স্বামীর তার স্ত্রীর হায়েজ নিফাসকালীন কী করবে

 স্বামীর  কর্তব্যসমূহ পর্ব-৩


 

        (৬) যষ্ঠ কর্তব্যঃ স্বামী স্ত্রীকে মধ্যম অবস্থার খোরপোষ দেবে বরং এ ব্যাপারে কিছুটা সংকুচিত অবস্থা বজায় রাখা উত্তম। অতিরিক্ত খরচ করা কোনক্রমেই গ্রহণযাগ্য নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "কুলু অশরাবু অলা ভুসরিফু" অর্থাৎ তোমরা পানাহার কর এবং অপব্যয় করো না। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, "খাইরুকুম খাইরুকুম লি আহলিহী" অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীদের জন্য সর্বোত্তম। হযরত আলী (রাঃ)এর চারটি কন্যা ছিল, তিনি তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রতি চারদিনে এক দেরহাম মূল্যের গোশত ক্রয় করে দিতেন। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেন যে, পূর্ব যুগের বুযর্গদের মধ্যে যারা সচ্ছল অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন, তারা জীবনযাপন ব্যাপারে মধ্যম অবস্থা অবলম্বন করে চলতেন। হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক পুরুষের জন্য মুস্তাহাব এই যে, প্রতি সপ্তাহে একবার পরিবারবর্গের জন্য ফালুদা (অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চলীয়দের জন্য একপ্রকার বিশেষ খাদ্য) ব্যবস্থা করে দেবে। তবে কোনরূপ মিঠাই-মন্ডার আবশ্যকতা নেই। অবশ্য তা' একেবারেই বর্জন করা কার্পণ্যের লক্ষণ। গৃহস্বামীর জন্য উচিত যে, সে নিজ স্ত্রীকে বলে দেবে, পরিবারের প্রয়োজনের পর যে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে তা' গরীব মিসকীনকে বিতরণ করবে। এটা ছদকাহ ও খয়রাতের নিম্নতম পর্যায়। স্ত্রীলোকদের জন্য জায়েয রয়েছে যে, এগুলো সে স্বামীর প্রকাশ্য অনুমতি ব্যতিরেকেও গরীব দুঃখীকে দান করতে পারে। 

        গৃহস্বামীর উচিত যে, সে নিজে যে সকল উত্তম ও উপাদেয় খাদ্য আহার করবে পরিবারের অন্য লোকদেরকেও তাতে শরীক করবে। তার জন্য' এটা উচিত, হবে না যে, সে ঘরের কর্তা বলে একাই উত্তম খাদ্য খাবে আর পরিবারের অন্যান্য, লোক মামুলি খাদ্য খাবে। এ কাজটি গৃহবাসীদের পরস্পরের মধ্যে নিবিঢ় বন্ধন ছিন্ন করার কারণ এবং এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে সম্ভাব-সম্প্রীতিও বিঘ্নিত হতে পারে। তবে যদি বিশেষ কারণে গৃহস্বামীর কিছুটা স্বতন্ত্র ও বিশেষ খাদ্য গ্রহণের প্রয়াজনীতা দেখা দেয়, তাহলে যেন তার একাকী পানাহার করার সুব্যবস্থা থাকে এবং এতে গোপনীয়তা রক্ষা করাও উত্তম। উত্তম নিয়ম হল, গৃহবাসীগণ সকলে একসাথে একস্থানে বসে খাবে। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহতায়ালা এরং তাঁর ফিরেশতাগণ সেই গৃহবাসীদের উপর রহমত বর্ষণ করেন, যারা একস্থানে একসাথে বসে পানাহার করে।

        পরিবারের খোরপোষের ক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা চাই, তা' হল স্বামী স্ত্রীকে নিজের হালাল উপার্জন দ্বারা তার খোরপোষ দান করবে।

