হযরত (সাঃ)-এর বয়স ৩৫ বৎসর। ঐ সময় কুরায়শগণ বায়তুল্লাহ শরীফ পুর্ণাঙ্গভাবে নির্মাণের মনস্থ করেন। বায়তুল্লাহ নির্মাণে অংশ গ্রহণে প্রত্যেকেই নিজকে সৌভাগ্যবান এবং এটাকে নেক কাজ মনে করতেন। কুরায়শ গোত্র নিজেদের ভাগ্যে এটাই ফয়সালা করে রেখেছিল যে, এর নির্মাণ কাজে তারা সিংহ-ভাগ অংশ নেবে। তাই এ নির্মাণ কার্য সমস্ত গোত্রের মধ্যে বণ্টন করার ব্যবস্থাপনা করতে হলো, যাতে কোন বিবাদ সৃষ্টি না হয়।
কা'বা নির্মাণ বণ্টনের কাজ ক্রমান্বয়ে' হাজরে আসওয়াদ' পর্যন্ত পৌছল। কিন্তু নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের ব্যাপারে মতানৈক্য শুরু হলো। প্রত্যেক গোত্র এবং প্রত্যেকেরই কামনা ছিল যে, তারাই এ পূণ্য অর্জন করবে। ফলে ঘটনাটি এতদূর পর্যন্ত পৌছে গেল যে, তারা মারামারি-কাটাকাটির জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে লাগলো। জাতির কোন কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি প্রস্তাব করলেন যে, পরামর্শ করে কোন সন্ধির পথ বের করা হোক। এ প্রস্তাবে সবাই পরামর্শের জন্যে মসজিদে একত্রিত হলেন।
পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম মসজিদের এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন তিনিই এ ব্যাপারে মীমাংসা করবেন এবং তাঁর নির্দেশ সকলেই কুদরতী নির্দেশ মনে করে মেনে নিতে বাধ্য হবে।
আল্লাহ্ তা'আলার কুদরতে সর্বপ্রথম নবী (সাঃ) এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। হযরতকে দেখে সবাই একবাক্যে বললেন, এ যে আল-আমীন। আমরা তাঁর নির্দেশে সম্মত আছি।' এমনি পরিস্থিতিতে পরামর্শ সভার সিদ্ধান্তে মুহাম্মদ (সাঃ) বুদ্ধিমত্তার সাথে এমনভাবে এর মীমাংসা করলেন যে, সবাই খুশী হলেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক একটি চাদর বিছানো হলো। তিনি নিজ হাতে 'হাজরে আসওয়াদ'টি চাদরে রাখলেন এবং প্রত্যেক গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে চাদরের এক কোণা ধরার জন্য নির্দেশ দিলেন। তাই করা হলো। পাথর যখন নির্ধারিত স্থানে পৌঁছালো, তখন হযরত (সাঃ) স্বীয় হাতে তা পুনঃস্থাপন করলেন।
ইবনে হিশাম এ ঘটনা বর্ণনা করার পর লিখেছেন যে, নবুওয়তের পূর্বে সমস্ত কুরায়শ সর্বসম্মতিক্রমে এবং সম্মিলিতভাবে তাঁকে 'আল-আমীন' বলে ডাকতেন।
নবুওয়াত প্রাপ্তি
হযরত (সাঃ)-এর বয়স যখন চল্লিশ বৎসর এক দিন, তখন প্রকাশ্যভাবে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে নবুওয়ত প্রদান করে সম্মানিত করেন। জন্ম তারিখের মত উহাও রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার ছিল।
ইসলাম প্রচারের প্রথম পদক্ষেপ
যখন নবী (সাঃ) এর উপর ওহী নাযিল হয়, তখন প্রকাশ্যভাবে দ্বীন প্রচারের জন্য তিনি আদিষ্ট হননি। বরং এতে শুধু হযরতের ব্যক্তিগত আমলের জন্য আহকাম ছিল। এর পর কিছুদিন ওহী নাযিল বন্ধ থাকার পর যখন দ্বিতীয়বার ওহী নাযিল আরম্ভ হলো, তখন এতে হযরতকে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো, কিন্তু দুনিয়াতে তখন মুর্খতা ও গোমরাহীর রাজত্ব বিদ্যমান। বিশেষ করে আরবদের অংকার ও গৌরব এবং পূর্বপুরুষদের অনুসরণ তাদেরকে সত্যের আওয়াজে কান লাগাবার (আমল করার) কখনই সুযোগ দিত না হিকমতে ইলাহীর উদ্দেশ্য এই যে, হযরতকে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রথমেই নির্দেশ না দেওয়ার কারণ। যেন প্রথম হতেই এর প্রতি মানুষের বিদ্বেষ না জন্মে। সুতরাং হযরত (সাঃ) প্রথমত, ইসলামের দাওয়াত পরিচিত এবং সে সমস্ত লোকদের মাঝে শুরু করেন, যাদের উপর তিনি বিশ্বাস করতেন অথবা তিনি দুরদর্শিতার মাধ্যমে তাদের মাঝে কল্যাণ ও মঙ্গলের চিহ্ন দেখতেন।
