সুরা আল ফীলে তফসীর

মক্কায় অবতীর্ণ-পবিত্র কোরআনের সূরার ক্রমিক নং-১০৫

        শানে নযুল ও সংক্ষিপ্ত আলোচ্য বিষয়ঃ-এই সূরার প্রথম আয়াতের শেষ শব্দটি আল ফীল। এই শব্দ থেকে 'ফীল' শব্দটিকেই এই সূরার নাম ম হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আল্লাহর কোরআনের সমস্ত গবেষক এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এই সূরাটি মক্কায় নবুওয়াতের প্রাথমিককালে অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম সূরা। আল্লাহর রাসূলের নবুওয়াত তথা তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের প্রতি মক্কার ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী যখন বিরোধিতা করছিল, তখন এই সূরা অবতীর্ণ হয়।

        হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামের অনুসারীদের ওপর নাজরানে ইয়েমেনের ইহুদী শাসক যুনাওয়াস অত্যাচারের যে স্টীম রোলার চালিয়েছিল, তার প্রতিশোধ হিসাবে হাবশা বর্তমানে আবিসিনিয়ার খৃষ্টান শাসক ইয়েমেনের ওপর আক্রমণ করে হেমইয়ারী শাসনের পতন ঘটিয়েছিল। এরপর থেকেই ঐ এলাকায় ৫২৫ খৃষ্টাব্দেই হাবশীদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে রোমান সরকার তাদেরকে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা করেছিল। তদানীন্তন হাবশী সরকারের কোন নৌবাহিনী ছিল না, এ জন্য তারা রোমানদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের নৌবাহিনী ব্যবহার করে নিজেদের প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য ইয়েমেনের উপকূলে নামিয়ে দিয়েছিল। পূর্ব আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশ ও রোমান প্রভাবিত এলাকার মধ্যে যে ব্যবসায়ের ওপর শত শত বছর ধরে আরবদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা খর্ব করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই ছিল হাবশা ও রোমান সরকারের উদ্দেশ্য।

        রোমানরা নিজেদের নৌবাহিনীকে লোহিত সাগরে নামিয়ে দিয়ে আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্য অচল করে দিয়েছিল এবং আরবদের জন্য তখন কেবলমাত্র স্থলপথ ইয়েমেনের মধ্য দিয়ে মুক্ত ছিল। এই স্থলপথও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোমানরা হাবশার খৃষ্টান সরকারে সাথে গোপন আঁতাত করে নৌবাহিনীর সাহায্যে হাবশীদের দিয়ে ইয়েমেন দখল করালো। ইয়েমেনের ওপর হাবশীদের আক্রমণ সম্পর্কে নানা ধরনের ইতিহাস বিদ্যমান। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর লিখেছেন, দুইজন সেনাপতির অধিনে হাবশীদের বাহিনী সক্রিয় ছিল। একজনের নাম আজইয়াত এবং আরেকজনের নাম আবরাহা। পরবর্তীতে এই দুই সেনাপতির মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় এবং আজইয়াত নিহত হয় আবরাহার হাতে। পরবর্তীতে আবরাহা গোটা ইয়েমেন দখল করে হাবশার সম্রাটের কাছ থেকে নিজেকে তার প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দানে রাযী করায়। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, প্রচীন যুগে সাবা নামক রাজ্যের সীমানা ছিল দক্ষিণ আরব সাগর থেকে শুরু করে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, আফ্রিকা এবং ইয়েমেনের মাঝে সাগরের যে অংশ ছিল তাকে হাব্‌শ সাগর বলা হতো। ইয়েমেনের সামনের হাব্‌শ সাগরের ওপারে আফ্রিকার যে সমস্ত এলাকা ছিল তা সাবা রাজ্যের উপনিবেশ ছিল। এই জায়গাটাকে আরবরা হাশ বলে অভিহিত করেন। আরবী 'হাশ' শব্দের অর্থ হলো মিশ্রণ। ঐতিহাসিকদের মতে ঐ এলাকার মূল অধিবাসী এবং সাবাদের মিশ্রণের ফলে নতুন এক জাতির সৃষ্টি হয়, এদেরকেই হাবশী বলা হয়। বংশ পরিচয় সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তারা বলেন, হাবশার অধিবাসীগণ একবার ইয়েমেনের ওপর আক্রমণ করে তা দখল করে নিয়েছিল। সে সময়ে তারা সাবার বিভিন্ন বংশের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবার সময় বলতো, আমরা তাই ইবনে উদাদ বা বনী কাহলানের বংশধর। (আব্দুল বার-আল্ ক্কাছ দুওয়াল উমাম-পৃষ্ঠা, ২৬)ইউরোপীয়দের মতে, হাবশীগণ অমিশ্রিত প্রকৃত সাম বংশের নয়। প্রকৃত অধিবাসীদের সাথে আরবের নানা এলাকার গোত্র এসে তাদের সাথে মিশ্রিত হয়েছে। (এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, ২৪ নং খন্ড, সাবা অধ্যায়, পৃষ্ঠা, ৬২৪)  আরবরা হাশার শাসককে নাজ্জাশী নামে পরিচিত করে। প্রকৃত তত্ত্ব এই যে, নাজ্জাশী শব্দটা হাব্‌শী নয়-আরবী। আরবী নাজুশ শব্দের আরেকটি রূপ নাজ্জাশী। হাবশী ভাষায় নাজুশ শব্দের অর্থ হলো, শাসক বা বাদশাহ। বিশ্বনবীর যুগে হাবশার বাদশাহ ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার নাম ছিল আস্হামা ইবনে আব্জার। তাঁর শাসনামলেই মুসলমানেরা দ্বীনি আন্দোলন বিরোধীদের অত্যাচারে মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে হাবশায় হিজরত করেছিলেন।