        (৭) সপ্তম কর্তব্যঃ স্বামীর অন্যতম কর্তব্য হল স্ত্রীকে হায়েজ নিফাসকালীন কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দান করা। হায়েজ নিফাসকালে কোন কোন বস্তু থেকে তাকে বিরত থাকতে হবে স্ত্রীর তা' জানা না থাকলে স্বামী তাকে তা' উত্তমরূপে শিখিয়ে দেবে। তাছাড়া নামাযের যাবতীয় মাসয়ালা মাসায়েলও শিক্ষা দান করবে। বিশেষতঃ হায়েজ নিফাসকালে নামায সম্পর্কে নারীদের জন্য কি হুকুম রয়েছে তা' ভালরূপে জানিয়ে বুঝিয়ে দেবে। কেননা, পবিত্র কুরআনে পুরুষদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে যে, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ স্ত্রীদেরকে দোযখের অগ্নি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। যেমন এরশাদ হয়েছে, "বু আনফুসাকুম অ আহলীকুম নারা" অর্থাৎ তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখ। এজন্যই পুরুষদের উচিত, যেন অবশ্যই তারা স্ত্রীলোকদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদাহ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে দেয়। যদি কারও স্ত্রী কোন বেদআত কার্যে অভ্যস্ত থাকে তাহলে তা' তার থেকে দূর করে দেবে। যদি স্ত্রী দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন থাকে তাহলে তাকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়ে সতর্ক এবং সন্ত্রস্ত করে দেবে। তাছাড়া হায়েজ নিফাস এবং এস্তেহাজা (অর্থাৎ রোগরক্ত) সম্পর্কিত মাসয়ালা মাসায়েল সমূহ শিক্ষা দান করবে। মাসয়ালা মাসায়েল জানার জন্য স্ত্রীগণ আলিমের কাছে যাবে না। তবে স্বামী নিজে যদি এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ হয় তাহলে সে কোন বিজ্ঞ আলিম অথবা মুফতীর কাছ থেকে মাসয়ালা জেনে এসে স্ত্রীকে বাতিয়ে দেবে কিন্তু সাবধান! স্ত্রী নিজে যেন কখনও মাসয়ালা জানার জন্য ঘরের বাইরে না যায়। এটা কোনক্রমেই তার জন্য জায়েয হবে না। তবে যদি একাজ স্বামীর দ্বারা কোনক্রমেই সম্ভব না হয় তাহলে স্ত্রীর জন্য যথারীতি পর্দা রক্ষা করে মাসয়ালা জানার জন্যে ঘরের বাইরে যাওয়া জায়েয বরং ওয়াজিব হবে। কিন্তু তখন যদি স্বামী তা' নিষেধ করে তাহলে সে গুনাহগার হবে। আর যদি স্ত্রী ফরজ অর্থাৎ একান্ত আবশ্যকীয় মাসয়ালাগুলোতে ওয়াকিফ থাকে তাহলে অন্যান্য মাসয়ালাসমূহ জানার জন্য কোন ওয়াজের মজলিস অথবা আলিমের দরবারে স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে গমন করবে না। এক্ষেত্রে উত্তম নিয়ম এই যে, স্ত্রী যদি হায়েজ এবং এস্তেহাজা সম্পর্কিত শরীয়তের হুকুম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকে এবং এজন্য সে শরীয়ত অনুযায়ী আমল না করে এবং স্বামীও তাকে সে বিষয়টি শিক্ষা না দেয় তাহলে সে উক্ত হুকুম জানার জন্য স্ত্রীর সাথে গমন করবে। নতুবা সেও স্ত্রীর সহিত গুনায় শরীক হবে।

        (৮) অষ্টম কর্তব্যঃ যদি কোন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকে তাহলে তাদের মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠা বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে এক স্ত্রীর তুলনায় অন্য স্ত্রীর দিকে কোনক্রমেই বেশী ঝুঁকে পড়বে না। এমতাবস্থায় প্রয়োজনবশতঃ যদি স্বামীর প্রবাস গমন করতে হয় এবং স্ত্রীদের মধ্যে কোন একজনকে সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে কোরা ডেলে যে স্ত্রীর নাম উঠে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমাদের নবী (দঃ) এরও এরূপ অভ্যাস ছিল। হাঁ তবে যদি কোন স্ত্রী তার নিজের দাবী অন্য স্ত্রীর পক্ষে ছেড়ে দেয়, তাহলে সে কথা ভিন্ন। একাধিক স্ত্রী বর্তমান থাকলে তাদের মধ্যে ইনসাফ অর্থাৎ ন্যায়নিষ্ঠা বজায় রাখার মাসয়ালা মাসায়েল এবং হুকুম আহকামগুলো পুরুষের জন্য অবশ্যই জেনে নেয়া চাই। 

