একদা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা জনমানবহীন মাঠের ভিতর দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। এমন সময় শূন্য থেকে গুরুগম্ভীর স্বর ভেসে এল। হে মুহাম্মদ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শব্দ শুনে উর্ধদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন। একখানা বিরাট সিংহাসনে হযরত জিব্রাইল (আঃ) ফেরেস্তা বসে আছেন, শূন্য পথে ভেসে আসছে। তাকে দেখা মাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি এসে হযরত খাদীজাকে বললেন, খাদীজা। শীঘ্র আমাকে বস্ত্রের দ্বারা আবৃত করে দাও। হযরত খাদীজা তাঁকে একখানা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। ঠিক সে সময় তাঁর উপর কোরান শরীফ নাজেল হল। তিনি শুনতে পেলেন-
يَا أَيُّهَا الْمُدَّخِرُ قُمْ فَانْذِرُ وَرَبَّكَ فَكَبِّرُ وَنِيَابَكَ فَطَهِّرْ .
উচ্চারণ: ইয়া আইয়হাল মুদ্দছছিরুকুম ফাজির, ওয়া রাব্বুকা ফাকাব্বির, ওয়া ছিয়াবাকা ওয়া ফাতাহহির।
অর্থঃ হে বস্ত্রাবৃত ব্যক্তি! লোকদেরকে আল্লাহর ভয় দেখাও এবং তোমার প্রতিপালকের গুণ-গান কর। তোমার পরনের বস্ত্র পবিত্র রাখ এবং শিরক ও কুফরী হতে দূরে থাক।
এ ঘটনার পর হতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঘন ঘন অহী নাযিল হতে থাকল। যখন যে আয়াত নাজিল হত সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা মুখস্থ করে ফেলতেন এবং হযরত খাদীজাকে তা পাঠ করে শুনাতেন। ইসলাম প্রচারের আদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর একদা তিনি হযরত খাদীজাকে বললেন, খাদীজা। তুমি আমার সম্বন্ধে কিরূপ ধারণা পোষণ কর ? হযরত খাদীজা উত্তর করলেন, আমি আপনাকে সত্যবাদী, ওয়াদা পালনকারী, ন্যায় বিচারক, সচ্চরিত্রবান ও আমানতদার বলে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে খাদীজা। যদি তাই মনে কর তবে তুমি বিশ্বাস কর যে, আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। তুমি মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে শেরেকী ও কুফরী গোনাহ হতে তওবা করে এক নিরাকার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁর এবাদতে মনোনিবেশ কর। তুমি পাঠ কর- 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।' হযরত খাদীজা তখনই কালেমা তাইয়েব পাঠ করে পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।
হযরত খাদীজা সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এজন্য আজ পর্যন্ত তিনি সারা মুসলিম জগতে উম্মুল মুমেনীন বা মুমেনদের মাতা বলে সকলের অশেষ শ্রদ্ধা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। তাছাড়া ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক যুগে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিনী হিসাবে ইসলামের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন, ইসলাম প্রচারের জন্য তাঁর সে দান ও ত্যাগ স্বীকারের নজীর ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় জন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কতকাল চলে গেছে এবং আরও কত শতাব্দী চলে যাবে, হযরত খাদীজার উপকারের কথা প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে চিরদিনই রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। হযরত খাদীজা (রা) যদি তখন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর নবী বলে বিশ্বাস করে ইসলাম গ্রহণ না করতেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কায়মনোবাক্যে ইসলাম প্রচারে সক্রিয় সাহায্য না করতেন, তবে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে ইসলাম প্রচার করা অতটা সহজসাধ্য হত না। তাহলে হয়তো জগতে ইসলামের ইতিহাস সম্পূর্ণ অন্যভাবে লিখিত হত। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের নিকট আল্লাহর বাণী প্রচারে মনোনিবেশ করলেন। তিনি যখন সকলকে দেব-দেবীর পূজা পরিত্যাগ করে নিরাকার এক আল্লাহর উপাসনা করতে আহ্বান করলেন। তখন সকলেই তাঁর সাথে ঘোর শত্রুতা আরম্ভ করে দিল। তারা এই নতুন ধর্মের কথা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর একেবারে ক্ষেপে উঠল। তাদের স্বার্থে ক্ষতিকর ও মতের বিপরীত এ নতুন ধর্ম প্রচারে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাধা দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল। তারা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নানা প্রকার অমানুষিক অত্যাচার করতে আরম্ভ করে দিল। যাঁরা এ ধর্ম গ্রহণ করলেন তাঁদের ওপরেও চলল নিষ্ঠুর অত্যাচার। তবুও তিনি আপন কর্তব্য হতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হলেন না। এ ঘোর দুর্দিনে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবুতালিব ও হযরত খাদীজা ছাড়া হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনগণ পর্যন্ত তাঁর ঘোর বিরোধিতা করতে আরম্ভ করে দিল। এমনকি বিধর্মীরা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করতে লাগল। একদিকে আরবের যাবতীয় কুরাইশ ও তাদের অমিততেজা দলপতিগণ এবং অন্যদিকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর নগণ্য সংখ্যক নিঃস্ব উম্মত। একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহ ছাড়া তাদের সাহায্য করার আর কেউ ছিল না সমগ্র আরবে। কুরাইশগণ তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করল বিভিন্ন প্রকারে তাদেরকে হয়রান করতে, ইসলাম প্রচারে বাধা দিতে। এমনকি তাদের জীবিকা অর্জনের পথে পর্যন্ত বাধা সৃষ্টি করল। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপরে এবং নবদীক্ষিত মুসলমানদের ওপরে দিবারাত্রি কুরাইশদের কত নিষ্ঠুর অত্যাচার যে চলতে লাগল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এসময় হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মানসিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ত। কখনও কখনও তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন। কি করবেন কিছুই ভেবে পেতেন না। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কঠিন বিপদের দিনে হযরত খাদিজা কুসুম-কোমল গৃহিণীর ন্যায় গৃহকোণে বসে কেবল রান্না করতেন না বা আয়েশ-আরামের কোলে গা ঢেলে দিয়ে পড়ে থাকতেন না। তিনিও স্বামীর সঙ্গে সঙ্গেই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতেন আল্লাহর বাণী প্রচার করতে। সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে।
হযরত খাদীজার বলিষ্ঠ ও সক্রিয় সহযোগিতা ও সাহায্যের ফলেই মুসলমানগণ সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ইসলামের আদর্শ প্রচারে সফলকাম হয়েছিলেন। হযরত খাদীজা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ঘোর দুর্দিনে একদিকে অনলবর্ষী উৎসাহসচক বাক্যোর ছরা জামীকে কর্তব্য প্যাথ এগিয়ে নিতেন, অপরদিকে সহানুভূতি ও মধুবর্দী বাক্যের যারা তাঁর দহ হৃদয়ে শাড়িবারী সিঞ্চন করতেন। কঠিন বিপদ ও দুঃখ কষ্টের সাময়ও প্রাণপ্রিয়া স্ত্রীর সহানুভূতিপূর্ণ কথা, উৎসাহ ও মনোবল প্রদায়িনী উপদেশ, স্নিগ্ধ ও মিষ্টি মন্ত্রর আদি হয়নরত রাসু্যুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক অনাবিল আনন্দের রাজ্যে পৌছিয়ে দিত।
