হালালের চার স্তরের দৃষ্টান্ত


         প্রথম স্তরঃ ন্যায়পরায়ণ সাধারণ মুসলমানের সতর্কতা, হারাম থেকে বেঁচে থাকা। তা ছ'প্রকার। সে প্রকারগুলোর বিবরণ দেয়া হয়েছে। হারামের কোন শর্ত পাওয়া গেলেই তা সাধারণতঃ হারাম হয়। যে তাতে লিপ্ত হয়, সে গুনাহ এবং ত্রুটির মধ্যে জড়িয়ে যায়। এর কোন দৃষ্টান্তের দরকার পড়ে না।

        দ্বিতীয় স্তরঃ নেককারদের সতর্কতা। তারা যে প্রত্যেক সন্দেহজনক জিনিস পরিত্যাগ করে তা' ওয়াজিব না হলেও মুস্তাহাব এবং উত্তম, তাতে সন্দেহ নেই। এবিষয় সন্দেহের অনুচ্ছেদে বর্ণনা করব। এমন কিছু সন্দেহজনক বস্তু আছে যা ত্যাগ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। সেগুলো হারামের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। আবার তার মধ্যে এমন কিছু সন্দেহজনক বস্তু আছে যা' ত্যাগ করা একান্তই অহেতুক এবং অকারণ। তা' থেকে পরহেজ করা কুমন্ত্রণাকারীদের পরহেজ করার ন্যায়। যেমন কোন সন্দেহমনা ধর্মভীরু ব্যক্তি সন্দেহবশে শিকারের মাংস ভক্ষণ করা হতে বিরত থাকে। কেননা সে এরূপ সন্দেহে লিপ্ত হয় যে, হয়তো শিকারের প্রাণী তার মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে। এটা শয়তানের কুমন্ত্রণামাত্র। এরূপ সন্দেহ পরিত্যগ করা মুস্তাহাব, তবে ওয়াজিব নয়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যা' তোমার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে, তা' ত্যাগ করে যা' সন্দেহের উদ্রেক করে না তা-ই গ্রহণ কর। আমরা একে মাক্কহ তানযীহ্ বলব। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যে শিকারের উপর তীর লেগে তা' তোমার সামনে মরে যায়, তার মাংস ভক্ষণ কর এবং যে জন্তু ক্ষত নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তাকে মৃত অবস্থায় তোমার সামনে আনা হয়, তার মাংস ভক্ষণ করো না। আমাদের মতে ভক্ষণ করা হারাম নয়, কিন্তু ভক্ষণ না করা ধার্মিক লোকের সতর্কতা। তিনি আরও বলেছেন, যা' সন্দেহের উদ্রেক করে তা' বর্জন কর। এটা জরুরী নির্দেশ। কোন কোন বর্ণনায় আছে, তা' ভক্ষণ কর। তবে যদি তোমার নিকট হতে তা' অদৃশ্য হয় এবং যদি তোমার তীরের চিহ্ন ব্যতীত তার শরীরে অন্য চিহ্ন দেখা যায়, তবে তা' ভক্ষণ করো না। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) আদী বিন হাতেমকে একটি শিকারী (শিক্ষাপ্রাপ্ত) কুকুর সম্বন্ধে বলেছিলেন, যদি কুকুর শিকারকে ভক্ষণ করে থাকে, তা'হলে তা' আমরা ভক্ষণ করব না। কেননা আমার আশঙ্কা হয় যে, সে শিকারকে নিজের জন্যই ধরেছে। এটা মাকরূহ তানযীহ বলা হয়েছে। কেননা হুযুর (দঃ) আবি-ছালাবাহ রোশনীকে বলেছেন, তোমরা ওটাকে ভক্ষণ কর। যদিও কুকুর তাকে ভক্ষণ করে থাকে। হুযুর (দঃ) তাকে এরূপ নির্দেশ এজন্যই দিয়েছিলেন যে, তাঁর অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। তিনি শারীরিক পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা উপার্জন করতেন। তাঁর পক্ষে সতর্কতা অবলম্বন করা সাধ্যের বাইরে ছিল। কথিত আছে যে, হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) তাঁর ব্যবসায়ী অংশীদারদের জন্য চার হাজার দেরহাম রেখে দিয়েছিলেন। কেননা তাঁর মনে অহেতুকভাবে এমন একটি বিষয় উদিত হয়েছিল যা' ওলামাদের সম্মিলিত মতানুযায়ী তার কোন কারণ বা আবশ্যকতাই ছিল না।

