হযরত সাওদা বিন্তে যাম'আহ্ (রাঃ) জীবনী

        মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনু গোত্রে হযরত সাওদা বিনতে যাম'আহ্ (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম যাম'আহ্ ইবনে কায়েস আর মাতার নাম শামুস বিনতে কায়েস। তাঁদেরই সন্তান এই সাওদা বিনতে যাম'আহ্ (রাঃ)। সর্বপ্রথম এই সাওদার বিয়ে হয় সাকরান ইবনে আমরের সহিত। আর এই সাকরান ছিলেন সাওদার চাচাতো ভাই। সুহাইল ইবনে আমর, সাহল ইবনে আমর, সালীত ইবনে আমর ও হাতেব ইবনে আমার বিখ্যাত এই চার সাহাবা ছিলেন সাকরানের ভাই। এই সাকরান এবং সাওদা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়াত অর্জনের প্রথম দিকে এই দু'জন ইসলাম গ্রহণ করেন। স্বামী-স্ত্রী দু'জনের ইসলাম গ্রহণের সময় একই সময়ে। মক্কার অসহায় মাসলমানদেরকে যখন কুরাইশরা নির্যাতন করেন তখন সেই নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকার জন্য এই দলটি হাবশায় হিযরত করার পর তাঁরা মক্কার মাটি আঁকড়ে থাকে। যখন কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে লাগল ঠিক সেই মুহূর্তে মক্কার মুসলমানের দ্বিতীয় দলটি হাবশায় হিযরতের জন্য তৈরি হন। তখন সাওদা এবং তাঁর স্বামীসহ এই দলটির সহিত হাবশায় হিযরত করলেন। তাঁরা কয়েক বছর সেখানে থাকার পরে আবার মক্কাতে ফিরিয়া আসলেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় হিযরতের কিছুদিন আগে সাকরান সেই মুসলমান থাকাকালীন মক্কাতে মৃত্যুবরণ করেন। হযরত সাওদা (রাঃ) একদা তাঁর প্রথম স্বামীর জীবিত থাকাকালে দুইটি স্বপ্ন দেখেছেন এবং স্বামীর কাছে বুঝিয়ে বললে তিনি যে একজন তা'বীর করেন তা শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হয়। সাওদার প্রথম স্বামী সাকরানের জীবীত থাকাকালে একবার স্বপ্নে দেখিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিকটে এসে একটি পা তাঁর কাছে রাখলেন। এই স্বপ্নের কথা হযরত সাওদা (রাঃ) তাঁর প্রথম স্বামী সাকরানকে জানাইলেন। তখন তাঁর স্বামী তাঁকে বলিলেন, আল্লাহর কসম! সত্যিই যদি তুমি এই স্বপ্ন দেখিয়া থাক তাহলে মনে রাখবে আমার মৃত্যুর পর তোমার বিয়ে হবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে। হযরত সাওদা (রাঃ) কয়েকদিন পর আবার স্বপ্নে দেখেন যে, বালিশে হেলাম দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন। এমন সময় হঠাৎ করে আকাশ হতে চাঁদ ভাঙ্গিয়া তাঁর উপর আসিয়া পড়িল। এই স্বপ্নের কথা তিনি তাঁর স্বামীকে বলিলেন। তখন হযরত সাওদা (রাঃ)-এর স্বামী বলিলেন, অতি তাড়াতাড়ি আমি মারা যাচ্ছি এবং আমার মৃত্যুর পর তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে। ঠিক ঔ দিন হতে সাকরান খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর তিনি মারা যান। একদিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে গেলেন উসমান ইবনে মাজউন (রা)-এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম। অনেক কথা মাঝে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি পুনরায় বিয়ে করুণ!

        তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে প্রশ্ন করিলেন যে, পাত্রী কে? তখন খাওলা বলিলেন, আমার নিকট বিধবা এবং কুমারী এই দুই ধরনের পাত্রীই আছে। অতএব আপনি এখন যে ধরনের পাত্রী পছন্দ করেন সেই পাত্রীর সাথে কথা বলা যেতে পারে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় প্রশ্ন করলেন, পাত্রী কে? এবার খাওলা বলিনে বিধৰা পাত্রী হলেন সাওদা বিনতে যাম'আহ্, আর কুমারী পাত্রী হলো, হযরত আবু বকরের মেয়ে আয়েশা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই বিয়ে সম্পর্কে সম্মতি প্রদান করলেন। খাওলা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সম্মতি পেয়ে প্রথমে সাওদার গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। আর এদিকে সাওদার পিতা তখন প্রায় জীবনের প্রান্ত সীমানায়। এই দুনিয়ার প্রায় সকল কাজ-কর্ম শেষ করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে হালকা করে নিয়েছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে খাওয়া তাঁর কাছে হাজির হয়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানালেন। তখন সেই বৃদ্ধ তাকে প্রশ্ন করেন, তুমি কে? খাওলা উত্তর দেন, আমি হলাম খাওলা বিনত হাকীম। সাওদার পিতা বলেন, তাতো অভিজাত কুফু। তাহলে তোমার বান্ধবী সাওদার মতামত কি? তখন খাওলা বলিলেন, সাওদার সম্মতি আছে। তখন সাওদার পিতা তাকে ডাকতে বলিলেন। সাওদা হাজির হলেন। তাঁর পিতা বললেন, খাওলাকে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ পাঠিয়েছে তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সে খুব ভাল। আমি তাঁর সহিত তোমাকে বিয়ে দিতে চাই, তাতে কি তুমি রাজি আছ? তখন সাওদা বলিনে, হ্যাঁ পিতা, আমি রাজি।

        সাওদার পিতা তখন খাওলাকে বলিলেন, তুমি গিয়ে মোহাম্মদকে ডাকিয়া আন। তখন খাওয়া গিয়ে মোহাম্মদকে ডেকে বর সাজিয়ে হাজির করালেন। এরপর সাওদার পিতা সাওদাকে মোহাম্মদের হাতে সপে দিলেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় বুঝা যায় যে, বিয়ের আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সরাসরি সাওদার সহিত আলোচনা করেন এবং এই আলোচনার মাধ্যম হিসেবে ছিলেন খাওলা।

        ইমাম আহমাদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা হতে বুঝা যায় যে, রাসূল (সাঃ) তাঁহার বংশের সাওদা নাম্নী একজন মহিলাকে বিয়ের পয়গাম পাঠালেন। আর সেই সাওদার পাঁচ থেকে ছয়টি ছেলেমেয়ে রাখিয়া তাঁহার স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে বলিলেন যে, আমার প্রস্তাবে সম্মতি দিতে তোমার বাধা কিসের? তখন সাওদা বলিলেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কসম। হে মহান আল্লাহর নবী। এই সৃষ্টিকূলে মাঝে আপনি হলেন আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আর আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মতি দিতে কোন প্রকার বাধা নেই, কিন্তু আমার খুবই ভয়, আমার সন্তানগুলো সকাল-সন্ধ্যা সব সময় আপনাকে জ্বালাতন করিবে, আপনার সেবা-যত্ন হতে আমাকে বিরত রাখবে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলিলেন, এটা ব্যতিত আর কোন প্রকার বাধা আছে কি? তখনই সাওদা বলি- লেন, না, আমার এছাড়া আর কোন বাধা নেই।

        আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলিলেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাকে করুণা করুন। সবচেয়ে উত্তম নারী তারা, কুরাইশদের সৎ কর্মশীলা নারী তারা যাহ- ারা তাহাদের সন্তানদের জন্য মমতাময়ী আর স্বামীদের প্রতি যত্নশীলা। সাওদা বলিলেন, আমার এই ব্যাপারটি আপনার উপরেই ছাড়িয়া দিলাম। তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলিলেন, তুমি তোমার বংশের যেকোন ব্যক্তিকে এই কাজটি সমাধান করার দায়িত্ব দাও। এরপর সাওদা হাতেব ইবনে আমর আল-আমেরীকে এই কাজের দায়িত্ব দিলেন। হাতেব ইবনে আমর আল- আমেরী সাওদাকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সহিত বিয়ে দেন। এই বিয়েতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাওদাকে ৪০০ দিরহাম মোহর দান করেছিলেন। হযরত সাওদা (রাঃ) হিজরতের প্রায় তিন বছর আগে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঘরে আসেন। নবুয়াতের দশম বছরের রমজান মাস হতে ত্রয়োদশ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর সাওদা স্ত্রী হিসাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাহচর্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। আয়েশা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর সহিত বিয়ে হবার পর তিন বছর পিতার বাড়িতে ছিলেন। তখন সাওদাই ছিলেন একক গৃ- হিনী। সাওদা খুবই বিচক্ষণতাভাবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর গৃহের সকল দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং মা হারা কন্যা ফাতিমাসহ অন্যান্য কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্বও তিনি তার নিজের কাঁধে নিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের খুব কঠিন এবং সংকটময় সময়ে হযরত সাওদা (রাঃ) তাঁহার স্ত্রী হিসাবে এই কঠিন কর্তব্য পালন করিয়া হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর শূন্যতা নিবারণ করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

