হুনাইনের যুদ্ধ
ফেব্রুয়ারি, ৬৩০ খৃষ্টাব্দে নবী (সাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী হুনাইন প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি শুক্র বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদদের কাতারবন্দী হওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মুহাজির বাহিনীর পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-র হাতে, আনসার খাযরাজ গোত্রের পতাকা খাব্বাব ইবনে মুনযির (রাঃ)-র হাতে, আওস গোত্রের পতাকা উসাইদ ইবনে হুদাইর (রাঃ)-র হাতে অর্পণ করলেন। অনুরূপভাবে তিনি অপরাপর গোত্রের পতাকা স্ব-স্ব গোত্রপতির হাতে দিলেন। স্বয়ং নবী (সাঃ) অস্ত্রসজ্জিত হয়ে লৌহ শিরস্ত্রাণ পরিধান করে নিজের প্রসিদ্ধ খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে ইসলামী ফৌজের সেনাপতিত্ব করেন।
এখনও ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়নি, মুসলিম বাহিনীর সংখ্যাধিক্য দেখে শক্তির অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে কতিপয় মুসলমান "ইনশাআল্লাহ" উচ্চারণ ব্যতীতই বলে ফেলল, আজ কোন শক্তিই আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।
মুসলমানগণ এক আল্লাহর দাসত্বকারী মুসলমান, তারা মহান আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিবর্তে নিজেদের সংখ্যা শক্তির অংহকারে নিমজ্জিত হবে। এটা তাদের ভ্রান্তি। এজন্য মুসলমানদের এই অহংকার আল্লাহ্ তাআলার পছন্দনীয় ছিল না। তাই তিনি তাদের সমুচিত শিক্ষা দিতে চাইলেন। যখন যুদ্ধের সূচনা হল এবং মুসলিম বাহিনী সামনে অগ্রসর হল তখন হঠাৎ করে পাহাড়ের ঘাঁটিসমূহে ওৎ পেতে থাকা মুশরিক কমান্ডো বাহিনী চারদিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর তীরবৃষ্টি শুরু করে দিল। মুসলিম বাহিনী এই ধরনের তীরবৃষ্টির কথা অনুমানও করতে পারেনি। ফলে তাদের সারিবদ্ধ বাহিনীতে বিশৃংখলা দেখা দিল এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেল।
নবী (সাঃ) এবং প্রবীণ মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ ব্যতীত সমস্ত বেদুঈন গোত্র ও মদীনা থেকে আগত বাহিনীর অধিকাংশ পলায়নে তৎপর হল।
মহানবী (সাঃ) এই অবস্থায়ও নিম্নোক্ত কবিতাংশ পাঠ করতে থাকেন এবং নিজের বীরত্ব প্রদর্শন করতে থাকেন: "আমি সত্যবাদী নবী, তাতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই, আমি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র (পৌত্র)।"
ঐ সময় নবী (সাঃ)-এর ইংগিতে হযরত আব্বাস (রাঃ) পলায়নপর মুসলমানদের উচ্চস্বরে ডাকতে থাকেন: হে আনসার সম্প্রদায়, হে বাইআতে রিদওয়ানের সদস্যগণ। তাঁর ডাক শুনতেই মুসলমানগণ পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফিরে আসে এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চারপাশে সমবেত হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। ফলে সমূহ পরাজয় আল্লাহর অনুগ্রহে বিজয়ে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
অনেক মুশরিক ও তাদের গোত্রের সামনে ইসলামের সত্যতা যদিও দিবালোকের মত উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরও তারা নিজেদের ধারণায় বৈষয়িক প্রাচুর্যকে সত্যের উৎস বলে মানত। অতএব তারা যখন স্বচক্ষে মুসলমানদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে দেখল তখন সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করল।
হুনাইনের যুদ্ধে নিজেদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব-অহংকার এবং তার পরিণতিতে প্রাথমিক পর্যায়ে পরাজয়, অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহে সাহায্য ও বিজয়ের চিত্র কুরআন মজীদে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভংগীতে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
"আল্লাহ ইতিপূর্বে অনেক ক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং হুনাইনের যুদ্ধের দিনও। এই দিন তোমাদের সংখ্যাধিক্যের অহংকার ছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি। জমীন তার বিশালতা সত্ত্বেও তোমাদের কাছে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পশ্চাদপসারণ করে পালিয়ে গেলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর শান্তির অমিয়ধারা তাঁর রসূল ও ঈমানদার লোকদের উপর বর্ষণ করলেন এবং এমন বাহিনীও পাঠালেন যা তোমরা দেখতে পাওনি। আর সত্যের দুশমনদের তিনি শান্তি দান করলেন। কেননা এটাই হচ্ছে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতিদান। অতঃপর এভাবে শাস্তি দানের পর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তওবা করার সুযোগ দান করেন। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।" (সূরা তাওবা: ২৫-২৬)
