সূরা কুরাইশ
মক্কায় অবতীর্ণ-পবিত্র কোরআনের সূরার ক্রমিক নং-১০৬
শানে নযুল ও সংক্ষিপ্ত আলোচ্য বিষয়ঃ-এই সূরায় কুরাইশদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং সূরাটির প্রথম আয়াতের শেষ শব্দটি 'কুরাইশ' এ জন্য এই শব্দটিকেই এই সূরার নাম হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু কোরআনের অধিকাংশ গবেষক বলেছেন, এই সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এ ব্যাপারে সবাই একমত। এই সূরার মূল বক্তব্যের সাথে সূরা ফীলের মূল বিষয়বস্তুর গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এই দুটো সূরার মধ্যে অদ্ভুত সামঞ্জস্য বিদ্যমান রয়েছে বলে অনেকে মন্তব্যের দিক থেকে এতটা অগ্রসর হয়েছেন যে, এই দুটো সূরা আসলে একটি সূরা। হযরত উবাই ইবনে কা'ব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছে লিখিত যে মুসাহফ ছিল, তার ভেতরেও এই সূরা দুটো এমনভাবে লিখিত হয়েছে যে, দুটো সূরার মধ্যে বিস্মিল্লাহ পর্যন্ত লেখা হয়নি। পরবর্তীতে হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বিপুল সংখ্যক সাহাবীদের সহযোগিতায় সরকারীভাবে আল্লাহর কোরআনের যে অনুলিপি তৈরী করিয়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রেরণ করেছিলেন, তার ভেতরে সূরা ফীল ও সূরা কুরাইশকে দুটো সূরা হিসাবে পৃথক করা হয়েছে। তখন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সেভাবেই চলে আসছে। প্রকৃত অর্থেও এ সূরা দুটো পৃথক সূরা এবং পৃথকভাবেই তা অবতীর্ণ হয়েছিল। এ সূরা দুটোর বিষয়বস্তুতে সামঞ্জস্য থাকলেও এর বক্তব্য ও আলোচিত বিষয় ভিন্ন।
এই সূরাটির সাথে সূরা ফীল-এর সামঞ্জস্য বিদ্যমান। এ এই সূরার মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে হলে এই ঐতিহাসিক পটভূমি জানা একান্ত আবশ্যক। বহু পূর্ব থেকেই আল্লাহর রাসূলের উর্ধ্বতন বংশ ছিল সে সময়ের সবচেয়ে সম্মানও মর্যাদার অধিকারী। তারপর তিনি যে কুরাইশ গোত্রে আগমন করেছিলেন সে কুরাইশ গোত্রও ছিল সে সময়ে সবচেয়ে মর্যাদার অধিকারী। যিনি এই গোষ্ঠীকে কুরাইশ নামে অভিহিত করেছিলেন তিনি হলেন আন্ নজর ইবনে কেনানা। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, আন্ নজরের নাতি এবং মালিক ইবনে নজরের সন্তান ফিহিরের উপাধি ছিল কুরাইশ। সুতরাং ফিহিরের পরবর্তী বংশধরগণই কুরাইশ নামে অভিহিত হয়েছে। আল্লামা হফেজ ইরাকীও এই বর্ণনা সমর্থন করেছেন।
তবে 'কুরাইশ' শব্দের অর্থ নিয়ে অভিধানকারকদের মধ্যে মতানৈক্য বিরাজমান। কেউ এই শব্দের অর্থ করেছেন, সমস্ত কিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরে পুনরায় একত্র হওয়া। এই অর্থ প্রযোজ্য হয় কুছাই ইবনে কিলাবের প্রতি। কেননা, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তাঁর সময়েই তাদের শতধা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী মক্কায় একত্রিত হয়েছিল।
আবার কেউ বলেছেন, 'কুরাইশ' শব্দের অর্থ হলো ব্যবসা বাণিজ্য ও উপার্জন। কেননা তাদের উপার্জনের মাধ্যম ছিল ব্যবসা। কেউ বলেছেন, 'কুরাইশ' শব্দের অর্থ হলো, খোঁজ করা। এই অর্থ প্রযোজ্য হয় নজর ইবনে কিনানার প্রতি। কেননা, তাঁর সম্পর্কে আরব ইতিহাস বলে, সে অভাবী মানুষ খোঁজ করে করে তাদেরকে সাহায্য করতো।
কেউ বলেছেন, এর অর্থ হলো বিশাল জলধীর মত। যা সমস্ত কিছুই ধ্বংস করে ফেলে। কেউ বলেছেন, কুরাইশ ইবনে বদর ইবনে নজর ইবনে কিনানা বংশের একজন লোক ছিল। সে দ্রব্যাদি সরবরাহ করতো এবং সরবরাহের পথে প্রহরার ব্যবস্থা করতো। এ কারণে আরববাসী ঐ কাফেলা দেখলেই বলতো, কুরাইশদের কাফেলা। দারুণ নদওয়া' নামে একটা পরামর্শ পরিষদ গঠন করেছিল কুছাঈ। কুরাইশদের সমস্ত সমস্যা নিয়ে সেখানে আলোচনা করে সমাধান করা হত। ইতিহাসে দেখা যায়, এই ব্যক্তি ছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক। সমাজের কল্যাণে সে বহু কিছু করেছিল। কা'বা শরীফের খেদমত করার লক্ষ্যে সে একটা সমিতি গঠন করেছিল। মক্কায় আগত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা সে করেছিল। হাজীদের তত্ত্বাবধান, তাদের পানি পান করানো এবং আহারাদীর ব্যবস্থা সে করেছিল। এ উপলক্ষ্যে সে গোত্রের সবার কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে মিনায় হাজীদেরকে আহার করাতো। চামড়ার মশক নির্মাণ করে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতো। হজ্জের সময় আলোর ব্যবস্থা সে করেছিল। তাঁর প্রচেষ্টাতেই তাদের গোত্র বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মক্কার আশে পাশে বসবাস শুরু করেছিল।
