তৃতীয় উপকারঃ বিবাহ হৃদয়ে শান্তি দান করে। স্ত্রীর সাহচর্যে, তার সাথে রসালাপে, মনে প্রেম-প্রীতি পূর্ণ হয়। তার দিকে দৃষ্টিপাতে, তার সাথে আমোদ ও প্রমোদে আন্তরিক সুখ লাভ হয়। সুখ উপভোগ দ্বারা ইবাদাতে নবোদ্যমে মনোনিবেশ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। হৃদয়ে অশান্তি থাকলে, মন নিরানন্দ হলে, সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অবিরাম ইবাদাতের ফলে হৃদয়-মন ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু যখন আবার হৃদয় আস্বাদ উপভোগ করে, তখন তথায় শক্তি ও আনন্দের সঞ্চার হয়ে ইবাদাতের জন্য চাঙ্গা হয়ে উঠে। মিষ্টি মধুর আলাপে-প্রলাপে মনে শান্তি এবং বিশ্রাম আসে, দুঃখ অবসাদ দূরীভূত হয়। খোদাভীরু ও ধার্মিকদের আত্মা হালাল জিনিসে শান্তি লাভ করে। এজন্যই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "তিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকেই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যেন তার মধ্যে সে শাস্তি লাভ করে।" হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, সব সময় মনকে শাস্তি দাও। কেননা মন অশান্ত হয়ে গেলে তা' অন্ধের মত হয়ে যায়।
হাদীস শরীফে আছে, জ্ঞানীদের নিকট তিনটি সময় আছে। একটি সময়ে সে নিজ প্রভুর সহিত গোপন আলাপ করে। দ্বিতীয় সময়টিতে সে স্বীয় কার্যাবলীর হিসেব দেখে আর তৃতীয় সময়টিতে সে নিজের পানাহারের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকে। তবে একটি সময় অন্য সময়ের সাহায্য করে। অন্য বর্ণনায় আছে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা তিনটি বিষয় ব্যতীত অন্য বিষয়ের জন্য লালায়িত হয় না। পারলৌকিক রিযিক অর্জন, রিযিক অর্জনের চেষ্টা এবং হালাল জিনিস ভক্ষণ করা। হুযুরে পাক (দঃ) বলেন, প্রত্যেক কাজেই পরিশ্রম আছে এবং প্রত্যেক পরিশ্রমের কাজান্তেই বিশ্রাম আছে। যে ব্যক্তি বিশ্রাম করতঃ আমার সুন্নতের দিকে যায়, সে ব্যক্তি হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলতেন যে, আমি আমার প্রবৃত্তিকে আমোদ-প্রমোদ দ্বারা ভুলিয়ে দেই তারপর যে সত্যের উদ্ভব হয়, তা' খুবই জোরদার হয়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, ফিরেশতা জিব্রাইলের নিকট আমার সঙ্গমশক্তি হ্রাসের অভিযোগ করলে, তিনি আমাকে হারিছাহ গ্রহণের পরামর্শ দিলেন। অত্র হাদীস ছহীহ বলে প্রমাণিত হলে এর উদ্দেশ্য বিশ্রামের দ্বারা পুনঃ শক্তি অর্জন। কামশক্তি দূর করার দ্বারা তা' সম্ভব নয়; বরং এমতাবস্থায় কামশক্তি বৃদ্ধির জন্য উপদেশ গ্রহণ করা প্রয়োজনীয়, কামশক্তিহীন ব্যক্তির অধিকাংশ ভালবাসাই দূর হয়ে যায়।
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, তোমাদের পার্থিব জিনিসের মধ্যে তিনিটি জিনিস আমার নিকট খুবই প্রিয়। তা' হলঃ (১) সুগন্ধি (২) স্ত্রীলোক এবং (৩) আমার চোখের পুতুলি নামায, মনের শান্তির জন্য উক্ত আরাম ও বিশ্রাম প্রয়োজনীয়। যে ব্যক্তি চিন্তা-ভাবনা, যিকির-আযকার ও অন্যান্য কাজে অধিক পরিশ্রম করে, সে প্রথমোক্ত বস্তু দুটো থেকে বঞ্চিত হয় এবং সে যদি সহবাসে প্রবৃত্তিহীন নপুংসক না হয়, তাহলে এই পর্যায়ের উপকার শুধু বিবাহ দ্বারাই অর্জিত হয়। অবশ্য বিবাহের ক্ষেত্রে এরূপ নিয়ত খুব অল্প লোকই করে; বরং অধিক সংখ্যক লোকই বিবাহ দ্বারা সন্তান কামনা, কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ এবং অন্যান্য বিষয়ের নিয়ত করে। আবার কোন কোন লোকের এরূপ প্রকৃতিও দেখা যায়, তারা প্রবাহিত পানি এবং সবুজ বর্ণ প্রভৃতি দেখে আরাম লাভ করে কিন্তু স্ত্রীলোকের সংসর্গ, সাহচর্য বা তাদের সহিত প্রমোদ কৌতুকে কোন আরাম বোধ করে না। বিভিন্ন ব্যক্তির এরূপ বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে।
