ইসলামী বিবাহের উপকার


          বিবাহের উপকার:     বিবাহের মধ্যে পাঁচটি উপকার আছে। যথাঃ (১) সন্তান লাভ করা। (২) কামরিপু দমন করা। (৩) বসবাসের শৃঙ্খলা হওয়া। (৪) আত্মীয়স্বজন বৃদ্ধি হওয়া। এবং (৫) পারিবারিক জীবনে স্ত্রীর সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করা।

        প্রথম উপকার:     বিবাহের দ্বারা সন্তান-সন্ততি লাভ। এটাই মূল এবং এজন্যই বিবাহ। এর উদ্দেশ্য বংশ রক্ষা করা এবং দুনিয়া মানবশূন্য না হওয়া, যে রূপ কোন প্রাণী ধরবার জন্য জাল বিস্তারপূর্বক বীজ ছড়ানো হয়, তদ্রুপ মানব বংশ রক্ষার জন্য কামরিপুর সৃষ্টি হয়েছে। নর ও নারীর সঙ্গমের ফলে সন্তান জন্মে। অবশ্য আল্লাহর কুদরত ও শক্তি এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ইচ্ছে করলে এই মনুষ্য বীজ ব্যতীতও মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু এও এক হিকমত যে. সৃষ্টিকে একটি কারণের ভিতর নিবদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর এ কারণের কোন প্রয়োজন ছিল না, তবু তাঁর শক্তি প্রকাশ করার জন্য এবং তাঁর সৃষ্টি কৌশল সম্পন্ন করার জন্য আল্লাহতায়ালার ইচ্ছে হয়েছে, মানুষ আল্লাহর এই প্রিয় কর্মে যত্নবান হোক। বিবাহের ফলে সন্তান লাভে চারটি উদ্দেশ্য সফল হয়ে থাকে। কামরিপুর তাড়না হতে নিরাপদ হওয়ার জন্য মানুষের এই সন্তান উৎপাদনের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট। সন্তান লাভে চারটি উদ্দেশ্যের প্রথমটি হল, মানব বংশ বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য রাসূলুল্লাহর (দঃ) উম্মত বৃদ্ধি ও তার ভালবাসা অন্বেষণ করা। তৃতীয় উদ্দেশ্য নিজের মৃত্যুর পর নেককার সন্তানের দোয়ার আশা করা। চতুর্থ উদ্দেশ্য যদি সন্তান শিশুকালেই পিতামাতার পূর্বে মারা যায় তবে তার সুপারিশ অন্বেষণ করা।