তাবুক যুদ্ধ
মুসলমানদের জন্য এই সময়টা ছিল অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ। হিজাজ ভূমিতে তখন দুর্ভিক্ষ, জমিতে উৎপাদন বলতে কিছুই ছিল না, কূপ এবং খাল পানিশূন্য হয়ে পড়েছিল, গরমও অত্যন্ত তীব্র। সকলেই অতি কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিল। উপরন্তু ছিল বসন্তকাল, বাগানে খেজুর পেকে আসছিল, খেজুর পাতা দিয়ে ছাউনি তৈরি করা হচ্ছিল এবং আরবের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী লোকেরা বাগানে তাঁবু গেড়ে বসন্ত ঋতু উপভোগ করছিল, এমনি সময় এই খবর এসে পৌছল।
বাইজান্টাইন-রাজ হেরাক্লিয়াস মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য এক বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করছে এবং এ পর্যন্ত কয়েক লাখ যুদ্ধবাজ স্বেচ্ছাসেবক ভর্তি করা হয়েছে।
কঠিন পরীক্ষার সময় ছিল, শত শত মাইলের পথ, লু হাওয়া ও উত্তপ্ত বালুকাময়মরুভূমির প্রতিবন্ধকতা, কিন্তু ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মুজাহিদ বাহিনী পার্থিব সুখ-শান্তি ও ঋতুগত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মদীনায় সমবেত হলেন।
সাধারণত নবী (সাঃ)-এর রীতি এই ছিল যে, তিনি যখন কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতেন, সাধারণ্যে প্রকাশ হতে দিতেন না যে, কোন এলাকায় অভিযান পরিচালিত হবে, যাতে শত্রুপক্ষ সঠিক অবস্থা অবগত হতে না পারে। কিন্তু তাবুকের যুদ্ধে যেহেতু আবহাওয়া ও ঋতু ছিল চরম ভাবাপন্ন, হিজাজে দুর্ভিক্ষ ও প্রতিকূল অবস্থা বিরাজিত ছিল এবং এক পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তাই এই কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে নবী (সাঃ) সমগ্র আরব গোত্রগুলোর কাছে আসল সত্য প্রকাশ করে দিলেন। যাতে এই কণ্টকপূর্ণ অভিযানে প্রতিটি ব্যক্তি বুঝে শুনে চিন্তা-ভাবনা করে পদক্ষেপ নিতে পারে।
এই নাজুক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে নবী (সাঃ) প্রথম বারের মত জিহাদে আর্থিক সাহায্যের আহ্বান জানালেন এবং আল্লাহর দীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী প্রবীণ সাহাবীগণকে ধন-সম্পদ উজাড় করে দেয়ার সুযোগ করে দিলেন। অতএব হযরত উসমান (রাঃ) ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা, ৩০০ উট এবং ৫০টি ঘোড়া দান করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জন্য দোয়া করলেনঃ "হে আল্লাহ্! তুমি উসমানের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও, আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট।"
হযরত উমর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদের অর্ধেক দান করলেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) ১০০ আওকিয়া ও হযরত আসিম ইবনে আদী (রাঃ) ৬০ ওয়াসাক খেজুর দান করলেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) ও হযরত তালহা (রাঃ) প্রচুর সম্পদ দান করলেন। মহিলারাও তাদের অলংকারপত্র দান করেন। এমন কি হযরত আবু বক্ক (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করেন। তিনি নিজের সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হলে নবী (সাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: তুমি কি পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু রেখে এসেছ? আবু বক্ (রাঃ) উত্তর দিলেন, "হে আল্লাহর রসূল। আমি আমার ঘরে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাম রেখে এসেছি।"
মোটকথা এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার পর মুসলিম বাহিনী আল্লাহর বাণী সমুন্নত করার জন্য প্রবল আবেগ ও উৎসাহ নিয়ে তাবুকের দিকে রওয়ানা হলেন। অপর দিকে গোয়েন্দারা এ সম্পর্কে হিরাক্লিয়াসকে অবহিত করে। হিরাক্লিয়াস তখন হয়ত সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল অথবা এই খবর শুনামাত্র সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে এবং তার রুমীয় বাহিনী মুসলিম বাহিনীর অসীম বীরত্ব ও প্রাণ উৎসর্গী মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের তাবুক প্রান্তরে পৌঁছার পূর্বেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নবী (সাঃ) পথে কয়েকটি খৃষ্টান পাগন্ত-রাজাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সাথে সন্ধি করে বিজয়ীর বেশে মদীনা ফিরে আসেন।
0 Comments