খাদীজা (রাঃ) একজন বুদ্ধিমতী ও বোধশক্তিসম্পন্না মহিলা ছিলেন। হুযুর (সাঃ)-এর ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, আভিজাত্য এবং আশ্চর্যজনক উন্নত চরিত্র দেখে খাদীজা (রাঃ) স্বয়ং এ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, যদি তিনি সম্মত হন তবে তাঁর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবেন। যখন হযরত (সাঃ)-এর পঁচিশ বৎসর তখন হযরত খাদীজা (রাঃ) এর সাথে তাঁর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত খাদীজার বয়স ঐ সময় চল্লিশ বৎসর ছিল।
বিবাহ অনুষ্ঠানে আবু তালিব, বনু হাশিম এবং মুদার বংশের সর্দারগণ সমবেত হন। আবু তালিব বিবাহের খুতবা পাঠ করেন। ঐ খুতবায় আবু তালিব হযরত (সাঃ)-এর সম্পর্কে যে সমস্ত কথাবার্তা বলেন, তা হলোঃ ইনি মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। যদিও তিনি ধন-সম্পদে কম, কিন্তু ভদ্র চরিত্র ও উচ্চ মর্যাদার কারণে যে ব্যক্তিকেই তাঁর প্রতিদ্বন্দী হিসেবে রাখা যাক না কেন, পরিণামে তিনিই হবেন উচ্চমর্যাদার অধিকারী। কেননা, ধন-দৌলত ধ্বংসশীল, ছায়াস্বরূপ এবং ক্ষয়মাণ বস্তু। ইনি মুহাম্মদ (সাঃ) যার আত্মীয়তা সম্পর্কে আপনারা সবাই জানেন, খাদীজা বিনতে খোয়াইলীদের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করাতে চাই। তাঁর সমস্ত মোহরে মুয়াযফেল (তাৎক্ষণিক আদায়কৃত) এবং মোহরে মুয়ায্যাল (বিলম্বে পরিশোধযোগ্য) আমার সম্পদ হতে আদায়কৃত এবং আল্লাহর শপথ, এর পর তাঁর মান সম্মান ও প্রভাব অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
হুযুর (সাঃ)-এর মাহাত্ম্য সম্পর্কে আবূ তালিবের এ বাক্য বা মন্তব্য ঐ সময় করা হয়েছিল, যখন তাঁর বয়স একুশ বৎসর এবং তখনও প্রকাশ্যভাবে তাঁকে নবুওয়ত প্রদান করা হয়নি। এরপর অবস্থা ছিল এই যে, আবূ তালিব তখনও তাঁর সনাতন ধর্মেই ছিলেন, যে ধর্ম বিলোপ করে দেওয়ার জন্য হুযূর (সাঃ) সারাটি জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সাথে হুযুর (সাঃ)-এর বিবাহ হয়ে গেল। তিনি ওহী নাযিল হওয়ার পূর্বে ও পরে মোট চব্বিশ বৎসর হুযুর (সাঃ)-এর সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভে প্রিয়নবী (সাঃ)-এর সন্তান
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভে হুযুর (সাঃ)-এর দুই পুত্র ও চার কন্যা সন্তান জন্মেছিলেন। সন্তানদের মধ্যে কাসেম ও তাহের পুত্রসন্তান ছিলেন। কাসেম (রাঃ)-এর নামের দ্বারা তাঁর পদবী আবুল কাসেম হিসাবে খ্যাত এবং তাহের (রাঃ) সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর নাম ছিল আবদুল্লাহ। হযরত ফাতিমা, যয়নাব, রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুম তাঁর চার কন্যা সন্তান ছিলেন। হযরত যয়নাব তাঁর সন্তানদের মধ্যে বয়োজ্যৈষ্ঠ ছিলেন।
এরা সবাই হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভজাত সন্তান। তবে তৃতীয় পুত্র ইবরাহীম (রাঃ) শুধু হযরত মারিয়া কিন্তীয়া (রাঃ)-এর গর্ভে জন্মেছিলেন। এ তিন পুত্রসন্তান শিশুকালেই ইন্তেকাল করেন। হযরত কাসেম (রাঃ) সম্পর্কে কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তিনি বাহনের উপর আরোহণ করার উপযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রিয়নবী (সাঃ)-এর কন্যা সন্তানগণ