        তৃতীয় স্তর : খোদাভীকদের সতর্কতা। হুযুরে পাক (দঃ)এর নিম্নোক্ত হাদীস খোদাভীরুদের পরহেজগারীর ভিত্তিস্বরূপ। যেমন তিনি এরশাদ করেছেন, সন্দেহজনক জিনিসের ভয়ে সন্দেহমুক্ত জিনিসকে পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত মানুষ খোদাভীরুমের পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমরা হালাল বস্তুসমূহের দশ ভাগের নয় ভাগ হারামে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে ছেড়ে দিয়েছি। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, পরহেজগারীর পরিপূর্ণতা হয় তখন, যখন বান্দা বিন্দু পরিমাণ ব্যাপারেও সতর্ক থাকে এবং তা' ভয় করে চলে, এমন কি সে যা হালাল দেখে তারও অধিকাংশ হারামে পতিত হওয়ার ভয়ে এবং তার ও নরকাগ্নির মধ্যে পর্দা না হওয়ার আশংকায় ত্যাগ করে।

        উদাহরণঃ কোন ধামিক ব্যক্তি কাউকে একশ' দেরহাম কর্জ দিয়েছিলেন, করজদার তা' তার নিকট নিয়ে এলে তিনি তার থেকে নিরানব্বই দেরহাম গ্রহণ করলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করত যে, যখন তিনি কারো কাছ থেকে কোন দ্রব্য ওজন করে নিতেন তখন তিনি পরিমাণ থেকে কিছু কম নিতেন এবং যখন তিনি তা' কাউকে ওজন করে দিতেন তখন তা' পরিমাণের চেয়ে কিছু বেশী দিতেন। এর কারণ ছিল, দোযখের অগ্নি থেকে নাজাত পাওয়া। এ শ্রেণীর কাজগুলো তৃতীয় স্তরের অন্তর্গত। মানুষ সাধারণতঃ এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করে না, যা শরীয়ত মতে সিদ্ধ; কিন্তু দরজা উন্মুক্ত থাকার কারণে তা' হারাম হওয়ার আশংকা থাকে। সাধারণতঃ শয়তান নফসকে প্রলোভন দেখিয়ে এ সতর্কতা অবলম্বন ত্যাগ করতে উৎসাহ দেয়।

        হযরত আলী বিন মা'বাদ (রহঃ) বলেছেন, অমি একটি ভাড়া করা বাসায় বসবাস করতাম। একদা আমি একখানা চিঠি লিখে মনে করলাম যে, বাসার দেয়াল থেকে সামান্য মাটি খুঁড়ে নিয়ে তদ্বারা লিখাটা শুকিয়ে নেই। ভাবলাম এ-মাটির মালিক আমি না হলেও সামান্য মাটিতে কি আর ক্ষতি হবে? তাই আমি দেয়ালের মাটিদ্বারা চিঠির লেখা শুষ্ক করলাম। অতঃপর যখন আমি নিদ্রা গেলাম, নিদ্রাযোগে স্বপ্নে দেখলাম যে, একব্যক্তি আমার পাশে বসে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, রোজকিয়ামতে এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই তোমাকে বলবে যে. আমার দেয়ালের এ স্থানের মাটি কোথায়? এর তাৎপর্য এই যে, ক্ষুদ্রতম ব্যাপারেও সতর্কতায় ত্রুটি হলে পদমর্যাদার লাঘব ঘটে। পরহেজগারীর মধ্যে অবশ্যই পদমর্যাদা নিহিত। পরহেজগারদের এরূপ ত্রুটি হলে, তাদের পদমর্যাদায়ও হানি ঘটে।

