হাবশায় হিজরতের নির্দেশ


        হযরত (সাঃ) নিজে সর্বপ্রকার জুলুম-অত্যাচার ও কষ্ট সহ্য করছিলেন; কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম ও তাঁদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত যখন এই নির্যাতনের ধারা সম্প্রসারিত হলো এবং হযরত দেখলেন যে, তাঁরা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সমস্ত জুলুম-অত্যাচার সহ্য করার জন্য তৈরী আছেন, কিন্তু এ সত্য বাণী এবং আল্লাহর নূর হতে মুখ ফিরাতে কখনো তৈরী নন, যা হুযুর (সাঃ)-এর বদৌলতে তাঁদের লাভ হয়েছে, তখন হুযুর (সাঃ) তাঁদেরকে আবিসিনিয়ার দিকে হিজরত করার অনুমতি দিলেন।

        নবুওয়তের পঞ্চম বৎসর রজব মাসে বারো জন পুরুষ এবং চারজন মহিলা হিজরত করেন, যাঁদের মধ্যে হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর স্ত্রী হযরত রুকাইয়া (রাঃ)-ও ছিলেন। 

        হাবশার বাদশাহ নিরাপত্তায় সাথে সেখানে বাস করতে লাগলেন। যখন কুরায়শদের নিকট এ খবর পৌঁছলো, তখন তাদের পক্ষ হতে আমর ইবনুল 'আস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাবী'আকে নাজ্জাশীর নিকট (এ ফরমান নিয়ে) পাঠানো হলো যে, 'এ সমস্ত লোক ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টিকারী; তাদেরকে আপনার রাজ্যে অবস্থানের অনুমতি দেবেন না, বরং তাদেরকে আমাদের হাতে সোপর্দ করে দিন।"

         নাজ্জাশী একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাদের উত্তরে বললেন, "আমি তাদের ধর্ম ও তাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে জ্ঞাত না হয়ে এ কাজ করতে পারব না।" অতঃপর যখন নাজ্জাশী মুসলমানদেরকে বললেন যে, তোমাদের ধর্ম ও এর ঘটনাবলী সঠিক বর্ণনা কর, তখন যাফর বিন আবি তালিব (রাঃ) সামনে এগিয়ে আসেন এবং বলেনঃ "বাদশাহ নামদার! আমরা প্রথমে অন্ধকারে ছিলাম, প্রতিমা পুজা করতাম; মৃত জন্তু ভক্ষণ, অবৈধ কাজ, আত্মীয়তা-বন্ধন দিয়া, নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ইত্যাদিতে নিমগ্ন ছিলাম। আমাদের মধ্যে শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতো। এমনি মুহর্তে আল্লাহ তা'আলা আমাদের মাঝে একজন

        রসূল পাঠালেন, যিনি আমাদেরই আত্মীয়। আমরা তাঁর বংশ ও সত্যবাদিতা, আমানতদারী ও পবিত্রতা সম্পর্কে ভালো ভাবেই জ্ঞাত আছি। তিনি আমাদেরকে এ কথার দাওয়াত দেন যে, আমরা যেন আল্লাহরই ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার ও সমকক্ষ মনে না করি; প্রতিমা পূজা ত্যাগ করি, সত্য কথা বলি, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সহমর্মিতা পোষণ করি, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করি। তিনি হারাম বস্তু হতে নিষেধ করেন; রক্তপাত করা, মিথ্যাকথা বলা এবং ইয়াতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করা হতে নিষেধ করেছেন। আমাদেরকে নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা এসব শুনে তাঁর উপর ঈমান (বিশ্বাস) স্থাপন করেছি।"

        নাজ্জাশী এ সমস্ত শুনে খুব প্রভাবিত হলেন। কুরায়শদের দু'জন দূতকে ফেরত পাঠালেন এবং নিজে মুসলমান হয়ে গেলেন। মুহাজিরীন সেখানে তিন মাস নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করে ফিরে আসেন। এ সময় হুযুর (সাঃ)-এর দোয়ার বরকতে হযরত উমর ফারুক (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সময় পর্যন্ত মুসলমান পুরুষদের সংখ্যা চল্লিশ এবং মহিলাদের সংখ্যা এগারো জনের বেশী ছিল না। ফারুকে আজম হযরত উমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের এক প্রকার মর্যাদা লাভ হলো; যে সমস্ত লোক প্রমাণাদির মাধ্যমে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, কিন্তু কুরায়শদের শাস্তির ভয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করতে পারেনি, তারা এখন প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। এভাবে আরব গোত্রসমূহের মাঝেক্রমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার লাভ করতে লাগলো।

         যখন কুরায়শরা দেখলো যে, হযরত (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদা দিন দিন বেড়ে চলছে এবং হাবশার বাদশাহ্ও তাঁদের খুব সম্মান দেখাচ্ছেন, তখন তারা তাদের পরিণতি সম্বন্ধে ভাবিত হয়ে পড়ল।

        কুরায়শরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, বনী আবদুল মুত্তালিব ও বনী হাশিমের নিকট দাবী উত্থাপন করা হবে, তারা যেন তাদের ভাতিজাকে (মুহাম্মদ (সাঃ)) তাদের নিকট সোপর্দ করে দেয়, নতুবা তারা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবে।

        কিন্তু বনী আবদুল মুত্তালিব এটা গ্রহণ করলো না। তাই সর্বসম্মতিক্রমে এই অঙ্গীকারপত্র লেখা হলো যে, বনী হাশিম ও বনী আবদুল মুত্তালিবের সাথে পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে; আত্মীয়তা, বিবাহ-শাদী, ক্রয়-বিক্রয় সব বন্ধ করা হবে। এ অঙ্গীকারপত্র বায়তুল্লাহর ভিতর টাঙিয়ে দেয়া হলো।

        এক পাহাড়ের উপত্যকায় হযরত (সাঃ) তাঁর সমস্ত বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনকে বন্দী করা হলো। তাদের ঐ উপত্যকায় অবরুদ্ধ হয়ে সব দিক থেকে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। পানাহারের যে সমস্ত দ্রব্য সাথে ছিল, তাও এক সময় শেষ হয়ে গেল। তখন কঠিন দুর্ভাবনা শুরু হল। ক্ষুধার তাড়নায় বৃক্ষের পাতা খাওয়ার উপক্রম হলো। এ অবস্থা দেখে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সাহাবায়ে কিরামকে দ্বিতীয়বার হাবশায় হিজরত করার আদেশ দিলেন। এবার এক বিরাট দল হিজরত করে হাবশায় চলে যান। তাঁদের সংখ্যা ৮৩ জন পুরুষ এবং ১২ জন মহিলা বলে বর্ণনা করা হয়। এঁদের সাথে ইয়ামানের মুসলমানগণও মিলিত হন, যাঁদের মধ্যে হযরত আবু মুসা আশ'আরী (রাঃ) এবং তাঁর গোত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল।

        এদিকে নবী করীম (সাঃ) বাকী পরিবারবর্গ ও সাহাবায়ে কিরামসহ প্রায় তিন বছর এ জুলুম-অত্যাচার ও দুঃখ-কষ্টে কালাতিপ কষ্টে কালাতিপাত করেন। এরপর কয়েক এবং হযরত (সাঃ)-এর উপর থেকে এ অবরোধ তুলে ফেলার জন্য এগিয়ে আসে। এদিকে হযরত (সাঃ)-কে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয় যে, ঐ অঙ্গীকারপত্র পিঁপড়া লোকায় গেছে ফেলেছে এবং আল্লাহর নাম ছাড়া সেখানে অন্য কোন অক্ষরই অবশিষ্ট নেই। তিনি লোকদের কাছে তা বর্ণনা করলেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, হযরত (সাঃ) ঘটনা যেরূপ বর্ণনা করেছেন তা'ই সত্য ও যথার্থ। অবশেষে হযরতের উপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়।

তোফায়ল বিন আমর দুসীর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ

        এ সময় হযরত তোফায়ল বিন আমর দুসী (রাঃ)-তিনি অত্যন্ত সজ্জন এবং স্বীয় গোত্রের সর্দার ছিলেন- হযরত (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে ইসলামের সত্যতা ও 'হযরত (সাঃ)-এর চরিত্র মাধুর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হুযুর (সাঃ)-এর নিশ্চয় আরয করলেন, হে "আল্লাহর রসূল। আমার গোত্রের মাঝে আমার কথা মান্য করা হয়। আমি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেব। কিন্তু আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, যেন আমার মধ্যে এমন কোন নিদর্শন প্রকাশ করা হয়, যার দ্বারা আমি তাদেরকে নিজের দাবীর বা আহ্বানের সপক্ষে বিশ্বাস স্থাপন করাতে পারি।"

         হযরত (সাঃ) দোয়া করলেন। আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর কপালে এমন এক নূর চমকিয়ে দিলেন যে, তা অন্ধকারে একটি অত্যুজ্জ্বল প্রদীপের ন্যায় জ্বলত। যখন তোফায়ল বিন আমর স্বীয় গোত্রের নিকট গেলেন, তখন চিন্তা করলেন, কোন সময় আমার গোত্র যেন এই নূর বা আলোককে কোন বিপদ বা রোগ বলে মনে না করে এবং এও না বলে যে, ইসলাম গ্রহণ করার ফলে আমার মধ্যে এ রোগ সংক্রমিত হয়েছে। এ জন্য তিনি দোয়া করলেন যে, এটা যেন করায়ত্ত করে দেওয়া হয়। আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর দোয়া কবুল করলেন এবং এই নূরকে তাঁর চাবুকের সাথে ঝুলন্ত প্রদীপের ন্যায় লাগিয়ে দেন।

        তিনি স্বীয় গোত্রের নিকট গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তাঁর চেষ্টায় কিছু লোক মুসলমান হলেন বটে, কিন্তু তাঁর সাফল্য আশানুরূপ হলো না। তখন তিনি হুযুর (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে নিবেদন করলেন, "আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আমার চেষ্টা সফল হয়। হযরত (সাঃ)- দোয়া করলেন এবং বললেন, 'যাও, তবলীগ করো এবং কোমলতার সাথে কাজ করো।" তোফায়ল বিন আমর ফিরে এলেন এবং লোকদের ইসলামের দিকে আহবান জানালেন। আল্লাহর ফজলে এরূপ কামিয়াব হলেন যে, খন্দকের যুদ্ধের পর ৭০/৮০ পরিবারকে মুসলমান করে খায়বরের যুদ্ধে নিজের সাথে নিয়ে আসেন এবং সবাই জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন।

Post a Comment

0 Comments