
যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা স্পর্শ করা হয়, তদ্বারা বায়ু প্রবাহের সময় বায়ুর দেহ ধরা যায় না। তার দেহ নয়ন দ্বারাও দেখা যায় না। বায়ুমণ্ডল। একটি সমুদ্র সদৃশ। পক্ষীগণ শূন্য মার্গে লটকানো থাকার ন্যায় অবস্থান করে। তারা এই বায়ু- সমুদ্রের মধ্যে তাদের পাখা দ্বারা সাঁতার দেয়, যেরূপ সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রে সাঁতার দেয়। বায়ু প্রবাহের সময় সমস্ত বস্তু হিল্লোলিত হতে থাকে। যেরূপ সমুদ্রের ঢেউ তুফান ও তরঙ্গের সময় উদ্বেলিত হয়ে উঠে। যখন আল্লাহতায়ালা বায়ুকে চালনা করেন এবং তাকে বর্ষণকারী করেন, তখন তিনি ইচ্ছা করলে তাঁর করুণা বর্ষণের পূর্বে তাকে বিস্তৃত করেন। যেরূপ আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি পানি সঞ্চয়কারী বায়ু প্রেরণ করি। তার প্রবাহে বায়ু প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে পৌছে এবং তা' বর্ধনের জন্য প্রস্তুত হয়। তিনি ইচ্ছা করলে, তা' পাপী বান্দাদের উপর শাস্তিস্বরূপ প্রেরণ করেন। যেরূপ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমি তাদের উপর এক কঠিন দুর্দিনে ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করেছিলাম, যা উৎপাটিত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায় মানবদেরকে নিক্ষিপ্ত করেছিল। তারপর বায়ুর লঘুত্ব, গরুত্ব ও শক্তির দিকে লক্ষ্য কর। যখন কোন চর্মের মোশককে বায়ু দ্বারা পূর্ণ করে কোন শক্তিশালী লোক পানির মধ্যে নিমজ্জিত করতে চায়, সে তা' পারবে না। আবার একটি লৌহ খণ্ডকে পানির উপরে ভাসিয়ে রাখতে চাইলেও সে তা' পারবে না বরং তা' ডুবে যাবে। এখন লক্ষ্য কর, বায়ুর লঘুত্ব সত্ত্বেও তা' পানির মধ্যে যায় না, উপরে থাকে। এই কৌশলের দরুন আল্লাহতায়ালা নৌকাকে পানির উপরে ভাসমান রাখেন। তদ্রূপ যে সংকীর্ণ পানির পাত্রের মধ্যে নিমজ্জন থেকে রক্ষা পায়। নৌকার মধ্যে ছাদকে বায়ু ত্যাগ করে না, এর ফলে ভারী বড় নৌকাও তার শক্তি ও গুরুত্ব সত্ত্বেও লঘুবায়ুর সাথে লটকানো থাকে, যেরূপ কুয়ার মধ্যে পতিত ব্যক্তি ঐ শক্তিশালী লোকের আঁচল ধরে রাখে যে কুয়ার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং নৌকার গভীরতা সত্ত্বেও তা' প্রচণ্ড বায়ুর আঁচল সদৃশ। তা' বায়ু পানিতে নিমজ্জনকে বারণ করে রাখে। ঐ আল্লাহকে ধন্য! যিনি ভারী যানবাহনকেও লঘু বায়ুর মধ্যে লটকিয়ে রেখেছেন। অথচ তার কোন স্তম্ভ, দৃষ্ট হয় না বা কোন দৃঢ় বন্ধনও দেখা যায় না।