        বর্ণিত রয়েছে যে, একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে দান-দক্ষিণা এবং রাত্রিবাস ইত্যাদি ক্ষেত্রেই সকলের মধ্যে ইনসাফ এবং সমতা রক্ষা করা ওয়াজিব। কিন্তু আন্তরিক আকর্ষণ, আন্তরিক ভালবাসা ও সাহচর্যের ক্ষেত্রে ওয়াজিব নয়, কেননা মানুষের মনের ব্যাপার তার অধিকারে নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "অ লান তাসতাত্ত্বীউ আন তা'দিলু বাইনান নিসায়ী---" অর্থাৎ নিশ্চয় তোমরা সমর্থ হবে না যে, স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা কর। 

        অর্থাৎ হৃদয়ের আকর্ষণ এবং অন্তরের ভালবাসার মধ্যে ইনসাফ এবং সমতা রক্ষা করা তোমাদের ক্ষমতার বাইরে। হুযুরে পাক (দঃ) তার স্ত্রীগণের মধ্যে খোরপোষ দান এবং তাঁদের সহিত রাত্রিবাস বা ছোহবতের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করতেন এবং বলতেন, হে মাবুদ! যে বিষয় আমার সাধ্যের আয়ত্তে, সে বিষয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু যা আমার সাধ্যের বাইরে, যার মালিক তুমি, সে ক্ষেত্রে, যেমন আন্তরিক আকর্ষণ, ভালবাসা ইত্যাদির ব্যাপারে ত আমার কোন হাত নেই। হযরত আয়েশা (রাঃ) এর প্রতি অন্যান্য স্ত্রীদের তুলনায় হুযুরে পাক (দঃ) এর আকর্ষণ অধিক ছিল এবং প্রত্যেকেরই সে কথা জানা ছিল। তাঁর জীবনের শেষ রোগ অবস্থায়ও তিনি প্রত্যেক স্ত্রীর গৃহে রাত্রি যাপন করতেন এবং রাত্রে তিনি বলতেন, প্রত্যুষে আমি কোথায় থাকব? হুযুরে পাক (দঃ)এর অন্যতমা স্ত্রী বুঝতে পারলেন যে, হুযুর (দঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)এর পালা কবে, তাই জানতে চাচ্ছেন। তখন সমস্ত বিবিগণ একমত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমরা সবাই অনুমতি দিলাম, আপনি হযরত আয়েশা (রাঃ) এর গৃহে অবস্থান করুন। তাঁদের কথা শুনে তিনি বললেন, এ ব্যাপারে সবাই কি রাজী আছে? তারা বললেন, হাঁ আমরা সবাই রাজী আছি। তখন তিনি বললেন আমাকে আয়েশার ঘরে নিয়ে চল।

         যদি কোন স্ত্রী তার নিজের হক অন্যের পক্ষে সোপর্দ করে দেয় তবে ঐ হক তারই সাব্যস্ত হয়ে যায়। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) উম্মুল মু'মিনীন সাওদাহ (রাঃ)এর বয়োধীক্যজনিত কারণে তাঁকে তালাক দেয়ার ইচ্ছে করেছিলেন। তখন হযরত সাওদাহ (রাঃ) তাঁর অংশের পালা হযরত আয়েশা (রাঃ)কে দান করলেন এবং হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আবেদন জানালেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আপনি আমাকে তালাক দেয়া থেকে বিরত থাকুন। তাহলে রোজ কিয়ামতে আপনার বিবিদের দলের সহিত আমার হাশর হওয়ার ভাগ্য হত। তখন হুযুরে পাক (দঃ) হযরত সাওদাহ (রাঃ) এর আবেদন মঞ্জুর করলেন। এরপর থেকে হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আয়েশার (রাঃ) গৃহে দু'রাত করে ও অন্যান্য প্রত্যেক স্ত্রীর গৃহে এক রাত করে অবস্থান করতেন। 

Post a Comment

0 Comments