কাবা শরীফ থেকে মূর্তি অপসারণ
মহানবী (সাঃ) মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেই সর্বপ্রথম কা'বা শরীফের অভ্যন্তর থেকে সব মূর্তি অপসারণ করার এবং দেয়ালগাত্রে অংকিত প্রতিকৃতিগুলো মুছে ফেলার নির্দেশ দিলেন। ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের সময় হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর দুইটি কল্পিত মূর্তি এমন অবস্থায় দেখা গেল যে, তাদের কল্পিত মূর্তির হাতে বাঁশের তীর ছিল। নবী (সাঃ) তা দেখে বললেন: আল্লাহ্ এই মুশরিকদের নিশ্চিহ্ন করুন, কারণ এরা ভালো করেই জানত যে, এ উভয় পয়গাম্বরই এসব থেকে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন।
নবী (সাঃ) কা'বা ঘর তাওয়াফ করলেন। তখন তিনি মূর্তিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে লাঠি দিয়ে এগুলোকে আঘাত করতেন আর পড়তেনঃ "সত্য সমাগত মিথ্যা (বাতিল) অপসৃত, বাতিল না কোন জিনিস সৃষ্টি করতে পারে, আর না পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে (অর্থাৎ বাতিল স্বয়ং বিলীয়মান)"
প্রিয়নবী (সাঃ)-এর মহত্ত্ব
কা'বা ঘর যখন প্রতিমার অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করে দেয়া হল। নবী (সাঃ) অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন, এর মধ্যে পায়চারি করে উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিলেন এবং নামায আদায় করলেন। অতঃপর বাইরে এসে মাকামে ইবরাহীমে নামায পড়লেন। নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ যখন উযু করছিলেন, মুশরিকরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল তাঁদের মধ্যে না আছে বিজয় উল্লাস আর না আছে গর্ব-অংকার; বরং আল্লাহর দরবারে নিজেদের ইবাদত পেশ করার ব্যস্ত। নিঃসন্দেহে এটা "রাজতন্ত্র" নয়, বরং অন্য কোন জগত।
জন্য প্রত্যেকেই নামায থেকে অবসর হওয়ার পর হযরত আলী (রাঃ) আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল। আপনি আমাদের জন্য দুইটি সেবাকর্ম "হিজাবাহ্ ও সিকাইয়াহ" একত্র করে দিন এবং কা'বার চাবি আমাদের জিম্মায় দিয়ে দিন। হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব হাশিম বংশীয়গণ পালন করত, 'আলী (রাঃ)-এর সাথে কা'বার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্বও যোগ করতে চান। কিন্তু নবী (সাঃ) তাঁর পুনঃপুনঃ আবেদনে কোন সারা দিলেন না এবং বার বার জিজ্ঞেস করলেন, উসমান ইবনে তালহা কোথায়? উসমান ইবনে তালহা উপস্থিত হওয়ার পর নবী (সাঃ) তার হাতে কা'বার চাবি দিয়ে বললেনঃ "উসমান। তোমার চাবি লও, আজকের দিন কল্যাণ কামনা ও প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার দিন।"
[উল্লেখ্য যে, এই সেই উসমান ইবনে তালহা যিনি এক সময় নবী (সাঃ)-কে কাবা শরীফের চাবি দিতে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু নবী (সাঃ)-এর দৃষ্টিতে প্রতিশোধ গ্রহণ একটি পশু সূলভ অর্থহীন ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আজ তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে বরং উসমান ইবনে তালহা (রাঃ)-এর গোত্রকেই কাবার সংরক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। বর্তমানেও এই গোত্র 'শাইবী' নামে পবিত্র কাবার খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।।
যেসব মুশরিক নবী (সাঃ) ও তাঁর সহচরগণকে বছরের পর বছর ধরে নানা উপায়ে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে আসছিল, আজ তাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করা হবে তা অবলোকন করার জন্য লোকেরা অপেক্ষা করছিল। নবী (সাঃ) সব কুরাইশ বন্দীদের উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। সকলকে তাঁর সামনে উপস্থিত করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : হে কুরাইশগণ। তোমাদের কি ধারণা, আজ আমি তোমাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করব? তারা উত্তর দিল, আমরা আপনার কাছে কল্যাণের প্রত্যাশী।
তাদের উত্তর শুনে তিনি বললেনঃ তোমরা যাও, তোমরা সবাই স্বাধীন। মুক্ত। এই ঘোষণা শুনে শুধু কুরাইশই নয়; বরং প্রত্যেক প্রতিভাবান ব্যক্তির সামনে এই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল যে, একজন বাদশাহ ও একজন নবীর জীবন ধারার মধ্যে কত পার্থক্য নবী সুলভ জীবন ধারায় ব্যক্তিগত শত্রুতা ও নীচতার কোন স্থান নেই এবং তাঁর ক্রোধ ও অসন্তোষ কখনও প্রবৃত্তির অনুগত হয় না। কোন নবীকে যদি ধৈর্যের শেষ সীমা পর্যন্ত দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন করা হয় অতঃপর তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় তবে নির্যাতন কারীর নিশ্চিতই ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভ করবে এবং নবীর উন্নত চরিত্রের প্রদর্শনী দেখতে পাবে। সুতরাং এই অবস্থায় অপরাধীরা কাঁপতে কাঁপতে নবী (সাঃ)-এর সামনে উপস্থিত হলে তিনি মিষ্ট ভাষায় বললেনঃ "ভয় পেও না, আমি রাজা-বাদশাহ নই, আমি শুকনা গোশত আহারকারিণী এক কুরাইশ মহিলার পুত্র।"
ক্ষমা ও উদারতার এই নিদর্শন দেখে কুরাইশরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করল। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ)-র পিতা আবু কুহাফা (রাঃ) ঐ দিন ইসলাম গ্রহণ করেন।
প্রিয়নবী (সাঃ) -এর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ
মহানবী (সাঃ) এই উপলক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন- যা ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশের ভিত্তি।
(১) মুসলিম ও অমুসলিম পরস্পরের উত্তরাধিকারী হবে না।
(২) মামলা-মোকদ্দমায় সাক্ষী উপস্থিত করা বাদীর দায়িত্ব এবং সাক্ষীর অবর্তমানে বিবাদীকে শপথ করতে হবে।
(৩) কোন মহিলার জন্য সংগে মুহরিম পুরুষ ব্যতীত তিন দিনের পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করা জায়েয নয়।
(৪) ফজর ও আসরের নামাযের পর কোন (নফল) নামায নেই। এবং ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহার দিন রোযা রাখা জায়েয নয়।
(৫) হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের জাহিলী যুগের গর্ব-অহংকার ও বংশ-গৌরবের মূলোচ্ছেদ করে দিয়েছেন। জেনে রাখ! গোটা মানব জাতি আদম (আঃ)-এর সন্তান এবং আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
"হে মানব মণ্ডলী। নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা থেকে সৃষ্টি করেছি, এরপর তোমাদের জাতি ও ভ্রাতৃগোষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছি- যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যকার সর্বাধিক মুত্তাকী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। নিশ্চিতই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সর্ব বিষয়ে অবহিত।" (সূরা হুজুরাত)
0 Comments