        বাদশাহ আস্হামা তাদেরকে সম্মান-মর্যাদার সাথে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ইসলামের শত্রুরা হাক্কায় পৌঁছে স্বয়ং বাদশাহ আস্হামার দরবারে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজক কথা বলে তাদের হাতে মুসলমানদেরকে সমর্পণ করতে অনুরোধ করেছিল। আস্হামা তাদের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারপর তিনি হযরত জাফরের বক্তব্য শুনে এমনই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি স্বয়ং ইসলাম কবুল করেছিলেন। এই বাদশাহের সাথেই আল্লাহর রাসূলের পত্র মারফত যোগাযোগ হয়েছিল। এই বাদশাহ ইন্তেকাল করলে বিশ্বনবীকে মহান আল্লাহ তা'য়ালা ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ শুনিয়ে ছিলেন। বিশনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাদেরকে হাশার বাদশাহ আস্হামার ইন্তেকালের সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে তিনি মক্কায় গায়েবানা জানাযার নামাজ আদায় করেছিলেন।

        উল্লেখিত ঘটনার পূর্বে হাবশার ধর্ম এবং সভ্যতা সংস্কৃতি মিসর তথা আরবদের কৃষ্টি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ধর্মের দিক দিয়ে তারা আরবের মূর্তি পূজকদের মতই ছিল কিন্তু রোম শাসকদের প্রভাবে মিসরে খৃষ্ট ধর্মের বিস্তৃতি ঘটলে হাশাতেও এর প্রভাব পড়ে। ফলে ৩৩০ খৃষ্টাব্দে হার্শার বাদশাহ ওনিয়াহ্ সর্বপ্রথম খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ধর্মীয় বিরোধ ও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হার্শার আরবাত মতান্তরে আস্বাহ নামক আরেক বাদশাহ ইয়েমেন আক্রমন করে তা দখল করে নেয়। সে সময় আবরাহা নামক এক শক্তিশালী ব্যক্তিকে হাবশার বাদশাহ ইয়েমেনের গভর্ণর নিয়োগ করেছিল। পরবর্তীতে আবরাহা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল এবং হাবশার বাদশাহ এ সংবাদ পেয়ে তাকে হত্যা এবং ইয়েমেনকে একেবারে তছনছ করার প্রতীজ্ঞা ব্যক্ত করেছিল।

        ইবনে কাসির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খন্ডে লিখেছেন, আবরাহা এ সংবাদ পেয়ে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। তারপর সে তাঁর নিজের শরীরের কিছু রক্ত আর ইয়েমেনের কিছু মাটিসহ হাশার বাদশাহের কাছে প্রেরণ করে পত্রে জানিয়েছিল, 'ইতিপূর্বেকার গভর্ণর যেমন আপনার অনুগত ও আজ্ঞাধীন ছিল, আপনার এই গোলামও তেমনি থাকবে। যখন থেকে আমি শুনেছি আপনি আমার ওপরে ক্রোধান্বিত, তখন থেকে আমি বড় অস্থিরতার মধ্যে দিন যাপন করছি। আমার নিজের শরীরের রক্ত ও ইয়েমেনের মাটি আপনার কাছে প্রেরণ করলাম, আপনি এই মাটির ওপরে আমার রক্ত ঢেলে তা আপনার পা দ্বারা পিষ্ট করে আপনি আপনার প্রতীজ্ঞা পূরণ করুন এবং আমাকে ক্ষমা করুন।' আবরাহার এই প্রস্তাবের কারণে তাকে বাদশাহ ক্ষমা করে দিয়েছিল এবং তার প্রতিনিধিত্ব অনুমোদন করেছিল।

        আবরাহা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা হলো, সেছিল রাজবংশের সন্তান এবং তার নাক ছিল কাটা। এ কারণে তাকে 'আশরাম' অর্থাৎ নাককাটা বলা হতো। কেউ বলেছেন, আবরাহার রাজত্ব শুরু হয় ৫২৫ খৃষ্টাব্দে কিন্তু আরদুল কোরআনের রচয়িতার বর্ণনানুসারে আবরাহার রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল ৫৪৩ খৃষ্টাব্দে। আরবী ইবরাহীম শব্দকে হাবশী ভাষায় উচ্চারণ করা হয় আবরাহা। এই আবরাহা খৃষ্টধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। সে গোটা ইয়েমেনে খৃষ্টধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য বহু প্রচারক নিয়োগ করেছিল এবং গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য গির্জা নির্মাণ করিয়েছিল। সবচেয়ে বড় এবং সুদর্শন-দৃষ্টিনন্দন গির্জা সে নির্মাণ করেছিল ইয়েমেনের রাজধানী শহর 'ছা'য়। আরবরা এই গির্জার নাম দিয়েছিল 'আল কালিস'।