আল্লামা ইবনে আব্দে রাব্বিহি তাঁর গ্রন্থ 'ইকদুল ফরিদ'-এ উল্লেখ করেছেন, কুছাই ইবনে কিলাবের জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে কুরাইশ উপাধিদান করা হয়েছিল। কেউ বলেছেন, কুরাইশ ছিল একটা বিশাল মাছের নাম। সে সময়ে কুছাঈকে লোকজন ঐ বিশাল মাছের সাথে তুলনা করতো।
আল্লামা সুহাইলী (রাহ) বলেন, একটা কবিলার নাম ছিল কুরাইশ। ইসলাম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, আরবের লোকেরা নানা ধরনের জানোয়ারের পূজা করতো এবং যে গোত্র যে জানোয়ারের ভক্ত ছিল, তারা সেই জানোয়ারের নামেই গোত্রের নামকরণ করতো। তাদের এই অভিমত যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার হীন চক্রান্তের ফসল হলো তাদের ঐ কষ্ট কল্পনা। কেননা, আরব ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত গবেষণালব্ধ অভিমত হলো বনী ফিহিরের উপাধি ছিল কুরাইশ।
কুছাঈয়ের পুত্র সন্তান ছিল ছয়জন। আব্দুদ্দার, আব্ব্দে মানাফ, আব্দুল উজ্জা, আব্দ ইবনে কুছাঈ, তাখাম্মুর ও বাররাহ। কুছাঈয়ের ইন্তেকালের পরে তাঁর বড় সন্তান আব্দুদ্দার কা'বার মুতাওয়াল্লীর পদে আসীন হয়। তাঁর অযোগ্যতার কারণে পরবর্তীতে এই পদে আসীন হয়েছিলেন আবৃদে মানাফ। এই আবৃন্দে মানাফের খান্দানেই বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
হযরত ইসমাঈল আলাইহিস্ সালামের গর্ভধারিণী হযরত হাজেরা অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। তিনি যেমন মনে মনে আশা করছিলেন তাঁর বসবাসের এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠুক এবং তাঁর আকাংখা অনুযায়ীই তিনি জোরহামীদের কা'বা এলাকায় বসবাস করার অনুমতি প্রদান করেছিলেন। ক্রমশঃ জোরহামীদের প্রভাব প্রতিপত্তি সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছিল। অপরদিকে হযরত ইসমাঈলের বংশধরগণ আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করার লক্ষ্যেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। কা'বার ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল গুবশান গোত্র। ক্রমশঃ তাদের অনাচার বৃদ্ধি পেলে তারা যুদ্ধ করে জোরহামীদের মক্কা থেকে বিতাড়িত করে এবং জোরহামীগণ চলে যাবার সময় কা'বার সমস্ত সম্পদ যমযম কূপের ভেতরে নিক্ষেপ করে যমযম কূপের চিহ্ন মুছে দিয়ে যায়।
নানা ঘটনাবলীর পরে কুছাঈ ইবনে কিলাবের হাতে পূর্ববর্তীদের বিভিন্ন অনিয়মের অবসান ঘটে এবং কা'বা কুরাইশদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কুছাঈয়ের মা ফাতেমা বিনতে সায়াদ স্বামীর ইন্তেকালের কারণে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। সে ব্যক্তির নাম ছিল রাবিয়া ইবনে হারাম। কুছাঈও শিশু বয়সে পিতৃহারা হয়ে সে মায়ের সাথেই সৎ পিতার কাছে শামে বসবাস করতো। কুছাঈ যখন উপযুক্ত বয়েসে পদার্পণ করে জানতে পেরেছিল তার গোত্রের সমস্ত লোকজন বাস করে মক্কায়। তারপরই সে বনী খুযায়ার হজ্ব যাত্রীদের সাথে মক্কায় চলে এসেছিল।
মক্কায় পূর্ব হতেই কুছাঈয়ের ভাই যুহরা বাস করতো। তার প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল। কুছাঈ তাঁর এই ভাইয়ের কাছেই রয়ে গেল। এই সময়ে কা'বার মুতাওয়াল্লী ছিল হোলাইল ইবনে হোবশিয়া খোযায়ী। এই ব্যক্তির মেয়েকে কুছাঈ বিয়ে করেছিল। এরপর কুছাঈ কিভাবে কা'বার মুতাওয়াল্লী পদে আসীন হয়েছিল এ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, স্বয়ং হোলাইল ইন্তেকালের সময় নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল কুছাঈকে ঐ পদে আসীন করার জন্য, আবার কেউ বলেছেন, শ্বশুরের মৃত্যুর পরে স্বয়ং কুছাঈ দাবী করেছিল ঐ পদের সে অধিক যোগ্য-অতএব তাকেই ঐ পদ দান করতে হবে।
