সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়াতের দশম বর্ষে ইসলাম গগণের দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে গেল-(১) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালিবের মৃত্যু ও (২) হযরত খাদীজার (রা) মহাপ্রয়াণ। এজন্য সে বছরটিকে বলা হতো আমোল হুজন অর্থাৎ শোকের বছর। আবু তালিব ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলমানদের যেন একেবারে পাঁজর ভেঙে গেল। আর হযরত খাদীজা (রা) তো ছিলেন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দক্ষিণ হস্ত। এ দুজনের ইন্তেকালে হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শোকে একেবারে মূহ্যমান হয়ে পড়লেন। আবু তালিব ছিলেন হযরত রাসূলে আকরামের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃগর্ভে থাকতেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছিলেন। জন্মের পর হতে তিনি দাদা আবদুল মুতালিবের স্নেহের ছায়ায় লালিত-পালিত হয়ে আসছিলেন। ছ'বছর বয়সে যখন তাঁর দাদা ইন্তেকাল করেন তখন থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি চাচা আবু তালিবের স্নেহের ছায়া লাভ করে এসেছিলেন। আবু তালিব যদিও নানা কারণে প্রকাশ্য ইসলাম গ্রহণ করেননি তথাপি তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতায় ইসলামের আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিরাট সহায়ক হয়েছিল। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত তিনি হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরাইশদের খড়যন্ত্র হতে রক্ষা করেছিলেন।
শুধু নিজের ভাতিজা হিসেবেই নয় বরং আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবেই তিনি হযরত মুহাম্মদকে শত্রুর কবল হতে রক্ষা করার জন্য সর্বদা প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত লাভ সম্বন্ধে তিনি সে দিনই অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যেদিন বসরার খ্রিস্টান ধর্মযাজক বহিরা তাঁকে বলেছিলেন যে, আপনার ভাতিজা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অদূর ভবিষ্যতে পয়গম্বর হবেন। তাই কুরাইশদের অমানুসিক অত্যাচার, অশেষ লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও তিনি হযরতকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। এমনকি শুধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যই তিনি সুদীর্ঘ তিনটি বছর পরিজনবর্গসহ পর্বত গুহায় অবস্থান করে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের দশম বর্ষে মহাত্মা আবু তালিব এ নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে অনন্তধামে প্রস্থান করেন। আবু তালিবের ইন্তেকালে একদিকে মুসলমানদের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হল অপরদিকে কুরাইশরা তেমনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আবু তালিবের ইন্তেকালের তিন মাস পরে হযরত খাদীজা (রা) শেষ রোগশয্যায় শায়িতা হলেন।
একদিন দু'দিন করে হযরত খাদীজা ও রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাম্পত্য জীবনের পঁচিশ বছর পূর্ণ হল। স্বামীর সুখ-দুঃখের সমভাগিনী হয়ে পরম শান্তিতেই কাটিয়ে দিয়েছেন এ পঁচিশটি বছর হযরত খাদীজা (রা)। তিনি সর্বদা স্বামীর সুখ-শান্তির কথাই চিন্তা করতেন এবং স্বামীর সুখকে নিজের জীবনের সর্বাপেক্ষা বড়সুখ ও স্বামীর বিপদকে নিজের জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় বিপদ বলে মনে করতেন। এতদিনে তাঁর সে কর্মময় জীবনের অবসান হতে চলেছে। কঠিন পীড়ায় তিনি শয্যাশায়িনী হয়ে পড়লেন। দেশের প্রত্যেকটি নর-নারী তাঁর এ কঠিন অসুখ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল। বিষাদের কাল মেঘে তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। দীন-দরিদ্রের হা-হুতাশে আরবের আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে গেল, যেহেতু তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি দেশবাসীর মাতৃরূপী।
হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন, সেবা-যত্নের কোন ত্রুটি হল না। কিন্তু সবই ব্যর্থ হল, হযরত খাদীজার শরীর দিন দিনই খারাপ হতে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে, কিছুতেই আর বাঁচার আশা নেই। তিনি স্বামীকে ডেকে বললেন, স্বামী। আমার আর সময় নেই, অচিরেই আমাকে আপনার নিকট থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। সুদীর্ঘ পঁচিশটি বছরে জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে আপনার নিকটে কত যে অপরাধ করেছি তার অন্ত নেই, আমার সে সব অপরাধ স্বীয় গুণে ক্ষমা করবেন।
