মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ

 কুরায়শ দূত সুরাকা বিন মালিক

        হযরত (সাঃ) সামনে চলছেন। তখন কুরায়শ দূতদের মধ্যে সুরাকা বিন মালিক তাঁর তালাশে এখানে এসে পৌঁছে। যখন সে হুযুর (সাঃ)-এর নিকটবর্তী হয়, তখন তার ঘোড়া হোঁচট খাওয়ায় সুরাকা ঘোড়া হতে পড়ে গেল; কিন্তু এরপর আবার তাতে আরোহণ করে হযরত (সাঃ)-এর পেছনে পেছনে চললো। এতদূর নিকটবর্তী হলো যে, সে হযরত (সাঃ)-এর কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে লাগলো। এ সময় হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) বারবার ফিরে পেছনের দিকে দেখতে লাগলেন। কিন্তু হুযুর (সাঃ) তার দিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না। যখন সে হযরত (সাঃ)-এর অতি নিকটবর্তী হল, তখন জমি শক্ত ও শুকনা হওয়া সত্ত্বেও তার ঘোড়ার চার পা জমির মধ্যে ঢুকে গেল এবং সুরাকা দ্বিতীয়বার মাটিতে পড়ে গেল।

        এখন সে বারবার ঘোড়াটি বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে হুযুর (সাঃ)-এর নিকট সে সাহায্য প্রার্থনা করল। হযরত (সাঃ) থামলেন এবং তাঁর বরকতে ঘোড়াটি ঐ জায়গা হতে বের হয়ে আসল।

        যখন গোড়ার পা মাটি হতে বের হলো, তখন ঐ জায়গা হতে ধোঁয়া বের হতে দেখে সুরাকা আরও বেশি আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল এবং অতি বিনয়ের সাথে হুযুর (সাঃ)-এর সামনে তার সমস্ত আসবাবপত্র ও উট পেশ করল। হযরত (সাঃ) তা গ্রহণ না করে বললেন, "যতক্ষণ তুমি ইসলাম গ্রহণ না করো, ততক্ষণ আমরাও তোমার উট ও অন্যান্য দ্রব্য গ্রহণ করতে পারি না। শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি আমাদের অবস্থা কারো নিকট প্রকাশ না করো।" সুরাকা এদকি থেকে চলে গেল এবং যতদিন পর্যন্ত হযরতের বিপদের আশঙ্কা ছিল, ততদিন এ ঘটনা সে কারো নিকট বর্ণনা করেনি।

সুরাকা কর্তৃক নবুওয়তের স্বীকারোক্তি

        কিছুদনি পর সুরাকা আবু জাহলের নিকট উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার পর কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন:

        হে আবুল হিকাম (আবু জাহল), লাতের শপথ, (লাত এক প্রতিমার নাম, কুরায়শগণ যার পূজা করত,) যদি তুমি এ মাটিতে বসে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করতে, তাহলে এ ব্যপারে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকত না যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। আমার মতে তোমার অবশ্যই কর্তব্য হলো এই যে, তুমি নিজে তাঁর বিরোধিতা হতে দূরে থাক এবং লোকদেরকে নিষেধ কর; কেননা আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বিজয়ের চিহ্ন চতুর্দিকে প্রকাশ পাবে এবং সমস্ত মানুষই কামনা করবে যে, যদি আমরা তাঁর সাথে সন্ধি করতাম।।

উম্মে মা'বাদ ও তাঁর স্বামীর ইসলাম গ্রহণ

        হুযুর (সাঃ) উম্মে মা'বাদ নামক একজন মহিলার বাড়ীর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার স্বকরী দুধ দিত না। হযরত (সঃ) তার স্তনে হাত বুলালেন। ফলে তা দুধে ভর্তি হয়ে গেল, তা তিনি নিজেও পান করলেন এবং নিজ সাথীদেরও পান করালেন। এ বরকত সর্বদা অব্যাহত ছিল। যখন হযরত (সাঃ) এখান থেকে রওয়ানা হলেন, তখন উম্মে মা'বাদের স্বামী আসলেন এবং বকরীর দুধ সম্পর্কে এ আশ্চর্য ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঘটনা জিজ্ঞেস করলে উম্মে মা'বাদ বললেন, একজন অত্যন্ত নম্র ভদ্র যুবক আজ আমাদের এখানে কিছু সময়ের জন্য মেহমান হয়েছিল। এ সমস্তই তার হাতের বরকত। স্বামী একথা শুনে বলতে লাগলেন, "আল্লাহর শপথ, এ তো সেই মক্কাবাসী বুযুর্গ বলে মনে হয়।" এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, এর পর তাঁরা উভয়ে হিজরত করে মদীনায় চলে যান এবং মুসলমান হয়ে যান।

মসজিদে কুবা প্রতিষ্ঠা

        এখান থেকে রওয়ানা হলে তাঁরা কুবায় পৌছলেন (মদীনার নিকট একটি জায়গার নাম)। আনসারদের নিকট যখন থেকে হযরত (সাঃ)-এর আগমনের খবর পৌঁছেছিল, তখন থেকে প্রতিদিন হুযুর (সাঃ)-এর সম্বর্ধনার জন্য তাঁরা মহল্লা থেকে বেরিয়ে আসতেন। এদিনও তাঁরা নিয়মানুযায়ী অপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছেন। হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল যে, এতদিন তারা যাঁর অপেক্ষায় ছিল, তিনি শুভাগমন করেছেন।