        উদাহরণ: হযরত ওমর (রাঃ)এর খেলাফত আমলে বাহরাইন থেকে যুদ্ধলব্ধ কস্তুরী মদীনায় পৌঁছলে খলীফা বললেন, কোন মহিলা যদি কস্তুরী ওজন করত এবং আমি তা' মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করতাম তা'হলেই তা' ভাল হত। খলীফার স্ত্রী বললেন, আমি উত্তমরূপে ওজন করতে জানি। স্ত্রীর কথা শুনে খলীফা নীরব থাকলেন। কিছুক্ষণ পর আবার তিনি বললেন, যদি কোন মহিলা এ কস্তুরী ওজন করে দিত এবং আমি তা' মুসলমানদের, মধ্যে বন্টন করতাম, তাহলেই ভাল হত। তাঁর স্ত্রী খলীফার সেই একই কথা শুনে বললেন, আমিত বললাম যে. আমি নিখুঁতভাবে ওজন করতে পারি। এবার খলীফা বললেন, শোন, আমি চাই না যে, কস্তুরী  ওজন করা কালে তার কিছু অংশ তোমার হাতে লেগে যাবে এবং তদ্বারা তুমি তোমার যাঁরা মুছে দেবে। আর বলবে যে, হাতে লেগে গেছে সে হাত দ্বারাই গ্রীবা মুছে নিয়েছি। এ আয় এমন অপরাধ কি হল? কিন্তু জেনে রাখ, এটা সাধারণ মুসলমানদের সম্পত্তি। এর উপদ প্রত্যেকের ন্যায্য অংশ ব্যতীত এতটুকুও অতিরিক্ত গ্রহণ করা কারুর-ই অধিকার নেই।

         উদাহরণঃ একবার খলীফা ওমর বিন আবদুল আযীযের সামনে সর্বসাধারণ মুসলমানের জন্য কস্তুরী ওজন করা হলে, তিনি তাঁর নাসিকার ছিদ্র বন্ধ করে রাখলেন, যেন তার সুঘ্রাণ নাকের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। এ ব্যাপারে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, কস্তুরী থেকে আর কি উপকার পাওয়া যায়? সুঘ্রাণ গ্রহণ করাইত তার থেকে উপকার নেয়া।

         উদাহরণ: একদা শৈশবকালে হযরত হাসান (রাঃ) যাকাতের খুরমা হতে একটি খুরমা তুলে মুখে দিয়েছিলেন। তা' দেখে হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, থু থু ফেল অর্থাৎ খুরমা ফেলে দাও। উদাহরণ: এক ব্যক্তি রাত্রিবেলা তার এক রুগী বন্ধুকে দেখতে গেল। একটু পরেই রুণী ব্যক্তির মৃত্যু হয়ে গেল। তার মৃত্য হওয়ামাত্র ঐ ব্যক্তি গৃহের প্রদীপটি নিবিয়ে ফেলল এবং বলল, এ প্রদীপের তৈলে এখন মৃত্যু ব্যক্তির ওয়ারিসী স্বত্ব হয়ে গেছে।