হযরত খাদিজা ছিলেন একদিকে রাসূলে আকরাম সাররাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী, সহকর্মী ও অস্ত্রয়দাতা। অন্যদিকে যাঁরাই ধন-দৌধাত লাভ করে তিনি অভাবশূন্য হয়ে নিশ্চিত মনে কাতব্য পাথে এগিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর সান্ত্বনা বাণী ও উৎসাহ বাক্য সর্বদা হনবার রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহ আলাইহি আয়া সাল্লামকে কর্তব্য পথে অনুপ্রেরণা প্রদান করত। হবরাক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালিব ছিলেন কুরাইশ দলের অন্যায়াম দোয়া। কাজেই কুরাইশগণ তাঁর ভাতিজা হযরত মুহাম্মদের প্রতি প্রকাশ্যে অত্যাচার করকে সাবনা পেত না। অপরদিকে হযরত খাদীজা ছিলেন শিক্ষায়, বংশ-মর্যাদায় ও ধন-দৌল্যাত আছিলীয়া, সেজন্য অনেক লোক জীর নিম্নাঙ বাধ্য ও অনুগত ছিল। কাজেই খাদীজার স্বামীর উপরে কারা আর্য্যামার করতে সাহস পেত না, এই উভয় কারণে হযরত রাসুলুল্লাহ সরাল্লাছ আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসলাম প্রচার অনেকটা সহজ হয়েছিল।
যখনই কোন নতুন বিশদ উপস্থিত হল, হযরত খাদীজা স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, স্বামী। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনার সহয়। তিনি তাঁর রাসূলকে সাহায্য করার ওয়াদা করেছেন, সে ওয়াদা তিনি খেলাপ করতে পারেন না। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার ভয়ের কোন কারণই নেই, কাফেররা আপনার কোন অনিষ্টই করতে সমর্থ হবে না। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই আপনাকে সব বিপদ হকে রক্ষা করবেন। হয়ং আল্লাহ তা'য়ালা যার সহায়, সহস্র শত্রু শত্রুতা করেও তীর কোন অনিষ্ট করতে পারে না। হযরত খাদীজা ইচ্ছা করেই সকল দুঃখ কষ্ট বরণ করে নিয়েছিলেন এবং অতবড় বিপদের ঝুঁকি মাথা শেকে নিয়েছিলেন। নতুবা সমগ্র আরব দেশে ব্যক্তিণারভাবে জীর কোন শত্রু ছিল না; আরবের প্রতিটি নয়-নারী তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ ছিল।
কাফেররা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেরে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করছে, এ সংবাদ শুনে হযরত খাদীজার মনে সর্বদাই ভয় ও দুশ্চিন্তা জেগে থাকত। তিনি এক মুহূর্থের জন্যও প্রাণে শান্তি পেতেন না।
একদিন রাতে হযরত রানুহুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাড়ি ফিরতে কিছু বিলাম্ব হলা। হযরাত খাদীজা ক্রমেই ব্যাকুল হয়ে উঠতে লাগল । অবশেষে নিজের বিপদের কথা ভুলে তিনি একাই বের হয়ে পড়লেন স্বামীর খোঁজে। সে সময় মুসলমানদের উপরে কাফেররা এক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুসলমান পেলেই নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেনাত। এসব বিপদের কথা জানা সত্ত্বেও হযরত খাদীজা (রা) ঘোর অন্ধকার রাতে বের হয়ে পড়লেন স্বামীর খোঁজে। আমীর বিগান্দের কথা চিন্তা করে নিজের বিপদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন কিনি। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তায় একজন লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হল। লোকটি অন্ধকারে হযরত খাদীজাকে (রা) চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল। মুহাম্মদ সরাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এদিকে বেথায়ও দেখেছো কি? হযরত খাদীজা (রা) সংক্ষেপে কেবল 'না' বলে এগিয়ে চললেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, কাফেররা তাঁর স্বামীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই খোঁজ করছে। তাঁর মনের চিন্তা আরও বেড়ে গেল। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে যে স্থানে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তার প্রত্যেক স্থানে খোঁজ করেও তাঁকে না পেয়ে হযরত খাদীজা (রা) হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তিনি বাড়ি এসে দেখতে পেলেন যে, কিছুক্ষণ পূর্বে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়ি এসেছেন। তাঁর বুক হতে যেন একটা বিরাট ভারী বোঝা নেমে গেল।
0 Comments