যে ব্যক্তি স্বর্গ ও মর্ত্যরাজ্যের আশ্চর্য বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পেরেছে, সে সব কিছুই উপলব্ধি করেছে। যে তা' ধরতে পারেনি, সে প্রকৃতপক্ষে সব কিছুই হারিয়েছে। ভূখণ্ড, সমুদ্র, বায়ু ইত্যাদি জড় পদার্থ আকাশের বিশালত্বের তুলনায় সমুদ্রের জলরাশির তুলনায় এক বিন্দু জল সদৃশ। তুমি লক্ষ্য কর, কিরূপে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে আসমান এবং তারকারাজির ব্যাপারটিকে বড় করে দেখিয়েছেন? কুরআনে পাকে এমন কোন সূরা নেই যার মধ্যে এগুলোর বিষয় কিছু না কিছু উল্লেখ না হয়েছে। তাছাড়া পবিত্র কুরআনে এসব বস্তুর নামে আল্লাহ কর্তৃক শপথ গ্রহণ করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেছেন, (১) বুরূজ বিশিষ্টি আকাশের শপথ, (২) আকাশ এবং রাত্রির আবির্ভাবের শপথ, (৩) বহু পথবিশিষ্ট আকাশের শপথ, (৪) আকাশ এবং তার সাথে যা' নির্মাণ করা হয়েছে তার শপথ, (৫) সূর্যের ও তার কিরণের শপথ এবং চন্দ্রের, যখন তা' তার অনুসরণ করে, (৬) আমি পশ্চাদগামী, চলাচলকারী ও লুক্কায়িত নক্ষত্রের শপথ করছি, (৭) অস্তগামী তারকার শপথ, (৮) কখনই নয়, আমি তারকার পতনের শপথ করি। যদি তোমরা জানতে তা-ই বড় শপথ।
এখন তুমি জানতে পারলে যে, সামান্য অপবিত্র শুক্রের পূর্ণ পরিচয় পূর্বাপর কেউই জানতে পারেনি এবং পারবে না। আল্লাহ যে সব বস্তুর নামে কসম করেছেন তার পরিচয় লাভেও মানুষ ব্যর্থ। আল্লাহ যে সব বিষয়ের শপথ গ্রহণ করেছেন, তাদেরকে যে জীবিকা দিচ্ছেন এবং তাদের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা? আল্লাহ বলেন, আকাশে তোমাদের জীবিকা আছে এবং যা' তোমাদেরকে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, যেমন কুরআনে পাকে রয়েছেঃ "অফিসামায়ি রিযকুকুম অমা-তুআসুন।" যে সব লোক সে বিষয়ে চিন্তা করে আল্লাহ তাদেরকে প্রশংসা করেছেন এবং তজ্জন্যই আল্লাহতায়ালা এক স্থানে বলেছেন, "শূন্যমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সম্বন্ধে চিন্তা কর।"
হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, "ঐ ব্যক্তির জন্য দুঃখ। যে এসব আয়াত পাঠ করে তদ্বারা তার গোঁফ মোসেহ করে অর্থাৎ চিন্তা ব্যতীত তা' ফেলে রাখে।" যারা এভাবে তা' ফেলে রাখে, হুযুরে পাক (দঃ) তাদেরকে তিরস্কার করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আমি আসমানকে সুরক্ষিত ছাদ করেছি।" কিন্তু তারা আমার নিদর্শন থেকে বিমুখ থাকে। ভূখণ্ড আকাশের তুলনায় ত কিছুই নয়। তবে সে অবস্থায় আছে তা-ও শীঘ্রই পরিবর্তিত হবে। কিন্তু আসমান শক্ত, কঠিন, পরিবর্তন থেকে সুরক্ষিত, অবশ্য রোজ কিয়ামতে সব বস্তুরই পরিবর্তন হবে। এজন্যই আল্লাহতায়ালা তাকে সুরক্ষিত বলেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমি তোমার উপর সাতটি শক্ত আকাশ করেছি। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছে, "অবানাইনা ফাওত্ত্বাকুম সাবআন শিদাদা," আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, তোমরা কি সৃষ্টিতে সত্য অথবা তিনি যে আকাশ সৃষ্টি করেছেন তা'? তিনি তার ছাদকে উচ্চে রেখেছেন এবং তারপর তা' ঠিক করেছেন।
