পঞ্চম উপকারঃ বিবাহের পঞ্চম উপকার হল, পরিবারের তত্ত্বাবধান, রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য স্বামীর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। স্ত্রীর স্বভাব-চরিত্র যেরূপই হোক না কেন স্বামীকে ধৈর্যাবলম্বন করতে হয়। তাদের থেকে প্রাপ্ত দুঃখ-কষ্ট অম্লান বদনে সহ্য করতে হয়। তাদেরকে দ্বীনের পথ প্রদর্শন করতে হয়। তাদের জন্য হালাল রুজী অর্জন করতে হয়। সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ভার বহন করতে হয়। এ সমস্ত কষ্ট সহ্য করা ও এ কাজগুলো আঞ্জাম দেয়া উৎকৃষ্ট ইবাদাত রূপে গণ্য হয়। কর্তৃত্ব ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রাজার দায়িত্বের ন্যায়, পরিবারবর্গ ও সন্তান-সন্ততি প্রজার মত; সুতরাং এদের তত্ত্বাবধান করার ছওয়াব অনেক বেশী। কেননা কর্তব্যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয়, সে জন্য কর্তা অত্যন্ত সতর্ক থাকে।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "ইয়াওমুম 'মিন অলীয়্যি আদিলিন আফজালু মিন ইবাদাতি সাবঈনা সানাতিন" অর্থাৎ সুবিচারক শাসকের একটি দিন সত্তর বছর কাল ইবাদাত করা থেকে উত্তম। তারপর তিনি বললেন, "আলা কুলুকুম রাইন অ কুলুকু মাছউলুন আন্ রাইয়্যাতিহী" অর্থাৎ তোমরা সতর্ক হও। তোমাদের প্রত্যেককেই তাদের যার যার অধীনস্থ প্রজার কথা জিজ্ঞেস করা হবে। যে ব্যক্তি নিজের এবং অন্যান্যের জন্য কর্মব্যস্ত, সে কি ঐ ব্যক্তির মত, যে শুধু নিজের সঙ্গমের জন্যই ব্যস্ত থাকে? যে ব্যক্তি তার দুঃখে-কষ্টে ধৈর্যাবলম্বন করে থাকে, সে কি ঐ ব্যক্তির মত, যে নিজেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করে? যে ব্যক্তি স্বীয় সন্তান-সন্ততি ও পরিবারবর্গ থেকে আগত দুঃখ-ক্লেশ বরণ করে লয়, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথের মুজাহিদ তুল্য। এজন্যেই হযরত বাশার ইবনে ফজল ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) কে তিনটি উপদেশ দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল এই যে, নিজের ও অন্যের জন্য হালাল রুজী অন্বেষণ করবে।
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, কোন ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য যা ব্যয় করে তা' দানের কার্যরূপে গণ্য হয়। স্ত্রীকে যে ভরণপোষণ দেয় তজ্জন্যও সে পুরস্কার লাভ করবে। জনৈক আলিম অন্য একজন আলিমকে বলেছিল, আল্লাহতায়ালা আমাকে আমার প্রত্যেক কাজের বিনিময়ে ছওয়াব দিয়ে থাকেন। এমন কি তিনি হজ্জ, জিহাদ এবং অন্যান্য বড় বড় ইবাদাতের ছওয়াবের অনুরূপ ছওয়াবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তাঁকে বললেন যে, তুমি আবদালের দ্বীনী কাজ থেকে বহু দূরে। দ্বিতীয় আলিম বললেন, সে কি? তিনি বললেন, হালাল রুজী অর্জন করে তা' পরিবারের জন্য ব্যয় করা। হযরত ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেছিলেন, (সে সময় তিনি তাঁর ভাইদের সহিত এক জিহাদে ছিলেন)। আমরা যে কাজের মধ্যে রত, তা' থেকেও উত্তম কাজ কি তোমরা জান? তারা বলল, আমরা জানি না। তিনি বললেন, যে ব্যক্তির পরিবার-পরিজন অনেক হওয়া সত্ত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে নি; বরং সারা রাত নামায পড়ে, তার নিদ্রিত সন্তানগণকে উলঙ্গ দেখে তাদের কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়। তার কার্য আমাদের এ জিহাদের থেকেও উত্তম।
হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যার নামায উত্তম, পরিবারের লোক সংখ্যা অধিক, ধন- সম্পদ কম এবং সে মুসলমানের নিন্দা করা থেকে বিরত, সে এই দু'অঙ্গুলির মত আমার সহিত বেহেশতে থাকবে। অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ বহুসংখ্যক পরিজন বিশিষ্ট ভিক্ষাবিমুখ দরিদ্রকে বেশী ভালবাসেন। একজন বিজ্ঞ আল্লিম বলেছেন, যাবতীয় গুনাহর মধ্যে এমন একটি গুনাহ আছে, যার কাফফারা পরিবার প্রতিপালনের কষ্ট সহ্য ছাড়া হয় না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যাবতীয় গুনাহর মধ্যে এমন একটি গুনাহ আছে, যার কাফফারা (পরিবারের) জীবিকা অন্বেষণের চিন্তা-ভাবনা দ্বারাই হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেছেন, যার তিনটি কন্যা আছে এবং যে পর্যন্ত আল্লাহ তাদের অভাব মুক্ত না করেন, সে পর্যন্ত সে তাদের ভরণ-পোষণের জন্য অর্থ ব্যয় করে, আল্লাহ তার জন্য বেহেশত সুনিশ্চিত করেন। অবশ্য সে যদি এমন কোন গুনাহ করে যার কোন ক্ষমা নেই, তবে তার জন্য বেহেশত সুনিশ্চিত হবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা কালে বলতেন, আল্লাহর কসম, এটি গরীব হাদীস।
জনৈক বুযর্গ তাঁর স্ত্রীকে খুবই আদর-যত্ন এবং উত্তমরূপে ভরণ-পোষণ করতেন। তাঁর সে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তাকে আবার বিবাহ করতে বলা হল, কিন্তু তিনি তা' অস্বীকার করে বললেন, একাকী থাকা হৃদয়ের জন্য শান্তিদায়ক এবং তাতে দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু তারপর একদা তিনি বললেন, আমার স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক 'সপ্তাহ পর আমি একদিন স্বপ্নো দেখলাম, যেন আকাশের দ্বার খুলে গেল, তথা থেকে লোকজন অবতরণ করতেছে ও তারা শূন্যে বিচরণ করতেছে এবং একে অন্যের অনুসরণ করতেছে। এদের মধ্যে একজন অবতরণ করতঃ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করল। তার পিছনে যে ছিল, সে বলল, হাঁ এ সেই হতভাগ্য ব্যক্তি। তার পিছনের ব্যক্তি বলল যে, হাঁ। তার পরবর্তী ব্যক্তিও তা-ই বলল, তারপর যে ব্যক্তি এল, সেও ঐ একই কথা বলল। আমি ভয়ে তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওহে! তোমরা কাকে লক্ষ্য করে হতভাগা বললে? সে বলল, তোমাকে লক্ষ্য করে। আমি বললাম, তার কারণ কি শুনি? সে বলল, আমরা আল্লাহর পথে মুজাহিদদের আমলের সাথে তোমার আমলও তুলে নিচ্ছিলাম, কিন্তু এক সপ্তাহ হল, আমাদের উপর নির্দেশ হয়েছে, তোমার আমলকে এখন থেকে মুজাহিদের আমলের পিছনে নেয়া হবে। আমরা জানি না, তোমার কি নতুন কাজের জন্য এরূপ হয়েছে। অতঃপর তিনি তার ভাইগণকে বললেন, তোমরা আমাকে বিবাহ করিয়ে দাও, অতঃপর তাঁকে দুটি কি তিনটি বিবাহ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
কাছাছুল আম্বিয়ায় আছে, একবার একজন লোক হযরত ইউনুস (আঃ) এর নিকট এসে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলেন। তিনি একবার গৃহ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন। আর একবার ভিতরে প্রবেশ করতেছিলেন। কেননা তাঁর স্ত্রী তাঁকে অত্যন্ত অতিষ্ঠ করে তুলছিল। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। অতিথিগণ অবস্থা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হলে তিনি তাদেরকে বললেন, আপনাদের আশ্চর্য হওয়ার কোন কারণ নেই। এ আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আপনারা যা দেখছেন, আমি এ ব্যাপারে ধৈর্যাবলম্বন করে আছি। এই ধৈর্যাবলম্বনের ব্যাপারে আমি আমার নফসের উপর কর্তৃত্ব করি, ক্রোধ দমিয়ে রাখি এবং এর দ্বারা আমি নিজ স্বভাবকে সুন্দর করে তুলি। যে ব্যক্তি বিবাহ করে নি তার নফসের গুপ্ত মন্দ স্বভাবগুলোর অবস্থা সে পর্যন্ত যায় না, যে পর্যন্ত না সেগুলো প্রকাশ পাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দ্বীনের পথের যাত্রীদের কর্তব্য এই সমস্যার মধ্যে জর্জরিতাবস্থায় স্বীয় নফসের লাগাম আকর্ষণ করে রাখা ও স্বভাবের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ধৈর্য ধরে থাকা এবং গুপ্ত নিন্দনীয় দোষগুলো থেকে নিজের অন্তরকে নিষ্কলুষ রাখা। পরিবারবর্গের কষ্টের উপর পূর্ণ সহিষ্ণুতা বজায় রাখা। এটাই হল দিলের আভ্যন্তরীণ ইবাদাত। একেই বলে রিয়াজাত এবং আত্মিক জিহাদ। পরিবারবর্গের তত্ত্বাবধান করা, ভরণ-পোষণ দায়িত্ব বহন করা হল বাহ্যিক ইবাদাত। নামায, রোযা, হজ্জ প্রভৃতি হল শারীরিক ইবাদাত। যে ব্যক্তি বিবাহ- শাদী করে স্বভাব ও চরিত্র সুন্দর করে, সে দ্বীনের মূলকে সুন্দর করে। অবিবাহিত থাকার কারণে যার দিলে ভাবনা-চিন্তা নেই, পারিবারিক কষ্ট সহ্যের বালাই নেই এবং যে শুধু শারীরিক ইবাদাত নামায রোযায়ই ব্যস্ত থাকে, তার তুলনায় প্রথমোক্ত ব্যক্তিই উত্তম, যে তার পরিবার- পরিজনের ও সন্তানাদির তত্ত্বাবধান করে, তাদের জন্য হালাল জীবিকা সংগ্রহ করে। প্রথম ব্যক্তির শারীরিক ইবাদাতের চেয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির শারীরিক ইবাদাতের মূল্য অধিক। কেননা দ্বিতীয় ব্যক্তির শারীরিক ইবাদাত অন্যের জন্য কিছু নয় কিন্তু প্রথম ব্যক্তির শারীরিক ইবাদাত অন্যের জন্য করা হয়। তবে যে ব্যক্তির স্বভাব-চরিত্র স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব বর্ণিতরূপে নিজ চেষ্টা যত্নের দ্বারা উত্তম রাখে, যে ইলমের অন্বেষণে ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাঙ্গনে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, তার বিবাহের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী নয়, কেননা বিবাহ দ্বারা যে গুণ ও উপকার অর্জিত হবে, তা' তার পূর্ব থেকেই অর্জিত হয়েছে। তার মধ্যে রিয়াজাত রয়েছে। পরিবার- পরিজনের রুজী অর্জনের কাজ অপেক্ষা বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনই তার পক্ষে উত্তম। কেননা এর চেয়ে বিদ্যার্জন অনেক বেশী উপকারী। রুজী অর্জন পরিবারের মুষ্টিমেয় লোকের জন্য, কিন্তু জ্ঞানার্জন সমস্ত লোকের জন্য উপকারী।
0 Comments