        উদাহরণঃ হযরত ওমর (রাঃ) সর্বসাধারণ মুসলমানের স্বত্ব কস্তুরী থেকে একটি অংশ তাঁর স্ত্রীকে বিক্রয় করতে দিলেন তিনি তা' এক আতর বিক্রেতার নিকট বিক্রয় করলেন। এই ক্রয়-বিক্রয়কালে হযরত ওমর (রাঃ)এর স্ত্রীর একটি আঙ্গুলে কিছু সুগন্ধি লেগে গেল। তিনি তাঁর ওড়নার দ্বারা ঐ অঙ্গুলিটি মুছে নিলেন। এমনি সময় হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হলেন এবং বললেন, এ সুঘ্রাণ কিসের? তিনি তার নিকট ঘটনাটি খুলে বললেন। তখন হযরত ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, সর্বসাধারণের সুগন্ধি তুমি গ্রহণ করেছ? একথা বলে তিনি তাঁর স্ত্রীর মস্তক থেকে ওড়নাটি টেনে নিয়ে পানির পাত্র হতে তাতে পানি ঢালতে লাগলেন এবং ওড়নাটি মাটিতে ঘষতে লাগলেন। যখন ওড়না থেকে সুঘ্রাণ বের হওয়া বন্ধ হল তখন তিনি ওড়নাটি তার স্ত্রীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন। যদিও এ সামান্য ব্যাপারটি মোটেই কিছু নয় বরং ক্ষমার যোগ্য তথাপি ন্যায়ের প্রতীক হযরত ওমর (রাঃ) ঐ সুগন্ধি তাঁর স্ত্রীকে উপভোগ করতে দেন নি। তিনি পূর্ণ পরহেজগারীর ছওয়ার লাভের আশায় এবং হারামে পতিত হওয়ার আশঙ্কায় এভাবে হালাল বস্তুও বর্জন করেছিলেন।

        উদাহরণঃ লোকগণ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করল, কোন ব্যক্তির মসজিদে থাকাকালীন বাদশাহর লোকেরা মসজিদে যদি সুগন্ধি চন্দন কাষ্ঠ জ্বালিয়ে দেয় তখন সে ব্যক্তির কি করা উচিত? তিনি বললেন, তার বের হয়ে আসা উচিত। কেননা এটা তার জন্য হারামের নিকটবর্তী। এজন্য যে, তার মনে এ খেয়াল হবে যে, সে কিছু সুগন্ধি উপভোগ করুক এবং কিছুটা তার কাপড়-চোপড়েও লেগে থাকুক। অথচ অত্যাচারী বাদশাহর সুগন্ধি গ্রহণ করলে পরহেজগারীর হানি ঘটে। উক্ত ইমাম সাহেবের নিকট এক বাক্তি জিজ্ঞেস করল, হুযুর! কারও কাছ থেকে সংবাদ সম্বলিত একখানা চিঠি পড়ে গেলে যে ব্যক্তি তা' পায় সে তা হুবহু নকল করে রেখে মালিককে ফেরত দিতে পারে? তিনি উত্তর দিলেন, না। তবে সে মালিকের অনুমতি চেয়ে নকল করতে পারে। তারপরও তারপরও সন্দে সন্দেহ থাকে যে, মালিক এতে সন্তুষ্ট থাকে কি অসন্তুষ্ট হয়। মোটকথা, ব্যাপারটি সন্দেহজনক। যার চাই। আর এটাই হল প্রথম শ্রেণী ক্ষেত্রেও পরহেজ করতে হয়। প্রার মূল হারাম তা হারাম না হলেও তা ত্যাগ শ্রণীর পরহেজগারীর অন্তর্গত। এভাবে সৌন্দর্য বর্ধন করার কেননা নিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ইমাম নন্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হালাল হলেও তা' মন্দ পথের দিকে হেমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)কে নকশী করা জুতা ব্যবহার করা মাম আহম সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। করে সে যেন তা' ব্যবহার করে। ।তিনি। জবাব দিলেন, এন. আমি তা' তা' ব্যবহার করে।