        উল্লিখিত চারটি বিষয়ের প্রথম বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সাধারণের বুদ্ধির অগম্য। যারা আল্লাহ তায়ালার অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি কৌশল ও তাঁর নির্দেশের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখে তাদের নিকট সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং সত্য এই প্রথম বিষয়। তার প্রমাণ এইঃ মনে কর কোন মনিব তার ভূত্যের নিকট শস্যবীজ এবং চাষ করার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দিয়ে দিল এবং চাষের জন্য উর্বর ভূমিও সোপর্দ করল। তারপর ভৃত্যটি চাষাবাদ করার শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা' না করে হাত গুটিয়ে থাকে এবং অলসভাবে সময় কাটায়, চাষাবাদের যন্ত্রপাতি বেকার ফেলে রাখে, শস্যবীজ নষ্ট করে দেয় এবং তার উপর অর্পিত কর্তব্য কোন ওযর দেখিয়ে সে পালন না করে তবে নিঃসন্দেহে এই ভৃত্য তার মনিবের ক্রোধভাজন এবং তিরস্কারযোগ্য হয়। আল্লাহতায়ালা মানুষকে দু' শ্রেণীতে সৃষ্টি করেছেন। এক শ্রেণী পুরুষ এবং অন্য শ্রেণী নারী। তিনি পুরুষের পিঠের হাড়ের মধ্যে এবং নারীর বক্ষে শুক্রকে সন্তান উৎপাদনের বীজ স্বরূপ স্থাপন করেছেন। স্ত্রীলোকের জরায়ুকে উর্বর ভূমি স্বরূপ এবং পুরুষাঙ্গকে ভূমি কর্ষণ যন্ত্রস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। জন্মকোষকে বীর্যের বিশ্রাম স্থলরূপে নির্ধারণ করেছেন। সাথে সাথে প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর মধ্যে কামরিপুর প্রেরণা দিয়েছেন এবং তাকে প্রবল করেছেন যেন সহবাসে লিপ্ত হয়ে সন্তানোৎপাদন প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে। এসকল ব্যবস্থাপনা ও যন্ত্রপাতি অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যের সাক্ষ্য দেয়; এবং জ্ঞানীদেরকে এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও সেই উদ্দেশ্য তাঁর প্রিয় রাসূল (দঃ) এর রসনার মারফত পরিষ্কারভাবে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। কেননা, তিনি বলেছেন, "তানাকিছু ওয়া তানাসিলু" অর্থাৎ বিবাহ কর এবং বংশ রক্ষা কর। এ আদেশ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এর পরও যে বিবাহ করে না, কর্ষণ কার্য থেকে বিরত থাকে, জনাবীজ অন্য ভাবে নষ্ট করে। আল্লাহতায়ালা যে সকল যন্ত্রপাতি সৃষ্টি করেছেন তা' বেকার ফেলে রাখে, সে স্বাভাবিক উদ্দেশ্য এবং জ্ঞান ও হিকমতের বিরুদ্ধে চলে যায়। স্বাভাবিক সৃষ্টি দর্শনে যা উপলব্ধি করা যায় এবং এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর যে তাকদীর তদ্বারাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সন্তান উৎপাদন বুঝা যায়। যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিসম্পন্ন এবং যে সুগভীর জ্ঞানের সূক্ষ্ম তত্ত্ব বুঝতে সমর্থ, সে এই তাকদীর লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারে। এজন্যই সন্তানদেরকে প্রথিত করা স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, একাজ আল্লাহর উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ার প্রতিবন্ধক। আল্লাহতায়ালা কিছু বন্ধন দ্বারা যা পূর্ণ করার ইচ্ছে করেন বিবাহিত নর ও নারী তাই পূর্ণ করার চেষ্টা করে। আল্লাহ যা প্রিয় মনে করেন বিবাহ বিমুখ ব্যক্তি তা' নষ্ট করে। মানুষ জীবিত থাকুক। আল্লাহর এই ইচ্ছেকে বহাল রাখার জন্য তিনি মানুষকে পানাহার করার নির্দেশ করেছেন এবং তা' সংগ্রহের জন্য অনুপ্রেরণাও দিয়েছেন। এজন্যই ঋণ গ্রহণ করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, কে আল্লাহকে কর্জে হাসানা দেবে?

        যদি তোমার মনে এরূপ প্রশ্ন জাগে যে, যখন আপনার বর্ণনানুযায়ী বংশ এবং প্রাণ রক্ষা করা আল্লাহতায়ালার নিকট প্রিয় হয়, তাহলেও তা' ধ্বংস করা তাঁর নিকট নিশ্চয়ই প্রিয়। তবে তিনি কেন মৃত্যুর বিধান করলেন? এতে বুঝা যায়, জীবন ও মৃত্যু দুটোই আল্লাহর ইচ্ছের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেননা একথা সর্বজ্ঞাত যে, সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছাধীন এবং আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অভাবমুক্ত। এই অবস্থায় কিভাবে মানুষের মৃত্যু হতে তার জীবনকে অথবা তার বিলুপ্তি হতে তার স্থিতিকে পার্থক্য করা যায় এবং তাঁর ইচ্ছে হতে উভয়কে পৃথক করা যায়?