        ইবনে কাসির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইবনে জারীরের বর্ণনা উল্লেখ করে লিখেছেন, নির্মাণ শিল্পের দিক দিয়ে এই গির্জা ছিল তদানীন্তন পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। এই গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হলে আবরাহা হাশার বাদশাহকে লিখেছিল, আপনার সম্মানে রাজধানী ছাত্র শহরে এমন একটা অতুলনীয় গির্জা নির্মাণ করেছি, ইতিপূর্বে যা কোন ইতিহাস অবলোকন করেনি। যারা আরবের কা'বাঘরে হজ্জের জন্য সমবেত হয়ে থাকে, আমার ইচ্ছে হলো তারা এখন থেকে এই গির্জায় এসে সমবেত হোক এবং এটাই যেন আরব জাতির হজ্জের স্থানে পরিণত হয়। (তারীখে ইবনে কাসীর-দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং-১৭০) আবরাহার এই ঘোষনা জানতে পেরে শুধু আরবের অধিবাসীগণই নয়-কা'বাঘরের ভক্ত যারাই ছিল, তারা সবাই আবরাহার ওপরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সুহাইলী উল্লেখ করেছেন, এই গির্জা নির্মাণকালে আবরাহা তাঁর প্রজাদের ওপরে জুলুম অত্যাচারের সয়লাব বইয়ে দিয়েছিল। মানুষদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিক নিযুক্ত করেছিল। মহামূল্যবান হীরা জহরত এবং রাষ্ট্রের অপরিমিত সম্পদ সে এই নির্মাণ কাজে ব্যয় করেছিল। দুষ্প্রাপ্য পাথরসমূহ দ্বারা নির্মিত অদ্ভুত সুন্দর এবং দীর্ঘ ও প্রশস্ত ভবন ছিল, বিস্ময়কর ও বিচিত্র স্বর্ণ খচিত চিত্রাবলীতে চিত্রিত এবং রত্ন খন্ডে সজ্জিত ছিল। আবলুস কাঠ, হাতীর দাঁত ও সুগন্ধি যুক্ত কাঠের কারুকার্যে সুশোভিত মিম্বর, রৌপ্য নির্মিত ক্রুশ চিহ্ন দিয়ে এই গির্জার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল। প্রথম আব্বাসীয় খলীফা সাফফার শাসনকাল পর্যন্ত এই গির্জার ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান ছিল। (রাওজুল আনফ প্রথম খন্ড, ইবনে কাসীর দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং-১৭০)

        গোটা আরবে যে কোন ধর্ম বিশ্বাসীর কাছে কা'বার মর্যাদা ছিল অসীম। তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ীই কা'বাঘর তাওয়াফ করতো ও হজ্জ আদায় করতো এবং তাদের নিজস্ব মূর্তি সেখানে স্থাপন করতো। বোখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনায় জানা যায়, কা'বাঘরে তিন শত ষাটটি মূর্তি ছিল। হযরত ইবরাহীম, হযরত ইসমাঈল, হযরত ঈসা ও হযরত মারইয়াম আলাইহিমুস সালাম আজমাঈনের ছবি ছিল। সুতরাং যে কোন শ্রেণীর মানুষের কাছে কা'বা ছিল সম্মান ও মর্যাদার পাত্র।

        আবরাহার ঘোষনা সমস্ত মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটিয়েছিল। ইয়েমেনের ছা শহরে অবস্থানকারী এক আরবের কানে যখন আবরাহার এই ঘোষনা পৌঁছলো, তখন সে আবরাহার নির্মিত ঐ বিশাল গির্জায় গিয়ে সুযোগ মত মলমূত্র ত্যাগ করে তা অপবিত্র করে দিয়ে এসেছিল। আবরাহা এ সংবাদ জানতে পেরে স্পষ্ট অনুমান করলো, এ কাজ করেছে আরবের কোন লোক। তখন সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রতীজ্ঞা করলো, ইবরাহীমের কা'বাকে সে নিশ্চিহ্ন না করে শান্তিতে থাকবে না। এরপর সে ৫৭০ অথবা ৫৭১ খৃষ্টাব্দে ৬০ হাজার সৈন্য ও বহু সংখ্যক হাতীসহ মক্কার দিকে অগ্রসর হলো। মুহূর্তে এ সংবাদ আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিটি মানুষের ভেতরে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। সর্বপ্রথম ইয়েমেনের যুনাজার নামক একজন নেতা ইয়েমেন থেকে বের হয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে দূত প্রেরণ করেআবরাহাকে মোকাবেলা করার জন্য তাদের সাহায্য কামনা করলো। যুনাজার মোটামুটি একটা দল নিয়ে আবরাহাকে মোকাবেলা করে পরাজিত এবং বন্দী হলো। এরপর খাছআম গোত্রের নেতা নেফাইল ইবনে হাবিব মোকাবেলা করে পরাজিত হয়ে আবরাহার হাতে বন্দী হলো। আবরাহা যখন তায়েফে এলো তখন বনী সাক্কীফের নেতা মাসউদ ইবনে মুআত্তাব তাকে বললো, আমার বিশ্বাস আপনি কা'বা ধ্বংস করবেন না। কা'বায় আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা 'লাত' রয়েছে। এ কথা শুনে আবরাহা নীরব ছিল। তারপর মাসউদ মক্কার পথ আবরাহাকে দেখানোর জন্য আবু রাগাল নামক এক লোককে তাঁর পথপ্রদর্শক করে দিল। পক্ষান্তরে আবু রাগাল ওয়াদিয়ে মুহাস্সার পর্যন্ত এসে মৃত্যুবরণ করলো। আরবের লোকজন সেই জাহিলিয়াতের যুগেও আবু রাগালের ওপর এতটা ক্ষুব্ধ ছিল যে, তারা তার কবরের ওপরে পাথর নিক্ষেপ করতো। তার অপরাধ ছিল, সে আবরাহাকে মক্কার পথ দেখাচ্ছিল।

