(৯) মনকে উন্নত করাঃ প্রথমতঃ কুরআন পাঠকালে এভাবে মনকে উন্নত করবে যে, তুমি যেন আল্লাহর কালাম শুনতেছ। জেনে রাখবে, কুরআন পাঠের তিনটি ফজীলত আছে। তন্যধ্যে সর্বনিম্ন ফজীলত এই যে, বান্দ্য নিজে মনে করবে যে, সে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ করছে এবং আল্লাহ তার দিকে তাকিয়ে আছেন ও তার তিলাওয়াত শুনতেছেন। এসময় তার অবস্থা, হয় প্রশ্ন করা, কাকুতি-মিনতি করা অথবা প্রার্থনা করা এরূপ হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কুরআন পাঠকালে তোমার মন এরূপ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন, তোমাকে সাদরে সম্বোধন করছেন, তোমার সাথে তিনি নিজ দয়া গুণে গোপন আলাপ করছেন। তোমার তখন লজ্জা, সম্মান, মনোযোগ এবং বুঝের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। তৃতীয়তঃ কালামকারীকে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যে দেখবে। আয়াতের মধ্যে তাঁর গুণাবলী অবলোকন করবে। কুরআন পাঠক নিজের দিকে বা তার পাঠের দিকে দেখবে না বা নিজের উপর অনুগ্রহ বর্ষিত হয়েছে বলে মোটেই ভাববে না; বরং নিজের লক্ষ্য ও চিন্তাকে আল্লাহর উপরই সীমাবদ্ধ এবং স্থগিত রাখবে যেন সে অন্য সব কিছু পরিত্যাগ করে দীদারে ইলাহীর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। এটাই হল আল্লাহর নিকটবর্তীদের পদমর্যাদা এবং পূর্ববর্তী সৌভাগ্যশীলদের সম্মান। যে তিলাওয়াত উল্লিখিত তিন প্রকার পদমর্যাদার বহির্ভূত তা' অমনোযোগীদের পদমর্যাদা।
হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (রহঃ) সর্বোচ্চ মর্তবা সম্বন্ধে বলেছেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য নিজ কালামের মধ্যে অপরূপ তাজাল্লী বা নূর প্রকাশ করেছেন কিন্তু বান্দা তা' দেখতে পাচ্ছে না। হযরত জাফর ছাদেক (রহঃ) একবার নামাযের মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। যখন তার হুঁশ ফিরে এল, লোকজন তাকে এ অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি বার বার কুরআনের আয়াতকে আমার দিলের মধ্যে আওড়াচ্ছিলাম। তখন যেন আমি তা' খোদ কালামকারী আল্লাহর নিকট থেকেই শুনতেছিলাম। তাঁর এই অপূর্ব কুদরতের প্রভাবে আমি আমার দেহ-মন সুস্থির রাখতে সক্ষম হলাম না। মন এই পর্যায়ে উন্নীত হলে আয়াতে মিষ্টতা এবং মুনাজাতের স্বাদ লাভ করা যায়। জনৈক বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছিলেন যে, আমি কুরআন পাঠ করতেছিলাম কিন্তু তার স্বাদ পেলাম না। তবু তিলাওয়াতে লেগে থাকলাম। এমনকি শেষপর্যন্ত হযরত রাসূলে করীম (দঃ) কে তা' তিলাওয়াত করতে শুনলাম যেন তিনি তা' তাঁর ছাহাবীগণকে পড়ে শুনাচ্ছেন। অতঃপর আমি অপেক্ষাকৃত উচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়ে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত শুরু করলাম। তখন যেন আমি ফিরেশতা জিব্রাইলকে তা' হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নিকট পাঠ করতেও দেখলাম। অতঃপর আমি উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়ে দেখতে পেলাম এবার স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাশরীফ আনলেন। তখন যেন আমি স্বয়ং কালামকারী আল্লাহর নিকট থেকেই শুনতে লাগলাম। আর তার স্বাদ গ্রহণে ধন্য হতে থাকলাম। যার ফলে আমি আর নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারলাম না। হযরত ওছমান (রাঃ) ও হযরত হোযায়ফা (রাঃ) ছাহাবীদ্বয় বলেছেন, যখন মন পবিত্র হয়ে যায় তখন তা' শুধু কুরআন তিলাওয়াতে তৃপ্তি লাভ করে স্থির থাকতে চায় না। একথা বলার কারণ হল, মনের পবিত্রতার দ্বারা কালামের ভিতর কালামকারীর দর্শন তথা দীদারে ইলাহী প্রাপ্তি পর্যন্ত মন উন্নীত হয়। এজন্যই হযরত ছাবেত বানানী (রহঃ) বলেছেন, গত বিশ বছর পর্যন্ত আমি পরিশ্রম করেছি এবং ততদিন পর্যন্তই আমি তাঁর নিয়ামত লাভ করেছি। কালামকারী আল্লাহর দর্শনের দ্বারা কোন বান্দা আল্লাহর এই আয়াতের উপযুক্ত হয়। যেমন "ফাফিররু ইলাল্লাহি” অর্থাৎ আল্লাহর দিকে পলায়ন কর, অন্য আয়াত রয়েছে, "আল্লাহর সহিত অন্যকে শরীক করো না।" যে ব্যক্তি তাঁকে প্রত্যেক জিনিসে দেখে না, সে অন্যকে দেখে থাকে; এবং আল্লাহ ব্যতীত যেদিকেই বান্দা লক্ষ্য করে সে গুপ্ত শিরকের দিকে লক্ষ্য করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে কোন বস্তুতে না দেখাই হল সত্যিকার তাউহীদ।
(১০) মুক্ত বা বেপরোয়া হওয়াঃ অর্থাৎ নিজের শক্তি সামর্থ্য থেকে মুক্তি লাভ করা বা বেপরোয়া হওয়া। সন্তুষ্টির চোখে নিজেকে না দেখা। যখন আল্লাহর ওয়াদা এবং সৎলোক সম্পর্কিত প্রশংসার আয়াত পাঠ করবে তখন নিজেকে তার ভিতর শামিল করবে না; বরং যারা দৃঢ় বিশ্বাসী এবং প্রকৃত ছিদ্দীক তাদের জন্য সাক্ষ্য দিবে কিন্তু আশা করবে যেন আল্লাহ তায়ালা তোমাকে তাদের দলভুক্ত করে নেন। যখন গুনাহগারদের প্রতি তিরস্কার এবং ক্রোধের আয়াত পাঠ করবে, তখন নিজের প্রতি সাক্ষ্য দিবে এবং ভীত এবং সন্ত্রস্তভাবে খেয়াল করবে যে, এই কথা তোমার জন্য বলা হয়েছে। এজন্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলতেন, হে মাবুদ। আমার গুনাহ ও কুফরীর জন্য তোমার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, গুনাহ বুঝতে পারি কিন্তু কুফরী কি জিনিস? তখন তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করলেন। যথা "ইন্নাল ইনসানা লাজালুমুন কুফফার" নিশ্চয় মানুষ বড়ই অত্যাচারী, কাফির (অকৃতজ্ঞ)।" হযরত ইউসুফ বিন আছবাতকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পবিত্র কুরআন পাঠকালে আপনি কি প্রার্থনা করেন? তিনি বললেন, আমার গুনাহর জন্য আল্লাহর নিকট সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করি। যখন গুনাহর আকৃতিতে নিজেকে দর্শন করবে, নিজেকে তিলাওয়াতের মধ্যে দেখবে। জেনে রাখবে, সেই দর্শন নৈকট্যের কারণ হয়। কেননা, যে নৈকট্য প্রার্থনা করতে গিয়ে দূরত্ব দেখতে পায়, সে ভয় থেকে নিরাপদ হয়ে যায় এবং তাকে আরও দূরত্বের আর একটি ধাপ দেয়া হয়, যা তার চেয়ে নিম্নের। যখন সন্তুষ্টির চক্ষে নিজেকে দেখবে, তখন নিজের নফসই পর্দা হয়ে দাঁড়াবে। যখন নফসের প্রতি দৃষ্টির সীমা অতিক্রম করে যাবে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে তোমার তিলাওয়াতে দেখতে পাবে না, তখন তোমার নিকট আধ্যাত্মিক জগতের গূঢ় তত্ত্বসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন, ইবনে ছাওবান তার এক ভ্রাতাকে এরূপ ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, তিনি তার নিকট ইফতার করবেন। কিন্তু ইবনে ছাওবান ইফতারের সময়ের পরও এত বিলম্ব করতে লাগলেন যে, রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে গেল। তবু তিনি তথায় উপস্থিত হলেন না। তার ভ্রাতা তার পরদিন ইবনে ছাওবানের সাথে সাক্ষাত করে বললেন,আপনি আমার সহিত ওয়াদা দিয়েছিলেন যে, আমার নিকট ইফতার করবেন। কিন্তু আপনি ত তাশরীফ আনলেন না? তিনি জবাব দিলেন, যদি আমি আপনার সহিত ওয়াদা না করতাম কোন বন্ধু আমাকে আসতে বিরত রেখেছে তা' আপনার কাছে প্রকাশ করতাম না। দেখুন যখন আমি এশার নামায পড়লাম, তখন মনে করলাম যে, আপনার নিকট যাওয়ার পূর্বে বেতেরের নামায আদায় করে নেই। কেননা, আমার জানা নেই আমি এর পরও জীবিত থাকব কিনা। যখন আমি বেতেরের দোয়া পাঠ শুরু করলাম, তখন আমাকে একটি সবুজ বাগিচায় তুলে নেয়া হল। তা' নানা প্রকার ফল-ফুলে সুশোভিত। আমি তার প্রতি তাকাতে তাকাতে ভোর হয়ে গেল। এটাকেই কাশফ বলা হয়। এর মাধ্যমে নিজের নিকট থেকে দূরত্ব মুক্তি পায়; এবং তৎপ্রতি ও তার মোহের প্রতি দৃষ্টি থাকে না। এই প্রকার বান্দার অবস্থানুসারে এ ধরনের কাশফের বিশেষত্ব অর্জিত হয়।
যখন তুমি আশা-আকাঙ্খার আয়াত পড়বে এবং সুসংবাদ তোমার অবস্থার উপর প্রাধান্য লাভ করবে, তখন তোমার নিকট বেহেশতের রূপ প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং তা' অবলোকন করবে। যেন তুমি তা' নিজের চোখের সামনে দেখতেছ এরূপ মনে হবে। আর যখন তোমার মনে ভয় প্রাধান্য লাভ করবে, তখন তোমার নিকট দোযখের রূপ প্রকাশ পাবে। এমন কি তুমি তার নানা প্রকার শাস্তিও দেখতে পাবে। এর কারণ হল, আল্লাহর কালামের মধ্যে সাধারণতঃ সমন্বয় থাকে। যেমন সূক্ষ্ম কালাম, কঠিন কালাম, আশার কালাম এবং ভয়ের কালাম ইত্যাদি। আল্লাহর বর্ণনানুসারে তা' ঘটে। কেননা, সে সকল বর্ণনা থেকে নির্গত হয়ে থাকে রহমত, করুণা, প্রতিশোধ, প্রতিবিধান এবং শাস্তি। এসকল বাণী ও তার গুণাগুণ অবলোকনের পরিমাণ অনুসারে বিভিন্ন অবস্থায় হৃদয় পরিবর্তিত হয় এবং তন্মধ্যে প্রত্যেক অবস্থার পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিটি কার্য কাশফের জন্য উপযোগী হয় এবং তা' স্থায়ী থাকে। কেননা, শ্রোতার অবস্থা একই প্রকার থাকা এবং কালামকারীর অবস্থা বিভিন্ন হওয়া অসম্ভব বৈ কি! কেননা এর ভিতর যে সন্তুষ্ট হয়, তাঁর কালাম রয়েছে, যে ক্রোধান্বিত হয়, তাঁর কালাম রয়েছে, প্রভূত ক্ষমতাশালী ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীর কালাম রয়েছে, যে বেপরোয়া, তাঁর কালাম রয়েছে, যে অসীম করুণাময় ও পরম কৃপাময় তাঁর কালাম রয়েছে।
0 Comments