মহান আল্লাহ বলেন: "মহা প্রলয়। মহা প্রলয় কি? হে নবী। মহা প্রলয় কি তা কি আপনি জানেন? সেদিন সকল মানুষ দিশেহারা হয়ে পাগলের ন্যায় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াবে। আর পাহাড়সমূহের অবস্থা হবে ধুনিত পশমের ন্যায়। (সূত্র: সূরা আল কারিয়াহ)
উপরোক্ত আয়াতে আল কারিয়া (খট খট আওয়াজ করা) দ্বারা মহা প্রলয় বা কেয়ামতের কথা বুঝানো হয়েছে। কারিয়া নামটি এজন্য রাখা হয়েছে যে, সেদিন ভয়-ভীতি এবং কঠিন আওয়াজে কান ঝনঝন করবে। সেদিন মানুষ দিশেহারা হয়ে কীটপতঙ্গের ন্যায় ছুটোছুটি করবে এবং অস্থির অবস্থায় হাশর ময়দানে জমায়েত হওয়ার জন্য সজোরে চলতে থাকবে। তারা এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় চলবে, যেমন কীট পতঙ্গ ছুটাছুটি করে আগুনের আলোয় এসে পড়ে। আর পাহাড়গুলোর অবস্থা এমন হবে যে, তা যেন ধুনা পশম ও তুলা। সেগুলো ধুনার পর যেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অনুরূপভাবে পাহাড়গুলোও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়তে থাকবে।
সূরা মুরসালাতে আল্লাহ তাআ'লা বলেন-
- "আর পাহাড়গুলো যখন উড়তে থাকবে।"
সূরা নাবায় বলেন-
- "আর পাহাড়গুলোকে পরিচালিত করা হবে এবং সেগুলো পরিণত হবে উজ্জল বালুকায়।" সূরা নামলে বলেন- "আর আপনি পাহাড়গুলো দেখছেন এবং মনে করছেন যে, এগুলো অটল ও স্থির হয়ে হয়ে আছে, অথচ (কেয়ামতের দিন) সেগুলো মেঘমালার ন্যায় উড়তে থাকবে। এ কাজটি করবেন সে মহান আল্লাহ তাআ'লা, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে সুদৃঢ় করে রেখেছেন।" (সূত্র: সূরা নামল, ৭ম রুকু)
অর্থাৎ হে নবী। আপনি বিরাট বিরাট পাহাড় ও পর্বতমালাকে দেখে ভাবছেন যে, এগুলো অটল অনড় ও চির স্থীর, কখনোই স্থানচ্যুত হবে না। কিন্তু এমন একদিন আসবে, যেদিন এসব পাহাড় পর্বত আল্লাহ তাআ'লার ধ্বংসলীলায় ধুনো পশম বা তুলার ন্যায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উড়তে থাকবে। উড়তে থাকবে আকাশে উড়ন্ত মেঘমালার ন্যায়। মহান আল্লাহ তাআ'লা প্রত্যেক জিনিস যথোপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি পাহাড় পর্বতমালাকে এমন ভারী ও স্থির করে সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে পৃথিবী হেলতে দুলতে পারছে না। আল্লাহ তাআ'লা বলেন,
অর্থাৎ- "আর তিনি পৃথিবীতে পাহাড়গুলো এজন্য বানিয়েছে, যাতে পৃথিবী তা নিয়ে হেলতে দুলতে না পারে।" অত:পর এ পাহাড়গুলোকে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআ'লা কেয়ামতের দিন চূর্ণ বিচূর্ণ করে বাতাসের সাথে খণ্ড খণ্ড মেঘমালার ন্যায় উড়াবেন। এ হবে সে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার ক্রিয়া কৌশল, যার কোন কাজই হেকমত বা প্রজ্ঞাশূন্য নয়। সূরা ওয়াকিয়ায় আল্লাহ তাআ'লা বলেন:
অর্থাৎ- "আর পাহাড় পর্বতগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে, অতঃপর তা পরিণত হবে উড়ান্ত ধুলো-বালির ন্যায়।"
আকাশ ও পৃথিবীর অবস্থা
কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দিন আকাশ ও পৃথিবীর অবস্থা কিরূপ হবে, তার বর্ণনায় আল্লাহ তাআ'লা বলেন: "হে নবী! লোকেরা আপনার কাছে পাহাড় পর্বতমালা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি তাদেরকে বলুন, কেয়ামতের দিন আমার প্রতিপালক এগুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দেবেন। অতঃপর তিনি পৃথিবীকে পরিণত করবেন সমতল ময়দানে। যাতে আপনি কোন বক্রতা ও উচ্চতা দেখতে পাবেন না।"
(সূত্র: সূরা তাহা, আয়াত: ১০৫-১০৭)
কেয়ামতের দিন মহাপ্রলয়ের কারণে পাহাড়-পর্বতগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দেয়া হবে। আর সমগ্র পৃথিবীকে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হবে। কোথাও কোন অসমতল ভূমি থাকবে না, থাকবে না পাহাড় পর্বত, টিলা, উচ্চ ভূমি, মালভূমি ইত্যাদি। সূরা ইবরাহীমে আল্লাহ তাআ'লা বলেন: "সেদিন এ পৃথিবীকে অন্য পৃথিবীর দ্বারা পরিবর্তন করা হবে এবং আকাশকেও পরিবর্তন করা হবে। আর মানুষ দণ্ডায়মান হবে একক ও পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআ'লার সম্মুখে।" (সূত্র: সূরা ইবরাহীম- ৭ম রুকু)
এ আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, বর্তমান আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবর্তন করা হবে। তা বর্তমান অবয়ব ও রূপাকৃতিতে বহাল থাকবে না। এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা) রাসূল (স:)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, আকাশ ও পৃথিবীকে পরিবর্তন করা হলে সেদিন মানুষ কোথায় থাকবে? প্রত্যুত্তরে নবী করীম (স:) বললেন, মানুষ তখন পুলসেরাতের উপর থাকবে। (সূত্র: মুসলিম, মেশকাত শরীফ)
এ হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, এ আয়াতে কারীমায় আকাশ ও পৃথিবী পরিবর্তন হওয়ার যে কথা উল্লেখ রয়েছে, তা হিসাব নিকাশ হওয়ার পর তখনই হবে, যখন মানুষ জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের জন্য পুলসিরাতে গিয়ে উপনীত হবে।
উপরোল্লিখিত আয়াতে যে, পৃথিবীকে সমতল ময়দানে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে হিসাব নিকাশ শুরু হওয়ার পূর্বের অবস্থা। হযরত সাহল ইবনে সাআ'দ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, কেয়ামতের দিন মানুষ এমন ভূমিতে সমবেত হবে, যার বর্ণ হবে সাদা ও মেটে রং বিশিষ্ট। এ সময় ভূমি ময়দার রুটির ন্যায় হয়ে যাবে। তাতে কোন নিদর্শন বা চিহ্ন থাকবে না। (সূত্র: বোখারী, মুসলিম শরীফ)
কেয়ামত সংঘটন কালে আকাশে এ পরিবর্তন সূচিত হবে যে, তার তারকারাজি খসে পড়বে এবং আলোহীন হয়ে যাবে। আর চন্দ্র-সূর্যের আলোও নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে। আকাশ ফেটে তাতে দরজা সৃষ্টি হবে। যেমন সূরা নাবায় আল্লাহ তাআ'লা বলেন-
"যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন তোমরা দলে দলে হাশর ময়দানে আল্লাহর দরবারে আসতে থাকবে। আর আকাশমণ্ডলী খুলে দেয়া হবে, তাতে থাকবে অনেক দরজা।"
(সূত্র: সূরা নাবা ১ম রুকু)
