নামাযের হাকীকত কী

        স্মরণ রাখবেন, কখনও মানুষ হাযিরাতুল কুদস বা পবিত্র মজলিস পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন সে আল্লাহ পাকের অত্যধিক নৈকট্য লাভ করে। তাই সেখান থেকে তার ওপর পবিত্র জ্যোতি অবতীর্ণ হয়। তখন সে ইন্দ্রিয়ের ওপর বিজয়ী হয়ে এমন সব অতিন্দ্রিয় ঘটনা অবলোকন করবে যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তারপর আবার যেখানে ছিল সেখানে ফিরে আসে। ফলে তার ভেতর অস্থিরতা দেখা দেয় ও অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে সে এ নিম্ন অবস্থা মেনে নেয়। অবশ্য তার এ নিম্ন অবস্থা সাধারণের নিম্ন অবস্থা থেকে অনেক উত্তম। তখন সে আল্লাহ্-প্রেমে মগ্ন হয়ে যায় এবং সেটাকে তার হারানো অবস্থা ফিরে পাবার উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। এ অবস্থাটি আসলে কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে আবেদন-নিবেদন ও কাকুতি-মিনতি করার নামান্তর মাত্র। এটাই তার জন্য নির্ধারিত কাজ।

        এর পরবর্তী স্তর হল সেই ব্যক্তির যে এক সত্য সংবাদ দাতার সত্য খবর শুনে সেটাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছে এবং প্রথমোক্ত অবস্থার দিকে তার আহ্বানকে যথার্থ বলে মেনে নিয়ে আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে চলেছে। ফলে তাকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে রহমত লাভের তাও সে পেয়ে চলেছে। তাকে যে আশা দেয়া হয়েছে সে আশাও তার পূর্ণ হয়েছে।

        তার পরের স্তরে সেই ব্যক্তি রয়েছে যাকে নামায আদায়ের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম বাধ্য করেছেন অথচ সে নিজে কিছুই জানত না। যে ভাবে কোন পিতা তার ছেলেকে তার অপছন্দনীয় কোন কল্যাণকর কারিগরি শিক্ষাদানে বাধ্য করে, এও ঠিক তেমনি ব্যাপার।

        কখনও মানুষ তার প্রতিপালকের কাছে বিপদ বিদূরণ ও নিয়ামত অর্জনের প্রার্থনা জানায়। সে ক্ষেত্রে তার উচিত সম্মান প্রদর্শন ও বিনয় প্রকাশের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান। দোয়ার প্রাণ হল প্রার্থনাকারীর মনোভংগী। এমন মনোভংগী থাকা চাই যা প্রার্থনা কবুলে প্রভাব বিস্তার করে। ইস্তেস্কার নামায এ কারণেই সুন্নত হয়েছে।

        নামাযের মূল ব্যাপার তিনটি-

    ১। আল্লাহ পাকের অপার মহত্ত্ব ও অশেষ প্রতিপত্তি অনুসারে অন্তরে পরম বিনয় ও ভীতি পোষণ করা।

    ২। সেই বিনয় ও ভীতি বিশুদ্ধ ভাষায় মুখে প্রকাশ করা।

    ৩। সেই ভীতি ও বিনয় মোতাবেক অংগ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন করা।

           "তোমার অনুগ্রহরাজি আমার তিনটি জিনিসকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করেছে। তা হচ্ছে আমার হাত, আমার মুখ ও আমার লুকানো অন্তর। অর্থাৎ এগুলো তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নিয়োজিত রয়েছে।"

        সম্মানসূচক কাজের একটি হচ্ছে, নিজ প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করবে এবং তাঁর দিকে পূর্ণ মাত্রায় খেয়াল রাখবে। তার চাইতেও বড় প্রভূর সামনে ভৃত্যের মতই নিজকে পেশ করবে। মাথা সর্বক্ষণ আনত রাখবে। মানব তো দূরে, পশুও বুঝে যে মাথা উঁচু রাখা বিনয়ের পরিপন্থী দাম্ভিকতা পূর্ণ কাজ আর মাথা নত করাই বিনয়ের চিহ্ন। আল্লাহর বাণীও তাই বলছে:

فظَلَّتْ أَعْنَا قُهُمْ لَهَا خَاضِعِينَ *

সূরা শু'আরা: আয়াত ৪

        অর্থাৎ অতঃপর সে নিদর্শন দেখে তাদের ঘাড় আনত হত।

        তার চাইতেও বড় কথা হল, শ্রেষ্ঠতম অংগ মুখমন্ডল তাঁর সিজদার জন্যে ভূমিতে বিন্যস্ত করা। মানুষের দৃষ্টির মাধ্যমে সব অনুভূতিই নিবদ্ধ থাকে এ মুখমন্ডলের দিকে।