এই অবস্থায় দুটো দলের সৃষ্টি হলো এবং শক্তিশালী দল দুর্বল দলকে মক্কা থেকে বহিষ্কার করে দিল। পরবর্তীতে ইয়ামুর ইবনে আওফকে বিচারক মেনে নিয়ে তারা এক সালিস করলো। সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হলো যে, যেহেতু কুছাঈ নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং সে বনী ইসমাঈলীদের বংশধর। অতএব কা'বার মুতাওয়াল্লী কুছাঈ-ই হবে।
ক্রমশঃ সে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও শক্তিদ্বারা গোটা মক্কার নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর প্রভাব এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে, সে সময়ে কোন মেয়ের বিয়ে হলে তাঁর বাড়িতে এনে বিয়ে দিতে হতো। যে কোন সমস্যা দেখা দিলেই গোত্রের অন্যান্য নেতারা তার কাছেই সমাধানের জন্য ছুটে আসতো। গোটা মক্কার যখন সে অবিসংবাদিত নেতা, তখন সে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা কুরাইশদের একত্রিত করে তাদের মধ্যে গোটা মক্কা ভাগ করে দিয়েছিল। মক্কার আশে-পাশের এলাকা সে ভাগ করে দিয়েছিল কা'ব ইবনে লুয়াই-এর বিভিন্ন শাখার মধ্যে।
মক্কার আশে পাশে যারা বাস করতো তাদেরকে বলা হত হারামবাসী। এদের ভেতরে ছিল বনী নওফেল, বনী আল মুত্তালিব, বনী আবদে শামস, বনী আদী, বনী হাশিম, বনী আব্দুদ্দার, বনী জুমাহ্, বনী আব্দুল উজ্জা, বনী সাহম, বনী যুহরা, বনী তাইম ও বনী মাখযুম। এদেরকে কুরাইশ আল্ল্বিতাহ্ বলা হতো। এ ছাড়া অন্যদেরকে মক্কার বাইরের এলাকা ভাগ করে দিয়েছিল। এভাবে শহরের বিভিন্ন অংশে এক একটি পরিবারকে সে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কুছাঈয়ের ইন্তেকালের পরে তাঁর পুত্র আবদে মানাফের ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পিত হয়েছিল। আব্দে মানাফেরও পুত্র সন্তান ছিল ছয়জন। তার মধ্যে আমর ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং নানা গুনাবলী সম্পন্ন। এই আমরেরই উপাধী ছিল হাশিম। আমর পরবর্তীতে মক্কার মুতাওয়াল্লীর পদে আসীন হয়েছিল। ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে পূর্ব থেকেই কিছু পদ্ধতি মক্কায় প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এককভাবে কারো কোন দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন নেতা এক একটি দায়িত্ব পালন করতো। হাজীদের পানি পান করানো এবং খাদ্যের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হাশিম পালন করতো। কেননা, যমযম কূপের কোন চিহ্ন ছিলনা। বিধায় চামড়ার মশকে পানি সংরক্ষণ করা হত। হাজীদের আহারের জন্য কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের কাছ থেকে চাঁদা এসে হাশিমের কাছে জমা হতো।
মক্কায় একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আমর বহু উট জবাই করে রুটি বানিয়ে মানুষকে খেতে দিয়েছিল। তারপর রুটি টুকরা টুকরা করে ছিড়ে এক ধরনের খাবার বানিয়ে তা মানুষকে খেতে দেয়া হয়েছিল। আরবী 'হাশিম' শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু ভেঙ্গে গুড়ো করা। তিনি রুটি টুকরো করে মানুষকে খেতে দিয়েছিলেন বলে তাকে হাশিম উপাধি দান করা হয়েছিল। হাশিম ছিল একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। সে তাঁর ভাই নওফেল, আবদে শামস এবং মুত্তালিবের সাথে পরিকল্পনা করেছিল, কিভাবে ব্যবসার ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত করা যায়। পরিকল্পনা মাফিক তাঁরা এগিয়ে গিয়েছিল।