অর্থাৎ, সেদিন আকাশে ফাটল সৃষ্টি হয়ে এমন হবে যে, মনে হবে যেন অনেক দরজা সৃষ্টি হয়েছে। সূরা মুরসালাতে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ- "আর যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে।"
সূরা ফুরকানে আল্লাহ তাআ'লা বলেন- -"যেদিন আকাশ মেঘমালাসহ বিদীর্ণ হবে এবং ফেরেশতাগণকে অবতরণ করানো হবে।" (সূরা ফুরকান ৩য় রুকু)
সূরা হাক্কায় আল্লাহ তাআ'লা বলেন: "অতএব যখন শিংগায় একটি মাত্র ফুঁক দেয়া হবে, তখন পৃথিবী ও পাহাড় উৎক্ষিপ্ত হবে এবং এক ধাক্কায় উভয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, সেদিন ঘটবে মহাপ্রলয়। আর আকাশ বিদীর্ণ হয়ে সেদিন তা বিযুক্ত হয়ে পড়বে। ফেরেশতাগণ আকাশের কিনারায় অবস্থান করবে। আর আপনার প্রতিপালকের আরশ সেদিন আটজন ফেরেশতা বহন করবে।" (সূত্র: সূরা হাক্কাহ)
আকাশ যখন ফাটা শুরু করবে তখন ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তে চলে যাবে। সূরা আর রহমানে আল্লাহ তাআ'লা আকাশের অবস্থা বর্ণনায় বলেন-
"যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে, তখন তা হবে রক্ত গোলাপ বর্ণে রঞ্জিত চামড়ার ন্যায়।" (সূত্র: আর সূরা রহমান -৩৭)
সূরা মাআ'রিজে আল্লাহ তাআ'লা বলেন, সেদিন আকাশ গলিত তামার ন্যায় হয়ে যাবে। অর্থাৎ ফাটল ধরার সাথে সাথে তার রংও বিবর্তন হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করবে। সূরা তুরে বলা হয়েছে-
"সেদিন আকাশ থর থর করে কাঁপতে থাকবে।"
সূরা ইনশিকাকে আল্লাহ তাআ'লা বলেন: "যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং স্বীয় প্রতিপালকের নির্দেশ পালন করবে। আর এ দু'টোই তার করণীয়। আর যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হবে এবং তার অভ্যন্তরে যা কিছু আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে এবং শূন্য গর্ভ হয়ে পড়বে। সে তার প্রতিপালকের নির্দেশ পালন করবে এবং এটাই হবে তার করণীয়।
(সূত্র: সূরা ইনশিকাক, আয়াত: ১-৫)
আকাশ বিদীর্ণ হওয়া এবং পৃথিবী সম্প্রসারিত হওয়ার নির্দেশ তার প্রতিপালক আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ থেকে দেয়া হবে। এরা উভয়ই আল্লাহ তাআ'লার সৃষ্টি। আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন করাই সৃষ্টির অপরিহার্য কাজ। এরা উভয়ই আল্লাহ তাআ'লার নির্দেশ কার্যকরি করবে এ কার্যকরি করাই হচ্ছে তাদের কর্তব্য। আর স্বীয় মালিকের সম্মুখে মাথা অবনত করে বিনাবাক্যে তার নির্দেশ মেনে চলাই হবে তাদের করণীয়।
পৃথিবীকে টেনে রাবারের ন্যায় লম্বা করা হবে এবং দালান-কোঠা পাহাড়-পর্বত সব কিছু ধ্বংস করে তাকে একটি সমতল ময়দানে পরিণত করা হবে। যাতে পূর্বাপর সমস্ত মানুষ একই সময় দণ্ডায়মান হতে পারে, আর তাদের মধ্যে কোন ব্যবধান ও পর্দা না থাকে। পৃথিবী তার ভূগর্ভের সমুদয় জিনিস ও সম্পদ বাইরে উদগীরণ করে সম্পূর্ণ শূন্যগর্ভ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীর ভূগর্ভে যত প্রকার খনিজ সম্পদ এবং মৃত লাশ ছিল তা সহ সেসব জিনিস সে উদগীরণ করে ফেলবে, যা মানুষের কর্মের প্রতিদানের সাথে সংশ্লিষ্ট।
0 Comments