        আবরাহা মুহাস্স্সার পর্যন্ত এসে তাঁর আসওয়াদ ইবনে মাকসুদ নামক এক সেনাপতিকে আদেশ দিল, সে যেন তাঁর বাহিনী নিয়ে মক্কায় গিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে। সেই সেনাপতি মক্কার কাছে এসে দেখতে পেল, মক্কার অধিবাসীদের হাজার হাজার উট, দুম্বা, মেষ ও ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। সে আক্রমণ না করে ঐ সমস্ত পশুপাল তাড়িয়ে নিয়ে গেল। এই সমস্ত উটের ভেতরে আব্দুল মুত্তালিবের দুইশত উটও ছিল এবং সেই ছিল কুরাইশদের নেতা। আবরাহার এই আক্রমণাত্মক ভূমিকা দেখে মক্কার সমস্ত গোত্র মিলে পরামর্শ করলো, আবরাহার সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আবরাহা যখন আক্রমণ করবে, সে সময়ে তারা সবাই পাহাড়ের ওপাশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করবে।

        মক্কার অধিবাসীগণ মক্কায় অবস্থানকালেই আবরাহা তদের কাছে দূত প্রেরণ করলো। সে দূত এসে লোকজনের কাছে জানতে চাইলো, তোমাদের নেতা কে? সমস্ত লোকজন বিশ্বনবীর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের দিকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে দিল। আবরাহার দূত জানাতাহুল হিমইয়ারী গোত্রপতি আব্দুল মুত্তালিবের দিকে তাকিয়ে বললো, 'আমাদের বাদশাহ আপনাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসেননি। তিনি এসেছেন ঐ কা'বাঘর ধ্বংস করতে। আপনারা যদি বাধা দেন তাহলে আপনাদের ক্ষতি হবে। আর যদি বাধা না দেন তাহলে আমাদের বাদশাহ আপনাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।'

         আব্দুল মুত্তালিব জবাব দিল, 'তোমাদের বাদশাহের সাথে আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা কোনটাই নেই। কা'বা আল্লাহর ঘর এবং তাঁর নবী ইবরাহীমের স্মৃতি। আল্লাহর যদি ইচ্ছা হয় তাহলে তিনি তা রক্ষা করবেন। তবে বাধা দানের ক্ষমতা আমাদের নেই।'

        তারপর আব্দুল মুত্তালিব তাঁর সাথীদের নিয়ে বাদশাহের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেল। আবরাহা আব্দুল মুত্তালিবের সুন্দর চেহারা এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দেখে তাকে নিজের পাশে বসালো। আব্দুল মুত্তালিবের মুখের প্রাঞ্জলভাষা শুনে ও তাঁর বাগ্মিতা দেখে আবরাহা অত্যধিক প্রভাবিত হয়ে পড়লো।

         আলোচনার একপর্যায়ে আব্দুল মুত্তালিব অভিযোগ করলো, 'আপনার লোকজন আমাদের পশুপাল ধরে এনেছে। আমি আপনার কাছে আবেদন করছি, আমাদের পশুপাল ফেরৎ দিয়ে দিন।' আব্দুল মুত্তালিবের আবেদন শুনে আবরাহা কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, 'আপনি জানেন আমি কি উদ্দেশ্যে এসেছি। কিন্তু আপনি সে সম্পর্কে কোন কথা না বলে পশুপাল সম্পর্কে বলছেন, আপনার কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছি।' আব্দুল মুত্তালিব জবাব দিল, 'পশুপালের মালিক আমি, সুতরাং আমি সেগুলোর দাবী করছি। আর কা'বার মালিক আমি নই, আমি তাঁর খাদেম মাত্র। যিনি কা'বার মালিক তিনি যদি তা রক্ষা করার ইচ্ছা করেন, তাহলে করবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি জানেন আর আপনি জানেন।' আব্দুল মুত্তালিবের সাথীদের একজন আবরাহার কাছে প্রস্তাব দিল, 'আপনি যদি কা'বা ধ্বংস না করেন তাহলে আমরা আমাদের তেহামাহ এলাকার মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ আপনার খেদমতে উপস্থিত করবো।' কিন্তু আবরাহা তাঁর এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে দম্ভভরে বলেছিল, 'আমি যে প্রতীজ্ঞা নিয়ে এসেছি, তা বাস্তবায়ন করেই ফিরে যাবো।'

        আব্দুল মুত্তালিব তাঁর সাথীদের নিয়ে ফিরে আসার সময় পরামর্শ করলো কা'বা ধ্বংসের মর্মন্তুদ দৃশ্য তারা চোখে দেখতে পারবে না। অতএব তারা সবাই পাহাড়ের ওপাশে গিয়ে অবস্থান করবে। মক্কার অধিবাসীরা যখন পাহাড়ের দিকে যেতে থাকলো তখন আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে অনেকে কা'বায় এসে কা'বার দরোজার শিকল ধরে আল্লাহর কাছে আবেদন করলো, 'হে খোদা! আমরা বিশ্বাস করি, তুমি তোমার কা'বাকে রক্ষা করবে যেমন আমরা আমাদের সম্পদ রক্ষা করি। তোমার শক্তির ওপরে ক্রশ শক্তি এবং তার পূজারিরা জয়ী হতে পারবে না সে বিশ্বাস আমাদের আছে। তবে তুমি নিজেই যদি তোমার ঘর তাদেরকে ধ্বংস করার সুযোগ দাও তাহলে তোমার মন যা চায় তাই করো।'

        সে সময়ে কা'বাঘরে ৩৬০ টি মূর্তি ছিল। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মক্কার একটি লোকও এই বিপদের সময় কোন মূর্তির কাছে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেনি। তারা সাহায্য চেয়েছিল একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে। মক্কার নেতৃবৃন্দসহ আব্দুল মুত্তালিব মহান আল্লাহর কাছে যে ভাষায় দোয়া করেছিলেন, তা ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থে শব্দের পার্থক্যসহ বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

