জীবজন্তর মধ্যে কতগুলো শূন্যে পা দ্বারা চলে। যেগুলো পা দ্বারা চলে, তাও কয়েক প্রকার। এর কতগুলো দুপায়ে চলে, কতগুলো চার পায়ে চলে, কতগুলো দশ পায়ে চলে আবার কতগুলো শত পায়ে হাটে। কোন কোন কীট পতঙ্গ এরূপ আছে। এই প্রাণী সমূহের আকৃতি, প্রকৃতি গঠন এবং স্বভাব বিভিন্ন প্রকার। শূন্যের পাখি এবং ভূ-পৃষ্ঠের প্রাণীর দিকে লক্ষ্য কর। তার মধ্যেও তুমি আশ্চর্য কলা কৌশল দেখতে পাবে। সেগুলো দেখে গভীরভাবে চিন্তা করলে সৃষ্টিকর্তার গৌরব, সৃষ্টিক্ষমতা, তাঁর আকৃতি গঠনের কৌশল উপলব্ধি করতে পারবে। এসব বর্ণনা করা সহজ এবং সম্ভব নয়। যদি আমরা সামান্য জীব মক্ষিকা, পিপীলিকা, মৌমাছি, মাকড়সা ইত্যাদি ক্ষুদ্র প্রাণীর আশ্চর্য রহস্য বর্ণনা করতে ইচ্ছা করি, তবেই 'তা' অসম্ভব বলে মনে হবে। লক্ষ্য কর কিরূপে তারা তাদের থাকার জন্য বাসা নির্মাণ করে, কিরূপে তারা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে রাখে, কিরূপে তারা তাদের সাথীদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে, কিরূপে তাদের গৃহনির্মাণ করে এবং কিরূপে তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে নিজেদের দরকারী পথ উদ্ভাবন করে, আমরা মানব হয়েও আমাদের পক্ষে তা' সম্ভব হত না।
ক্ষুদ্র মাকড়সার দিকে লক্ষ্য কর। এগুলো জলাশয়ের কোণায় কোণায় বাসা নির্মাণ করে প্রথমে দুটো নিকটবর্তী স্থান অন্বেষণ করে লয়, তার মধ্যে প্রায় একহাত যা তার কম পরিমাণ ফাঁকা থাকে ঐ স্থান তারা সূত্র দ্বারা আবদ্ধ করে লয়। তারপর সে তাতে জাল বুনতে আরম্ভ করে এবং মুখের লালা দ্বারা সূতা প্রস্তুত করতঃ এক প্রান্ত তদ্বারা আটকিয়ে লয় তারপর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে সূত্র নিয়ে যায়। প্রথমে একদিকে সূত্রের টানা নিয়ে যায় এবং অন্যদিকে সূত্রের বানা নিয়ে যায়। এভাবে একটি জালের ন্যায় হয়ে উঠে। টানা ও বানার উভয় সূত্রগুলি সমান ব্যবধানে স্থাপন করে। কোনস্থানে ঘন এবং কোন স্থানে পাতলা করে না। যখন এই সূত্র তারগুলি মজবুতভাবে নির্মিত হয়ে যায়, তখন মাকড়সা গবাক্ষ নির্মাণ করে, যেন তন্মধ্যে মশা-মাছি পড়তে না পারে। মাকড়সা তখন একগাছি সূতা মুখে নিয়ে মশা-মাছির প্রতিক্ষায় বসে থাকে। যখন শিকার তার মধ্যে পড়ে যায়, মাকড়শা দ্রুত গতিতে এসে মুখের সূত্র দ্বারা তাকে ধরে ভক্ষণ করে। যদি ধরতে না পারে তখন এক কোণে সূত্র নিয়ে দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে এসে একটি সূত্র ধরে শূন্যে লটকিয়ে থাকে এবং মশা-মাছি উড়ে যাওয়ার প্রতীক্ষায় থাকে। যখন সেখান দিয়ে তা' উড়ে যেতে থাকে, সে তখন নিজে হঠাৎ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরে ফেলে এবং মুখের সূতা দিয়ে তার হাত পা বেঁধে ফেলে এবং তারপর তাকে ভক্ষণ করে।