        এ তিন ধরনের সম্মানসূচক কাজ সার্বজনীন ভাবেই প্রচলিত রয়েছে। কেউ সেগুলো নামাযে আল্লাহর দরবারে এসে করে আর কেউ শাসক কিংবা কর্মকর্তার সামনে গিয়ে। সর্বোত্তম নামায সেটাই যার ভেতর এ তিনটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তার সাথে সাথে বিনয় ও নম্রতার সাধারণ অবস্থাটি অসাধারণ পর্যায়ে উন্নীত্ত হয়েছে। শুধু বিরাট ভাবে সম্মান দেখানো কিংবা সাধারণভাবে সম্মান দেখানোর হাবভাব দ্বারা এ ক্ষেত্রে উন্নতি বা অবনতি নির্ণীত হয় না।

        নামাযকে বলা হয় আল্লাহর নৈকট্য লাভের সকল কাজের ভিত্তিমূল। আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গবেষণা ও তাঁর স্থায়ী জিকর-আজকারকেও এ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কারণ, খুব উচ্চ মার্গের আত্মা ব্যতীত আল্লাহ পাকের মহান শ্রেষ্ঠত্বের সঠিক ধ্যান গবেষণা সম্ভব নয়। তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সেই বিশেষ স্তরের লোক ছাড়া অন্যরা তা করতে গেলে ঈমান হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। এ পথে চলতে গিয়ে অনেকেরই মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে। যে জিকরের পেছনে অংগ প্রত্যংগের সক্রিয় অংশ গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে না, থাকে না কোনরূপ প্রশস্ততা তা বিকৃতি ও ব্যর্থতা ডেকে আনে। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এ কাজ অর্থহীন হয়।

        নামায মূলতঃ একটি টনিক-মিকচার। একেতো তার ভেতর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব ভাবনার নিয়ত ও প্রয়াস রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এমন পদ্ধতিতে ও পারিপার্শ্বিকতায় সে চিন্তা-ভাবনার কাজটি হচ্ছে যা সাধারণ মানুষেরও অনুসরণ যোগ্য। এরূপ অবস্থায় তারা স্বভাবতঃই আল্লাহর ধ্যানে তন্ময় হতে পারে। নামায এ ব্যাপারে তার সহায়ক হয়ে থাকে। নামাযের ভেতরে এমন দোয়া-কালামও রয়েছে যাতে খালেস অন্তরে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার কথা রয়েছে। তাতে আল্লাহরই সাহায্য চাইতে বলা হয়েছে।

        নামাযের রুকু এবং সিজদাও সম্মানসূচক কাজ। সেগুলো একে অপরের পরিপূরক ও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো নামাযীকে সতর্কও করে। এর কারণ সাধারণ অসাধারণ সবার জন্যই নামায কল্যাণপ্রদ ও শক্তিশালী প্রতিষেধক। যে কেউ তা থেকে যোগ্যতানুপাতে কল্যাণ নিতে পারে।

        ঈমানদারদের জন্যে নামায হল মিরাজ। নামায তাদের পারলৌকিক জ্যোতির্ময় জীবনের জন্যে প্রস্তুত করে! নবী করীম (সঃ) বলেনঃ তোমরা শীঘ্রই আল্লাহ্ পাকের দীদার লাভ করবে। তাই ফজর ও আসর নামাযে গাফেল থেকনা। নামায পড়তে থাক, কারণ তা আল্লাহ্র মহব্বত ও রহমত লাভের বড় উপায়।

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম আরও বলেনঃ আমি তোমাদের শাফায়াত করে জান্নাতে নেব। কিন্তু তোমরাও আমাকে সাহায্য কর। তোমরা বেশী বেশী নামায পড়। আল্লাহ পাক জাহান্নামীদের সম্পর্কে 

    বলেন যে, তারা সেদিন বলবে, وَلَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ আমরা নামায পড়তাম না।

        মুমিনের অন্তরে যখন নামাযের প্রীতি মজবুত হয়ে যায়, তখন আল্লাহর নূরে নিমগ্ন হয়ে থাকে। তখন পাপ দূর হয়ে যায়। কারণ, পুণ্য পাপ দূর করে। আল্লাহকে পাওয়া ও জানার জন্যে নামাযের চাইতে সহায়ক ও কল্যাণপ্রদ আর কোন বস্তু নাই। বিশেষতঃ নামাযের প্রতিটি কাজ যখন বিনয় ও আন্তরিকতা নিয়ে পবিত্র নিয়তে আদায় করা হয়, তখনই তা উপকারী হয়। যদি কেউ সামাজিক প্রথা হিসেবে নামায পড়ে তা হলেও সে সামাজিক অন্যায়-অনাচার থেকে বেঁচে যাবে।

        নামায মুসলমানকে কাফের থেকে আলাদা করে দেয়। নবী করীম (সঃ) বলেন: কাফের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী হল নামায়। তাই যে ব্যক্তি নামায ছাড়ল সে কাফের হয়ে গেল।

        সন্দেহ নেই, আত্মাকে জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে চলার অভ্যেস সৃষ্টি করার ব্যাপারে নামাযের কোন জুড়ি নেই।

Post a Comment

0 Comments