প্রিয়নবীর (সাঃ) বিদায়ী হজ্জ
দশম হিজরীর ২৫ যিলকাদ সোমবার দিন হুযুর (সাঃ) হজ্জ আদায়ের জন্য মক্কা মুয়ায্যমায় রওয়ানা হন। ঐতিহাসিকদের মতে ১ লাখের চেয়ে বেশী সংখ্যক সাহাবীর এক বিরাট দল হুযুর (সাঃ) এর সাথে ছিলেন। মদীনা মুনাওয়ারা থেকে ৬ মাইল দরে মূলহোলাইফা নামক স্থানে ইহরাম বাঁধেন। যিলহজ্জ মাসের ৪ তারিখ শনিবার মক্কা মুয়ায্যমায় প্রবেশ করেন এবং শরীয়তের নিয়মানুযায়ী হজ্জ আদায় করেন।
বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ
৯ তারিখে আরাফাতের ময়দানে হযরত (সাঃ) এক বিস্তারিত উপদেশ ও নির্দেশপূর্ণ বক্তৃতা ছিল আল্লাহ্ তা'আলার শেষ রসূলের অন্তিম ভাষণ।
হুযুর (সাঃ) বলেন- হে মানুষ সকল। আমার কথা শোন, আমি তোমাদের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় বিয়ে বর্ণনা করছি। আগামী বৎসর আমি তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি কিনা তা জানা নেই। এরপর তিনি বলেন, অপরের জান ও মাল এবং সম্মান তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত এমনিভাবে হারাম করা হলো, যেমনিভাবে এই দিন (আরাফাতের) এই মাসে (যিলহজ্জ) এই শহরের (মক্কার) সম্মান রক্ষা করা হয়েছে। এইজন্য যার কাছে কারো কোন আমানত থাকে, সে যেন তা আদায় করে।
এরপর তিনি বলেন, 'হে লোক সকল, তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের কিছু হক রয়েছে এবং তাদের উপর তোমাদের হক রয়েছে। হে লোক সকল। মুসলমান সব ভাই ভাই। কারো জন্য তার ভাইয়ের মাল তার সন্তুষ্টি ছাড়া হালাল নয়। আমার পরে তোমরা কাফির হয়ে যেয়ো না, ফলে একজন অন্যজনকে হত্যা করতে থাকবে। আমি তোমাদের জন্য আমার পর আল্লাহ্ তা'আলার কিতাব (কুরআন) রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা এর নির্দেশাবলী শক্তভাবে আঁকড়ে ধর প্রর্থাৎ সঠিকভাবে অনুসরণ কর, তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।'
এরপর তিনি বলেন, 'হে লোক সকল। তোমাদের প্রভু বা পালনকর্তা এক, তোমাদের দিপ্তা এক, তোমরা সবাই আদম (আঃ) এর সন্তান এবং আদম (আঃ) মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানী ঐ ব্যক্তি যিনি বেশি আল্লাহভীরু। কোন আরবের অনারবের উপর আল্লাহভীরুতা ছাড়া কোন মর্যাদা নেই। স্মরণ রেখ যে, আল্লাহর বাণী আমি পৌছিয়ে দিয়েছি। এবং হে আল্লাহ। তুমি সাক্ষী থাক যে, আমি তোমার বাণী পৌছিয়ে দিয়েছি। উপস্থিত লোকদের উচিত যে অনুপস্থিতদের নিকট এ সমস্ত বাণী পৌছিয়ে দেয়।' অতঃপর হজ্জ সমাপন করে হযরত (সাঃ) ১০ দিন মক্কায় অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসেন।
সারিয়ায়ে উসামা (রাঃ)
মক্কা মুয়াযমযা থেকে ফিরে আসার পর ১১ হিজরীর ২৬ সফর সোমবার প্রিয়নবী (সাঃ) রোমে জিহাদে প্রেরণের জন্য এক সারিয়া তৈরি করেন, যাতে হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) হযরত ফারুকে আযম (রাঃ) এবং হযরত আবু উবায়দা (রাঃ)-এর মত সম্মানিত সাহাবা ছিলেন। কিন্তু এই সারিয়ার আমীর রূপে হযরত উসামা (রাঃ) কে নির্বাচন করেন। এটাই সর্বশেষ দল যার প্রেরণের ব্যবস্থা প্রিয়নবী (সাঃ) নিজেই করেছিলেন। এই সারিয়া রওয়ানা হবেন এমনি সময় প্রিয়নবী (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন।
প্রিয়নবী (সাঃ)-এর অন্তিমরোগ
২৮ সফর বুধবার দিবাগত রাত্রে প্রিয়নবী (সাঃ) 'বাকীয়ে গারকাদ' নামক কবরস্থানে গমন করে কবরবাসীদের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করেন এবং বলেন, 'হে কবরবাসিগণ তোমাদের এ অবস্থা এবং কবরের অবস্থান মুবারক হোক। কেননা এখন দুনিয়াতে বিভিন্ন ফিতনার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে।