তারপর শূন্যমণ্ডলের আশ্চর্যজনক বিষয়গুলির দিকে লক্ষ্য কর, মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রধ্বনি, বিদ্যুৎ, তুষার, বরফ ইত্যাদি আসমান ও যমিনের মধ্যে বিশেষ আশ্চর্য ব্যাপার। আল্লাহতায়ালা এক আয়াতে ইঙ্গিত করেছেনঃ "অমা খালাকুনাস সামাওয়াতি অল আরদ্বা অমা বাইনাহুমা লাইবীন।" অর্থাৎ আসমান যমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে তা' আমি খেল-তামাশা রূপে সৃষ্টি করিনি। এর ব্যাখ্যা আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন আয়াতে ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "আসসাহাবুল মুসাখখারু বাইনাস সামায়ি অলআরছ।" অর্থাৎ আসমান ও যমিনের মধ্যে সুনিয়ন্ত্রিত মেঘ রাশি। অন্য আয়াতে বজ্রধ্বনি, বিদ্যুৎ, মেঘ রাশি এবং বৃষ্টির কথা আছে। যদি এসব কথা থেকে তোমার কোন উপকার না হয়, তবে বুঝবে যে, তুমি যে বৃষ্টি নিজ চোখে দেখছ তুমি যে বজ্রধ্বনি তোমার নিজ কানে শ্রবণ করছ, এই পরিচয়ে নিম্নোক্ত প্রাণীগণও তোমার সাথে অংশীদার; সুতরাং পশুর নিকৃষ্ট জগত থেকে উচ্চাদপি উচ্চ জগতে উন্নত হও। যখন তোমার দু চোখ খুলে যাবে, তুমি তার বাহ্যিক ব্যাপার দর্শন করবে। তারপর তোমার বাহ্যিক চক্ষু বন্ধ করে, অন্তর্চক্ষু দ্বারা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে, এটাও এমন এক বিষয়, যার সম্বন্ধে দীর্ঘ চিন্তার আবশ্যক; কেননা তা' সংক্ষেপ করার কোন আশা নেই।
এবার কৃষ্ণবর্ণ ঘন মেঘের দিকে লক্ষ্য কর, কি করে তা পরিষ্কার আকাশে একত্র হয়। তার মধ্যে কোন ময়লা নেই এবং কিরূপে আল্লাহতায়ালা তাকে যখন ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যথায় ইচ্ছা চালনা করেন। মেঘ ভারী সলিল রাশি বহন করে। তিনি শূন্য মার্গে তা' স্থিরভাবে রেখে দেন, যে পর্যন্ত আল্লাহ পানি প্রেরণের আদেশ না করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে তা' বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত না হয়। তিনি ইচ্ছা মত তার আকৃতি পরিবর্তন করেন। তুমি মেঘকে মাটিতে বৃষ্টি বর্ষণ করতে দেখবে এবং তা' মধ্যে মধ্যে বর্ষিত হতে দেখবে। এক বিন্দু অন্য বিন্দুকে ধরতে পারে না এবং একটির সাথে অন্যটির যোগ থাকে না বরং প্রত্যেক বিন্দুর তার চিরাচরিত পন্থায় অবতীর্ণ হয়। তা' থেকে এক বিন্দুও অন্য দিকে যায় না অথবা তা' একই স্থানে বা জনপদে অবতীর্ণ করেন। মানুষ ও জ্বিন তার হিসাব গ্রহণে ব্যর্থ হয়। তিনি যা উৎপাদন করেছেন তিনি ব্যতীত তার সংখ্যা অন্য কেউ জ্ঞাত নয়। তারপর তার প্রত্যেক বিন্দু দুনিয়ার প্রত্যেক অংশের জন্য নির্ধারিত আছে এবং তা' প্রত্যেক পশু পক্ষি ও অন্যান্য প্রাণী এবং কীট পতঙ্গের জন্য আল্লাহর বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে, বাহ্যিক চক্ষুর দ্বারা তা' ধরা যায় না। পাহাড়-পর্বতের নিভৃত কোণে যে কীট-পতঙ্গ আছে, তার জন্যও জীবিকা নির্ধারিত আছে। নির্দিষ্ট সময়ে তার ক্ষুধা তৃষ্ণার সময় তা' তার নিকট এসে পৌঁছে যায়।