        এভাবে তারা আবেদন করে পাহাড়ের দিকে চলে গেল এবং কি ঘটে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। পরের দিন ঊষা লগ্নে আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হলো কা'বাঘর ধ্বংস করার লক্ষ্যে। তার বাহিনীর সামনে হস্তী বাহিনী এবং পেছনে ছিল পদাতিক বাহিনী। বাহিনীর প্রথমেই আবরাহা তার হাতীর ওপরে উপবিষ্ট ছিল। আবরাহার হাতী যাত্রা শুরু করলেই তাকে সবাই অনুসরণ করবে। যাত্রা শুরু করে মক্কার কাছাকাছি এসে সে হাতী দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতী মক্কার দিকে কোনক্রমেই অগ্রসর হলো না। চালক হাতীর মাথায় এবং শুড়ে আঘাতের পরে আঘাত করলো, কিন্তু হাতী কোনক্রমেই মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলো না। ইয়েমেনের দিকে যেতে ইশারা করলে হাতী দ্রুত বেগে অগ্রসর হয় কিন্তু মক্কার দিকে এক পা-ও অগ্রসর হয় না।

        এটা ছিল আবরাহার প্রতি মহান আল্লাহর সর্বশেষ সতর্ক সংকেত। কিন্তু দাম্ভিক আবরাহা সে সংকেত অমান্য করলো। এই জঘন্য পাপ কাজ থেকে সে নিজেকে বিরত করলো না। এ সময় হঠাৎ প্রচন্ড বেগে বাতাস প্রবাহিত হতে লাগলো। সেই সাথে কোন এক অদৃশ্য পরিমন্ডল থেকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখির ঝাঁক উড়ে এলো। তাদের মুখে এবং পায়ে ছিল প্রস্তর খন্ড। পাখির ঝাঁক প্রথমে ভয়ংকর শব্দ করলো, তারপর আবরাহার বাহিনীর ওপরে পাথর খন্ড বৃষ্টির আকারে বর্ষন করতে লাগলো। সে পাথর যার দেহের ওপরে পড়তো, দেহ ভেদ করে বের হয়ে যেত এবং সাথে সাথে গোটা দেহ পচে গলে নিঃশেষ হয়ে যেত। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, 'সামান্য সময়ের ব্যবধানে আবরাহার বিশাল হস্তী বাহিনী, পদাতিক বাহিনী চর্বিত তৃণ খন্ডের আকার ধারণ করেছিল।'

        মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইকরামার বর্ণনানুসারে, পাথর কুচির স্পর্শেই দেহে বসন্ত উদগত হতো এবং আরব দেশে সেবারই সর্বপ্রথম এই রোগ দেখা দিয়েছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, পাথর কুচি যার ওপরেই পড়তো, তার দেহে মারাত্মক চুলকানি শুরু হতো। চুলকানির কারণেই দেহ ফেটে গোস্ত খসে পড়ে হাড় বেরিয়ে যেতো। যারা কোনক্রমে গলিত দেহ নিয়ে দিক্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের ভেতরে স্বয়ং আবরাহাও ছিল। তাঁর অবস্থা এমন ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল যে, ক্ষত-বিক্ষত পচা গলা ঝলসানো দেহ দেখে ভয়ে মানুষ চমকে উঠতো। তাকে চেনার কোন উপায় ছিল না। মনে হত, সে যেন একটা গলিত মাংস পিন্ড। পালাতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছিল।

        স্বয়ং আবরাহা খাশয়াম এলাকায় পৌছে মারা গিয়েছিল। মহান আল্লাহ হাবশীদের এই শাস্তি দিয়েই বিরত ছিলেন না। এই ঘটনার তিন চার বছরের মধ্যে ইয়েমেন থেকে হাবশীদের দোর্দন্ড শাসনের অবসান ঘটান। ইয়েমেনের বিভিন্ন গোত্রের নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সাইফ ইবনে যীইয়াজান নামক একজন প্রতাপশালী ইয়েমেনী নেতা পারস্য সম্রাটের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য গ্রহণ করে। পারস্যের মাত্র একহাজার সৈন্যের আক্রমণে ৫৭৫ খৃষ্টাব্দে ইয়েমেন থেকে হাবশীদের শাসনের অবসান ঘটে।

        এই ঘটনাটি ঘটেছিল মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী স্থানে মুহাচ্ছাব নামক উপত্যকার কাছে মুহাসির নামক স্থানে। মহান আল্লাহ এই ইতিহাস গোটা মানব জাতির শিক্ষার জন্য পবিত্র কোরআনে সূরা ফীল-এ বর্ণনা করেছেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলেন, এই ঘটনা বিশ্বনবীর আগমনের পঞ্চাশ দিন পূর্বে ঘটেছিল এবং সেই বছরই আরবে মারাত্মক বসন্ত রোগ দেখা দিয়েছিল। মহান আল্লাহ এভাবেই প্রতিটি যুগে ইসলামী আন্দোলন বিরোধী বাতিল শক্তিকে চূর্ণ-বিচণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা'য়ালার অসীম ক্ষমতার ওপর যাদের বিশ্বাস নেই তারা তাদের লেখনীতে মহান আল্লাহ প্রেরিত পাথর কুচি বর্ষনের কথা এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র উল্লেখ করেছে, আবরাহার বাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে।

        ইউরোপের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছে বসন্ত রোগের কথা। তাদের সমর্থক কিছু সংখ্যক মুসলমান ঐতিহাসিকও মুরব্বিদের সুরে সুর মিলিয়েছে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও ইসলাম সম্পর্কিত কোন অলৌকিক ঘটনা স্বীকৃতি দিতে এসব ঐতিহাসিকদের ভীষণ কার্পণ্যতা। কেননা, পবিত্র কোরআন ঘোষনা করেছে, মহান আল্লাহ পাখি প্রেরণ করে আবরাহাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আর এ সমস্ত জড়বাদি ঐতিহাসিকগণ বলছেন, আবরাহার বাহিনীর এক অংশ ধ্বংস হয়েছিল সংক্রামক ব্যাধিতে আরেক অংশ ধ্বংস হয়েছিল ভয়ংকর ঝড়ের কবলে নিপতিত হয়ে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনাকে তারা মিথ্যা ও গুরুত্বহীন প্রমাণ করার লক্ষ্যে ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।

