প্রিয়নবী (সাঃ)-এর বংশ পরিচিতি

 প্রিয়নবীর (সাঃ) আবির্ভাব আরবে হওয়ার তাৎপর্য

        যখন সর্বপ্রকার পাপের বিভীষিকা নিয়ে সমগ্র পৃথিবীর প্রত্যেকটি কোণ, অলি-গলি, আনাচ্-কানাচ্ কলুষিত হয়ে পড়েছিল, সারা জাহান অধীর হয়ে ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় কাতর নয়নে তাকিয়েছিল, সে সময় রাহমানুর রাহীম আল্লাহ্ তা'আলা প্রেরণ করেন স্বীয় হাবীব, সৃষ্টসেরা মহামানব মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সাম্যবাদী, স্বাধীনচেতা, অসামান্য বীরত্বের অধিকারী, দুর্ধর্ষ আরব জাতির আবাসভূমি, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল আরব উপদ্বীপে।

        ভৌগলিক হিসাবে আরব দেশের মক্কানগরী ভূমণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। স্থলপথে ইরাক হয়ে ইরান, তুর্কিস্থান, খোরাসান, কাবুল, ভারতবর্ষে পৌছা যায়। অপরদিকে সিরিয়া হয়ে মিসর, তিউনিসিয়া, মরক্কো ও স্পেন পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। আবার সমুদ্রপথে আফ্রিকা ইউরোপের নানা শহরে যাওয়া যায়। তাছাড়া ভারতবর্ষ, সুমাত্রা এবং চীন পর্যন্ত সুগম পথ বিদ্যমান।

         আরব দেশে বংশগত ও গোত্রগত কৌলীন্য প্রথার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ বংশ মর্যাদা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। প্রাচীনকাল হতে তাঁরা নিজেদের বংশ পরিচয়, বংশের মূল ও শাখা-প্রশাখার পূর্ণ বিবরণ যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেক গোত্রেই দুই একজন বেতনভুক্ত বংশপরিচয়-বিশারদ নিযুক্ত করে রাখত। তাদের স্মরণশক্তিও ছিল অসাধারণ। তাঁরা প্রাচীন ও মধ্য যুগের লক্ষ লক্ষ কবিতা অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করে রেখেছিল। বাৎসরিক মেলা ও হজ্জ উপলক্ষে গোত্র-বিবরণবেত্তা ও কবিগণ প্রকাশ্য সম্মিলন ক্ষেত্রে নিজেদের জ্ঞান ও ধীশক্তির পরিচয় দিয়ে প্রশংসিত হওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতা করত।

        পবিত্র কাবা গৃহকে তাঁরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতম ধর্ম মন্দির বলে বিশ্বাস করত। তাঁরা প্রতি বৎসর মক্কায় সমবেত হয়ে হজ্জব্রত পালন করত। এ পবিত্র ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ, কা'বাস্থিত ঠাকুর-দেবতাগণের পূজা করা, তাদেরকে ভোগাদি দেওয়া, হজ্জযাত্রীদের পানাহার ও বাসস্থানের তত্ত্বাবধান করা তাদের নিকট সবচাইতে গৌরবজনক কাজ ছিল। এ গৌরবজনক কাজের অধিকারী ছিল একমাত্র মক্কাবাসী কুরাইশগণ।

        তাঁরা দাবি করত যে, আমরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক, হযরত ইব্রাহীম ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) আমাদের পূর্বপুরুষ। আবার তাঁরাই ছিলেন এ পবিত্র কাবা গৃহের নির্মাতা এবং হযরত ইসমাঈল (আঃ) হলেন এর সর্বপ্রথম সেবায়েত। সুতরাং বংশমর্যাদা এবং উত্তরাধিকার উভয় হিসাবেই আমরা এ সেবার অধিকারী। অতএব সেবায়েত ও পুরোহিত হবার অধিকার আমাদিগের ব্যতীত অন্য কারো নেই এবং থাকতেও পারে না। অন্যান্য বংশের লোকেরা অবনত মস্তকে তাদের এ দাবীকে মেনে নিত।