এ পথে সর্বপ্রথম আযওয়াজে মুতাহআরাত হযরত খাদীজা (রাঃ) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত (সঃ)-এর চাচাতো ভাই হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত (সাঃ)-এর পালক পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারিসা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবূ বকর (রাঃ) নুবুওয়তের পূর্বে হুযুর (সাঃ)-এর বন্ধু ছিলেন এবং হযরতের সত্যবাদিতা, সাধুতা ও চরিত্র সম্পর্কে খুব ভাল জানতেন। যখন হযরত (সাঃ) তাঁকে রিসালাতে ইলাহিয়ার (নবুওয়তের) খবর জানালেন, তখন তিনি সাথে সাথেই হযরতের দাওয়াত সত্য বলে বিশ্বাস করলেন এবং কালেমা শাহাদাত পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর গোত্রের মধ্যে সবার নিকট সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। সমস্ত ব্যাপারে লোকেরা তাঁর উপর বিশ্বাস করতো। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ঐ সমস্ত লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, যাদের মধ্যে কিছু কল্যাণ ও মঙ্গলের কিছু চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং হযরত উসমান গনী (রাঃ), হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রাঃ), হযরত সা'দ বিন ওয়াক্কাস (রাঃ), যুবায়র ইবনুল আওয়াম (রাঃ) এবং তালহা বিন উবায়দুল্লা (রাঃ) তাঁর দাওয়াত কবুল করলেন। তিনি সবাইকে হযরত (সাঃ)-এর খিদমতে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে তাঁরা সকলেই মুসলমান হয়ে গেলেন।
এরপর আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ, উবায়দাহ ইবনুল হারিস বিন আবদুল মুত্তালিব, সাঈদ বিন যায়দ আদভী, আবু সালমা মাখযুমী, খালিদ বিন সাঈদ ইবনুল 'আস, উসমান বিন মাজউন এবং তাঁর দু'ভাই কুদামা ও উবায়দুল্লাহ, আরকাম বিন আরকাম (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের সবাই কুরায়শ গোত্রের ছিলেন। কুরায়শ ব্যতীত সুহায়ব রুমী, আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ), আবু যর গিফারী (রাঃ), আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন।
ঐ সময় পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত গোপনে চলছিল। ইবাদত ও শরীয়তের আমলও গোপনে পালন করা হতো; এমন কি পুত্র পিতা হতে এবং পিতা পুত্র হতে লুকিয়ে নামায পড়তেন। যখন মুসলমানদের সংখ্যা ত্রিশোর্ধ হয়ে গেল, তখন হযরত (সাঃ) তাদের জন্য একটি প্রশস্ত ঘর নির্ধারণ করলেন, যেখানে সবাই একত্রিত হতেন এবং হুযুর (সাঃ) তাঁদেরকে তালিম দিতেন।
এ পদ্ধতিতে ইসলামের দাওয়াত তিন বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সময় কুরায়শদের এক বিশেষ জামা'আত ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর আরো অন্যান্য লোক ইসলাম গ্রহণ করা শুরু করে। এ খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণের মাঝে বিভিন্ন জায়গায় তা আলোচনা হতে থাকে। তাই এখন প্রকাশ্যভাবে সত্যের দাওয়াত পৌছানোর সময় এসে যায়।
0 Comments