        উদাহরণ : যখন হযরত উমার (দঃ) খেলাফত লাভ করলেন তখন তার মাত্র একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। খেলাফত লাভ করার পর তিনি তাঁকে এই ভয়ে তালাক দিয়েদিলেন যে, হয়ত হয়ত তিনি তনি তাঁকে কোন হারাম কাজের জন্য ধরে বসবেন; এবং তিনিও হয়ত তার সন্তুষ্টিকল্পে তাঁর দাবী পূরণ করে ফেলবেন। এজন্যই যা সন্দেহজনক তাঁর ভয়ে যা' সন্দেহমুক্ত তা ত্যাগ করা হত। পূর্বকালের বুযর্গ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিগণ এভাবেই জীবন যাপন করতেন। মানুষ অধিকাংশ হালাল জিনিসে অভ্যাস হতে হতে হারাম জিনিসের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়। যেমন অনবরতঃ অধিক ভক্ষণ। অবশ্য অধিক ভক্ষণ হারাম বা নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু সর্বদা উদর পূর্ণ করে তৃপ্তির সাথে আহার করলে কামভাব জাগ্রত হয়ে উঠে। ঐ কামভাবের ফলে নানা ধরনের কুচিন্তা মনের মধ্যে দানা বাঁধে। যার ফলে চোখে কুদৃষ্টির আকাঙ্খা জাগে; এবং কুকাজে লিপ্ত হওয়ার বাসনাও মনে জাগ্রত হয়। এভাবে ধনবানদের সুরম্য অট্টালিকা ও তাদের শান-শওকতের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হালাল বটে, কিন্তু তা' দেখে দেখে নিজের মনেও এরূপ শান-শওকত ও স্বচ্ছলতা অর্জনের বাসন্য উদয় হয় এবং তা' অর্জনের চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য মানুষের ব্যগ্রতা এবং ব্যস্ততা আসে যা' কোন পরহেজগারের জন্যই অনুকূল এবং শোভনীয় নয়; বরং এটা সম্পূর্ণরূপে পরহেজগারীর বিপরীত।

        উদাহরণঃ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) গৃহের দেয়ালে চুনকাম করাও মাকরূহ জানতেন। তিনি বলতেন, মাটির দ্বারা মাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা মাকরূহ। দেয়ালে চুনকাম করে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হালাল সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে কোন উপকার হয় না। এমন কি ইমাম সাহেব মসজিদের দেয়ালে চুনকাম করা বা যেকোনরূপে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা মাকরূহ বলেছেন এবং তাঁর এ মতের সপক্ষে প্রমাণও দিয়েছেন। একবার হুযুরে পাক (দঃ) কে মসজিদে রং লাগাবার বিষয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, হযরত মূসা (আঃ) এর আরিশের ন্যায় অন্য কোন আরিশ নেই। তা' হল, সুরমার ন্যায় একটি জিনিস। যদ্বারা দেয়ালে লেপ দেয়া হয়। কিন্তু হুযুরে পাক (দঃ) তাও জায়েয রাখেন নি।

        উদাহরণঃ অতীতকালের খোদাভীরু ব্যক্তিগণ সরু ও মিহিন বস্ত্র ব্যবহার করাকে মাকরূহ মনে করতেন। তাঁর। বলতেন, যার বস্ত্র সরু তার ধর্মও ক্ষীণ। তাঁরা আরও বলতেন যে, হালাল বস্তু সীমাতিরিক্তভাবে ভোগ করার ফলে সংসারের প্রতি মোহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর তা' অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে হারামে লিপ্ত হওয়ার পথ সুগম হয়। তখন মানুষ তাকওয়া ও অভ্যাসে এটা মানুষের ভুলে গিয়ে গাফলতীর কূপে নিমজ্জিত জন্য চরম দুর্গতি ।। আল্লাহর রহমত হতে দূরে সরে যায়। হয়। ও দুর্ভাগ্যের কারণ। সুতরং হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা জিনিস থেকেই নিবৃত্ত থাকা সবার কর্তব্য। তৃতীয় স্তরের পরহেজগারী ও পদমর্যাদার দৃষ্টান্ত এগুলো।

          চতুর্থ স্তর: এটা হল ছিদ্দীকিনদের সতর্কতা বা পরহেজগারী। যে সব কার্যে নাফরমানী থাকে না এবং যে সব বিষয় গুনাহরও সাহায্য করে না, তা' তাদের নিকা কাজেই আল্লাহর ভয় নিহিত। তাঁত অন্যের জন্য যা' কিছু করা কাজের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টিবিধান এবং তাঁদের প্রত্যেক কার তাঁদের জীবন ধারণ শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তাঁরা। আল্লাহ ব্যতীত হয় তা' হারাম জানতেন। তাঁরা নিম্নোক্ত আয়াতের অনুসরণ করে যার হুম ফী খাওয়িহিম ইয়ালআবৃন" অর্থাৎ বল, আল্লাহ তারপর চলতেন। "কুলিল্লাহু হুম্মা তাদেরকে তাদের অনর্থক নিজেদের প্রবৃত্তি বাক্যে ছেড়ে দাও। এটাই হল তাওহীদ পন্থীদের পদমর্যাদা। তাঁদের উদ্দেশ্য নিজেদের হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। এতে কোন সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়ান্তে কাজ না করে সে ছিদ্দীক শ্রেণীর লোকের নিকট গুনাহ নিয়েই সামনে অগ্রসর হয়। উদাহরণঃ হযরত ইয়াহইয়া বিন কাছওয়ার (রহঃ) সম্পর্কে এরূপ রূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে ছে যে, তিনি একদা ওষুধ সেবন করলেন। তখন তার স্ত্রী তাঁকে বললেন, এখন যদি তুমি ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি কর তাহলে ওষুধে কাজ দিতে পারে। তিনি বললেন, আমি এরূপ পায়চারি করা জানি না; বরং বিগত ত্রিশ বছর ধরে আমি শুধু আমার নিঃশ্বাস গণনা করছি। মোটকথা তিনি এই পায়চারির উদ্দেশ্যকে ধর্মের সহিত কোনরূপ সম্পর্কযুক্ত আছে বলে মনে করেন নি; এবং এজন্যই তিনি তাঁর স্ত্রীর কথামত পায়চারি বা পদক্ষেপকে জায়েয ভাবতে পারেন নি।

        উদাহরণঃ হযরত সাররী ছাকতী (রহঃ) বলেছেন, আমি একদা পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে একটি ঝরণা দেখতে পেলাম এবং তার পার্শে উত্তম সব্জি দেখে তা' আমার ভক্ষণ করতে ইচ্ছে হল; সুতরাং আমি কিছু সব্জি ভক্ষণ করলাম এবং ঐ ঝর্ণার পানি পান করলাম। তারপর মনে মনে ভাবলাম যে, যদি আমি কোনদিন উত্তম হালাল জিনিস ভক্ষণ করে থাকি তাহলে তা' আজই করলাম। তখন অদৃশ্য থেকে জনৈক ঘোষণাকারী আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, যে শক্তি তোমাকে উন্নতির এই স্তরে পৌঁছিয়েছে তুমি কি বলতে পার কোন বস্তুর উসীলায় তা' তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে? তখন আমি অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলাম।

        উদাহরণঃ হযরত যুন্নুন মিসরী (রহঃ) একবার কারাগারে বন্দী অবস্থায় অনাহারে কাল কাটাতে থাকেন। এভাবে অনাহারে থেকে থেকে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন। এমন সময় জনৈকা সাম্মী মহিলা কারাগারের এক কর্মচারীর হাতে তাঁর জন্য কিছু খাবার পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি সে খাদ্য ভক্ষণ করলেন না এবং ভক্ষণ না করার কারণ উক্ত মহিলাকে জানিয়ে দিলেন যে, যে খাদ্য কোন অত্যাচারী ব্যক্তির হস্তের মাধ্যমে আমার নিকট এসেছে সে খাদ্যও তার পবিত্রতা হারিয়ে ফেলেছে। পাঠক, হাফী পাঠিকা। কা? জেনে রাখবে, এটাই হল পরহেজগারীর চরম পর্যায়।

Post a Comment

0 Comments