এবার তুমি লক্ষ্য কর পানি থেকে ঘনীভূত শক্ত বস্তু বরফের দিকে, বায়ুমণ্ডলস্থ জলকণা শীতের প্রভাবে তুষারের আকার ধারণপূর্বক ধুনিত তুলার ন্যায় পর্বতপৃষ্ঠে আরোহণ করে থাকে। পার্বত্য অঞ্চলের বায়ু অত্যন্ত শীতল তজ্জন্য পর্বত গাত্রে সর্বদা বরফ জমে থাকে এবং সে বরফ যথাশীঘ্র বিগলিত হয় না। শীত ঋতুর পর বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটলে বরফ ক্রমে ক্রমে গলতে শুরু করে এবং তখন ঝরণা ও নদ-নদী দিয়ে বরফ বিগলিত পানি প্রবাহিত হতে থাকে। তখন শস্যক্ষেত্রেও প্রয়োজন অনুযায়ী পানি যেতে থাকে। তুমি একটি বিষয় লক্ষ্য কর, যদি সদা-সর্বদা বৃষ্টিপাত হতে থাকত তাহলে শুধু মানুষ নয়; বরং উদ্ভিদ এবং অন্যান্য যে কোন জীব জন্তুর খুবই কষ্ট হত। বরফ সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কৌশলময় মঙ্গল নিহিত আছে। সাধারণ লোকগণ এই কৌশল উপলব্ধি করতে পারে না। কোন কোন লোক বলে থাকে যে, পানি জমে বরফাকার ধারণ করা অস্বাভাবিক কিছুই নয়, এটা একটা প্রকৃতিগত নিয়ম। শৈত্য প্রবাহ প্রবল হলেই পানি জমে তা' বরফ হয়ে যাবে। তাতে অস্বাভাবিকতার কিছুই নেই। কিন্তু যদি তাকে বলা হয় যে, সেই প্রকৃতির অর্থ কি? প্রকৃতিকে কে সৃষ্টি করল? পানিই বা কে সৃষ্টি করল? এ বৃক্ষসমূহের শাখা-প্রশাখা এত দীর্ঘ ও মোটা-তাজা করে তার অগ্রভাগ নিম্নগামী করল? কিরূপে বায়ু বৃক্ষসমূহের তলদেশে প্রবাহিত হয়ে উপরে উত্থিত হয় এবং বৃক্ষের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত ধীরে ধীরে প্রবেশ করে? তুমি কি তা' দেখতে পাচ্ছ না? ঐ বায়ু প্রত্যেক বৃক্ষ-পত্রের সমস্ত অংশে বিস্তৃত হয়ে তাকে জীবিকা দান করে। এমনকি তা' ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরার অভ্যন্তরেও প্রবেশ করে তা' থেকে পত্রের মূল শিরায় গিয়ে পৌঁছে। তারপর মূল বড় শিরা থেকে পাতার সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরায় পৌছে। মনে হয় যেন মূল শিরাটি একটি নদী এবং তা' থেকে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা শাখা-প্রশাখা রূপে বের হয় সেগুলো খাল ও নালা। তারপর খালগুলো থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়সার জালের ন্যায় সূত্র বিস্তৃত হয়। তা' চক্ষু দ্বারাও ধরা যায় না। পানি পাতার সকল অংশে প্রবেশ করে তার জীবিকার কার্য করে। তাতে পাতা বর্ধিত হয় এবং পানির মাধ্যমেই সে সবুজ ও সুন্দর বর্ণ ধারণ করে। পানি দ্বারাই তার আর্দ্রতা ও সজীবতা সৃষ্টি হয়। একইভাবে ফলের সমস্ত অংশেও এরূপ ঘটনা ঘটে থাকে। এখন প্রশ্ন এই যে, প্রকৃতিগত নিয়ম অনুযায়ী পানির গতি যদি নিম্নগামীই হয়ে থাকে তাহলে তা' কিরূপে এভাবে বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা এবং পত্র, পুষ্প ও ফলে পৌঁছে যায়? যদি বলা হয় যে, কোন আকর্ষণকারীর আকর্ষণের জন্য তা' হয়ে থাকে, তাহলে কে সেই আকর্ষণকারীকে এই নিয়মের অধীন করে দিয়েছেন? যদি তা' সর্বশেষ আসমান ও যমিনের সৃষ্টিকর্তা এবং দৃশ্য ও অদৃশ্যালোকে অধিপতির নিকট শেষ হয় তাহলে কেন প্রথমেই তার উপর তা' আরোপ করা হয় না? এরূপ বলা হয় যে, মূর্খের শেষ সীমা বুদ্ধিমানের প্রারম্ভ।
0 Comments