কথা কয়টি বলতে বলতে তিনি নিতান্ত হাঁপিয়ে উঠলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বলতে লাগলেন, রাজা, প্রজা, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলকেই এ জগৎ হতে বিদায় নিতে হয়, আমিও নিচ্ছি, সেজন্য আমার মনে একটুকুও দুঃখ নেই। কিন্তু মনে বড় দুঃখ রয়ে গেল যে, আপনার সাথে একত্রে যেতে পারলাম না। আপনার জীবনের সুখ-দুঃখের পূর্ণ অংশ গ্রহণ করতে পারলাম না। কুরাইশদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আপনি যখন ঘরে ফিরবেন, কে তখন আপনার সেবা-শুশ্রূষা করবে, কে তখন আপনার মনে সান্ত্বনা দেবে। এ চিন্তাই আমার অন্তরকে চুরমার করে দিচ্ছে। হযরত। আমার একটি বিনীত আরজ এই যে, আমার নয়নের মণি হৃদয়ের ধন ফাতেমার প্রতি সর্বদা স্নেহের দৃষ্টি রাখবেন। আমি চলে গেলে কে তাঁর চোখের পানি মুছে দেবে, কে তাঁকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলবে, কাকে সে আম্মা বলে ডাকবে। আমার আর একটা শেষ বাসনা যে পবিত্র পাগড়ী মস্তকে ধারণ করে আপনি সর্ব প্রথম আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সে পবিত্র পাগড়ীর দ্বারা আমার কাফন করে দেবেন। আমার অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস যে, সে পবিত্র বন্ত্রের বরকতে আমি কবরের কঠিন শাস্তি হতে মুক্তিলাভ করব।
হযরত খাদীজার এসব কথা শুনে নবীজীর দু'চোখ বেয়ে দরদর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি রুমালে চোখ মুছে কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন, প্রাণাধিকে। তোমাকে আমার জান্নাতবাসীনী আম্মার হাতে সমর্পণ করছি। হযরত হাজেরা, হযরত আছিয়া, হযরত সারা প্রমুখ জান্নাতী রমণীগণ জান্নাতের দ্বারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তোমাকে অভ্যর্থনা করে নেয়ার জন্য। যাও প্রিয়ে। বেহেশতের অগণিত হুর তোমার খিদমতের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান আছে। তুমি জান্নাতে গিয়ে পরম সুখে তথায় অবস্থান করতে থাক, যথাসময়ে আমার সাক্ষাৎ পাবে।
খাদীজা। তুমি জগতের প্রতিটি নারীর জন্য যে মহান আদর্শ রেখে গেলে কিয়ামত পর্যন্ত তা শ্রদ্ধার সাথে সকলে স্মরণ করবে। যাও প্রিয়ে। তোমার অন্তিমকালের অনুরোধগুলোর। প্রত্যেকটি আমি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করব।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল, তিনি চোখ মুছতে মুছতে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন। একটু পরেই তিনি আবার ফিরে এসে বললেন, খাদীজা। আমাকে এমাত্র জিব্রাইল ফেরেস্তা সংবাদ জানিয়ে গেলেন, পরম করুণাময় আল্লাহ তা'য়ালা তোমার জন্য বেহেস্তে মণি-মুক্তা খচিত একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে রেখেছেন। সেখানে অগণিত হুর তোমার খিদমতের জন্য প্রতীক্ষা করছে। অচিরেই তুমি সেখানে গিয়ে জগতের শ্রেষ্ঠ সতী-সাধ্বী রমণীদের সাথে মিলিত হবে। এখন প্রাণভরে কালেমা তাইয়েব পাঠ করতে থাক। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে হযরত খাদীজা (রা) অতি ক্ষীণক্ষষ্ঠে পাঠ করলেন। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রাণ-বায়ু বের হয়ে অনন্তে মিশে গেল। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।)
দশম হিজরীর ১০ রমযান, ইংরেজী ৫১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি তারিখ ৬৫ বছর বয়সে উন্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজা (রা) জগতের প্রতিটি মুসলমান নর-নারীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইহজগত হতে চির বিদায় গ্রহণ করলেন। হযরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হৃদয়ে শোকের ঝড় প্রবাহিত হল। মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে এ দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। সমগ্র আরব জগৎ বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র পাগড়ীর দ্বারা হযরত খাদীজার পবিত্র দেহ আচ্ছাদিত করে জান্নাতুল মুয়াল্লা নামক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হল। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বহস্তে তাঁকে কবরে নামিয়েছিলেন। হযরত খাদীজার ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জানাজার নামায পড়ার আদেশ ছিল না বলে দাফন করার পর হযরত রাসূলুল্লাহর সাথে অগণিত লোক হাত উঠিয়ে হযরত খাদীজার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন।
0 Comments