        হিজরী প্রথম সালে হযরত আয়েশা পতিগৃহে আগমন করেন। তাঁর আগমেন হযরত সাওদার অস্বস্তি বোধ হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কারণ দীর্ঘদিন তিনি রাসূলুল্লাহর মহিষীরূপে একাকিনী থাকায় সেখানে অপরের আগমণ স্বভাবতঃই তাঁকে পীড়া দিতে পারে বলে সকলেরই ধারণা জন্মিতে পারে। কিন্তু তাঁর এমন কোন লক্ষণই দেখা যায়নি। তাঁদের চালচলন, উঠা- বসা, কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার সবই ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সকল কাজে তাঁরা একে অন্যকে সাহায্য করতেন এবং উভয়ে একমত হয়ে সানন্দে ঘর-সংসারের কাজ সমাধা করতেন। হযরত সাওদা (রাঃ) ঘর-কান্নার কাজে সকল সময় হযরত আয়েশাকে সাহায্য করতেন ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতেন। হযরত সাওদা ছিলেন বয়ঃবৃদ্ধ মহিলা। তাই ইতোমধ্যে তাঁর মধ্যে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হল। তিনি মনে করলেন, তিনি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন, তাই নবী করীম (সাঃ) তাঁকে তালাক দিতে পারেন। যার ফলে তিনি তাঁর সাহচর্য হতে বঞ্চিত হবেন। তাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সর্বদা হযরত আয়েশার সঙ্গলাভের জন্য আপন অধিকার পরিত্যাগ করলেন। অথচ তাঁর এ ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ও কল্পনা প্রসূত, তদুপরি বাস্তবিক হয়ে থাকে বিধায় ধা- রণাটি করা স্বাভাবিক। হযরত আয়েশা হযরত সাওদাকে অতিশয় শ্রদ্ধা করতেন এবং খুব প্রশংসা করতেন। হযরত আয়েশা বলেন, 'আমি হযরত সাওদাকে একান্ত আপন হিসেবে গণ্য করতাম। তাঁকে দেখে আমি বলতাম, তাঁর দেহে যদি আমার আত্মা হত।'

        অভাব, অনটন, অনাদর, বেদনায় গড়া ছির হযরত সাওদা (রাঃ)-এর বেশির ভাগ জীবন। আর এই জন্যই দীন-দুঃখী এবং অভাবগ্রস্তদের জন্য তাঁর হৃদয সর্বদাই উন্মুক্ত ছিল। হযরত সাওদা (রা) আীতথিপরায়ণতা ও দানশীলতার জন্যে চিরস্মরণীয়া হয়ে রহিয়াছেন। তাঁর অন্তর ছিলো স্নেহ ও মায়া-মমতায় ভরপুর। আর এই কারণেই হযরত সাওদা (রাঃ) উম্মে কুলসুম ও ফাতেমার মধ্যে বেদনার একটু আঁচড়ও পড়তে দেননি। মা হারা এই কন্যাদেরকে তিনি নিজের হাতে আদার-সোহাদ করতেন এবং তাদের মুখে হাসি ফুটায়ে তোলার জন্যে সব সময় আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এক তাঁর সরলতা এবং অভিলাষহীন চরিত্রের দ্বারা বিমুগ্ধ করিয়া ছিলেন। মহান আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রেমে বিভোগর ছিল হযরত সাওদার (রাঃ) অন্তর। হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিশোধ গ্রহণ মনোবৃত্তি থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। হযরত সাওদা (রাঃ) মনে করিতেন কাম ও যৌন চাহিদাই কিন্তু সংসার জীবনের একমাত্র কামনা নয়, বরং পবিত্র ভালোবাসা এবং প্রকৃত আত্মত্যাগই হল সংসার জীবনের সুখের মূল উৎস। হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত সাওদার সম্পর্কে বলিয়াছেন, আমি শুধু একজন মহিলার সম্পর্কেই জানি, যে মহিলার মনে হিংসার ছোঁয়া কোনদিনই পড়ে নাই। আর সেই মাহিলা  হলেন বিবি সাওদা। হিজরতের পর সাওদা (রাঃ) সহ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরিবার- পরিজন মদিনাতে আগমণ করিলেন। হিজরতের তৃতীয় সালে অর্থাৎ আয়েশার ৯/১০ বছর বয়সে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে নিজের ঘরে তুলিয়া আনিলেন। ঐ মুহূর্তে বিবি সাওদা (রাঃ) নিজের জন্য রাত্রের থাকার পালা হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে দান করিলেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর খেদমতের জন্য আরজ করিলেন যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! যে রাত্রি আপনার কাছে থাকা আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, আমি সেই রাত্রটি বিবি আয়েশাকে প্রদান করিলাম। কারণ বিবি আয়েশা কুমারী, আর মহান আল্লাহ তাআলা আপনার সাহচর্য দ্বারা তাঁহাকে খুব বেশি উপকৃত করুন, তাহাই হল আমার কাম্য। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই কথা শুনিয়া খুবই আনন্দিত হইলেন এবং তিনি সাওদাকে বলিলেন যে, আসলেই তুমি খুবই অনন্যা।


        প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনারা একবার চিন্তা করে দেখুন যে, কতটুকু উদার হলে একজন মহিলা তার নিজের হিস্যা আরেকজনকে দান করিতে পারে। আর এটা ছিল একমাত্র হযরত সাওদা (রাঃ)-এর দ্বারাই সম্ভব ছিল। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পারিবারিক অশান্তি এবং হযরত সাওদার নিঃসঙ্গতায় ব্যথিত হয়ে এই বিধবাকে ৪০০ শত দিরহাম দেনমোহার দিয়ে বিবাহ করেছিলেন। এমতাবস্থায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, হযরত সাওদা (রাঃ)- কে বিবাহ করিবার পেছনে যতটা না হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দরকার ছিল, তার চেয়ে খুব বেশি দরকার ছিল বিবি সাওদার। আর সাওদা তার স্বামীকে হারিয়ে তখন নিঃসহায়া, অবলম্বনহীনা, নিরাশ্রয়া হয়ে পড়ে ছিলেন। এই জন্যই তাঁর ঐ মুহূর্তে একজন অভিভাবকের প্রয়োজন ছিল। আবার অন্যদিকে মহানবী (সাঃ) তখন ছিলেন নিঃসঙ্গ বিপত্নীক। অতএব এই প্রয়োজনের কারণেই দুই জনেরই একজন সঙ্গী অত্যাবশ্যক। আর এদিকে সাওদা হল একজন নারী, তাই তাঁহার অবশ্যই একজন আশ্রয়দাতা খুবই দরকার ছিল।

        কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারের হাত হইতে বাঁচার জন্য হযরত সাওদ। (রাঃ) প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুমতি নিয়ে স্বামীর সহিত আবিসিনিয়ায় হিযরত করেছিলেন। এদিকে সাওদার স্বামীর মৃত্যুর পর সে একাকী হয়ে পড়েছিলেন। এইজন্য এই অবস্থায় যদি সে অভিভাবকহীনা হন তাহলে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কাফির-মুশরিকদের হাতে অত্যাচ- ারিতা হইতে পারিতেন। এই জন্য সাওদার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে। চর্তুদিক বিবেচনা করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সাওদাকে বিয়ে করেছিলেন।