চতুর্থ উপকারঃ বিবাহ দ্বারা পুরুষ ব্যক্তি গৃহকর্ম থেকে অবসর লাভ করে। রন্ধন কার্য, শয্যা, বিছানা, কাপড়-চোপড়, তৈজসপত্র প্রভৃতি পরিষ্কার করা এবং পারিবারিক জীবনের অন্তর্ভাগের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতঃ স্ত্রী স্বামীর অনেক শ্রম লাঘব করে। যদি পুরুষের গৃহাভ্যন্তরের এ কাজগুলোও করতে হত তাহলে তার অধিকাংশ সময়ই ঐ কাজে চলে যেত। জ্ঞানার্জন, দ্বীন- ধর্মের কাজ প্রভৃতি করার তার সময় মিলত না। সতী-সাধ্বী, ধার্মিক ও স্বামী সোহাগিনী রমণীগণ এভাবেই তাদের স্বামীদের সাহায্য করে থাকে। হযরত আবু সোলায়মান সারানী (রহঃ) এজন্যই বলেছেন যে, ধর্মপরায়ণা নারীগণ কখনও দুনিয়ার ভোগ্য বস্তু রূপেই গণ্য নয় বরং তারা আখেরাতের অমূল্য উপকরণসমূহেরই অন্যতম। এরূপ রমণী গৃহকর্ম সম্পন্ন করে ও স্বামীর কাম ক্রিয়াকলাপের সঙ্গিনী হয়ে স্বামীকে পর্বির মনে ইবাদাতের সুযোগ করে দেয়। আল্লাহতায়ালা কুরআনে পাকে এরশাদ করেছেনঃ “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতান।"
অর্থাৎ হে মাবুদ। আমাদেরকে দুনিয়ায় মঙ্গল দান কর। হযরত মুহাম্মদ বিন কা'ব এ মঙ্গলকে সতী-সাধ্বী ও ধর্মপরায়ণা নারীর অর্থে উল্লেখ করেছেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যেন কৃতজ্ঞ হৃদয়, যিকিরকারী রসনা এবং সতী-সাম্মী ও আখেরাতের সাহায্যকারিণী মুমিনা স্ত্রী ব্যতীত গ্রহণ না করে। লক্ষ্য করার বিষয় বৈকি কিভাবে হুযুরে পাক কৃতজ্ঞতা ও যিকিরকে সতী স্ত্রীর সহিত সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব।" কোন তাফসীরকার এ পবিত্রতার অর্থ করেছেন ধর্মপরায়ণতা। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, ঈমানের পর ধার্মিকা রমণী অপেক্ষা উত্তম বস্তু কোন বান্দাকে দেয়া হয় নি। কোন (সাথী) নারী এমন অমূল্য নিয়ামত ও সম্পদ, যার তুলনায় অন্য ধন-দৌলত একেবারেই নগণ্য। এরূপ রমণী এমনই অমূল্য ধন, যার বিনিময় অন্য কোন কিছু নেই।
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, দুটি কারণে আদম (আঃ) এর উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়েছে। আদম (আঃ) এর স্ত্রী একটি গুনাহর কাজে তার সাহায্যকারিণী ছিল। পক্ষান্তরে আমার সহধর্মিনীগণ নেক কাজে-কর্মে আমার সাহায্যকারিণী ও সঙ্গিনী। শয়তান হযরত আদম (আঃ) এর নাফরমান হয়েছিল। কিন্তু সে আমার বশ্যতা স্বীকার করেছে। সে কোন নেক কাজ ব্যতীত আমাকে কিছু করতে বলে না।
হযুরে পাক (দঃ) দ্বীনের কাজে স্ত্রীদের সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ধার্মিক ব্যক্তিদেরও এটাই কাম্য, বিশেষতঃ যাদের অন্য কোন সাহায্যকারী ও সহযোগী নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শর্ত হল, একই সাথে কারও যেন একাধিক স্ত্রী না থাকে। কেননা একাধিক অর্থাৎ দুজন কি তিনজন স্ত্রী একই সময় থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে ও সাংসারিক কাজ-কর্ম, শৃংখলা, সুন্দর পরিবেশ সমস্ত কিছুই নষ্ট হয়ে যায়। এই উপকারের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য করা ও নানাভাবে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করাও ইচ্ছে থাকে। কেননা বিপদ আপদ দূর করার জন্য ও নিরাপত্তা লাভের জন্য এটা প্রয়োজনীয়। এজন্য বলা হয়ে থাকে, যার সাহায্যকারী বা সহায়ক নেই, সে হেয়, কিন্তু যার বিপদ আপদ দূর করার লোক থাকে, তার অবস্থা নিরাপদ এবং ইবাদাতের জন্য তার মন চিন্তাহীন থাকে।
0 Comments