হস্তের সৃষ্টি কৌশল

        আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুটো হস্ত দিয়েছেন এবং তা' কিছুটা দীর্ঘ করেছেন যেন তদ্বারা কোন বস্তু ধারণ করতে পারা যায়। তিনি হস্ত তালুকে বিস্তৃত করে তাতে পঞ্চ অঙ্গুলি দিয়েছেন এবং প্রত্যেক অঙ্গুলিকে এক পার্শ্বে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিকে অন্য পার্শ্বে স্থাপন করেছেন যেন বৃদ্ধাঙ্গুলিকে সব অঙ্গুলির উপর ঘুরাতে পারা যায়। যদি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকগণ একত্র হয়ে অত্যন্ত চিন্তা-ভাবনার সাথে অঙ্গুলি যেভাবে আল্লাহ সাজিয়ে দিয়েছেন তার বিপরীতভাবে স্থাপন করে এবং হস্তের দীর্ঘতা হ্রাস করে এবং অঙ্গুলির সারি পরিবর্তন করে দেয় তবে তাতে হাতের কার্য বিঘ্নিত হবে। কেননা আল্লাহতায়ালা কৃত এই শৃঙ্খলাই হস্ত দ্বারা ধারণ করা বা অন্যান্য কাজ করার উপযোগী। যদি তুমি তোমার হস্ত বিস্তৃত কর তবে তা' তন্তরীর কাজ দেয় এবং তার উপর যা' ইচ্ছা রাখতে পার। যদি তা' একত্র কর তবে তা' তোমার প্রহার করার যন্ত্ররূপে পরিণত হয়। যদি তা' মুষ্টিবদ্ধ কর তা' তোমার জন্য পাত্রের কার্য করে। যদি তা' বিস্তৃত কর এবং অঙ্গুলিগুলো সংযুক্ত করে রাখ তবে তা' তোমার জন্য ঝাড়ু এবং কোদালের কাজ করে। তারপর তোমার অঙ্গুলির অগ্রভাবে নখর সৃষ্টি করা হয়েছে, তা' অঙ্গুলির শোভা বর্ধক। যে পর্যন্ত তা' কর্তন করা না হয় তবে তদ্বারা এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তু কুড়িয়ে নিতে পার যা' অঙ্গুলি গ্রহণ করতে পারে না। প্রয়োজনের সময় নখর দ্বারা চুলকাতে পারা যায়। যে নখর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে অতি নিকৃষ্ট যদি তা' মানুষের না থাকত এবং তদ্বারা চুলকানো না যেত তবে সে সৃষ্টির অপদার্থ ও দুর্বল প্রাণীর মধ্যে গণ্য হত। অন্য কোন প্রাণীই তার শরীর চুলকাতে পারত না। যদি তুমি নিদ্রাযুক্ত থাক বা অসতর্ক থাক হস্তকে চুলকানির স্থান পর্যন্ত এত দীর্ঘ করা হয়েছে যেন তুমি হস্ত দ্বারা চুলকাতে পার। যদি তজ্জন্য অন্য বস্তুর সাহায্য চাও তা' অতি কষ্টের পর চুলকানির স্থান পর্যন্ত পৌছতে পারে। মূলে এসব কিছুই একবিন্দু শুক্র থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তা' তিনটি পর্দার অভ্যন্তরে জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে। যদি এই পর্দা না থাকত এ চক্ষু দ্বারা তা' দর্শন করা যেত তবে অংকন ও চিত্রণকার্য কিভাবে গঠিত হয় তা' দেখতে পারবে কিন্তু চিত্রকরকে ও তার যন্ত্রপাতিকে দেখতে পেতে না। তুমি কি এমন চিত্রকর ও কারীকর দেখেছ যে, সে তার যন্ত্রপাতি স্পর্শ না করে এবং তা' কাষে' না খাটিয়ে চিত্র প্রস্তুত করতে পারে? তা'হলে বুঝতে পার যে আল্লাহতায়ালার কি অপূর্ব শক্তি ও তার প্রমাণ কত স্পষ্ট।