        পাঠক-পাঠিকা! এ প্রশ্নের উত্তর এই জেনে রাখ যে, একথা বাহ্যতঃ সত্য হলেও এর উদ্দেশ্য বার্থ। কেননা, আমি যা বর্ণনা করেছি তদনুসারে ভাল ও মন্দ, উপকার ও অপকার ইত্যাদি সমস্ত বিষয় আল্লাহর ইচ্ছের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা' অস্বীকার করা যায় না। ভালবাস। ও ঘৃণা পরস্পর বিরোধী হলেও দুটোই আল্লাহর ইচ্ছের বিরোধী নয়। একইভাবে জীবন ও মৃত্যু দুটোই পরম্পর বিরোধী হলেও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। অনেক ইচ্ছাকৃত বিষয়ই নিন্দনীয় এবং অনেক অনিচ্ছাকৃত বিষয়ই পছন্দনীয়। গুনাহ নিন্দনীয় হলেও নিন্দার সহিত তা' কার্যে পরিণত করার ইচ্ছে হয়। নেক কাজ প্রিয় এবং সন্তোষজনক হলেও তা' করবার ইচ্ছে হয় না। আমি বলি না যে, কুফরী ও গুনাহর কার্যপ্রিয় এবং বাঞ্ছিত কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ঐ কাজও ইচ্ছে করে করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, "তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরী ভালবাসেন না। ধ্বংস স্থিতির ন্যায় কিভাবে আল্লাহর প্রিয় অপ্রিয় হওয়ার সম্পর্ক রাখে? হাদীসে কুদছীতে আছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার মুসলমান বান্দার প্রাণ হরণ করতে আমার যে কষ্ট হয়, তদ্রূপ কষ্ট আর কোন ক্ষেত্রেই হয় না। সে মৃত্যুকে অপ্রিয় মনে করা এবং তাকে কষ্ট দেয়া আমি ভালবাসি না; কিন্তু মৃত্যু থেকে অব্যাহতি নেই, মৃত্যু অনিবার্য। আল্লাহর এই বাক্য তাঁর ইচ্ছে এবং উল্লিখিত বিষয় নির্দিষ্ট হওয়ার কথা প্রকাশ করে। আল্লাহ বলেন, "তোমাদের ভিতর আমি মৃত্যুকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছি।" তিনি আরও বলেন, "আমি জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছি।" তিনি আরও বলেন, "আমি তোমাদের ভিতর মৃত্যুকে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি।" তিনি আরও বলেন, "আমি তাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে করি না।" শেষোক্ত আয়াত দুটো পরস্পর বিরোধী নয়; বরং দুটোই সত্য ঘটনা প্রকাশ করে মাত্র। এটাই আল্লাহর ইচ্ছে। ভালবাসা এবং অনিচ্ছার গূঢ় তাৎপর্য প্রকাশ করে ও তার আসল তত্ত্ব বর্ণনা করে তার ভিতর প্রথম বোধগম্য হয় সে সব বিষয়, যার সাথে মানুষের ইচ্ছে, অনিচ্ছে এবং ভালবাসার সম্পর্ক থাকে, আল্লাহর গুণাবলী ও মানুষের গুণাবলীর পার্থক্য এরূপ, যেরূপ আল্লাহর সত্তা ও মানুষের স্থিতির পার্থক্য, মানুষের দেহ ও দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আছে, আল্লাহর তা' নেই, তিনি তা' থেকে পবিত্র। যার দেহ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং স্থানের বালাই নেই। তাঁর সঙ্গে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং স্থানবিশিষ্ট মানুষের তুলনা করা যায় না। এসব নিগূঢ় তত্ত্ব আধ্যাত্মিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে রয়েছে, অদৃষ্টবাদের গুপ্ত বিষয়, যা প্রকাশ করা সিদ্ধ নয়। তাই এ বিষয় আলোচনা সংক্ষেপ করে এখন আমি বিবাহ করা ও না করার পার্থক্যের বিষয় আলোচনা শুরু করব। একটি আদমের বংশ বিলোপ করে, আর অন্যটি আদম থেকে শুরু করে যুগ যুগান্তরের পর আল্লাহর নিকট শেষ হবে। বিবাহ নিষেধকারী আদম বংশ বিলোপ করে সে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার আর বংশধর থাকে না, যদি কাম ও মোহ দমনের উদ্দেশ্যেই বিবাহ হত, তাহলে মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কলেরায় আক্রান্ত হয়েও বলতেন না যে, আমাকে বিবাহ করাও। আমি আল্লাহর সহিত অবিবাহিতাবস্থায় সাক্ষাত করতে চাই না।

        যদি প্রশ্ন করা হয় যে, রোগাক্রান্ত মুআযের কোন সন্তানের আশা না থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁর বিবাহের ইচ্ছে হল? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সঙ্গমের দ্বারা সন্তান জন্মে এবং সঙ্গম কাম ও মোহের প্রেরণারই ফল। অথচ এ ব্যাপারে মানুষের কোন স্বাধীনতা নেই। যার বিবাহ হয়, সে তার কর্তব্য পালন করে এবং অবশিষ্ট কাজ তার স্বাধীন ইচ্ছে থেকে বের হয়। এজন্য খোজা অর্থাৎ নপুংসকের জন্যও বিবাহ উত্তম। কেননা কামভাবের তাড়না তার বেলায় গুপ্ত থাকে, প্রকাশ পায় না। এমনকি যার অণ্ডকোষ ফেলে দেয়া হয়েছে। যার সন্তান হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তারও বিবাহ করার আকাঙক্ষা বহাল থাকে।

