পিতা-মাতার হক ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার কেমন আদায় করতে হয়

        আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ .

        -'আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা পরস্পরের নিকট যাজ্ঞা করে থাক এবং নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন কর।'     -সূরা নেসা ৪১

        আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَهُمْوَأَعْمَى أَبْصَارَ هُمْ .

        -'অতঃপর তোমরা যদি ক্ষমতা লাভ কর, তবে সম্ভবতঃ তোমরা দুনিয়াতে বিবাদ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক কর্তন করবে। এদের প্রতিই আল্লাহ্ লা'নত করেন, অতঃপর তাদের আপন রহমত থেকে বঞ্চিত করে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।'     -সূরা মুহাম্মদ: ২২-২৩

        তিনি আরও এরশাদ করেছেন-

الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ . وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِأولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ .

        -'যারা আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্ তাআলা যা ছিন্ন করতে নিধেষ করেছেন, তা ছিন্ন করে, আর দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।'    -সূরা বাকারা: ২৭

        আল্লাহ্ তা'আলা আরও এরশাদ করেছেন-

        'এবং যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি দৃঢ় পাকাপোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ্ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তারা সে সব লোক যাদের জন্য রয়েছে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে পীড়াদায়ক শাস্তি।'     সূরা রা'দ  ২৫

        বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ তাআলা যখন সমগ্র জগত সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করেন, তখন রেহেম (আত্মীয়তার সম্পর্ক) দাঁড়িয়ে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করে তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইল। আল্লাহ তাআলা বললেন: 'তুমি কি এতে সন্তষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখবে আমি তার পক্ষাবলম্বন করব, আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তার থেকে আমি আমার ভালবাসা ছিন্ন করে ফেলব। আল্লাহর এ কথা শ্রবণ করে রেহেম সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। অতঃপর নবী করীম (ছঃ) পবিত্র কোরআনের আয়াত পাঠ করলেন-অতঃপর তোমরা ক্ষমতা লাভ করলে দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের প্রতি আল্লাহ্ লা'নত করেন, অতঃপর তাদের তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করে বধির দৃষ্টিশক্তিহীন করে থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, দেন।' -সূরা মুহাম্মদ: ২২-২৩

         হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন 'জুলুম-অত্যাচার এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করা অপেক্ষা জঘন্য কোন গুনাহ নেই। এ অপরাধের শাস্তি ইহ-পরকাল উভয় স্থানেই দেয়া হবে।' এক হাদীসে এসেছে-

لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع رحمر.

            -'আত্মীয়তা ছেদনকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।' নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, 'আদম সন্তানদের আমল প্রতি জুমার রাতে আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা হয়, কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমল আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় না।'

        ইবনে হেব্বান প্রমুখ বর্ণনা করেছেন: 'তিন ধরনের লোক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক, মদ্যপায়ী, দুই, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, তিন, যাদুটোনার প্রতি বিশ্বাসী।'

        ইমাম আহমদ, ইবনে আবিদ্দুনইয়া ও ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন, এ উম্মতের বেশ কিছু লোকের ব্যাপারে এ ঘটনা ঘটবে যে, একদা রাতে তারা খাওয়া দাওয়া, আনন্দ-স্ফূর্তি ও ক্রীড়া-কৌতুকে লিপ্ত থাকবে; প্রত্যুষে বানর ও শূকরের আকৃতিতে রূপান্তরিত করে মাটিতে পুঁতে দিয়ে তাদের উপর পাথর বর্ষণ করা হবে। লোকেরা একে অপরের নিকট বলাবলি করবে, 'আজ অমুক সম্প্রদায় অথবা অমুক বাড়ির লোকদের মাটি গিলে ফেলেছে।' এদের অনেকের উপর ধ্বংসাত্মক ঝড় তুফান চালিয়ে দেয়া হবে, যেমন আদ জাতির ক্ষেত্রে করা হয়েছিল, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে না হয়ে সীমিতভাবে হবে। এরা ওইসব লোক যারা মদ্য পান এবং রেশমী বস্ত্র পরিধান করে থাকে, নর্তকী গায়িকা নিয়ে আমোদ ফুর্তিতে মত্ত থাকে, সুদে টাকা লেনদেন করে, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার হরণ করে। এ সঙ্গে আরও এক ধরনের লোকের উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু বর্ণনাকারী জাফর তা ভুলে গেছেন।

        হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আমাদের মাঝে তশরীফ এনে বলেছেন, 'হে মুসলমানরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করো না। কেননা, আত্মীয়তার অধিকার আদায়ের ন্যায় অত্যন্ত দ্রুত ফলপ্রদ নেক কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। অনুরূপ কারও প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাক। কেননা, জুলুম অপেক্ষা অতি জলদি আযাব আনয়নকারী অপরাধ আর কোনটি নেই। তদ্রূপ পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার এবং তাদের উপকারে ব্রতী হও। কেননা মানুষ হাজার বছরের ব্যবধান থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে, কিন্তু বাবা-মা'র অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তা ছিন্নকারী; বৃদ্ধ ব্যভিচারী এবং যে ব্যক্তি অহংকারভরে মাটিতে চাদর হেঁচড়ে চলে, এসব লোক জান্নাতের সুগন্ধ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকবে।'-তাবারানীঃ আওসাত

        একদা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, 'অদ্যকার এ মজলিসে আত্মীয়তা ছিন্নকারী কেউ যেন না বসে।' সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক মজলিস থেকে উঠে তার খালার নিকট গিয়ে ক্ষমা চায়। ইতোপূর্বে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল, খালা তাকে ক্ষমা করে দেয়ার পর পুনরায় সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের মজলিসে এসে বসে।    -ইসবাহানী

        রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন-

إِنَّ الرَّحْمَةَ لَا تَنْزِلُ عَلَى قَوْمٍ فِيهِمْ قَاطِعُ رَحِمٍ .

        -সে জাতির উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হয় না যাদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী থাকে।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা নবী করীম (ছঃ) ঘোষণা করলেন, 'আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী কেউ যেন মজলিসে না থাকে। এ মজলিসে উপস্থিত এক যুবকের তার ফুফুর সাথে কয়েক বছর যাবত মনোমালিন্য চলছিল, তৎক্ষণাৎ সে মজলিস থেকে উঠে ফুফুর নিকট ক্ষমা চেয়ে অন্তর পরিষ্কার করে নেয়।

        হাদীসে আছে, আত্মীয়তা ছিন্নকারী একজন লোকও যাদের মধ্যে থাকে, তাদের উপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয় না। -তাবারানী

        হযরত আ'মাশ (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হযরত ইবনে মাসউদ (রা) ফজরের নামাযান্তে বললেন, 'আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদনকারীকে আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, যেন সে এ মজলিস থেকে চলে যায়। কেননা, আমরা এখন আল্লাহর সমীপে দোয়া করব; দোয়ার মজলিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী থাকলে আল্লাহ্ দোয়া কবুল করেন না।'    -তাবারানী

         হাদীসে আছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক আল্লাহর আরশের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সে বলছে, 'হে আল্লাহ! আমার বন্ধন যে অটুট রাখবে তাকে হেফাযত করুন, আর আমার বন্ধন যে ছিন্ন করবে তাকে ছিন্ন করুন।' বুখারী, মুসলিম

        হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, 'আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, আমি দয়ালু। আত্মীয়তার সম্পর্ক দয়ারই নামান্তর। আমার 'রহমান' (দয়া) নাম থেকে ছাঁটাই করে এ 'রেহেম' নাম সৃষ্টি করেছি। কাজেই যে ব্যক্তি রেহেম তথা আত্মীয়তার হক আদায় করে, আমি তার প্রতি সদয় হই, আর যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদন করে আমি তার সাথে আমার ভালবাসা ছেদন করে ফেলি।'

        হাদীস শরীফে আছে, 'সবচেয়ে বড় জুলুম হচ্ছে কোন মুসলমানকে অপমান করা। আর আত্মীয়তার রেহেম পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্ তা'আলার সাথে সম্পৃক্ত বৃক্ষশাখা। এটি যে ছেদন করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।         -মোসনাদে আহমদ

        হাদীসে আরও আছে, 'রহমান বৃক্ষের সাথে সংযুক্ত রেহেম আল্লাহর কাছে নালিশ করে থাকে, হে আল্লাহ্! আমাকে ছিন্ন করা হয়েছে, হে আল্লাহ্ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, হে আল্লাহ্! আমার উপর জুলুম করা হয়েছে, হে আল্লাহ্! হে আল্লাহ্। এভাবে সে আর্তনাদ করতে থাকে। তখন আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, 'তুমি কি সম্মত নও যে, তোমার সাথে যে সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে ভালবাসা বজায় রাখব, আর তোমাকে যে ছেদন করে, আমিও তার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক ছেদন করব।' -মোসনাদে আহমদ ও ইবনে হেব্বান অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, রেহেম গো-কীট সদৃশ বস্তু, সে আল্লাহর আরশ জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর প্রতিনিয়ত তীব্র ভাষায় চিৎকার করে বলছে, 'হে আল্লাহ্। আমার বন্ধন যে রক্ষা করে আপনি তাকে রক্ষা করুন, আর আমার বন্ধন যে ছিন্ন করে আপনি তাকে ছিন্ন করুন।'        -মোসনাদে আহমদ