তাদের পরিকল্পনা ছিল, আরবদের পথে প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে মিশর এবং শামে যে ব্যবসা চলছিল সে ধরনের ব্যবসা করা। বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানী করতে হবে এবং তা বাজারজাত করতে হবে। এমন এক সময়ে তারা একাজে হাত দিয়ে সাফল্য লাভ করেছিল, যখন আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো পারস্যের সাসানী সরকার। রোম সরকার কুরাইশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে শুল্ক আদায় করতো, হাশিম তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দিয়ে সে শুল্ক মওকুফ করিয়েছিল। একইভাবে তিনি এবং তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে আরব জগতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি ঘটান। বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে তাদের একটা ভিন্ন সম্মান এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ব্যবসার পণ্য সামগ্রী যে পথে সরবরাহ হতো, তা যেন লুষ্ঠিত না হয় এবং পূর্বের ন্যায় কেউ যেন অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করতে না পারে-এ ব্যাপারে তারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গোটা আরবে লুঠতরাজ এবং ছিনতাই চলতে থাকলেও কুরাইশদের ব্যবসার কাফেলা বা বাণিজ্য বহরের গায়ে কেউ হাত দিত না। এর আরেকটি কারণ হলো, তারা ছিল আল্লাহর ঘরের খাদেম-এ কারণেও সর্বত্র তারা ছিল মর্যাদার পাত্র। ব্যবসার ক্ষেত্রে হাশিমরা চার ভাই এতটা উন্নতি করেছিল যে, তাদেরকে উপাধি দান করা হয়েছিল 'মুত্তাজিরীন' অর্থাৎ পেশাগত ব্যবসায়ী। আরবের চারদিকের রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন গোত্রের সাথে তারা যে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এ কারণে তাদেরকে উপাধিদান করা হয়েছিল 'আসহাবু ইলাফ'। যার অর্থ হলো বন্ধুত্ব সৃষ্টিকারী।
এভাবে তারা চারদিকে তাদের বহু রাজনৈতিক মিত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের চার ভাইয়ের এই শুভ উদ্যোগের কারণে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে কুরাইশদের ব্যবসা বাণিজ্যই শুধু নয়-সভ্যতা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসারও সুযোগ হয়েছিল। ফলে কুরাইশদের দূরদৃষ্টি এবং বুদ্ধিমত্তার পরিধি এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে, গোটা আরবে তাদের সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। অর্থ-সম্পদের দিক থেকে, জ্ঞান বিবেক বুদ্ধির দিক থেকে তথা সমস্ত দিকেই তারা আরবের মধ্যে ছিল শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। কুরাইশদের প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই মক্কা আরব উপদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এভাবে তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ইরাক থেকে লেখন পদ্ধতির বর্ণমালা সংগ্রহ করে এনেছিল। সে লেখন পদ্ধতি পরবর্তীতে আল্লাহর কোরআন লেখার কাজে এসেছিল। সে সময়ে কুরাইশদের মধ্যে যতো জ্ঞানী এবং শিক্ষিত লোক ছিল তা অন্য কোন গোত্রে ছিল না। মুসানাদে আহমাদে হযরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু একটি হাদীসে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন, 'কুরাইশ। বংশের লোক অন্য সব লোকদের নেতা।' কুরাইশদের অসংখ্য গুণাবলীর কারণেই আল্লাহর রাসূল উক্ত মন্তব্য করেছিলেন। এভাবে কুরাইশরা যখন ক্রমশঃ উন্নতিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, ঠিক তখনই মক্কাকে গুরত্বহীন করে ব্যবসা-বাণিজ্যের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিজেরা গ্রহণ করার লক্ষ্যে আবরাহা মক্কায় আক্রমণ করতে এসেছিল।