        ঐতিহাসিক Philip K. Hitti আবরাহাকে এবং তাঁর বাহিনীকে ধ্বংস করার ব্যাপারে মহান আল্লাহ যে পাখির ঝাঁক প্রেরণ করে তাদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সে ঘটনাকে শুধুমাত্র বসন্ত রোগের ঘটনা বলে উল্লেখ করে কোরআন বর্ণিত ইতিহাসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এই লোকটি বলতে চেয়েছে কোরআন যাকে 'সিজ্জিল' হিসাবে উল্লেখ করেছে, সেটা আসলে বসন্ত রোগ ছিল।

        কেন এবং কি উদ্দেশ্যে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও ইসলাম সম্পর্কিত অলৌকিক ঘটনাগুলোর ওপরে অবিশ্বাসের ছায়াদান করা হয় তা আমাদের কাছে বোধগম্য। কা'বা ধ্বংস করার দুঃসাহস যারা করেছিল, তাঁরা সবাই ছিল খৃষ্টান। এই খৃষ্টানরাই সেদিন মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সামান্য ক্ষুদ্র পাখির কাছে চরমভাবে লাঞ্ছিত এবং অপমানিত হয়েছিল। এই ইতিহাস খোদ খৃষ্টান এবং তাদের তল্পীবাহকরা বিকৃত করে পরিবেশন করে মানসিক তৃপ্তি লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। নিজেদের ব্যর্থতা আর কলঙ্ক ঢাকতে এ ধরণের অসংখ্য কল্পিত ঘটনার জন্ম তাঁরা দিয়েছে এবং আগামীতেও দেবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। আর আমুল ফীল বা হস্তী বছরের সূচনা সেখান থেকেই হয়েছিল। আমুল ফীল শব্দটা হলো আরবী, বাংলায় হস্তী বছর বলা হয়। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের জন্ম সনকে আমুল ফীল বা হস্তী বছর বলা হয়।

        এই ঘটনাটি ছিল একটা অলৌকিক অসধারণ বিস্ময়কর ঘটনা। গোটা আরব জগতে মুহূর্তের মধ্যে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যুগের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকগণ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কবিতা রচনা করেছিল এবং সেসব কবিতা বর্তমান সময় পর্যন্তও মওজুদ রয়েছে। সেই সাথে মওজুদ রয়েছে আরব নেতৃবৃন্দসহ আব্দুল মুত্তালিবের প্রার্থনা-যা তারা কা'বাঘর রক্ষার জন্য মহান আল্লাহর কাছে করেছিল। আবরাহার ধ্বংসের ব্যাপারে ও কা'বাঘর রক্ষার ব্যাপারে তাদের প্রার্থনা ও কবিতার মধ্যে এমন একটি শব্দও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে শব্দের মাধ্যমে তারা দেব-দেবীর প্রশংসা করে বলেছে যে, তোমরাই কা'বা রক্ষা করেছো, তোমরাই কা'বার রক্ষক এবং তোমরাই আবরাহাকে ধ্বংস করেছো। বরং তাদের প্রার্থনা ও কবিতার প্রতিটি ছত্রে একমাত্র আল্লাহর কথাই উল্লেখ করেছে এবং আল্লাহরই প্রশংসা করে বলেছে, একমাত্র তুমিই কা'বাকে রক্ষা করতে সক্ষম এবং তুমিই আবরাহাকে ধ্বংস করেছো। বিষয়টি এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনার পর থেকে কুরাইশরা ১০ বছর কোন বর্ণনায় ৭ বছর পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করেনি।

        ওপরে উল্লেখিত ইতিহাসের আলোকে আলোচ্য সূরাটির বক্তব্য বুঝতে হবে। যে সময় এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছিল, সে সময় পর্যন্ত আরবের একজন লোকও এমন ছিল না যে, সে উল্লেখিত ইতিহাস জানতো না। বালক কিশোর যুবক তরুণ বৃদ্ধ সবাই এই ইতিহাস অবগত ছিল। কারণ সেটা ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। গোটা আরববাসীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আবরাহার কবল থেকে কা'বাঘর সেই সব দেব-দেবী রক্ষা করেনি, যুগ যুগ ধরে তারা যাদের পূজা আরধনা করে আসছে-বরং কা'বাঘর রক্ষা করেছেন একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা এবং তাঁরই অসীম ক্ষমতাবলে আবরাহা ধ্বংস হয়েছে। কুরাইশ নেতৃবৃন্দও কা'বা রক্ষার জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছেই কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করেছিল।

        এ জন্য এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই সূরায় দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র ঘটনাটি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন কোন আল্লাহর গোলামীর দিকে তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন না। তিনি সেই আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করার জন্যই আহ্বান জানাচ্ছেন, যে আল্লাহর কাছে তোমরা আবরাহার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাতর স্বরে প্রার্থনা করেছিলে, যে আল্লাহর প্রশংসা করে তোমরা কবিতা রচনা করেছিলে এবং তোমরা এ কথাও বিশ্বাস করেছিলে যে, ঐ আল্লাহই আবরাহাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই আল্লাহর দিকেই তোমাদেরকে ডাকছেন। এখন যদি সেই আল্লাহর প্রেরিত রাসূলকে তোমরা অস্বীকার করো, তাহলে সেই আল্লাহ পূর্বে যেমন ছিলেন, বর্তমানেও তেমনি আছেন এবং ভবিষ্যতে তেমনি থাকবেন। আবরাহাকে তিনি যেভাবে পর্যদুস্ত করেছেন, তোমাদেরকেও তিনি একই ভাবে পর্যদুস্ত করতে সক্ষম। সুতরাং কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা পরিহার করে ইসলামী জীবন বিধান গ্রহণ করো।

