কুরায়শদের নির্যাতন এবং প্রিয়নবীর (সাঃ) অটলতা

        যখন কুরায়শরা তাদের অভিসন্ধি পুরণে ব্যর্থ হলো এবং দেখলো, দিন দিন হযরত (সাঃ)- এর দাওয়াতের প্রসার হচ্ছে এবং বিপুল সংখ্যায় লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করছে, তখন তারা সর্বপ্রকার উৎপীড়ন করতে লাগলো। মক্কার কয়েকজন বখাটে ও লম্পট ব্যক্তিকে একত্র করে উদ্বুদ্ধ করলো যে, তারা যেন প্রতিটি মজলিস ও সভায় হযরতকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে এবং যেভাবেই সম্ভব হযরতকে কষ্ট দেয়।

প্রিয়নবী (সাঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনা

            একদিন হযরত কা'বা শরীফে নামায পড়ছিলেন। যখন সিজদায় গেলেন, তখন আবু জাহল এই সময়টুকু সুবর্ণ সুযোগ মনে করে হুযুর (সাঃ)-কে পাথর মেরে মাথা মুবারক চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ফন্দি করলো। কিন্তু যখন সে পাথর নিয়ে হযরত (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছে, তখন হাত কেঁপে উঠে পাথর তার হাত থেকে পড়ে যায়। অতঃপর পলায়ন করে নিজেদের দলে চলে এসে বলে, "যখন আমি হযরতের মাথার উপর হাত বাড়াবার চেষ্টা করি, তখন এক আশ্চর্য ধরনের উট আমার দিকে আক্রমণ করার জন্য তেড়ে আসে। আমার মনে হয় যেন আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমি আজ পর্যন্ত এমন উট দেখিনি।"

        এটা ঐ ঘটনা যা কাফিরদের সমাগমে সবার সামনে ঘটেছিল এবং কাফিরদের সর্দার আবু জাহল স্বয়ং এটা স্বীকার করেছে। আবু জাহল, ওকবা বিন আবূ মুয়ীত, আবু লাহাব, আস বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন আবদে ইয়াগুস, আসওয়াদ বিন আবদুল মুত্তালিব, ওলীদ বিন মুগীরা, নজর বিন হারিস-এদের সবাই সর্বদা হযরত (সাঃ)-কে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করতো। এদের কেউ ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করে নি, বরং সবাই অত্যন্ত অপমানজনকভাবে ধ্বংস হয়। কিছু বদর যুদ্ধে তলোয়ারের আঘাতে নিহত হয়, আর কিছু অত্যন্ত কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

কুরায়শদের পক্ষ হতে লোভ দেখানো

        যখন কুরায়শদের অভিসন্ধিতে কোন কাজ হলো না, তখন সবাই পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা তাদের চালাক সর্দার ওতবা বিন রাবী'আকে তাঁর নিকট পাঠাবে, যেন সে তাঁকে দুনিয়ার সর্বপ্রকার লোভ দেখায়। হয়ত তিনি-ঐ তদবীরের দ্বারা তাঁর দাবী ও কার্যকলাপ হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়ে যাবেন। ওতবা বিন রাবী'আ হযরতের খিদমতে হাযির হলো। তিনি মসজিদে নামায পড়ছিলেন। নিকটে গিয়ে বললেন, ভাতিজা! তুমি অভিজ্ঞতা ও বংশের দিক দিয়ে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম। এতদসত্ত্বেও তুমি আমাদের সম্প্রদায়ে মতভেদ সৃষ্টি করে চলেছ এবং আমাদের মাবুদ ও তাদেরকে মন্দ বল। আমাদের বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষদেরকে জাহিল বলে থাক। তুমি আজ তোমার অন্তরের কথা বল। যদি এ সমস্ত ঘটনার দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য এই হয় থাকে যে, বিপুল সম্পদ জমা করবে, তাহলে শোন! আমরা তোমার জন্য এত বেশী ধন-দৌলত জমা করতে তৈরি যে, তুমি মক্কাবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্পদশালী হয়ে যাবে। যদি নেতৃত্ব চাও, তাহলে আমরা এতে সম্মত যে, তোমাকে সমস্ত কুরায়শদের নেতা বানিয়ে দেব এবং তোমার নির্দেশ ছাড়া এক তিলও কোন কিছু নড়বে না। যদি উদ্দেশ্য বাদশাহী বা রাজত্ব লাভ হয়ে থাকে, তা'হলে আমরা তোমাকে সকলের বাদশা বা রাজা বানাতে পারি। আর যদি তোমার উপর (নাউযুবিল্লাহ) কোন জ্বিনের আছর হয় তা-হলে আমরা কোন ডাক্তার বা হেকিম খোঁজ করে আনতে পারি, যিনি তোমার চিকিৎসা করবেন।

        যখন ওতবা তার কথাবার্তা শেষ করলো, তখন নবী (সাঃ) তার এতো সব কথার উত্তরে শুধু কুরআনের একটি সূরা শুনিয়ে দিলেন, যা শুনে ওতবা হতভম্ব হয়ে গেল এবং স্বীয় গোত্রের নিকট ফিরে এসে বললো যে, "আল্লাহর শপথ, আজ আমি এরূপ বাণী শুনেছি যা এর পূর্বে জীবনে কখনো শুনিনি। আল্লাহর শপথ! এটা কবিতা নয়, এটা গণকদের বাণী নয়, এটা যাদুও নয়। আমার মত হলো এই যে, তোমরা সবাই এই ব্যক্তিকে (হযরত (সাঃ) কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাক। কেননা তার যে বাণী আমি শুনেছি, আল্লাহর শপথ, এর বিরাট সম্মান ও মর্যাদা অবস্যই প্রকাশ হয়ে পড়বে। আমি তোমাদের শুভাকাঙ্খী, তোমরা আমার কথা মেনে নাও। দেশী না হোক আর কয়েকটি দিন ধৈর্য ধারণ করো; যদি আরব তাঁর উপর বিজয়ী হয়, তাহলে তোমরা বিনা প্রয়াসে এ আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। আর যদি তিনি আরবের উপর বিজয়ী হন, তবে তাঁর সম্মান তো আমাদেরই সম্মান। কেননা তিনি আমাদেরই বংশধর।

        কুরায়শরা তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও চতুর সর্দারের এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল এবং এ বলে মুখ বাঁচালো যে, এর উপর মুহাম্মদ (সাঃ) যাদু করেছেন।

        যখন কুরায়শদের কোন অভিসন্ধিতেও কাজ হলো না, তখন তারা নবী (সাঃ)-এর সাথে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম, পরিবারবর্গ ও আত্মীয় স্বজনদেরকে অত্যাচার ও বিভিন্নভাবে কষ্ট দেওয়া শুরু করলো। হযরত বিলাল (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হলো। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ)-এর মাতাকে এ কারণেই অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হলো। এটাই ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম শাহাদাতের ঘটনা।

Post a Comment

0 Comments