সে যদি বিজয়ী হতে পারতো, তাহলে কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে পড়তো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে হাবশী ও রোমানরা একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতো। কুরাইশরা কুছাঈ ইবনে কিলাবের পূর্বে যে বিক্ষিপ্ত ও দূরাবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল, তার থেকেও ভয়ঙ্কর পরিণতি তাদেরকে বরণ করে নিতে হতো। কা'বা ধ্বংস করে এসে আবরাহার বিশাল বাহিনীর করুণ পরিণতি দেখে গোটা আরববাসীর মনে এ কথা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, কা'বা সত্যকার অর্থেই আল্লাহর ঘর এবং তারা পূর্বের তুলনায় কা'বার প্রতি অধিক সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করতো। সেই সাথে কা'বার সেবক কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি লাভ করলো এবং তাদের কর্তৃত্ব সর্বত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চারদিকে বিস্তার লাভ করলো।
সাধারণ আবরবাসীদের মনে কুরাইশদের সম্পর্কে ধারণা জন্ম নিলো যে, কুরাইশদের প্রতি মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। এ জন্য কুরাইশরা আরবের সর্বত্র নির্ভীকভাবে যাতায়াত করতো পারতো এবং তারা যেখানেই যেতো, সেখানেই সম্মান ও মর্যাদার আসন লাভ করতো। এমন কোন শক্তি তখন ছিল না যে, তারা কুরাইশদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা দেয় বা তাদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করে। তাদের জন্য সর্বত্রই ছিল সম্মান-মর্যাদা আর নিরাপত্তা। এসবই সম্ভব হয়েছিল একমাত্র কা'বা ঘরের কারণে। কা'বা ঘরের সম্মান-মর্যাদার কারণেই কুরাইশরা সর্বত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ, প্রাচুর্যতা, বিত্ত-বৈভব, ধন-সম্পদ, সম্মান-মর্যাদা ও নিরাপত্তা লাভ করেছিল। আরবের লোকগুলোও এ কথা অকপটে স্বীকৃতি দিতো যে, আল্লাহর ঘর এই কা'বাই তাদেরকে অভাব থেকে মুক্তি দিয়েছে, নিরাপত্তা ও সম্মান-মর্যাদা দিয়েছে, সর্বত্র দিয়েছে উচ্চ আসন।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নবুওয়াত লাভ করলেন এবং এই সূরা অবতীর্ণ হলো, তখন আরবের লোকগুলো উল্লেখিত বিষয় সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় অবগত ছিল বলেই আলোচ্য সূরায় উল্লেখিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র ছোট্ট কথায় তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তোমরা স্বয়ং নিজেরাই সাক্ষ্য দাও যে, এই ঘর আল্লাহর-কোন দেব-দেবীর নয়। এই ঘরের কারণেই তোমরা অভাব মুক্ত হয়ে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েছো এবং সম্মান-মর্যাদা লাভা করেছো। নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছো। ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে নিজেদেরকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছো। সুতরাং তোমাদের একমাত্র কর্তব্য হলো, যে আল্লাহর ঘরের কারণে তোমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে, এখন সেই আল্লাহর দাসত্ব করা। তিনি যাকে নবী-রাসূল হিসাবে মনোনীত করেছেন, তাঁর প্রতি স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর ওপরে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে জীবন বিধান অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা অনুসরণ করা।
সুরা কুরাইশ
(১) কুরাইশ বংশের নিরাত্তার জন্যে, (২) তাদের শীত ও গরম কালের সফরের নিরাত্তার জন্যে-(৩) তাদের এই ঘরের মালিকেরই ইবাদাত করা উচিত। (৪) যিনি দুর্দিনে তাদের খাবার সরবরাহ করেছেন এবং তিনি তাদের ভয়-ভীতি থেকেও নিরাপদ করেছেন।
আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাঃ
আলোচ্য সূরার বক্তব্য অনুধাবন করতে হলে এই সূরার ঐতিহাসিক পটভূমি সামনে রাখতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরাইশদেরকে নানা ধরনের নে'মাত দান করে কিভাবে ধন্য করেছেন, তা আমরা আলোচ্য সূরার পটভূমিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। একমাত্র কা'বা ঘরের উপলক্ষ্যেই তাদেরকে এসব নে'মাত দানে ধন্য করা হয়েছিল, এ কথা স্বয়ং কুরাইশরা যেমন অবতগত ছিল, তেমনি অবগত ছিল গোটা আরববাসী। এরপর আল্লাহ তা'য়ালা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নে'মাত দান করে তাদের সম্মান ও মর্যাদা পূর্বের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি করেছেন, এই কথাটি তখন পর্যন্তও তারা অনুভব করতে সক্ষম হয়নি। আর সেই নে'মাতটি ছিল, স্বয়ং কুরাইশদের মধ্যে থেকেই মহান আল্লাহ তা'য়ালা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আখেরী জামানার পয়গম্বর বিশ্বনেতা, শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানবতার মহান মুক্তির দুত বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্বাচিত করেছেন। সেই অভ্রান্ত জীবন বিধান মহাগ্রন্থ আল কোরআনও সেই কুরাইশদের মধ্য থেকে নির্বাচিত নবী-রাসূলের ওপরেই অবতীর্ণ করেছেন।
সমস্ত নে'মাতের তুলনায় এই নে'মাতটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ নে'মাত, এ কথা তারা তখন পর্যন্তও অনুধাবন করতে পারেনি। এ কারণেই তারাই সর্বপ্রথম কোরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতকে তারা অস্বীকার করে আসছিল। এ জন্য মহান আল্লাহ তা'য়ালা আলোচ্য সূরায় তাদেরকে সেই নে'মাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, তোমাদের আচরণ তো বড়ই বিস্ময়কর! শুধু তোমরাই নও, গোটা আরববাসী এ কথা জানে যে, এই ঘরটি স্বয়ং আল্লাহর। আর এই ঘরের সম্মান ও মর্যাদার কারণেই তোমরা সর্বত্র সম্মান-মর্যাদা, উচ্চ আসন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ, অভাবমুক্ত ঐশ্বর্য্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, নিরাপত্তা, নেতৃত্ব ও শাসকের পদ লাভ করেছো। এ কথা তোমরা জানো এবং জানো বলেই আবরাহা যখন আক্রমণ করতে এসেছিল, তখন তোমরা তোমাদেরপূজিত দেব-দেবীর কাছে আশ্রয় বা সাহায্য কামনা না করে একমাত্র আমারই কাছেই আশ্রয় এবং কাতর কণ্ঠে সাহায্য কামনা করেছিলে। তাহলে জেনে শুনে সেই আল্লাহর দাসত্ব না করে, তাঁর বিধান অনুসারে জীবন পরিচালিত না করে কিভাবে তোমরা কল্পিত দেব-দেবীর পূজা আরধনা করছো? এটা তো বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার!
একটির পর আরেকটি নে'মাত আমি তোমাদেরকে দান করলাম। পৃথিবী ও আখিরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নে'মাত সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসূল ও কোরআন তোমাদের ভেতরে দিলাম সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য। সেই সর্বশ্রেষ্ঠ নে'মাতের সাথে তোমরা কি বিস্ময়কর আচরণ করছো? তোমাদের আপনজন, তোমাদেরই কল্যাণকামী আমার রাসূল তো তোমাদেরকে নতুন কোন আদর্শের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে না। তিনি তোমাদেরকে সেই পুরনো পাঠ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন মাত্র। যে আল্লাহ তোমাদেরকে অসংখ্য নে'মাত দানে ধন্য করেছেন, সেই আল্লাহর দাসত্ব করা তোমাদের কর্তব্য, সেই কর্তব্য পালনের দিকেই তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন।
গ্রীষ্মকালে মক্কায় প্রচন্ড গরম অনুভূত হতো কিন্তু সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে সে সময় গরমের অতটা তীব্রতা অনুভূত হতো না। এ জন্য মক্কার কুরাইশরা গ্রীষ্মকালে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের দিকে বাণিজ্য যাত্রা করতো। আর ঠান্ডার মৌসুমে মক্কা এলাকায় তীব্র শীত নেমে আসতো। কিন্তু সে সময় দক্ষিণ আরবের দিকটায় উষ্ণতা বিরাজ করতো। এ কারণে মক্কার কুরাইশরা শীতের মৌসুমে দক্ষিণ আরবের দিকে বাণিজ্য যাত্রা করতো। মৌসুম অনুকুলে হওয়ার কারণে তারা বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করতো। এটাও ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য এক বিরাট নেয়ামত। এই নে'মাতের কথাও আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যাতায়াতের পথে যেখানে অন্যান্য বাণিজ্য বহর দস্যু-তস্করদের হাতে পড়ে লুন্ঠিত হতো, সেখানে কুরাইশরা কা'বা ঘরের সেবক হওয়ার কারণে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তার সাথে বাণিজ্য করে মাতৃভূমিতে ফিরে আসতো।