সুরা ফীল

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ (1) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ (2) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ (3) تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ (4) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ (5)

উচ্চারণ : আলাম তারা কাইফা ফাআলা রাব্বুকা বিআসহা-বিল ফিল। (০১) আলাম ইয়াজ-আল কাইদাহুম ফি তাদলিল (০২) ওয়া আরসালা আলাইহিম তাইরান আবা-বিল। (০৩) তারমি-হিম বিহিজা-রাতিম মিন ছিজ্জিল। (০৪) ফাজাআলাহুম কাআসফিম মা’কুল। (০৫)

অর্থ : তুমি কি দেখনি যে, তোমার প্রতিপালক হাতি-ওয়ালাদের সাথে কিরূপ (আচরণ) করেছিলেন? (০১) তিনি কি তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন নি? (০২) তাদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী পাঠিয়েছিলেন। (০৩) যারা তাদের উপর পোড়া মাটির কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিল। (০৪) অতঃপর তিনি তাদের চিবানো তৃণ-ঘাসের মতো করে দিয়েছিলেন। (০৫)

আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ

        আলোচ্য সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, 'তুমি কি দেখোনি তোমার মালিক কা'বা ধ্বংসের জন্যে আগত সেই হাতিওয়ালাদের সাথে কি ব্যবহার করেছিল?' এই আয়াতের বর্ণনা ভঙ্গি দেখে সাধারণভাবে মনে হবে যেন, আল্লাহর রাসূলকে কথাটি বলা হচ্ছে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। কথাগুলো বলা হচ্ছে সেই সবলোকদের উদ্দেশ্যে যারা দ্বীনি আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করছিল। কারণ সে সময়ে যারা ইসলামের সাথে বিরোধিতা করছিল, তারা সবাই কা'বা ধ্বংস করতে যারা এসেছিল, তাদের মর্মান্তিক ইতিহাস অবগত ছিল। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তি অনেকেই ছিল, যারা সেই বিশ্বয় উদ্রেককারী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। এই জন্যই তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, তোমরা তো সেই ঘটনার সাক্ষী-যারা হস্তী বাহিনী নিয়ে কা'বা ধ্বংস করতে এসে আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে স্বয়ং নিজেরাই নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। হস্তী বাহিনী নিয়ে কোন শক্তি কা'বা ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হয়েছিল, তাদের কথা আয়াতে এ জন্য বলা হয়নি, কারণ যাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ অবতীর্ণ হয়েছিল, তারা সবাই অবগত ছিল যে, কারা কোন উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘর কা'বা ধ্বংস করতে এসেছিল। সেই ইতিহাস গোটা আরবের লোকদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। ছোট্ট একটি বালক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ লোক পর্যন্ত সেই ঘটনা জানতো। অধিকাংশ প্রত্যক্ষদর্শী সে সময় পর্যন্ত বর্তমান ছিল এবং তাদের মুখ থেকে পরবর্তীতে জন্মগ্রহণকারী লোকেরা শুনতো। এ জন্য সবার কাছে নিজ চোখে দেখা ঘটনার অনুরূপ ঘটনার মতোই সেই ইতিহাস তারা বিশ্বাস করতো। এ কারণে সেই ইতিহাসের বিস্তারিত বর্ণনা এই সূরায় দেয়া হয়নি।

        এরপর ২ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত ধ্বংসের বিবরণ এভাবে শোনানো হয়েছে যে, যেসব জালেমের দল কা'বাঘর ধ্বংস করতে এসেছিল, তারা যে নীল নক্সা প্রণয়ন করেছিলো-যে ষড়যন্ত্রে তারা মেতে উঠেছিল, তাদের সেই ষড়যন্ত্র কিভাবে সেই আল্লাহ নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন, তা তোমরা স্বয়ং নিজের চোখে দেখেছিলে। তারা ষড়যন্ত্র করেছিল, কা'বা ধ্বংস করে নিজেদের নির্মিত ঘরের দিকে লোকদেরকে নিয়ে যাবার জন্য এবং কুরাইশদের ও গোটা আরববাসীদেরকে আতঙ্কিত করে আরব থেকে বাণিজ্যের যে পথটি সিরিয়া ও মিসরের দিকে গিয়েছে, সেই পথের ওপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এভাবে হাবশীরা আরবদেরকে শোষণ করে নিজেদের মুখাপেক্ষী বানানোর এক মারাত্মক ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। তাদের ষড়যন্ত্রের সেই জাল তিনি কিভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন, তা কি তোমরা দেখোনি? তিনি তাঁর দুশমন সেই জালিমদের ওপরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী প্রেরণ করেছিলেন, সে ব্যাপারেও তোমরা স্বয়ং সাক্ষী।