        তারপর তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁর করুণার দিকে লক্ষ্য কর। যখন ক্ষুদ্র সংকীর্ণ জরায়ু ভ্রূণের জন্য বিস্তৃত হয়, কিরূপে আল্লাহ তাকে পথ প্রদর্শন করেন। ভ্রূণ যখন বড় হয় তা' নড়তে থাকে এবং সেই সংকীর্ণ স্থান থেকে বের হয়ে বহিয়ার অন্বেষণ করতে থাকে। মনে হয় যেন তখন তা' বুদ্ধিমান, দৃষ্টিমান। তারপর যখন তা' ভূমিষ্ট হয় এবং তার খাদ্যের প্রয়োজন হয় আল্লাহ কিরূপে তাকে মাতৃত্তনের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য পথ প্রদর্শন করেন। তারপর যখন তার শরীর একটু ভারী হয়ে উঠে আল্লাহ কিরূপে তার জন্য তরল, শুভ্র দুদ্ধ সৃষ্টি করে দেন এবং তা' তার মাতার লোহিত বর্ণ রক্ত গ্রন্থি থেকে বের করে সুষ্ঠু ও খালেছ দুগ্ধে পরিণত করেন। তিনি কিরূপে দুটি জন বের করে তার মধ্যে দুদ্ধের ফোয়ারা স্থাপন করেছেন। কিরূপে তিনি দুটি স্তনের বোটার আয়তন সৃষ্টি করেছেন যে, তা' শিশুর মুখের আয়তন অনুযায়ী হয়ে তা' থেকে অল্প অল্প দুগ্ধ খরন হয়। তারপর তিনি স্তনের বোটার মধ্যে অতি সংকীর্ণ গ্রন্থি সৃষ্টি করেছেন যেন অল্প অল্প পরিমাণে দুগ্ধ বের হয়ে আসে। কেননা শিশু অল্প পরিমাণ ব্যতীত টানতে পারে না। তারপর তিনি কিরূপে তাকে স্তন পান করার জন্য পথ দেখিয়েছেন, সেই সংকীর্ণ গ্রন্থি থেকে ক্ষুধার সময় প্রচুর পরিমাণে যেন দুগ্ধ বের না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

        তারপর তার দুগ্ধ পানে বিরতি ও তার স্নেহ ও করুণার বিষয়ের দিকে লক্ষ্য কর। কিরূপে তিনি দু বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দন্ত বের করতে বিলম্ব করেন। কেননা সে সময় তার মুখে দন্ত দেয়া হলে, সে দস্তাঘাতে স্তন ক্ষত বিক্ষত করতে পারে। এই দুবছর পর্যন্ত দুগ্ধ ব্যতীত তার আর অন্য কোন জীবিকা রাখেননি; সুতরাং এ সময়ে তার দন্তের প্রয়োজন হয় না। যখন শিশু একটু বড় হয় তখন ঐ দুগ্ধ শিশুর খাদ্যের জন্য যথেষ্ট থাকে না এবং সম্পূর্ণরূপে স্বাস্থ্যসম্মতও থাকে না তজ্জন্য তখন তার একটু শক্ত খাদ্যের প্রয়োজন হয় এবং সে খাদ্য চর্বণ এবং পিষণেরও প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজনের সময় আল্লাহতায়ালা শিশুর মুখে দন্তরাজি উদগত করেছেন। সাধারণতঃ ও স্বভাবতঃ শিশুর মুখের দন্ত এই কারণেই এ সময়ের পূর্বেও উদগত হয় না এবং পরেও হয় না। সেই মহান করুণাময় আল্লাহতায়ালাকে অশেষ ধন্যবাদ। যিনি কোমল মাংসপিণ্ড থেকে এরূপ শক্ত দন্তরাজি বের করে দেন। তারপর যখন শিশু আরও একটু বড় হয় সে নিজের চেষ্টা দ্বারা নিজের খাদ্য নিজেই গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। তখন আল্লাহতায়ালা কিরূপে পিতা-মাতার মনকে তার প্রতি স্নেহ প্রদর্শনের সৃষ্টি করে দেন। যদি আল্লাহতায়ালা তাদেরকে মস্তকে শিশুর প্রতি স্নেহ জনিন্ময়ে না দিতেন তবে শিশু তার নিজের চেষ্টায় কিছুতেই খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত না।