         দ্বিতীয় উদ্দেশ্যঃ বিবাহ বন্ধন দ্বারা হুযুরে পাক (দঃ)এর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা হয় এবং তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর উত্থত বৃদ্ধিয় চেল্লা করা হয়। কেননা রাসুলে করীম (দঃ) তাঁর উন্মত বৃদ্ধির জন্য রোজ কিয়ামতে গৌরব করবেন কবিবাহই সেই উদ্দেশ্য সাধনের প্রধান উপায়। হুযুরে পাক (দঃ) স্পষ্ট ভাবেই তা' বলেছেন। হযরত ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বহু বিবাহ করেছিলেন। তিনি বলতেন যে, আমি সন্তান কামনায় বিবাহ করি। বন্ধ্যা স্ত্রীলোকদের প্রতি হাদীস শরীফে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ঘরের কোণে অবস্থিত কারাগৃহ সন্তানহীনা নারী অপেক্ষা ভাল। তিনি আরও বলেছেন, তোমাদের নারীদের মধ্যে বহু সন্তান প্রসবিনী প্রেমিকা রমণী উত্তম। তিনি আরও বলেছেন, সন্তান প্রসবিনী কুরূপা রমণী সন্তানহীনা (বন্ধ্যা) রূপসী রমণী হতে উত্তম। হাদীসসমূহের মর্ম দ্বারা বুঝা যায়, বিবাহের মূল উদ্দেশ্য সন্তান লাভ, প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা নয়। তারপর চরিত্র রক্ষা, চক্ষুর কুদৃষ্টিরোধ এবং কামরিপু দমন করার জন্য বিবাহ হল মূল রক্ষা ব্যবস্থা।

        তৃতীয় উদ্দেশ্যঃ মৃত্যু কালে কেউ ধার্মিক সন্তান রেখে গেলে মৃত্যুর পরে ঐ সন্তান মৃত পিতার জন্য সে দোয়া করতে পারে এবং তাতে ছওয়াব অর্জিত হয়। হাদীস শরীফে আছে, আদম সন্তানের তিনটি কাজ ছাড়া সকল কাজই নিঃশেষ হয়ে যায়। হুযুরে পাক (দঃ) ঐ তিনটি কাজের মধ্যে ধার্মিক সন্তান রেখে যাওয়াকেও অন্যতম ধার্য করেছেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মৃত ব্যক্তির নিকট দোয়া একটি আলোর স্তবকের ন্যায় উপস্থিত করা হয়। কেউ এরূপ বলেছেন যে, বহুক্ষেত্রেই সন্তান ধার্মিক হয় না ও তার দ্বারা কোন উপকার লাভ হয় না। তবে ধার্মিক মুসলমানের সন্তানগণ সাধারণতঃ ধার্মিক হয়ে থাকে। যখন পিতা তাকে শিক্ষাদান এবং ধর্মপরায়ণ করার জন্য কৃতসঙ্কল্প হয়। সার কথা এই যে, পিতা-মাতার জন্য মুমিন সন্তানের দোয়া খুবই উপকারী। চাই সন্তান ধর্মভীরু হোক, গুনাহগার হোক, তার দোয়া ও সৎকাজের ফল তার পিতা-মাতা পেয়ে থাকে। কেননা সে পিতা-মাতারই উপার্জিত সম্পদ। অবশ্য সন্তানের গুনাহর জন্য পিতা-মাতার ফল ভোগ করতে হয় না। কেননা একের বোঝা অন্যের মাথায় চাপানো আল্লাহর বিধান নয়। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, "তাদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে যুক্ত করে দেব এবং সন্তানদের মন্দকাজের জন্য তাদের কোন অনিষ্ট হবে না, (তবে) তাদের সন্তানদের নেক আমলের জন্য তাদের নেক আমল (ও) বৃদ্ধি পাবে।"

        চতুর্থ উদ্দেশ্যঃ পিতার পূর্বে সন্তানের মৃত্যু হলে পুত্র পিতার জন্য সুপারিশ করবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেন, সন্তান তার পিতা-মাতাকে বেহেশতের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, সন্তান পিতা-মাতার বস্ত্র ধরে টেনে নিয়ে যাবে, যে রূপ আমি তোমাদের বস্ত্র ধরে আকর্ষণ করি। হুযুরে পাক (দঃ) এক হাদীসে বলেছেন, সন্তানকে বলা হবে, তুমি বেহেশতে যাও। সে তখন বেহেশতের দরজায় উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত রাগান্বিত ভাবে বলবে, আমার পিতা-মাতা ব্যতীত আমি বেহেশতে প্রবেশ করব না। তখন আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ করা হবে, ঐ সন্তানের সহিত পিতা-মাতাকেও বেহেশতে প্রবেশ করাও। অপর এক হাদীসে আছে, শিশু সন্তানগণও অন্যান্য লোকের ন্যায় বিচার স্থলে উপস্থিত হবে। ফিরেশতাদেরকে বলা হবে, এসকল শিশুকে বেহেশতে নিয়ে যাও। কিন্তু তারা গিয়ে বেহেশতের দরজায় অপেক্ষা করতে থাকবে। তখন তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হবে, মুসলিম শিশুসন্তানদেরকে স্বাগতম (অভ্যর্থনা) জানাচ্ছি। তোমরা ভিতরে প্রবেশ কর। তোমাদের কোন হিসেব নেই। তখন তারা বলবে, আমাদের পিতা-মাতা কোথায়? বেহেশতের দারোয়ান বলবে, তারা ত তোমাদের মত নয়। তাদের যে গুনাহ এবং দোষত্রুটি আছে, এজন্য তাদেরকে ডেকে তাদের থেকে হিসেব-নিকেশ গ্রহণ করা হবে। তাদের বিচার করা হবে। এ কথা শুনে শিশুগণ বেহেশতের দরজায় শোরগোল শুরু করে দেবে। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, এত চেচামেচি কিসের? ফিরেশতাগণ বলবে, হে মাবুদ! মুসলমান শিশু সন্তানগণ বলছে যে, তারা তাদের পিতা-মাতাকে ফেলে বেহেশতে যাবে না।