এমন কোন ক্ষুদ্র বা বৃহৎ প্রাণী নেই যে, যার মধ্যে এরূপ অত্যাশ্চর্য বস্তু নেই। তা' অগণিত। তুমি কি মনে কর যে, মাকড়সা বা অন্যান্য প্রাণী তার নিজ থেকেই তা' অবগত থাকে, বা নিজ থেকেই তা' হয়ে থাকে বা কোন মানুষ তাকে এসব শিখিয়ে দিয়েছে। বা তার অন কোন পথ প্রদর্শক বা শিক্ষক নেই; বরং যার শরীর অত্যন্ত বৃহৎ, যার শক্তি প্রকাশ্য তাও স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে নিজে নিজে তার কোন কাজ করতে পারে না, সে যে তা' পারে না তা' প্রকাশ্য, তবে তা' যদি না পারে একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর পক্ষে তা' কি করে সম্ভব? অথচ ক্ষুদ্র বৃহৎ সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের প্রত্যেকেরই আশ্চর্য কার্যকলাপ এবং ব্যাপারসমূহ যথানিয়মে হয়ে চলেছে। এই ব্যাপারটি কি সাক্ষ্য দেয় না যে, সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহাজ্ঞানী ও অসীম ক্ষমতাশালী আল্লাহ। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোক এই ক্ষুদ্র প্রাণীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার ও পরম পরিচালকের বিশালত্ব ও গৌরবপূর্ণ ক্ষমতা এবং কৌশলসমূহ দেখতে পায়। যা চিন্তা করে বুদ্ধিমানের বুদ্ধি হয়রান হয়ে যায়। এ ব্যাপারে কত বিষয়ে চিন্তা করবার আছে, তার ইয়ত্তা নেই। কত অসংখ্য শ্রেণীর প্রাণী, তাদের কত রকমের আকৃতি, কত রকমের গঠন, কত রকমের স্বভাব ও প্রকৃতি। এগুলি আমরা সদা-সর্বদা দেখার ফলে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে যার জন্য আমরা বিস্ময়বোধ করছি না। তবু সত্যি যে, যখন তুমি এমন একটি নূতন আশ্চর্য জীব দেখ, যা আর কোন দিন দেখনি, তা' দেখে অবশ্যই বলে ওঠ যে, সুবহানাল্লাহ! কি আশ্চর্য জীব, কিরূপ-এর গঠন ও আকৃতি।
মানুষ সব প্রাণীর মধ্যে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক প্রাণী। কিন্তু মানুষ নিজেকে দেখে বিশ্বয় বোধ করে না। সে চতুষ্পদ প্রাণীর দিকে লক্ষ্য করে, তা-ই ভালবাসে এবং তার আকৃতি ও গঠনের দিকে লক্ষ্য করে। তারপর তার কেশ থেকে যে উপকার পাওয়া যায়, তদ্বারা মানুষের প্রয়োজনীয় যে বস্তুসমূহ প্রস্তুত করা যায়, তাদের চর্ম দ্বারা যে সব দ্রব্য পাওয়া যায় তাদের মাংস এবং দুগ্ধ দ্বারা যে উৎকৃষ্ট জীবিকা পাওয়া যায়, সে দিকে লক্ষ্য করে। তারপর আল্লাহ কোন কোন প্রাণীকে আরোহণ করার জন্য বাহনরূপে সৃষ্টি করেছেন। কতক প্রাণীর আবার ভারী বোঝা বহন করে দূর-দূরান্তরে গমন করার শক্তি নিয়ে জন্ম লাভ করেছে। এদের এসব অবস্থা দেখে অবশ্য এদের সৃষ্টিকর্তার কৌশল এবং সর্বমুখী যোগ্যতায় বিস্ময় প্রকাশ না করে পারা যায় না। তিনি যা-ই সৃষ্টি করেছেন, তার কোনটার দ্বারা কি উপকার হবে, কোনটা কোন কাজে লাগবে তা' পূর্বাহ্নে জেনে বুঝেই সৃষ্টি করেছেন। এ ব্যপারে তিনি কোন উপদেষ্টা, পরামর্শদাতা বা বুদ্ধিদাতা থেকে সাহায্য গ্রহণ করেননি। কেননা যে কোন জ্ঞানী বা বুদ্ধিমানের চেয়েই তিনি বহুগুণে বড় বদ্ধিমান ও জ্ঞানী। তিনিই সর্বযামী, মহা বিচারক ও শক্তিশালী। তিনি সামান্য সৃষ্টিবস্তু দ্বারা আরেফীনদের হৃদয় থেকে তাউহীদের সত্যতার প্রমাণ বের করেছেন। সুতরাং সৃষ্টলোকের জন্য তাঁর প্রতাপ ও ক্ষমতা তাঁর প্রভুত্ব ও তাঁর গৌরব উপলব্ধি করার ব্যর্থতার স্বীকার ব্যতীত আর কি আছে? এমন কে আছে যে, তার প্রশংসার সীমা নির্দিষ্ট করতে পারে এবং তিনি নিজেকে যেরূপ প্রশংসা করেছেন, তিনি তদ্রূপ। তাঁর পরিচয় জানতে গিয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করাই আমাদের পরিচয় জ্ঞানের শেষ সীমা। আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে হেদায়েত, করুণা ও দয়া দ্বারা সম্মানিত করেন।
0 Comments