        আলোচ্য সূরায় আবাবীল শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এ কারণে অনেকেই ধারণা করেছেন যে, মহান আল্লাহ তা'য়ালা আবাবীল পাখী প্রেরণ করেছিলেন। প্রকৃত বিষয় হলো, আরবী আবাবীল শব্দের অর্থ হলো, অধিক সংখ্যক-যা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ছুটে আসে। কারণ সেই পাখীগুলো লোহিত সাগরের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে এসেছিল এবং প্রত্যেক পাখীর ঠোঁটে ও দু'পায়ে পাথর কুচি ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, সেই পাখীর ঠোঁট ছিল পাখীর ঠোঁটের মতোই কিন্তু তাদের পায়ের থাবা ছিল কুকুরের মতো। ঐতিহাসিকগণ বলেন, আরবের লোকজন এই পাখী ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি এবং ঘটনার পরেও সেই পাখীগুলোকে আর দেখা যায়নি। কেউ বলেছেন, সেই পাথর কুচি ছিল ছাগলের বিষ্ঠার আকারের, কেউ বলেছেন, তা ছিল মটর দানার অনুরূপ। আবার কেউ বলেছেন, তা ছিল ছোট্ট এক ধরনের ফলের অনুরূপ। এই ঘটনার পরে মক্কার বহু লোকদের কাছে সেই পাথর কুচির নমুনা রক্ষিত ছিল।

        ইতিপূর্বে কখনো না দেখা এবং পরবর্তীতেও যার দেখা মেলেনি, সেইসব ক্ষুদ্র পাখীর ঝাঁক হঠাৎ ধুমকেতুর মতোই উদিত হয়ে এমন একটি বিশাল বাহিনীর ওপরে পাথর নিক্ষেপ করা শুরু করেছিল, যে বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার এবং সে বাহিনী তৎকালের শ্রেষ্ঠ সমরাস্ত্রে সজ্জিত ছিল। শুধু তাই নয়, মক্কার লোকগুলো ইতিপূর্বে কোনদিন হাতী দেখেনি। অথচ সেই বাহিনীতে বহু সংখ্যক হাতীও ছিল। এ ধরনের একটি অত্যাধুনিক বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করেছিল ছোট্ট পাখীর ঝাঁক শুধুমাত্র ক্ষুদ্র পাথর কণা দিয়ে। এ কথাগুলোই এই সূরায় এভাবে বলা হয়েছে যে, 'এ পাখীগুলো কি এই সুসজ্জিত বাহিনীর ওপর পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করেছে?'

        সেই পাথর কণা নিক্ষেপের ফলে সমরাস্ত্রে সজ্জিত সেই বিশাল বাহিনীর অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, জন্তু-জানোয়ার ঘাস-পাতা চিবানোর পরে যে অবস্থা হয়, তাদের অবস্থাও তেমনি হয়েছিল। ধান থেকে চাল বের করে নেয়ার পরে যে খোসা পড়ে থাকে বা খোসাযুক্ত শস্য থেকে দানা বের করে নেয়ার পরে যে আবরণটি পড়ে থাকে, সেই নিষ্পেষিত খোসার অনুরূপ হয়েছিল সেই বিশাল বাহিনীর অবস্থা। এসব ঘটনা তাদের দৃষ্টির সামনেই ঘটেছিল, যারা বিশ্বনবীর আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করছিল।

        লোকগুলোকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, তোমরা যারা আমার প্রেরিত রাসূলের ও বিধানের সাথে বিদ্রোহ করছো, তাঁর সাথে বিরোধিতা করছো, তোমরা নিজেদের চোখে দেখেছো যে, আল্লাহর সাথে বিদ্রোহের মস্তক উত্তোলন করলে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়। নিজের চোখে সেই ঘটনা দেখেও তোমরা কিভাবে আমার প্রেরিত রাসূল ও বিধানের সাথে বিরোধিতা করছো? তোমরা আমার রাসূল ও কোরআনের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছো, আবরাহার বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের জাল আমি আল্লাহ কিভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে থাকি, তা কি তোমরা দেখোনি? আমার সাথে শত্রুতার পরিণতি কতটা মর্মান্তিক হতে পারে, তা কি তোমরা নিজের চোখে অবলোকন করোনি?

        এই সূরায় মহান আল্লাহ তা'য়ালা ঐ লোকগুলোকে সাবধান করে দিয়েছেন, যারা তাঁর দ্বীনের সাথে শত্রুতা করে। দ্বীনি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সেই আল্লাহ অমর অক্ষয়-তিনি চিরঞ্জীব এবং কালের প্রবাহে তাঁর ক্ষমতার কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। তিনি পূর্বেও যেমন অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, বর্তমানেও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। যারা তাঁর দেয়া বিধানের সাথে বিরোধিতা করবে, তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠাকামীদের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করবে, তাদের ষড়যন্ত্র তিনি ঐভাবেই ব্যর্থ করে দেবেন, তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন, যেভাবে তিনি হস্তীওয়ালাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে তাদেরকে লাঞ্ছিত করেছিলেন।

        সেই সাথে এই সূরা অবতীর্ণ করে মুসলমানদের হৃদয়ে সাহস সঞ্চার করেছেন এভাবে যে, তোমরা যাঁর বিধান অনুসরণ করছো এবং সেই বিধান প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জান-মাল কোরবানী করে আন্দোলন করছো, তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। কারণ যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছো, সেই আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন, তিনি তোমাদের অবস্থাও দেখছেন এবং তোমাদের সাথে যারা বিরোধিতা করছে, তাদের অবস্থাও দেখছেন। আমার বিধানের বিরোধিরা যখন সীমালংঘন করবে, তখনই আবরাহার সাথে যে আচরণ করা হয়েছিল, তাদের সাথেও অনুরূপ আচরণ করা হবে। সুতরাং নির্ভীক চিত্তে অসীম সাহসের সাথে একমাত্র আমার ওপরে নির্ভর করে সাহসী পদক্ষেপে আন্দোলনের ময়দানে এগিয়ে যাও।

Post a Comment

0 Comments