহ মজলিসে ব্যক্ত করবে। এসময় বালেগ ও ধার্মিক পুরুষ সাক্ষী থাকতে হবে। বিবাহ দিলাম ও বিবাহ করলাম অথবা এ জাতীয় উক্তি উচ্চারণ করতে হবে (এ গেল বিবাহের শর্ত)।
এবার বিবাহের নিয়ম প্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করছিঃ
কন্যার অভিভাবকের নিকট বিবাহের প্রস্তাব করবে যদি কন্যা পূর্বে বিবাহিতা থাকে এবং তার স্বামী মারা যায় বা উক্ত কন্যা তার পূর্বের স্বামী থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয় তবে পূর্বের স্বামীর মৃত্যু বা তালাকের ইদ্দতের মধ্যে বিবাহের প্রস্তাব দিবে না; বরং ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে প্রস্তাব দিবে। কোন লোকের প্রস্তাব প্রেরিত হলে সেখানে অন্য লোকের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিবে না। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) একজনের প্রস্তাবের উপর অন্যজনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠাতে নিষেধ করেছেন।
বিবাহের পূর্বে খুৎবাহ পাঠ করবে। ইজাব ও কবুলের সহিত আল্লাহর প্রশংসা করা ভাল। বিবাহ-বন্ধন কালে কন্যার অভিভাবক বলবে, আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা ও দরূদ রাসূল (দঃ) এর প্রতি'। আমার অমুক কন্যা আপনার নিকট বিবাহ দিলাম।
পাত্র বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং দরূদ আল্লাহর রাসূল (দঃ) এর প্রতি। এই মহরানার শর্তে তার বিবাহ কবুল করলাম। উল্লেখ্য যে, মহরানা পূর্বেই নির্দিষ্ট করে রাখবে। আর তা' স্বাভাবিক ও সংগত পরিমাণই হওয়া উচিত। স্মরণ রেখ খুৎবাহর পূর্বে আল্লাহর প্রশংসা করা মুস্তাহাব।
বিবাহের পূর্বে পাত্রের সবরকমের অবস্থা পাত্রীর নিকট ব্যক্ত করা চাই। কেননা এর দ্বারা বিবাহোত্তর কালে উভয়ের মধ্যে প্রীতি ও ভালবাসার আশা করা যায়। আর এ কারণেই বর ও কন্যা পরস্পরের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া উত্তম। এর দ্বারা প্রীতি ও ভালবাসা গড়ে উঠে এবং তা' স্থায়ী হয়। বিবাহের জন্য যে দুজন সাক্ষীর দরকার তা' ব্যতীত আরও কিছু সংখ্যক ধর্মভীরু লোক বিবাহ মজলিসে উপস্থিত থাকা ভাল। বিবাহ দ্বারা সুন্নত প্রতিষ্ঠা করা, চক্ষুর দৃষ্টি সংযত করা, সন্তান অন্বেষণ করা এবং পূর্বোল্লিখিত সমস্ত উপকারগুলো অর্জনের নিয়ত করবে। বিবাহ দ্বারা শুধু কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা এবং আমোদ-প্রমোদে মত্ত হওয়াই উদ্দেশ্য না হওয়া চাই। কেননা তা' দুনিয়ার ভোগ-লালসা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য ঐ ধরনের নিয়ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়। কেননা এগুলো মানবীয় বৃত্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গবিশেষ।
বিবাহ শওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং মসজিদে বিবাহানুষ্ঠানের আয়োজন করা মন্দকাজ নয় বরং মুস্তাহাব। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (দঃ) আমাকে শওয়াল মাসে বিবাহ করেছিলেন এবং আমাকে শওয়াল মাসেই তাঁর নিকট তুলে নেয়া হয়েছিল।
বিবাহের পাত্রী বিবাহকালে দুটি কর্তব্য পালন করবে। যথাঃ প্রথমতঃ বিবাহের সময় হালাল থাকবে। দ্বিতীয়তঃ হালাল জীবিকা লাভ এবং বিভিন্ন রকম হালাল উপকারের নিয়ত করবে। কন্যার বিবাহকালে হালাল থাকার অর্থ হল বিবাহে সে হারাম বিষয়সমূহ থেকে মুক্ত থাকবে।
হারাম বিষয়গুলোর সংখ্যা উনিশটি।
(১) অন্য লোকের স্ত্রী হওয়া (২) ইদ্দতের মধ্যে বিবাহ হওয়া অর্থাৎ পূর্বস্বামীর মৃত্যু বা তালাকের পর ইদ্দত পালনরত অবস্থায় বিবাহ হওয়া (৩) মুরতাদ (ধর্মত্যাগিনী) অবস্থায় বিবাহ হওয়া (৪) মাজুসী অর্থাৎ অগ্নি পূজারিণী অবস্থায় বিবাহ হওয়া (৫) মূর্তি পূজারিণী অবস্থায় বিবাহ হওয়া (৬) খ্রীস্টান বা ইয়াহুদী হওয়া অর্থাৎ যে হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নবী হওয়ার পর খ্রীস্টান ইয়াহুদী হয়েছে অধিকন্তু যে বনি ইসরাঈল তথা ইসরাঈলের বংশধর নয় (৭) কন্যার দাসী হওয়া, পক্ষান্তরে পাত্রের স্বাধীন হওয়া (৮) বিবাহিত পুরুষের অধিকৃত দাসী হওয়া (৯) স্বামীর এমন কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া যার সাথে শরীয়ত অনুযায়ী