        তখন আল্লাহ তায়ালা ফিরেশতাদেরকে বলবেন, তোমরা এদের পিতা-মাতাকে তাহলে মুক্ত করে দাও, যেন এরা তাদেরকে হাত ধরে বেহেশতে নিয়ে যেতে পারে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যার দুটি শিশুসন্তানের মৃত্যু হয়েছে সে দোযখ থেকে নাজাত পেয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, যার তিনটি নাবালেগ সন্তানের মৃত্যু হয়েছে, আল্লাহ তার অপার করুণা গুণে তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। দুটি নাবালেগ সন্তানের মৃত্যু হলেও কি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে? তিনি বললেন, হাঁ দুটি নাবালেগ সন্তানের মৃত্যু হলেও।

        একটি বিবরণে জানা যায়, জনৈক ধার্মিক ব্যক্তিকে লোকগণ বিবাহের জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু তিনি সহসা সে অনুরোধ রক্ষা না করে অপেক্ষা করলেন। কিছুদিন পরে একদা ঘুম থেকে উঠেই তিনি বললেন, আমি বিবাহ করব। আমি বিবাহ করব। লোকগণ তাকে বিবাহ করিয়ে দিল। লোকগণ তাকে হঠাৎ এভাবে তার বিবাহ করার ইচ্ছে হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, আল্লাহ হয়ত আমাকে একটি সন্তান দান করবেন এবং হয়ত বা তিনি তার আমার পূর্বেও মৃত্যু ঘটাতে পারেন। যাতে সে আখেরাতে আমার অগ্রবর্তী হতে পারে। তিনি আরও বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, কিয়ামত এসে গেল। আমি সব লোকের সহিত পেরেশানীর মধ্যে আছি। তৃষ্ণায় আমার কণ্ঠতালু শুষ্ক হয়ে গেছে। অন্যান্যদের অবস্থাও একইরূপ। আমাদের সবারই এই অবস্থা যখন ভীষণতর হয়ে চলল, তখন কতিপয় শিশু আমাদের মধ্যে প্রবেশ করল। তাদের হাতে নূরের রুমাল ছিল। স্বর্ণ ও রৌপ্যের পিয়ালা ছিল। তারা একেকজনে আমাদের একেকজনকে পানি পান করাল। কিন্তু আমাদের অনেককেই তারা পানি পান করাল না। আমি শিশুদের একজনের দিকে হস্ত প্রসারিত করে বললাম, আমাকেও একটু পানি পান করাও। আমি তৃষ্ণায় অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু সে আমাকে বলল, আমাদের মধ্যে তোমার সন্তান নেই। আমরা শুধু যে যার পিতা-মাতাকে পানি পান করাচ্ছি। আমি বললাম, তোমরা কাদের সন্তান? সে শিশুটি বল্ল, আমরা মুসলমানের সন্তান। আমাদের শৈশবেই মৃত্যু হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালার নিম্নোক্ত আয়াতেই এই বিষয়টির মর্ম রয়েছে। যথাঃ আল্লাহ বলেনঃ “ফা'তু হারছাকুম আন্না শি'তুম অধাদিমু লিআনফুসিকুম," অর্থাৎ যখন তোমাদের ইচ্ছে হয় তখন তোমাদের ক্ষেত্রের নিকট আস এবং তোমাদের জন্য অগ্রবর্তী কর।

        উপরোক্ত চারটি বিষয় দ্বারা পরিষ্কার বুঝা গেল যে, সন্তানের জন্যই বিবাহের অধিকাংশ ফায়েদাহ ও ফজীলত নিহিত।

Post a Comment

0 Comments