        আরব জাতি ছিল অপরিসীম বীরত্বের অধিকারী। কোন শক্তির বল-বিক্রমের ভয়-সংঙ্কোচ কখনও তাদের অন্তরকে স্পর্শ করতে পারে নাই। ভয়াবহ রণাঙ্গনকে তাঁরা ধুলি খেলার চাইতে অধিক মর্যাদা দেয় নাই। সেসঙ্গে তাদের অন্তরে ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ম সম্পাদনের অদম্য প্রেরণা। এজন্যই তাঁরা শুধু পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নহে, বরং দুনিয়ার সমস্ত জাতিও রাজ্যের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিল এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই একদিকে ভারত এবং অপরদিকে স্পেন ও ফ্রান্স পর্যন্ত ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে পেরেছিল। অতিথি-সেবা এবং প্রতিবেশীদের জন্য আত্মোৎসর্গ করা ছিল তাদের একটি বিশেষত্ব। অপরিচিত বিদেশী মেহমানের মেহমানদারী করা; জুয়া খেলায়, প্রতিযোগিতায় এবং ধুলা খেলায় বিজয়ীদিগকে পুরষ্কার দিয়ে অথবা ভোজ সভায় আপ্যায়িত করে নিজেদের ধন-সম্পদ বিলায়ে দেওয়া এবং আশ্রিত ও আত্মসমর্পণকারীদের সাহায্যার্থে নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করে দেওয়া ছিল তাদের চিরাচরিত প্রথা।

         পৃথিবীর সমস্ত অনাচার ও অবিচারের প্রতিকার ও প্রতিবিধান করার জন্য যে মহামানবের আগমন হবে তাঁর এমন দেশে আবিভূর্ত হওয়া ছিল সমীচীন, যে দেশ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, যে দেশের লোকেরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের স্বাধীন চিন্তা দ্বারা পবিত্র ধর্মের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবে এবং নিজেদের আল্লাহ প্রদত্ত স্মরণশক্তি বলে আল্লাহর পবিত্র কালাম এবং রসূলের অমূল্য উপদেশ কণ্ঠস্থ করে পৃথিবীর দূর-দূরান্তে প্রত্যেক নর-নরীর কর্ণকুহরে পৌঁছিয়ে দিতে পারবে। এজন্যেই সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রিয় হাবীব, সমগ্র জগতের ত্রাণকর্তা শেষ নবীকে প্রেরণ করলেন 'আরধের মক্কা নগরীতে।

প্রিয়নবী (সাঃ)-এর বংশ পরিচিতি

        প্রিয়নবী (সঃ)-এর বংশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশী মর্যাদাশীল ও পবিত্র। এটা এমন এক সত্য কথা যে, মক্কার সমস্ত কাফির এবং তাঁর শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারবে না। আবু সুফিয়ান (রাঃ) কাফির থাকাকালে রোমান সম্রাটের নিকট তা স্বীকার করেন। অথচ ঐ সময় তিনি সুযোগ পেলেই রসূলে করীম (সঃ)-এর বিরুদ্ধে যে কোন দুর্নাম রটাতে আগ্রহী ছিলেন।

        প্রিয়নবী (সঃ)-এর পিতার দিক থেকে তাঁর বংশ পরিচয় হলো- মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম বিন আবদে মান্নাফ বিন কুশাই বিন কিলাব বিন মুরারাহ বিন কা'ব বিন লুয়াই বিন গালিব বিন ফিহর বিন মালিক বিন নাযর বিন কিনানা বিন খুজায়মা বিন মুদরিকা বিন ইলইয়াস বিন মুদার বিন নিযার বিন মা'আদ বিন আন্নান। এ পর্যন্ত বংশানুক্রম


সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণিত। এখান থেকে হযরত আদম (আঃ) পর্যন্ত মতভেদ রয়েছে। মা-এর দিক থেকে বংশ পরিচয় হলো- মুহাম্মদ বিন আমিনা বিনতে ওয়াহ্হাব বিন আবদে মান্নাফ বিন জুহরা বিন কিলাব। উপরে বর্ণিত বংশানুক্রম দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কিলাব বিন মুরারাহ পর্যন্ত রসূলে করীম (সঃ)-এর পিতা-মাতার বংশ এক হয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments