তৃতীয় অপকারঃ এ অপকার প্রথম এবং দ্বিতীয় অপকার থেকে অপেক্ষাকৃত কম ব্যাপক। তা' হল আল্লাহর স্মরণ থেকে পরিবাববর্গ ও সন্তান-সন্ততিগণকে বিমুখ করে রাখা, তাদেরকে পার্থিব বিষয়বস্তুতে উৎসাহিত করা, সন্তানদের জন্য জীবিকার্জনের উত্তম তদবীর করা, বেশী পরিমাণে ধন-সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করা, পরস্পর অহংকার ও গৌরব অন্বেষণ করা। মোট কথা ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি প্রভৃতি যা-ই আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে, তা-ই মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ। এ সকল বস্তু নিষিদ্ধ বিষয়ের দিকে আকর্ষণ করে। এটা প্রথম ও দ্বিতীয় অপকারের অন্তর্গত। এসকল বস্তু সিদ্ধ হলেও স্ত্রী-পুত্র ও সন্তান-সন্ততি তা' উপভোগ করার উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়; বরং আমার মতে স্ত্রীর সাথে আমোদ-প্রমোদে নিমগ্ন থাকা, কৌতুকরত থাকা, তাকে ভোগ্যবস্তুরূপে ব্যবহার করা বিবহরই ফল। এরূপ বিবাহ মানুষের মনকে দিবানিশি একমুখী করে রাখে, যা মানুষকে আখেরাতের বিষয় চিন্তা করতেও অবসর দেয় না। এজন্যই হযরত ইবাহীম বিন আদহাম (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি নারীর কোমর ধরে বসে থাকে, তার কোন কিছুই হয় না। হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন, যে বিবাহ করে, সে দুনিয়ার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবাহের মধ্যে নিহিত রয়েছে। তবে এ সত্যি যে, বিবাহ করা ব্যক্তিগত ব্যাপার। বিবাহ করা উত্তম কি অনুত্তম সে সম্পর্কে মোটামুটিভাবে কিছু বলা যায় না। তবে উল্লিখিত উপকার ও অপকার উপদেশমূলক ও পথ নির্দেশক বৈ কি। এগুলো দ্বীনের পথের যাত্রীদের সামনে বিদ্যমান। যদি কেউ উক্ত বিপদসমূহকে লক্ষ্য করে সতর্ক থাকে এবং উপকারগুলো অর্জন করে অর্থাৎ হালাল মাল উপার্জন করে, সৎস্বভাবে বিভূষিত হয় এবং দ্বীনকে পূর্ণ করে, তবে বিবাহ তাকে আল্লাহ থেকে দূরে রাখতে পারে না, যদিও সে যুবক হয়। তার কামপ্রবৃত্তি শান্ত করার প্রয়োজন হয়। তার গৃহকর্মের তদবীরের দরকার করে ও আত্মীয়- স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। তবে নিঃসন্দেহে তার বিবাহ করা উত্তম বরং প্রয়োজন। আর যদি উল্লিখিত উপকারগুলোর প্রয়োজন না হয় এবং বিপদগুলোর মধ্যে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকে তাহলে তার বিবাহ না করাই উত্তম। আর যদি কোন ব্যক্তি দুই বিষয়েরই সম্মুখীন হয় এবং সে তার উপর প্রাধান্য লাভ করতে পারে, তখন ন্যায়ের পাল্লায় তার ধর্মের উপকারগুলো ও আপদ-বিপদগুলো ওজন করা চাই। তারপর যখন যেটি ভারী হয়, তখন তার নির্দেশ পালন করবে এবং তখন সন্তানের উপকার এবং কামশক্তি শান্ত হওয়ার উপকার প্রকাশ পাবে। হারাম রুজী অর্জন এবং আল্লাহ হতে বিচ্যুতির প্রয়োজনও প্রকাশ হয়ে পড়বে। এসকল বিষয়ের সম্মুখীন হওয়া তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। যার কামপ্রবৃত্তির দ্বারা অনিষ্টের আশংকা নেই যার শুধু সন্তান অর্জনের জন্য চেষ্টা করাই বিবাহের উপকার, যার হারাম রুজী অর্জনের আবশ্যকতার বিপদ এবং আল্লাহ হতে গাফেল থাকার বিপদ দেখা যায়, তার অবিবাহিত অবস্থায় থাকাই উত্তম। আল্লাহর স্মরণে অবহেলা করে যে কোন কাজ করা যায়, তা' অমঙ্গলকর, হারাম রুজী অর্জনে মঙ্গল নেই। এ দুই বিপদের ক্ষতি শুধু সন্তান অর্জনের উপকার দ্বারা পূরণ হয় না। সন্তান লাভোদ্দেশ্যে বিবাহ করলে সন্তানের জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে চিন্তালিপ্ত হতে হয়। এটা দ্বীন রক্ষার দিক থেকে বিশেষ ক্ষতিকর। নিজের জীবন রক্ষা করা ও ধ্বংস থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা সন্তান অর্জনের কষ্টবরণ থেকে অধিক প্রয়োজনীয়। এটাই হল দ্বীন-সম্পদের মূল। দ্বীন নষ্ট হলে পারলৌকিক জীবন ব্যর্থ হবে এবং দ্বীন-সম্পদের মূল বিনাশ হবে। সন্তানের উপকারের জন্য এ দুই বিপদের একটিরও সম্মুখীন হওয়া যায় না।
হাঁ তবে যদি সন্তান অর্জনের সহিত কামরিপু দমনেরও প্রয়োজন হয়, তাহলে বিবাহ করা উচিত। যদি আল্লাহ-ভয়ের লাগাম দৃঢ়ভাবে ধরা না থাকে এবং ব্যভিচার লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তার পক্ষে বিবাহ করাই প্রয়োজন এবং উত্তম। ব্যভিচার করা ও হারাম রুজী অর্জন করা এ দুটোর মধ্যে কোনটি অধিকতর সহজ, তা' চিন্তা করবে। যদি কারও দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, সে ব্যভিচারের গুনায় লিপ্ত হবে না, কিন্তু শুধু হারামের প্রতি চক্ষু বন্ধ রাখতে সে অসমর্থ, তাহলে তার বিবাহ না করাই উত্তম। কারণ হারামের প্রতি দৃষ্টি হারাম এবং হারাম' রুজীও হারাম। জীবিকা-রুজীর প্রয়োজন অনত্বরত এবং হারাম রুজীতে তার নিজের ও তার পরিবারবর্গের গুনাহ হয়। আর দৃষ্টি তার নিজস্ব। তা' কখনও কখনও বিশেষ কোন স্ত্রীলোকের উপর পড়ে। এ দৃষ্টিতে চক্ষুর ব্যভিচার হয় বটে, কিন্তু যদি গুপ্ত অঙ্গ তা' বাস্তবে পরিণত না করে, তবে তা' হারাম অর্জন এবং হারাম ভক্ষণ অপেক্ষা অধিক নিকটবর্তী। তবে যদি দৃষ্টি গুপ্তাঙ্গের গুনাহে পরিণত হওয়ার আশংকা থাকে, তাহলে ব্যভিচারের গুনাহর দিকে চলে যায়। তখন একটি তৃতীয় অবস্থা হয়। অর্থাৎ দৃষ্টি বন্ধ করার শক্তি থাকলেও হৃদয়ের চিন্তা দূরীভূত করার উপায় থাকে না। এ অবস্থায়ও বিবাহ ত্যাগ করা উত্তম। কেননা হৃদয়ের আমল ক্ষমার অধিক নিকটবর্তী। বাজে চিন্তা থেকে মন খালি হওয়ার অর্থ ইবাদাতের জন্য মন খালি হওয়া। হারাম অর্জন দ্বারা হারাম ভক্ষণ করা হয়। তাতে ইবাদাত সম্পূর্ণ হয় না।
এভাবে বিবাহের উপকার অপকার ন্যায়ের পাল্লায় মেপে সব কাজ করা চাই। যে ব্যক্তি এই নির্দেশ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, তার পক্ষে কিছুই কষ্টকর নয়। বিভিন্ন অবস্থানুসারে তার কার্যের উৎসাহ বৃদ্ধি পায়। যে ব্যক্তি পবিত্র এবং নিরাপদ থাকতে পারে, আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তার বিবাহিত অবস্থায় থাকা বা বিবাহ ব্যতীত থাকা উত্তম? এই প্রশ্নের উত্তরে বলব যে, এই অবস্থায় আল্লাহর ইবাদাতের জন্য দুটি বিষয় একত্র হওয়া আবশ্যক। বিবাহ আল্লাহর ইবাদাতের জন্য নিষিদ্ধ নয়। যদি কারও হালাল জীবিকা অর্জনের ক্ষমতা থাকে, তখন বিবাহ উত্তম। কেননা রাত্রি ও দিবসের অবশিষ্ট সময় সে ইবাদাতে লিপ্ত হতে পারে। ইবাদাতের কর্তব্যাবলীর অনুষ্ঠান বিশ্রাম ব্যতীত সম্ভব নয়। যদি একথা মেনে নেয়া হয় যে, তার সমস্ত সময় ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য ব্যয় করা হয়, এমনকি ফরজ নামায, নিদ্রা, আহার, মল-মূত্র ত্যাগের সময় ব্যতীত তার আর সময় অবশিষ্ট থাকে না এবং সে এমন লোকের অন্তর্ভুক্ত হয়, যারা নফল নামায, হজ্জ এবং শারীরিক এরূপ ধর্মানুষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য আখেরাতের পথে ভ্রমণ করতে সময় পায় না। তার জন্য বিবাহ উত্তম। এর কারণ হল, হালাল রুজী অর্জন এবং সন্তান অর্জনের জন্য পরিশ্রম করা, পরিবারবর্গের জন্য, পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টা করা, স্ত্রীলোকের মন্দ ব্যবহারে ধৈর্য ধরে থাকা ইবাদাতেরই বিভিন্ন রূপ। এর ফজীলত নফল ইবাদাতসমূহের ফজীলতের চেয়ে কম নয়। যদি তার ইবাদাতে জ্ঞানার্জন, সৎচিন্তা ও অন্তর চালনা থাকে এবং রুজী অর্জনেরও চেষ্টা থাকে, তবে তার পক্ষে বিবাহ করাই শ্রেয়।