        হযরত ওমর (রাঃ) পর্দার হুকুম নাযিল হবার আগে থেকে এই বিষয়ে নির্দেশ প্রদানের জন্য সব সময়ই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে দাবী জানাইতেন। সেই সময় মক্কা নগরীর কোন ঘরের মধ্যে পায়খানার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কারণ ঘরের মধ্যে পায়খানা থাকাটা তারা ভাল মনে করিতেন না। ঐ সময়ের মেয়েরাও তাদের কাজ শেষ করিবার জন্য রাত্রে বাড়ির বাহিরে খোলা মাঠে চলিয়া যাইতেন। এদিকে হযরত সাওদা (রাঃ) ছিলেন দীর্ঘদেহী এবং স্থূলকায়। অনেকগুলো লোকের ভীড়েও তাঁকে চিনতে পারা যেত। একদিন রাত্রে সাওদা বাইরে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে ওমর (রাঃ)-এর চোখে পড়েন। তখন ওমর (রাঃ) চেঁচিয়ে বলিয়া উঠেন, 'আপাকে আমি চিনিয়া ফেলেছি।' হযরত ওমর (রাঃ)-এর এই ধরণের ব্যবহারে সাওদা লজ্জা পাইলেন এবং রাগান্বিত হয়ে গেলেন। আর এই নানা ধরনের সমস্যার দরুণ পর্দার আয়াত নাযিল হয়েছিল।

        আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সবচেয়ে বেশি মিষ্টি পছন্দ করিতেন। তাই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যয়নাব বিন্তে জাহাশ অর্থাৎ হাফসার গৃহে গিয়েছিলেন মধুর শরবত গান করতে। আর এই কারণে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মনে কিছুটা ঈর্ষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই কারণে হযরত আয়েশা (রাঃ) ভাবলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যাতে হাফসার ঘরে গিয়ে আর মধুর শরবত পান না করেন সেই জন্য সাওদার সহিত বুদ্ধি করিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন হাফসার ঘর থেকে মধুর শরবত পান করে আসবেন তখন তারা বলিবেন যে, আপনার পবিত্র মুখ হইতে মুগফুরের গন্ধ বাহির হচ্ছে। আর তাতে করে হয়তো বা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেই মধুর শরবত পান করা ছাড়িয়া দিবেন।

        হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সেই মধুর শরবত পান করিয়া তাঁদের নিকটে গেলেন, তখন তাঁহারা নিজেদের আগের বুদ্ধি অনুসারে তাঁহার সাথে কথা বলিলেন। যেই বুদ্ধি সেই কাজ। আর তাতে খুব দ্রুত সফলতা আসল। তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সেই মধুর শরবত হারাম করিয়া ফেললেন নিজের জন্য। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নাজিল হল সূরা আত্মত্তাহরীমের ১-৩ নং আয়াত।

সাওদা (রাঃ)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

        একজন অত্যন্ত ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন হযরত সাওদা (রাঃ)। আর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর স্ত্রী হইবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। হযরত খাদিজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরেই হযরত সাওদা (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সংসারে প্রবেশ করেছিলেন এবং হযরতের সকল সুখ- দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিতে বাহিরে চলে গেলে বিবি সাওদা তাঁহার সংসার গুছিয়ে রাখতেন, মা হারা শিশু উন্মে কুলসুম ও ফাতেমাকে করিতেন আদর-সোহাগ। বিশ্বনবীর গৃহে বিবি সাওদা আসার পর দুই মা হারা শিশু সন্তান কোনদিনও কোনভাবেই আর মায়ের অভাবটুকু বুঝতে পারেন নি। কারণ সতীনের সন্তানদের আপন করিয়া নেবার ক্ষমতা হযরত সাওদা (রাঃ)-এর ছিল।

        হযরত আয়েশা (রাঃ) ছিলেন খুব অল্প বয়সের। তাই বিবি সাওদার সহযোগীতায় আয়েশা (রা) প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাহচর্য অর্জন করিতেন। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায় যে, হযরত সাওদা (রাঃ)-এর চরিত্রের সাথে অন্য কোন কিছুর তুলনা হয় না।

সাওদা (রাঃ)-এর ইন্তেকাল

        হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের ২৩ বছর হযরত সাওদা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় হযরত সাওদা (রা)-এর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। আর সাওদা (রাঃ)-এক দাফন করা হয়েছিল জান্নাতুল বাকীতে।

Post a Comment

0 Comments