এসব নে'মাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে বলছেন, তোমাদের একান্ত কর্তব্য হলো, সেই ঘরের মালিকের দাসত্ব করা এবং তাঁর দেয়া জীবন বিধান অনুসরণ করা, যে ঘরের কারণে তোমরা বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করছো, তোমাদের বাণিজ্য বহরে দুস্য-তস্করেরা আক্রমণ করছে না, তোমরা নিরাপত্তা পাচ্ছো এবং বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হচ্ছো।
কা'বা ঘরে তারা ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করেছিল এবং প্রতিদিন ঘটা করে এসব মূর্তির পূজা করা হতো। কিন্তু তারা এ কথারও স্বীকৃতি দিতো যে, এই মূর্তিগুলো তাদের রব্ব নয়। তাদের রব্ব হলেন একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা এবং তিনিই আবরাহার হামলা থেকে তাদেরকে হেফাজত করেছেন। এই কুরাশরা-যারা আল্লাহর রাসূলের আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করছিল, তারা এ কথাও জানতো যে, এই ঘরের সেবক হওয়ার পূর্বে বা এই ঘরের আশ্রয়ে আসার পূর্বে তারা ছিল এলোমেলো বিক্ষিপ্ত এবং হতদরিদ্র। কোথাও তাদের সম্মান-মর্যাদা ছিল না। অভাব ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। অন্যান্য গোত্রের মতোই তারাও এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতো। কিন্তু তারা যখন এই ঘরের আশ্রয়ে এলো এবং কা'বাঘরের সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তখনই তাদের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটলো। নেতৃত্বের আসন তারা লাভ করলো এবং সম্মান ও মর্যাদা তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লো। অভাব দূরিভূত হয়ে স্বচ্ছলতার সোনালী সূর্য উদিত হলো। ঐ ঘরের মালিকের অনুগ্রহেই যে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে, এ কথা তারা উত্তমভাবেই আবগত ছিল।
আল্লাহ তা'য়ালা সেই কথাই তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, চরম বিপদের সময় তোমরা মূর্তি ত্যাগ করে আমারই কাছে প্রার্থনা করেছিলে। সেই বিপদ দূর হবার পরেও দীর্ঘ সাত আট বছর আমারই বন্দেগী করেছিলে। তারপর তোমাদের এমন কি হলো যে, তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে মূর্তিপূজা শুরু করলে? যা ছিল তোমাদের কর্তব্য, সেই কর্তব্যের দিকেই তোমাদেরই আল আমীন তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তোমরা কেন তাঁর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁর সাথে বিরোধিতা করছো?
এই মক্কা অতীতে কতটা দৈন্য দশায় নিপতিত ছিল, জনমানবহীন ভয়াবহ এক রুক্ষ প্রান্তর ছিল, আল্লাহর কোরআন থেকেই তা অবগত হওয়া যায়। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম তাঁর শিশু সন্তান ও প্রিয়তমা স্ত্রীকে সেই কা'বা ঘরের কাছেই রেখে গিয়েছিলেন, যখন কা'বা মাটির নিচের চাপা পড়েছিল। তিনি তখন দোয়া করেছিলেন- رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ ... إِلَى اخر الاية হে আমার রব্ব! আমি পানি ও তরুলতা শূন্য এক মহাপ্রান্তরে আমার সন্তানদের একটি অংশকে তোমার মহাসম্মানিত ঘরের কাছে এনে পুনর্বাসিত করলাম। হে আমার রব্ব। আমি এই কাজ এ জন্য করেছি যে, এরা এখানে নামাজ কায়েম করবে। অতএব লোকদের হৃদয়কে এদের প্রতি অনুরক্ত বানিয়ে দাও এবং খাওয়ার জন্য তাদেরকে ফল দান করো। (সূরা ইবরাহীম-৩৭)
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের এই দোয়া থেকেই এ কথা প্রমাণিত হলো যে, মক্কা এলাকা কি ধরনের বিরান ভূমি ছিল। কুরাইশরা এই এলাকায় আসার পূর্বে দারিদ্র পীড়িত বিক্ষিপ্ত ছিল। যখনই তারা এই এলাকায় আগমন করলো, তখনই তাদের পূর্বের অবস্থা ক্রমশ পরিবর্তন হতে থাকলো। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীমের দোয়ার বরকতে ঐ এলাকাকে আল্লাহ তা'য়ালা গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে সম্মানিত এলাকায় পরিণত করলেন। যে সময় আরব ভূমির কোন একটি এলাকাও নিরাপদ ছিল না। দিন রাতের কোন একটি মুহূর্তও মানুষের জন্য নিরাপদ ছিল না। যে কোন মুহূর্তে দুস্যু তস্করের দল আক্রমণ করে নির্বিচারে হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষন চালাতো। কোন মানুষ নিজের গোত্রের বাইরে গেলেই জীবিত ফিরে আসবে বা তাকে ধরে দাস হিসাবে বিক্রি করা হবে না, এই নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কোন কাফেলা ছিল না, যারা নিরাপদে পথ চলতে পারতো। যেসব বাণিজ্য কাফেলা যে পথে যাতায়াত করতো, সেই পথে যেন তারা আক্রান্ত না হয়, এ জন্য তারা এলাকার গোত্রপতিকে ঘুষ দিতে বাধ্য হতো।