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, এই অবস্থায় যদি বিবাহ করা উত্তমই হয়ে থাকে, তবে হযরত ঈসা (আঃ) এরূপ ফজীলত সত্ত্বেও বিবাহ ত্যাগ করলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, যদি বিবাহ ত্যাগ করা উত্তম হয় তাহলে আমাদের নবী (দঃ) বহু বিবাহ কেন করলেন? পাঠক- পাঠিকা! জেনে রাখ, যে ব্যক্তির শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য অধিক, যার সাহস বেশী, উল্লিখিত বিপদ-আপদ অর্থাৎ বিবাহজনিত অসুবিধাগুলো তাকে আল্লাহ হতে উদাসীন করতে পারে না। বলাবাহুল্য, রাসূলে করীম (দঃ)এর শক্তি-সামর্থ্য ও সাহস অত্যধিক এবং উচ্চপর্যায়ের ছিল। এজন্যই ইবাদাত ও বিবাহের ফজীলত এ দু-এর সমন্বয় সুদৃঢ়রূপে ছিল। তাঁর কখনও একই সাথে নয়জন স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তাঁর মন সদা উন্মুক্ত ছিল। যেমন দুনিয়ার বড় বড় শাসনকর্তাদের মলমূত্র ত্যাগের জন্য কিছু সময় অতিবাহিত হলেও পার্থিব শাসন ব্যাপারে কোন ক্ষতি দেখা দেয় না। তদ্রূপ বিবাহ দ্বারা তাঁর প্রয়োজন পরিপূর্ণ হলেও তা' তাঁর ইবাদাতের প্রতিবন্ধক ছিল না। সাধকগণ প্রকাশ্যভাবে পার্থিব ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতেন কিন্তু তাঁদের মন সর্বদা আল্লাহর ধ্যানে ও চিন্তায় মগ্ন থাকত। তাঁদের কর্তব্য কার্য হতে তাঁরা বিন্দু মাত্রও অন্যমনস্ক থাকতেন না। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর সর্বোত্তম পদমর্যাদা ও ফজীলত থাকা নির্ধারিত সত্ত্বেও পার্থিব কাজকর্ম আল্লাহর স্মরণ হতে তাঁকে বিন্দুমাত্রও বিচ্যুত করতে পারে নি। এমনকি তিনি তার স্ত্রীর শয্যায় থাকা কালেও তাঁর উপর অহী অবতীর্ণ হত। তিনি ব্যতীত অন্য কারও ভাগ্যে এই পদগৌরব রয়েছে? যা গভীর সাগর পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়, তাঁকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী নালা ও খালের পক্ষে পরিবর্তন করা সুদূর পরাহত। অন্যের ক্ষেত্রে এই অবস্থা অনুমানই করা যায় না। হযরত ঈসা (আঃ) ধৈর্য্যের সহিত তা' অবলম্বন করেছিলেন। এক্ষেত্রে শক্তি বা সামর্থ্যের কথা নয়। তাঁর স্ত্রী থাকলে হয়তো সংসারে লিপ্ত হতেন। হয়ত বা তিনি হালাল রুজী অন্বেষণের জন্য ব্যস্ত থাকতেন অথবা ইবাদাতের জন্য তাঁর মন নির্লিপ্ত করা সহজ হতো না। এজন্যই তিনি সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ও খালেছ ইবাদাত পছন্দ করেছিলেন। নবীগণ নিজেদের গুপ্ত অবস্থা সম্পর্কে, নিজেদের সময়ের হালাল জীবিকা অর্জন সম্বন্ধে এবং নারীদের চরিত্র সম্বন্ধে সবিশেষ জ্ঞানী ছিলেন। বিবাহিত লোকের বিবাহের ফলে কি আপদ-বিপদ উপস্থিত হতে পারে, বিবাহে কি উপকার ও অপকার আছে, বিভিন্ন লোকের বিভিন্নাবস্থার তারতম্যে কিরূপ অবস্থার বিভিন্নতা ঘটে। এমনকি কার জন্য বিবাহ উত্তম এবং কার জন্য অনুত্তম এসব বিষয় তাঁরা সবিশেষ অবহিত ছিলেন। মোটকথা, নবীদের কার্যাবলী সর্বাবস্থায়ই উত্তম। আল্লাহ তায়ালাই এ বিষয় সর্বাধিক জ্ঞাত।
0 Comments