সেখান থেকে ফেরার সময় মাথাব্যথা ছিল এবং এরপর জ্বর শুরু হয়। এ জ্বর বুখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী একাধারে ১৩ দিন বিদ্যমান ছিল এবং ঐ জ্বরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় হযরত (সাঃ) নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন উন্মুল মুমিনীনদের আবাসস্থলে পালাক্রমে বাস করেন। যখন হযরত (সাঃ)-এর অসুস্থতা দীর্ঘমেয়াদী ও মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন উম্মুল মুমিনীনদের নিকট থেকে অনুমতি নেন যে, অসুস্থতার সময় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর ঘরে অবস্থান করবেন। সবাই এতে রাজি হন।' প্রিয়নবী (সাঃ)-এর রোগ ক্রমান্বয়ে এত বেড়ে গেল যে, তিনি মসজিদেও গমন করতে পারলেন না। তখন বললেন, সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) কে বলো যেন নামায পড়ান। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) প্রায় ১৭ ওয়াক্ত নামায পড়ান। এর পর ঘটনাক্রমে একদিন হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) ও হযরত আব্বাস (রাঃ) আনসারদের এক মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, তাঁরা সবাই কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বললেন, প্রিয়নবী (সাঃ)-এর মজলিসের কথা স্মরণ করে তাঁরা কাঁদছেন। এ কথা শুনে প্রিয়নবী (সাঃ) হযরত আলী (রাঃ) এবং হযরত ফজল (রাঃ)-এর কাঁধের উপর ভর করে বাইরে আগমন করেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) সামনে ছিলেন। প্রিয়নবী (সাঃ) মিম্বরের উপর চড়লেন; কিন্তু নীচের সিঁড়িতেই বসলেন। উপরের সিঁড়িতে উঠতে সক্ষম হলেন না। তখন তিনি এক প্রাঞ্জল ভাষণ পেশ করলেন।
হে লোকসকল! আমার মনে হয় যে, তোমরা তোমাদের নবীর মৃত্যুতে ভয় পাচ্ছ। আমার পূর্বে কি কোন নবী সর্বদা জীবিত ছিলেন যে, আমিও জীবিত থাকব? হ্যাঁ, আমি স্বীয় প্রভুর সাথে মিলিত হবো। এবং তোমরাও আমার সাথে মিলিত হবে। হ্যাঁ, তোমাদের সাথে মিলিত হবার জায়গা হলো হাওযে কাওসার। অতঃপর যে বক্তি এটা পছন্দ করবে যে, কিয়ামতের দিন এই হাওযে কাওসার দ্বারা তৃপ্তি লাভ করবে, তা হলে তার উচিত স্বীয় হাত ও মুখ যেন নিষিদ্ধ অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা হতে বিরত রাখে। আমি তোমাদেরকে মুহাজিরদের সাথে পরম্পর সদ্ব্যবহার করার জন্য ওসিয়ত করছি। (এবং আরো বলেন যে,) যখন মানুষ আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করে, তখন তাদের বিচারক ও বাদশাহ তাদের সাথে ন্যায় বিচার করে; যখন তারা তাদের প্রভুর সাথে নাফরমানী করে, তখন তারা (বিচারক ও বাদশাহ্) নির্দয় ব্যবহার করে।
এরপর প্রিয়নবী (সাঃ) গৃহে গমন করেন। অতঃপর ইন্তিকালের ৫ বা ৩ দিন পূর্বে একবার বাইরে আগমন করেছিলেন। পবিত্র মাথা বাঁধা ছিল। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) নামায পড়াচ্ছিলেন তিনি পেছনে চলে আসতে লাগলেন। প্রিয়নবী (সাঃ) হাতের ইশারায় নিষেধ করেন এবং নিজে আবু বকর (রাঃ)-এর বামদিকে বসে গেলেন। নামাযের পর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন, যাতে তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ) আমার সবচেয়ে বেশী উপকারী ছিলেন। যদি আমি আল্লাহকে ছাড়া কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ ছাড়া কেউ বন্ধু নেই, তাই আবু বকর আমার ভাই ও সোন্ত। তিনি আরো বলেন, মসজিদে যে সমস্ত লোকের দরোজা রয়েছে, হযরত আবু বকর (রাঃ) এর দরোজা ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দেয়া হোক। এরপর অধিকাংশের মতে ২ রবিউল আউয়াল প্রচলিত মতে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দিন লোকেরা ফজর নামায সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর পেছনে পড়ছিলেন। এ সময় প্রিয়নবী (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) এর গুজরা থেকে পর্দা খুলে মুসল্লীদের দেখলেন এবং একটু হাসলেন। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) তা দেখে পিছু সরতে লাগলেন। প্রিয়নবী (সাঃ) সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-কে হাতে ইশারা করে বললেন, নামায পূর্ণ কর। অতঃপর নিজে ভিতরে প্রবেশ করেন ও পর্দা টেনে দেন। এরপর আর বাইরে আগমন করেন নি।
0 Comments