        তারপর লক্ষ্য কর, তিনি কিরূপে তাকে ক্রমে ক্রমে শক্তি, পার্থক্য জ্ঞান, বুদ্ধি এবং পথের সম্বল প্রদান করেন। তাতে সে বর্ধিত হয়। তার শরীর পূর্ণতা লাভ করে। তারপর সে যুবকে পরিণত। হয়। অতঃপর সে পৌঢ়ত্বে এবং বার্ধিক্যে পৌঁছে যায়। তারপর সে কৃতজ্ঞ বা অকৃতজ্ঞ হয়। ধার্মিক অথবা পাপী হয়। মুমিন অথবা কাফির হয়। এটা আল্লাহতায়ালার এই আয়াত অনুসারে হয়ে থাকে। যথাঃ "মানুষের কি এমন এক সময় ছিল না, যখন সে কোন উল্লেখযোগ্য পদার্থই ছিল না। আমি মানুষকে একটি মিশ্রিত শুক্র দ্বারা পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি দান করেছি। আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি কৃতজ্ঞতার বা অকৃতজ্ঞতার পথ।"

        এখন তুমি আল্লাহর অপার করুণা ও দয়ার দিকে, অসীম শক্তি ও কৌশলের দিকে লক্ষ্য কর। মহাপ্রভুর অসীম শক্তি দেখে তুমি পরিশ্রান্ত হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি দেয়ালের উপর অঙ্কিত সুন্দর চিত্র দেখে, তাঁর কলা কৌশলে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তার সব চিন্তা সেই সুন্দর চিত্র সম্বন্ধেই ব্যয় করে যে, সে কিরূপে এই চিত্র অংকন করেছে। কিরূপে শক্তি তাতে খাটিয়েছে। এই কথা ভেবে সে চিত্রকে খুবই বড় মনে করতে থাকে এবং লতে থাকে, কি দূরদর্শী ও পরিপক্ক চিত্রকর। তার কারুকার্য কি সুিন্দর ও চমৎকার। তার ক্ষমতার কি বালাই। এসব বিচিত্র কারুকার্য সে নিজের মধ্যে এবং অন্যের মধ্যে লক্ষ্য করে কিন্তু তার মূল শিল্প কর্তার দিকে এতটুকু মনোযোগ দেয় না। সেই মহান শিল্পকর্তার গৌরব তাকে এতটুকুও ভাবিয়ে তোলে না। তাঁর কৌশল ও মহত্ব তার মনকে মোটেই পরিশ্রান্ত করে না। তোমার শরীরের অত্যাশ্চর্য ব্যাপারের এটা একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এ ব্যাপারে বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।

        মূলতঃ এ বিষয়ই তোমার চিন্তার জন্য নিকটবর্তী ক্ষেত্র এবং তোমার সৃষ্টিকর্তার গৌরবের সুস্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু তুমি তাতে অমনোযোগী। তুমি শুধু তোমার উদর ও কামরিপুর তৃপ্তিদানে নিমগ্ন। তুমি ক্ষুধা ব্যতীত আর কিছুই জান না। তা' জেনে তুমি তৃপ্তি সহকারে খাদ্যে লিপ্ত হও। ঘোর নিদ্রায় মগ্ন হও। কামরিপুর দ্বারা চালিত হয়ে সঙ্গম সুখ উপভোগ কর। তাতে তোমার ক্রোধ জন্মে এবং তার ফলে তুমি সংঘর্ষে লিপ্ত হও। এসব লোভের ব্যাপারে তোমার সাথে ইতর প্রাণীগণও অংশীদার হয়। ইতর প্রাণীগণ আল্লাহর পরিচয় এবং স্বর্গ ও মর্ত্য রাজ্যের বিচিত্র কলাকৌশল থেকে বঞ্চিত। কিন্তু মানুষকে তার বুঝার শক্তি ও জ্ঞান দেয়া হয়েছে এবং তারই বলে সে নিকটবর্তী ফিরেশতাদের দলভুক্ত হতে পারে এবং নবী ও ছিদ্দীকগণের দলের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারে। এই মর্যাদা পশুদের জন্য নয় বা ঐ লোকদের জন্য নয় যারা পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে দুনিয়ায় সন্তুষ্ট থাকে। তারা পশুর চেয়েও অনেকাংশে অধম। কেননা তাতে পশুর শক্তি নেই। কিন্তু আল্লাহ তার মধ্যে শক্তি সৃষ্টি করেছেন। তারপর সে তার অসৎ ব্যবহার করে আল্লাহর সম্পদের অকৃতজ্ঞ হয়েছে। সুতরাং তারা পশুসদৃশ বরং তদপেক্ষাও অধিক পথভ্রষ্ট।

Post a Comment

0 Comments