বিবাহ হারাম। যথাঃ (ক) মাতা, (খ) দাদী, (গ) কন্যা, (ঘ) ভগ্নি, (ঙ) পৌত্রী, (চ) ভ্রাতার কন্যা, (ছ) নিজ কন্যা, (জ) খালা, (ঝ) ফুফী (১০) দুগ্ধপান করার দরুন নিষিদ্ধ হওয়া। যথা-দুধ মা, দুধ ভগ্নি; কিন্তু শর্ত হল অন্ততঃ দ্বাদশ বার দুধ পান করা চাই। এর কম হলে ইমাম শাফেয়ীর মতে উক্ত নারীগণকে বিবাহ করা জায়েয। কিন্তু হানাফী মাযহাব মতে মাত্র এক ঢোক দুধ পান করলেই তার সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যায়। (১১) বিবাহ সূত্রে যে নারীগণ হারাম হয়, যেমন সহবাসকৃত স্ত্রীর পূর্বস্বামীর কন্যা বা পৌত্রী, তার মাতা, নানী, দাদী। (১২) চারজনের পরে পঞ্চমা স্ত্রী হওয়া। (১৩) এমন রমণী যার ভগ্নি বা খালাকে পূর্বে বিবাহ করা হয়েছে তাদের কারো সাথে উক্ত নারীকে বিবাহ করা অর্থাৎ খালা এবং খালার বোনঝি বা বোন ঝি এবং বোনঝির খালাকে একত্রে বিবাহ করা অথবা ফুফী ও ভাইঝি বা ভাইঝি এবং ফুফীকে একই সাথে বিবাহ করে রাখা হারাম। (১৪) তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীলোক তালাক দাতা স্বামীর সহিত বিবাহে আবদ্ধ হওয়া, তবে তিন তালাকপ্রাপ্ত নারী যদি তালাকের ইদ্দতের পরে অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহে আবদ্ধ হয় এবং উক্ত দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে তার সহবাসাদি হয়, তারপর যদি স্বেছায় উক্ত স্বামী ঐ স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, তবে সেই তালাকের ইদ্দতের পর উক্ত রমণী তার প্রথম স্বামীর সহিত বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে। (১৫) যে স্ত্রীলোক তার স্বামীকে স্বামী হওয়ার পূর্বে লা'নত বা অভিশাপ দিয়েছে। (১৬) হজ্জ বা ওমরার এহরাম অবস্থায় থাকা কালে। (১৭) নাবালেগা বিবাহিত বালিকা বালেগা না হওয়া পর্যন্ত অন্যত্র বিবাহ বসা হারাম। (১৮) ইয়াতিম বালিকা বালেগা না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বসা হারাম। (১৯) হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর সহধর্মিনীগণ উম্মাহাতুল মু'মিনীন অর্থাৎ মু'মিনদের মাতাগণ তারা অবশ্য আমাদের যুগে বর্তমান নেই।
পাত্রের গুণাবলী অনুসন্ধানঃ
পাত্রীর অভিভাবকদের কর্তব্য, বিবাহের পূর্বে তারা পাত্রের মধ্যে নিম্নোক্ত গুণসমূহ আছে কিনা তা' অনুসন্ধান করে নেবে। যে কন্যাকে তারা আদর ও যত্নে প্রতিপালন করেছে তার বিবাহোত্তর জীবনের সুখ শান্তির জন্য এটা করা অপরিহার্য।
যে পাত্রের স্বভাব রুক্ষ, চেহারা কুৎসিৎ, ধর্মে দুর্বল এবং কর্তব্য পালনে উদাসীন বা যার বংশ মর্যাদা পাত্রীর বংশের সমান নয়, তার নিকট কন্যা বিবাহ দেবে না। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন (এক দৃষ্টিতে) বিবাহ দাসত্বস্বরূপ; সুতরাং সাবধান! প্রাণাধিক কন্যাকে কিরূপ লোকের দাসী করে দেবে তা' লক্ষ্য রাখতে হবে। পাত্রের সকল ব্যাপারই লক্ষ্য করা প্রয়োজন। কেননা পাত্রী বিবাহের মাধ্যমে স্বামীর এরূপ দাসী হয়ে যায় যে তা' থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। স্বামী যেকোন অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। যে ব্যক্তি স্নেহের পুত্তলি কন্যাকে অত্যাচারী, পাপাসক্ত, বেদআতি এবং মদ্যপায়ী পাত্রের নিকট বিবাহ দেয়, সে তার ধর্মের প্রতি অত্যাচার করে এবং সে আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়। কেননা এ কাজ তার কন্যার সাথে রক্তের বন্ধন ছিন্ন করার নামান্তর।
এক ব্যক্তি হযরত হাসান বছরী (রহঃ) কে বলেছিল, কতক লোক আমার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন আমি কার কাছে কন্যা বিবাহ দেব? হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বললেন, যে আল্লাহকে ভয় করে, তার কাছে বিবাহ দাও। যদি তোমার কন্যা তাকে ভালবাসে তবে সে তাকে সম্মান করবে। যদি সে তাকে ঘৃণা করে তবু সে তাকে অত্যাচার করবে না। তিনি আরও বলেছেন, "মান যাওয়াজা কারীমাতাহু মিন ফাসিন্ট্রিন ফাক্বাদ ক্বাতাআ রাহিমাহা" অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার প্রিয় কন্যাকে পাপাচারী পাত্রের নিকট বিবাহ দেয় সে তার কন্যার সহিত রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে।
0 Comments