পক্ষান্তরে মক্কার লোকগুলো ছিল এর ব্যতিক্রম। সর্বত্র তাদের জন্য ছিল নিরাপত্তা এবং সম্মান ও মর্যাদা। তারা যে কোন অবস্থায় যে কোন স্থানে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারতো। ঘাতক যদি তাদের মাথার ওপরে তরবারি উঁচু করে তুলতো আর সেই মুহূর্তে সে যদি জানতো পারতো, লোকটি মক্কার, তখনই তার উঁচু তরবারি নিচে নেমে আসতো। 'লোকটি মক্কী এলাকার' নিরাপত্তা ও সম্মান-মর্যাদা লাভের জন্য তার ঐ পরিচয়টিই যথেষ্ট ছিল। আলোচ্য সূরায় এসব নে'মাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই তাদেরকে বলা হয়েছে, যে ঘরের কারণে তোমরা আজ নেয়ামতে পরিপূর্ণ, তোমাদের উচিত হলো সেই ঘরের যিনি মালিক, একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা। তিনি যে রাসূলকে প্রেরণ করেছেন সেই রাসূলের আনুগত্য করা এবং কোরআনের বিধান অনুসারে জীবন পরিচালিত করা। তাহলে তোমরা বর্তমানে যে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, এর থেকেও শত গুণ বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে সক্ষম হবে।
কা'বা স্বয়ং আল্লাহ নয় বা আল্লাহর সত্তা এমনও নয় যে, তিনি কা'বাঘরে অবস্থান করবেন। ঐ ঘরটিকে স্বয়ং আল্লাহ নির্বাচন করেছেন যেন সমস্ত মুসলমান ঐ ঘরকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয় এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। ঐ কেন্দ্র থেকেই তাওহীদের আলোর মশাল গোটা পৃথিবীকে আলোকিত কলে। আল্লাহ তা'য়ালা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সেই বিধান কোথায় কিভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রয়োগ করা হবে, সে সিদ্ধান্ত যেন ঐ কেন্দ্রে বসেই মুসলমানরা গ্রহণ করে। ঘরটিকে স্বয়ং আল্লাহ মুসলমানদের সামগ্রিক কাজের ব্যাপারে নির্বাচিত করেছেন বলেই তাকে বায়তুল্লাহ্ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়েছে। সেই ঘরের কারণে যদি মানুষ সম্মান-মর্যাদা, নিরাপত্তা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, নেতৃত্ব ও শাসকের পদ লাভ করতে সক্ষম হয়, তাহলে যারা ঐ ঘরের মালিকের দাসত্ব করবে, তাঁর রাসূলকে একমাত্র অনুসরণযোগ্য নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে, গোটা পৃথিবীর নেতৃত্ব এবং ধন-সম্পদ তো তারাই লাভ করবে-এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা পবিত্র কোরআনে এই ওয়াদা করেছেন এবং তাঁর ওয়াদা-ই সবথেকে সত্য। কোরআনের এই থিউরি কোন কাল্পনিক বিষয় নয়। বাস্তবে তা প্রমাণও করে দিয়েছে আল্লাহর কোরআন। দরিদ্র, অভাবী উত্তম গুণ-বৈশিষ্ট্যহীন একটি জাতি যখন ঐ ঘরের মালিক স্বয়ং আল্লাহর গোলামী করেছে, তখন তারা এই পৃথিবীর শাসকের আসনসহ যাবতীয় কিছু লাভ করেছিল। পৃথিবীর ধন-ভান্ডার তাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়েছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে পৃথিবী ইতিপূর্বে কখনো সেই সোনালী রাষ্ট্র দেখেনি, ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের অবর্তমানেও আকাশের নিচে ও যমীনের বুকে সেই সোনালী দিন আর ফিরে আসেনি। বর্তমানেও মুসলমানদের ললাটে সেই সৌভাগ্য শশীর উদয় পুনরায় হতে পারে, যদি তারা সেই ঘরের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দাসত্ব করে এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলকেই একমাত্র অনুসরণীয় নেতা হিসাবে মেনে নেয়।
0 Comments