উম্মতে মুহাম্মদীর সর্বসম্মত অভিমতানুসারে সমস্ত কন্যাসন্তানের মধ্যে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-ই সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাসম্পন্না ছিলেন। হুযুর (সাঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, তিনি বেহেশতবাসী মহিলাদের সর্দার বা নেত্রী হলেন। পনের বৎসর সাড়ে পাঁচ মাস বয়সের সময় হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। চারশত আশি দিরহাম মোহরানা ধার্য করা হয়েছিল। এই সাইয়্যেদাতুন নিসার বিবাহে যৌতুক ছিল একটি চাদর, একটি বালিশ, যাতে খেজুর বৃক্ষের নীল ভর্তি ছিল, একটি চামড়ার গনি, একটি চৌকি, একটি ছাগল, দু'টি মাটির পাত্র, দু'টি মশক্ত এবং একটি ঢাকা। ঢাকা ঘুরানো এবং ঘরের কাজকর্ম তিনি নিজে করতেন। ইহকাল ও পরকালের নেতার সবচেয়ে প্রিয়ঃ এই নন্দিনীর বিবাহে যৌতুক এবং মোহর ছিল এই এবং এই ছিল তাঁর দরিদ্র জীবনের চিত্র। তাঁকে দেখেও কি ঐ সমস্ত মহিলারা লজ্জাবোধ করবে না, যারা বিবাহের প্রচলিত কু-প্রথায় ভেসে নিজেদের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস করে দেয় ।
এ বিবাহে আল্লাহ তা'আলার বিরাট হিকমত বিরাজমান ছিল যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কোন পুত্র সন্তান জীবিত ছিলেন না। শুধু কন্যা সন্তানদের পক্ষ থেকে হুযুর (সাঃ)-এর বংশধারা মুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কন্যার মধ্যে শুধু হযরত ফাতিমার সন্তানগণই জীবিত ছিলেন। অন্যান্য কন্যার মধ্যে কারো সন্তান জন্মে নি, কারো কারো সন্তান জীবিত থাকে নি।
হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর বিবাহ আবুল আস বিন রাবিয়ার সাথে হয়েছিল। এর গর্ভে একজন ছেলে জন্মেছিল, যিনি অল্প বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং একজন নেরে (উমামা) জন্যগ্রহণ করেন, যাকে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (রাঃ) বিবাহ করেন। কিন্তু এর গর্ভে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি।
নবী-নন্দিনী হযরত রুকাইয়া (রাঃ)-এর হযরত উসমান গনী (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ হয়। হাবশায় হিজরতের সময় তিনি সাথে ছিলেন। দ্বিতীয় হিজরীতে বদর যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পথে নিঃসন্তান অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এর পর তৃতীয় হিজরীতে তাঁর বোন উম্মে কুলসুমকে হুযুর (সাঃ) হয়য়ত উসমানের সাথে বিবাহ দেন। এই জন্য হযরত উসমান (রাঃ)-এর উপাধি 'জিল্লুরাইন' হয়। নবম হিজরীতে এরও ইন্তেকাল হয়। ঐ সময় হুযুর (সাঃ) বলেছেন, "যদি আমায় নিকট তৃতীয় কন্যা থাকতো, তাহলে তাকেও আমি উসমানের সাথে বিবাহ দিতাম।"
মহিলাদের জন্য শিক্ষা
ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, একদা হযরত রুকাইয়া (রাঃ) হযরত উসমান (রাঃ)-এর সাথে মনোমালিন্য করে হযরত (সাঃ)-এর কাছে অভিযোগ করতে আসেন। হুযুর (সাঃ) বলেন, "আমার এটা পছন্দ নয় যে, কোন মহিলা আপন স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। যাও, আপন ঘরে ফিরে যাও।" এটা হলো মেয়েদের ঐ শিক্ষা যার দ্বারা তাদের জীবন ইহকাল ও পরকাল উভয়ই সফল হবে।
প্রিয়নবী (সাঃ)-এর চাচা ও ফুফু
আবদুল মুত্তালিবের দশজন পুত্র-সন্তান ছিল। হারিস, যুবায়র, হাজল, দেবার, মুকাব্বেম, আবু লাহাব, আব্বাস, হামযা, আবু তালিব, আবদুল্লাহ্। এদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ হযরতের পিতা ছিলেন। বাকি নয় জন তাঁর চাচা। হযরত আব্বাস (রাঃ) ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। হযরতের ছয় জন ফুফু ছিলেন।
প্রিয়নবী (সাঃ)-এর পাহারাদার
সা'দ ইবন মা'আজ (রাঃ) বদর যুদ্ধে, জাকওয়ান বিন আবদে কায়েস (রাঃ)-এবং মুহাম্মদ বিন সালমা (রাঃ) ওহুদ যুদ্ধের ঘুবায়র (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধে এবং এবাদ বিন বশীর (রাঃ) সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) আবু আইয়ুব (রাঃ) এবং বিলাল (রাঃ) ওয়াদী কেরাভ হয়ূর (সাঃ)-এর পাহারাদার ছিলেন। যখন এই আয়াত নাযিল হয়ঃ "আল্লাহ্ তা'আলা স্বয়ং আপনার হিফাজত করবেন" তখন এই পাহারাদারী উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
0 Comments