        হযরত (সাঃ)-এর শুভাগমন দেখে সবাই সানন্দে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করলেন। হুযুর (সাঃ) এবং তাঁর সহচরগণ কুবায় ১৪ দিন অবস্থান করলেন। এ সময়ে তিনি কুবায় একটি মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এটাই সর্বপ্রথম মসজিদ, যা ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পর নির্মাণ করা হয়।

আলী (রাঃ)-এর হিজরত

        হযরত (সাঃ)-এর আমানতদারী কাফিরদের মাঝেও স্বীকৃত ছিল, এই জন্য তাঁর কাছে অধিকাংশ লোকের আমানত রাখা হত। হিজরতের সময় হযরত আলী (রাঃ)-কে এজন্য মক্কায় রেখে আসলেন যাদের আমানত রয়েছে, তাদের মালামাল তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি মদীনায় পৌছে যাবেন।

মদীনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ

        রবিউল আউয়াল মাসের জুম'আর দিন কুবা থেকে বিদায় হয়ে হযরত (সাঃ) পবিত্র মদীনার দিকে রওয়ানা হলেন। মদীনার আনসারগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে হযরত (সাঃ)-এর বাহনের চতুর্দিক ঘিরে চলতে লাগল, কেউ পদব্রজে, কেউ বাহনে আরোহণ করে। হুযূর (সাঃ)-এর উটের রশি ধরার জন্য প্রতিটি লোকই অগ্রাধিকারের চেষ্টা করতে থাকে। প্রতিটি লোকেরই আন্তরিক ইচ্ছা যে, হুযুর (সাঃ) তাদের এখানে অবস্থান করবেন। মহিলা এবং শিশুরা আনন্দের গীত গাইতে লাগল। এ দিনটি জুম'আর দিন ছিল। বনী সালেম বিন আউফের বাড়ীর নিকট জুম'আর সময় হয়ে গেল। হুযুর (সাঃ) সওয়ারী হতে অবতরণ করলেন এবং জুম'আ আদায় করে পুনরায় সওয়ারীতে আরোহণ করেন। এখন যে আনসারের বাড়ী রাস্তায় পড়ে তিনি আশা করেন যেন হুযুর (সাঃ) তাঁর বাড়ীতেই অবস্থান করেন। কিন্তু হযরত (সাঃ) বললেন, তোমরা উটকে তার আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও। এটা আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট `রয়েছে। যে জায়গায় অবস্থানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে এটা নিজেই থেমে যাবে। সুতরাং উট চলতে লাগল। অবশেষে হুযুর (সাঃ) নানার বংশীয় বনী আদি বিন নাজ্জারের বাড়ীতে আসলেন এবং আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়ীতে মেহমান হলেন। তিনি বেশ কিছুদিন সেখানেই অবস্থান করেন।

মসজিদে নববীর নির্মাণ

        ঐ সময় পর্যন্ত মদীনায় কোন মসজিদ ছিল না। যে জায়গায় সুযোগ পাওয়া যেত, নামায আদায় করা হতো। এর পর ঐ জায়গাটুকু খরিদ করা হলো যেখানে হুযুর (সাঃ)-এর উষ্ট্রী বসেছিল, ঐ জায়গায় মসজিদে নববী নির্মাণ করা হল, যার দেয়াল কাঁচা ইট, থাম খেজুর গাছের তৈরি কাঠের এবং ছাদ খেজুর গাছের ডাল দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। কিবলার মুখ বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রাখা হল (যা ঐ সময় পর্যন্ত মুসলমানের কিবলা ছিল)।

        মসজিদের সাথে দু'টি হুজরা (ক্ষুদ্র কক্ষ) তৈরি করা হল একটি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর জন্য, দ্বিতীয়টি হযরত সাওদা (রাঃ)-এর জন্য। এরপর হুযুর (সাঃ) তাঁর আত্মীয়স্বজনকে আনার জন্য এক ব্যক্তিকে মক্কায় পাঠালেন। ঐ সময় হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) তাঁর সমস্ত পরিবারবর্গকে মদীনায় ডেকে আনলেন।

        উন্মুল মুমিনীন হযরত সাওদা (রাঃ) এবং দুই সাহেবযাদী হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও উম্মে কুলসুম (রাঃ) মদীনা চলে এলেন। তৃতীয় সাহেবযাদী হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে তাঁর স্বামী আবুল 'আস (তিনি তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি) আসতে দেয় নি। এদিকে সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ, স্বীয় মাতা এবং দু'বোন হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত আসমা (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনা পৌঁছলেন।

        এখন মক্কায় শুধুমাত্র কয়েকজন মুসলমান রইলেন, যাঁদের সফর করার ক্ষমতা ছিল না; বরং কিছু এমন লোকও সেখান থেকে চলে এসেছিলেন, যারা পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments