হযরত আয়েশা (রা) এর ইন্তেকাল

         হযরত আয়েশা (রা) ধর্মীয় বিধিবিধানের সমাধাসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তিনি ছিলেন অনন্যা। জীবনের সায়াহ্নে এসে হযরত আয়েশা (রা) জ্ঞান প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। শিক্ষকতা অবস্থায় ৫৮ হিজরীর রমযান মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে দেখার জন্য লোক ভিড় করতে লাগল। তাঁর অবস্থা জানতে চাইলে তিনি শুধু ভাল আছেন বলে উত্তর দিতেন।

        একবার হযরত ইবনে আব্বাস (রা) তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে অনুমতি প্রদান করলেন। তিনি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হয়েই হযরত আয়েশা (রা)-এর প্রশংসা আরম্ভ করে বলেন, উম্মুল মুমিনীন। আপনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরম প্রিয়, আপনার পিতার আদরের।

        ইন্তেকালের পরই আপনি তাঁদের সাথে মিলিত হবার সৌভাগ্য লাভ করবেন। আপনার উছিলায়ই তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর মুখে এ সকল প্রশংসাসূচক বাক্য শুনে তিনি বিরক্তির সাথে বললেন, ইবনে আব্বাস! ক্ষান্ত হও। প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে। এসব শোনার চেয়ে আমার জন্ম না হওয়াই ভাল ছিল। এর পরপরই তিনি বলেন, আমার মৃত্যুর পর আমাকে তোমরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজায় দাফন করবে না। জান্নাতুল বাকীতে দাফন করবে। রাতের অন্ধকারেই দাফনের কাজ সুসম্পন্ন করবে। তাঁর এ অন্তিম অছিয়ত শুনে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বললেন, আপনার পিতা হযরত আবু বকর (রা) এবং স্বামী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাফন করলে উত্তম হত।

        তিনি বললেন, তা হলে পূর্বের সকল সৎকাজ বাদ দিয়ে নতুনভাবে আমল আরম্ভ করতে হবে। কেননা, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর আমি দাওয়াতে ইছলাহের জন্য যে চেষ্টা চালিয়েছিলাম তা সম্ভবত আমার জন্য উচিত হয় নি। কাজেই আমি কোন ভরসায় আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সম্মানিত দু'সহচরের পাশে সমাহিত হবার আশা করতে পারি। তোমরা আমাকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পত্নীগণের পাশে জান্নাতুল বাকীতেই দাফন কর।

        ৬৭৮ ঈযায়ী ১৩ জুন ৫৮ হিজরি সনের ৭ রমযান শনিবার দিবাগত রাত্রে তারাবীর নামান সমাধা করে আপন শয্যায় শায়িত হলেন।

        এ শায়িত অবস্থায়ই তিনি এ পৃথিবীর মোহ কাটিয়ে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

        মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে চারদিক হতে লোক এসে জমায়েত হতে লাগল। আনসার ও মুহাজির মহিলাগণ এসে জড় হলেন। হযরত আয়েশা (রা)-এর ইন্তেকালে মদিনায় এক নিদারুণ শোকের ছায়া নেমে আসল। হযরত উম্মে সালমা শোকাতুর লোকদের লক্ষ্য করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, হযরত আয়েশা (রা)-এর জন্য বেহেশত ওয়াজিব। কারণ তিনি ছিলেন নবী সহধর্মিণীদের মধ্যে অধিক গুণবতী ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম। আল্লাহর রহমত তাঁর উপর বর্ষিত হোক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হযরত আবু বকর (রা)-এর পরেই সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিলেন হযরত আয়েশা (রা)। জান্নাতুল বাকীতে হযরত আয়েশা (রা)-এর অছিয়ত অনুযায়ী সমাহিত করা হয়।

        মদিনার অস্থায়ী গভর্নর হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। নামাযে জানাযায় তাঁর নিকটতম আপনজন কাসেম ইবনে মোহাম্মাদ ইবনে আবু বকর, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর, আবদুল্লাহ ইবনে আতীক, উরওয়া ইবনে জুবায়ের, আরও অনেক ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভাগিনা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাই তাঁকে কবরে স্থাপন করেন। তাঁকে দাফন করার পর মদিনাবাসী উপলব্ধি করল, নবী গৃহের এক উজ্জ্বল তারকা আজ তাদের চোখের অন্তরালে চলে গেলেন।

        আবু আইয়ুব আনসারী (রা) কে কুফা ও মিসরবাসীরা জিজ্ঞেস করেছিল, হযরত আয়েশা (রা)-এর ইন্তেকালের খবর শুনে মদিনাবাসী কি ধরনের শোকাভিভূত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তিনি যাদের মা ছিলেন তারা সকলেই শোকাতুর হয়েছিলেন। মাশরুর তাবেয়ী বর্ণনা করেছেন, মানব পূজার ভয় না থাকলে আমি হযরত আয়েশা (রা)-এর শোকের মজলিস করতাম।

        হযরত আয়েশা (রা) ইন্তেকালের পর মদিনায় যেন এক উজ্জ্বল জ্যোতি নির্বাপিত হল। ঘরে ঘরে হাহাকারের এক করুণ মূর্ত আর্তনাদ বহমান হল। হযরত আয়েশা (রা) ইন্তেকালের সময় যে সামান্য সম্পত্তি রেখে যান তার মধ্যে একখণ্ড অনাবাদী জমি ছিল। এটা তাঁর বোন আসমার অংশে পড়ে। আসমা তা একলক্ষ দেরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে সমুদয় দেরহামই গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এ শোকে মুসলিম বিশ্বের মুসলিম জগতের শোক এবং বেদনার ঝড় বয়ে চলেছিল তা সকলকে রীতিমত শোকে অভিভূত করে তুলছে।

Post a Comment

0 Comments