        মোসনাদে বাযযার গ্রন্থে রয়েছে, তিনটি বস্তু আরশের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। এক, রেহেমঃ সে বলছে, হে আল্লাহ। আমার সম্পর্ক আপনার সাথে, আমাকে যেন ছিন্ন না করা হয়। দুই, আমানত। সে বলছে, হে আল্লাহ্! আমি আপনার সাথে সম্পৃক্ত, আমাকে যেন খেয়ানত করে আলাদা না করা হয়। তিন. নে'য়ামতঃ সে বলছে, হে আল্লাহ্! আমি আপনার সান্নিধ্যে রয়েছি, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাকে যেন দূরে নিক্ষেপ করা না হয়।

        বায়হাকী শরীফে আছে, 'আরশের নিচে সীলমোহর লাগানোর সরঞ্জাম রক্ষিত আছে। যখন আত্মীয়তার অধিকার নষ্ট করা হয়, তখন রেহেম আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে, তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা প্রেরণ করে আত্মীয়তার হক যারা নষ্ট করে তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেন। পরিণামে সে বুদ্ধিহীন জ্ঞানহীন হয়ে যায়।'

        রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেনঃ

        -'যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং হাশরের দিনের প্রতি ঈমান আনে সে যেন মেহমানের মেহমানদারী করে, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখে এবং তার উচিত কথা বললে উত্তম কথা বলা নতুবা চুপ থাকা।'-        বুখারী, মুসলিম

        আরও বর্ণিত হয়েছে, 'যে ব্যক্তি দীর্ঘ জীবন ও সচ্ছল জীবিকার আশা করে, সে যেন  আত্মীয়তার অধিকার রক্ষা করে।' বুখারী, মুসলিম

         বুখারী ও তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, 'তোমরা নিজেদের বংশ-পরম্পরা আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নাও এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার কর। কেননা, আত্মীয়তার অধিকার রক্ষায় পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, সম্পদে প্রাচুর্য আসে এবং দীর্ঘায়ু লাভ হয়।'

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন-

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَمُدُّ لَهُ فِي عُمُرِهِ وَيُوَسِعَ لَهُ فِي رِزْقِهِ وَ يُدْفَع عَنْهُ مِيْتَةُ السُّوءِ فَلْيَتَّقِ اللَّهِ وَلْيَصِلُ رَحِمَهُ . 

        'যে ব্যক্তি দীর্ঘ জীবন ও সচ্ছল জীবিকা আশা করে এবং অপমৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং আত্মীয়তার হক আদায় করে।'        - যাওয়ায়েদুল মোসনাদ

         রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, 'তওরাত কিতাবে লিখিত রয়েছে, যে দীর্ঘ জীবন ও সচ্ছল জীবিকা কামনা করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে।'-বাযযার, হাকেম

        আবু ইয়ালা মোসেলী (রহঃ) বর্ণনা করেন, 'দান-খয়রাত এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের ফলে আল্লাহ্ তা'আলা দীর্ঘ জীবন দান করেন, অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন।'

        আবু ইয়ালা মোসেলী (রঃ) আরও বর্ণনা করেন, 'খাস'আম' সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, একদিন আমি নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমতে হাজির হলাম। তিনি সাহাবায়ে কেরাম পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'হে আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আমল কোনটি? তিনি বললেন, 'ঈমান'। আমি বললাম, ডারপর? তিনি বললেন, 'আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।' আমি জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা মন্দ আমল কোনটি? তিনি বললেন, 'শিরক।' আমি বললাম, তারপর? তিনি বললেন, 'আত্মীয়তার বন্ধন বজায় না রাখা।' আমি বললাম, 'তারপর কোন্টি? তিনি বললেন, 'অসৎ কর্মে উৎসাহিত করা এবং সৎকর্মে বাধা দেয়া।'

        একদা জনৈক গ্রাম্য লোক রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর উষ্ট্রীর লাগাম ধরে ফেলল। তিনি তখন সফরে ছিলেন। লোকটি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কোন আমল নির্দেশ করুন, যদ্বারা আমি জাহান্নাম থেকে বাঁচতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) সফর বিরতি করে সাহাবায়ে কেরামের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকটির উদ্দেশ্য সৎ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছঃ) লোকটিকে তার জিজ্ঞাসার পুনরাবৃত্তি করতে বলেন। সে আরজ করলে তিনি বললেন-

تَعْبُدُ اللَّهَ لا تُشْرِكْ بِهِ شَيْئًا وَ تُقِيمُ الصَّلَاةَ وَتُؤْتِيالزَّكَاةَ وَتَصِلُ الرَّحِمَ .

        -'তুমি এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না, নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আত্মীয়তার হক আদায় কর।' 

        লোকটি বিদায় নেয়ার পর রাসূল (ছঃ) বললেন, 'যদি সে আমার উপদেশ অনুযায়ী আমল করে, তবে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।'-বুখারী, মুসলিম

        'মোসনাদে আহমদ' গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, 'বিনয় ও মহত্ত্ব ইহ-পরকালে কল্যাণ আনয়ন করে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার দীর্ঘ সচ্ছল জীবন দান করে।'

        রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন-

أَتْقَاهُمْ لِلرَّبِّ وَأَوْصَلَهُمْ لِلرَّحِمِ وَأَمَرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَأَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ .


-'সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হচ্ছে যে আল্লাহকে অধিক ভয় করে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে উত্তম ব্যবহার করে এবং তাদের সৎকর্মে উৎসাহিত ও অসৎ কর্মে বাধা প্রদান করে।'         -ইবনে হেব্বান, বায়হাকী 

        হযরত আবু যর গেফারী (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'আমার পরম প্রিয় দোস্ত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আমাকে অসিয়ত করেছেন, ১. পার্থিব ব্যাপারে যারা আমার তুলনায় উন্নত, আমি যেন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা না করি। ২. যারা আমার চেয়ে কষ্টে এবং নিম্ন অবস্থায় আছে, আমি যেন তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। ৩. দরিদ্র অভাবীদের সাথে যেন মহব্বত রাখি এবং সর্বদা তাদের নিকটবর্তী হয়ে থাকি। ৪. আত্মীয়-স্বজনকে যেন খুশি রাখি; যদিও তারা আমার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। ৫. দ্বীনের ব্যাপারে যেন কারো পরোয়া না করি। ৬. তিক্ত হলেও যেন সত্য কথা বলতে অনীহা প্রকাশ না করি। ৭. বেশি বেশি যেন 'লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ' পাঠ করি। কেননা, এটি জান্নাতের ধনভাণ্ডারসমূহের একটি।'                - তাবারানী, ইবনে হেব্বান

        রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, 'শ্রেষ্ঠতম গুণ কোন্‌ন্টি? তোমাদের কি আমি তা বলে দেব না? শোন, তোমার সাথে কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করলে তুমি তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ কর, তোমাকে যদি কেউ বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান কর এবং যে তোমার প্রতি জুলুম করে তুমি তাকে মাফ করে দাও।'     -তাবারানী

        হাদীস শরীফে আছে, 'সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় ও শ্রেষ্ঠতম আমল হচ্ছে, যে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা, যে বঞ্চিত করে তাকে দান করা এবং যে গালিগালাজ করে তাকে মার্জনা করা।' -তাবারানী

        এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক আমলের নির্দেশ দেব না? সাহাবায়ে কেরাম সোৎসাহে বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল? তখন আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেন-

        -'কেউ তোমার সাথে মূর্খতা গোয়ার্তুমিপূর্ণ ব্যবহার করলে তুমি নিজেকে তার সামনে ধৈর্য ও গাম্ভীর্য সহকারে পেশ কর। কেউ তোমার প্রতি জুলুম করলে তুমি তাকে মাফ করে দাও। কেউ তোমাকে বঞ্চিত করলে তুমি তাকে দান কর। কেউ তোমা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তুমি তাকে ভালবাসার সূত্রে গেঁথে নাও।'         -তাবারানী

        হাদীস শরীফে আছে, 'কারও উপকার করা এমন এক ইবাদত, যা সর্বাপেক্ষা তাড়াতাড়ি সওয়াবের ভাগী করে। আর কারও প্রতি অত্যাচার করা এমন পাপ, যা সর্বাপেক্ষা তাড়াতাড়ি আযাবের উপযুক্ত করে তোলে।' -        ইবনে মাজা

        হাদীস শরীফে আরও রয়েছে, 'আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা খেয়ানত ও মিথ্যার চেয়ে বড় গুনাহ; এগুলোতে লিপ্ত ব্যক্তি দুনিয়াতে খুব ত্বরিৎ শাস্তি পায় এবং তার পরকালে শাস্তি তো পুঞ্জীভূত হয়েই থাকে। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার হক আদায় করা এমন পুণ্য কর্ম, যার পুরস্কার প্রতিফল দুনিয়াতেই নসীব হয়; অধিকার আদায়কারীর ধন-সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততিতে বরকত হয়; যদিও আত্মীয়বর্গ জঘন্য পাপে লিপ্ত থাকে; তথাপি তার বরকতে কোনরূপ ঘাটতি দেখা দেয় না।

Post a Comment

0 Comments