এখন তুমি ফিরেশতাগণের দিকে লক্ষ্য কর, যেন স্বর্গ রাজ্যের অত্যাশ্চর্য ব্যাপারসমূহ জানতে পার। কখনও একথা ভেবো না যে, স্বর্গরাজ্যের দিকে লক্ষ্য করার অর্থ তোমার চোখের দৃষ্টি সেদিকে নিক্ষেপ করা এবং তার ফলে তুমি আকাশের জীবিকা এবং নক্ষত্ররাজির জ্যোতি দেখতে পাবে এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য করবে। চতুষ্পদ জন্তগণও তোমার ন্যায় এই ব্যাপারে অংশীদার। যদি তা-ই উদ্দেশ্য হত আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা প্রশংসা করতেন না যে, "অকাযালিকা নূরী ইব্রাহীমা মাকতুবাতাসামাওয়াতি অল আরছি"। অর্থাৎ আমি ইব্রাহীমকে এরূপে স্বর্গ ও মর্ত্য রাজ্যের রাজত্ব দেখিয়েছি।
চক্ষু দ্বারা যা' দেখা যায় তার উদ্দেশ্য করে এখানে বলা হয়নি। কুরআন তার দৃশ্যলোকের রাজ্য বলে ব্যাখ্যা করেছে। আল্লাহতায়ালাই দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের বিষয়ে পরিজ্ঞাত। তিনি ইহলোক ও পরলোকের পরাক্রমশালী, অধিপতি। আল্লাহ যা' ইচ্ছা করেন তা' ব্যতীত কেউই তাঁর জ্ঞানের কোন কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। তিনি অদৃশ্যের বিষয়ে জ্ঞাত। যে রাসূলের প্রতি সন্তুষ্ট তিনি ব্যতীত অন্য কারও নিকট তিনি তাঁর অদৃশ্য বিষয় ব্যক্ত করেন না।
সুতরাং হে বুদ্ধিমান। স্বর্গ রাজ্যের বিষয়ে চিন্তা কর। হয়ত আকাশের দ্বার তোমার জন্য উন্মুক্ত হতে পারে। আসমানের সর্বাংশে তোমার মনকে বিচরণ করতে দাও যে পর্যন্ত তোমার মন পরম করুণাময় রহমানের সিংহাসনের সম্মুখে না দাঁড়ায়। এ সময়ে তোমার জন্য হযরত ওমর (রাঃ)এর মর্যাদার আশা করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, আমার আত্মা আমার প্রভুকে দেখেছে। এটাই সর্ব দূরবর্তী পথে পৌছে যাওয়া। তা' অনেক নৈকট্য অতিক্রম করার পর হয়ে থাকে। তোমার অতি নিকটবর্তী তোমার আত্মা, তরপর দুনিয়া, তারপর বায়ু, যা' তোমায় আবৃত করে রয়েছে, তারপর উদ্ভিদ এবং প্রাণীসমূহ এবং অন্যান্য যা' ধরাপৃষ্ঠে বিদ্যমান, তারপর শূন্য এবং আসমান ও যমিনের মধ্যে যে আশ্চর্য ব্যাপারগুলো আছে তারপর তারকারাজিসহ সপ্ত আকাশ, তারপর কুরসী, তারপর আরশ বহনকারী ফিরেশতাগণ এবং আকাশসমূহের প্রহরীগণ, তারপর তা' থেকে আরশ, কুরসী, আসমানসমূহ, দুনিয়া এবং তাদের মধ্যে যা' আছে তাদের মালিকের দিকে লক্ষ্য কর। তোমরা এবং এসব বস্তুর মধ্যে বহু বিস্তৃত ময়দান, বহু দূরত্ব এবং বহু ঘাঁটি আছে, কিন্তু তুমি এখনও সর্ব নিকটবর্তী উচ্চ ঘাঁটি থেকে বহু দূরে আছে তা' তোমার বাহ্যিক পরিচয়।
তারপর তুমি তোমার নির্বুদ্ধিতা সত্ত্বেও স্বীয় রসনার লাগাম ছেড়ে দিয়ে তোমার প্রভুর পরিচয়- জানের দাবী করে থাক এবং বল যে, আমি তাঁকে চিনেছি এবং তাঁর সৃষ্টিকে চিনেছি; সুতরাং আমি আবার কি সম্বন্ধে চিন্তা করব ও কিসের অনুসন্ধান করব? এখন তুমি মস্তক আকাশের দিকে উত্তোলন কর, সূর্যের দিকে, নক্ষত্ররাজির দিকে, তার ঘূর্ণনের দিকে, তার উদয় এবং অন্তের দিকে, তাঁর চন্দ্রের দিকে, তাঁর পূর্ব ও পশ্চিমের তারতম্যের দিকে এবং গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণনের দিকে লক্ষ্য কর, যার কোন বিরাম নেই, যার চলাচলের কোন পরিবর্তন নেই; বরং সবই সুনিয়ন্ত্রিত কক্ষপথে নির্দিষ্ট হিসাব অনুযাযী চলছে। তার কোন হ্রাস বা বৃদ্ধি নেই। তবে আল্লাহ একদিন সব কিছু পুস্তকের ভাঁজের ন্যায় ভাঁজ করে ফেলবেন। তুমি আকাশের তারকারাজির অগণিত সংখ্যা ও তার নানাবিধ বর্ণের বিষয় চিন্তা কর, কোনটি লোহিত, কোনটি শুভ্র বর্ণের নিকটবর্তী, কোনটি পারদ ধাতুর নায়। তারপর লক্ষ্য কর, তাদের বিভিন্ন আকৃতির দিকে। কোনটি বিচ্ছুর আকৃতির ন্যায়, কোনটি গর্দভের ন্যায়, কোনটি ষাঁড়ের ন্যায়, কোনটি বৃশ্চিকের ন্যায় দুনিয়ায় এমন কোন আকৃতি নেই যার সাদৃশ আকাশে নেই।
তারপর তুমি লক্ষ্য কর মূর্খের দূরত্বের দিকে। তা' এক বছর সময়ের মধ্যে একবার ঘুরে আসে। তারপর সূর্য দৈনিক উদয় হয় এবং অস্ত যায়। তার সৃষ্টিকর্তা তাকে বশীভূত করে দিয়েছেন। যদি তার উদয় এবং অস্ত না হত, তবে রাত্র ও দিনের প্রভেদ হত না, সময় নির্দ্ধারণ করা যেত না। তখন হয়ত সর্বদাই আলো বা অন্ধকার থাকত। বিশ্রামের ও পরিশ্রমের সময়ের পার্থক্য করা যেত না। এখন লক্ষ্য কর, কিরূপে আল্লাহতায়ালা রাত্রিকে পরিচ্ছদ, নিদ্রাকে বিশ্রাম এবং দিবসকে উপজীবিকার উপায় করেছেন। তারপর রাত্রকে তিনি কিরূপে দিবসে এবং দিবসকে রাত্রে পরিণত করছেন এবং তন্মধ্যে একটি বিশেষ নিয়মানুসারে তার বৃদ্ধি ও হ্রাস দিয়েছেন, তা' লক্ষ্য কর।
তারপর লক্ষ্য কর কিরূপে তিনি মধ্যগগন পথে সূর্যকে নামাতে থাকেন, তার ফলে গ্রীষ্মকাল, শীতকাল, বসন্তকাল এবং শরৎকাল আসে। যখন মধ্য গগন পথ হতে সূর্য ভ্রমণ করে এক দিকে পড়ে যায় তখন শীতল বায়ু প্রবাহিত হয় এবং শীতকালের আবির্ভাব হয়। যখন মধ্য গগনের পথে ঠিক থাকে, তখন অত্যন্ত গ্রীষ্ম হয়। যখন তা' মধ্য পথে থাকে তখন ঋতুও মধ্য পথে থাকে। স্বর্গ রাজ্যের আশ্চর্য ব্যাপারসমূহ এত অসংখ্য যে, তার একলক্ষ ভাগের একভাগও আমরা বর্ণনা করতে পারি না। যা আমি এতক্ষণ বর্ণনা করলাম, তা' চিন্তার খোরাক দেয়ার জন্যই করলাম।
মোটকথা এই বিশ্বাস রাখ যে, এমন কোন নক্ষত্র নেই যার জন্য তার সৃষ্টির মধ্যে, তারপর তার পরিমাণের মধো, তারপর তার আকৃতির মধ্যে, তারপর তার বর্ণের মধ্যে, তারপর আকাশ থেকে তার পতিত হওয়ার মধ্যে, লক্ষ গগন থেকে তার নৈকট্যের মধ্যে এবং তার পার্শ্ববর্তী তারকারাজির নৈকট্য ও দূরত্বের মধ্যে অসংখ্য বিধান নেই। আমরা তোমার শরীর সম্বন্ধে যা উল্লেখ করেছি, তা' থেকে এটা অনুমান কর। কেননা শরীরে এমন কোন অংশ নেই, যার মধ্যে কোন কৌশল নিহিত নেই; বরং তার বিধান অসংখ্য। স্বর্গীয় ব্যাপার তার চেয়েও অনেক অধিক। মর্তা জগতের সাথে স্বর্গীয় জগতের কোন তুলনা হয় না। আয়তনের বৃহত্তর দিক দিয়েও নয় এবং নৈসর্গিক ব্যাপারের আধিক্যের অধিক গুণের দিক দিয়েও নয়। তাদের উভয়ের মধ্যে পুণ্যের তারতম্য আছে। যেরূপ বৃহত্বের দিক দিয়ে তাদের তারতম্য আছে। মর্ত্যের বিশাল দেহ এবং তার চতুর্দিকের বিশাল স্থানের বিষয় তুমি জান। কোন মানুষ তা' সঠিক নির্ণয় করতে পারে না।
জ্যোতির্বিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে সূর্যে দুনিয়া থেকে একশ' ষাট গুণেরও অধিক বড়। হাদীসেও তার বৃহত্বের সংবাদ আছে। তারপর তারকারাজির দিকে লক্ষ্য কর। ক্ষুদ্রতম তারকাও দুনিয়ার চেয়ে আটগুণ বড়। বৃহত্তম তারকা দুনিয়া থেকে প্রায় একশ বিশগুণ বড়। এ থেকে তার উষ্ণতা ও দূরত্ব অনুভব করা যায়। কেননা যে তারকা যত দূরবর্তী তা' ততদূর ক্ষুদ্র দেখা যায়। তজ্জন্যই আল্লাহতায়ালা তার দূরত্বের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন, "তিনি তার ছাদকে উচ্চ করেছেন ও সঠিক করেছেন। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছে, "ওয়ারাফাআ সামকাহা ওয়া সাওয়্যাহা।" হাদীস শরীফে আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এক আসমান থেকে অন্য আসমানের দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথ। কোন কোন তারকার আয়তন দুনিয়া থেকে বহু গুণ বড়। তারকার অসংখ্য সংখ্যার দিকেও লক্ষ্য কর। তারপর লক্ষ্য কর আসমানের দিকে যার মধ্যে তারকারাজি বিস্তৃত আছে, সেই আসমান কত বিস্তৃত ও বিশাল। তারপর লক্ষ্য কর, আসমানে ক্ষিপ্র গতির দিকে। তুমি কোনরূপেই তার গতি ধরতে পারবে না। তবে সন্দেহ করো না যে, তা' এক মুহূর্তে একটি তারকার দৈর্ঘ্যের পরিমিত স্থান অতিক্রম করে যায়। কেননা তারকার প্রথম অংশের উদয় থেকে শেষ পর্যন্ত সময় চলছে। এই তারকা দুনিয়া থেকে একশ' গুণেরও অধিক বড়। এই ফালাক বা শূন্য এক মুহূর্তের মধ্যে দুনিয়ার ন্যায় একশ'বার ঘুরে। এভাবে তা' অনবরত চলছে; কিন্তু তুমি তা' থেকে অমনোযোগী। এখন লক্ষ্য কর কিরূপে হযরত জিব্রাইল (আঃ) কত ক্ষীপ্রগতিতে আকাশ অতিক্রম করেছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সূর্য কি অস্ত যায়? তিনি বলেছিলেন, না; হা। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি কিরূপ না, হা বললে? ফিরেশতা জিব্রাইল বললেন, না; হা বলতে যে সময় লাগে তন্মধ্যে সূর্য পাঁচশ' বছরের পথ চলে যায়। এখন লক্ষ্য কর, সূর্য কত বড় এবং তা' কি ক্ষিপ্রগতিতে চলে।
তারপর লক্ষ্য কর জ্ঞানের সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার দিকে। কিরূপে তিনি সূর্যের বিশাল দেহ সত্ত্বেও তার আকৃতিকে ক্ষুদ্র চক্ষুগোলকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন কি তুমি ভূ-খণ্ড থেকে সূর্যের দিকে তোমার চক্ষু খুলে তাকালে সূর্যের সারা দেহ দেখতে পাচ্ছ। আকাশ তার বিশালত্ব এবং নক্ষত্ররাজির স্থিতি থাকা সত্ত্বেওতুমি তার দিকে লক্ষ্য কর না বরং তার সৃষ্টিকর্তার দিকে লক্ষ্য কর যে, কিভাবে তিনি তা' সৃষ্টি করে স্তম্ভ ব্যতীত এবং কোন বন্ধন ব্যতীত ঠিক রেখে দিয়েছেন। গোটা দুনিয়াটাই একটি গৃহের ন্যায়। আকাশ তার ছাদ। এটা এক আশ্চর্য ব্যাপার যে, তুমি কোন ধনীর গৃহে প্রবেশ করে তাকে রং বেরংয়ে সজ্জিত দেখলে, তার মধ্যে স্বর্ণ রৌপ্যের অনেক মালামাল দেখলে এবং তাতেই তুমি সারা জীবন বিস্ময় প্রকাশ কর ও তার সৌন্দর্যের আলোচনা কর। অথচ তুমি সদা-সর্বদা এই বৃহৎ দুনিয়াটা দেখে চলেছ, তার ভূখণ্ড, ছাদ, বায়ু, আশ্চর্যজনক মাল-সামান, অদ্ভুত প্রাণীজগত এবং আরও কতকিছু দেখছ কিন্তু তুমি তার বিষয় এতটুকু আলোচনা করছ না এবং তুমি তোমার হৃদয় দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে সেদিকে দৃষ্টিপাত করছ না। চিন্তা করে দেখ, যে ধনী গৃহের বিষয় তুমি আলোচনা কর, তার তুলনায় এই দুনিয়া রূপ গৃহ কত বেশী আশ্চর্যজনক। সেই ক্ষুদ্র গৃহ অতিক্ষুদ্র একখন্ড ভূমি মাত্র। যা এই দুনিয়া রূপ বিশাল গৃহের সামান্যতম একটি ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র। তা' সত্ত্বেও এই জগত গৃহের দিকে তোমার দৃষ্টির অভাবের কোন কারণ থাকার কথা নয়, অথচ তুমি এদিকে তেমন দৃষ্টিপাত করছ না। এই গৃহ তোমার প্রভুর গৃহ। তিনি স্বয়ং একাকী এ গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং এর তত্ত্বাবধান করছেন। অথচ তুমি তোমার সেই প্রভুকে, তোমার প্রভুর গৃহকে ভুলে রয়েছ। তুমি শুধু ভোজনে এবং কাম প্রবৃত্তিতে নিমগ্ন। তোমার লোভ ব্যতীত আর কোন চিন্তা নেই। তোমার লোভের শেষ সীমা তোমার উদর চিন্তা করা। কিন্তু একটি পশু যা' ভক্ষণ করে, তার দশ ভাগের একভাগও তুমি ভক্ষণ করতে পার না। সুতরাং এই ব্যাপারে একটি পশুও তোমার চেয়ে দশ গুণ শ্রেষ্ঠ। তোমার গৌরবের শেষ সীমা এই যে, তোমার নিকট তোমার পরিচিত দশ জন লোক এসে তাদের রসনার দ্বারা তোমার সম্মুখে মুনাফিকী করে, কিন্তু তোমার সম্বন্ধে তাদের ধারণা অতি নিকৃষ্ট। যদি তারা তোমাকে যথার্থই ভালবাসে তবুও তারা তোমার বা তাদের নিজেদের কোন উপকার বা অপকার, জীবন ও মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের মালিক নয়। তোমার বাসস্থানের কাছে কত ইয়াহুদী ও খৃষ্টান ধর্মী লোক আছে, তোমার সুযশ ও সুখ্যাতির চেয়ে তাদের যশঃ ও নাম-ধাম অনেক অধিক। অথচ তুমি এই ভ্রমের মধ্যে নিমগ্ন এবং স্বর্গ ও মর্ত্য রাজ্যের সৌন্দর্যের
প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে অমনোযোগী এবং স্বর্গ ও মর্ত্য রাজ্যের অধিপতির গৌরবের দিকে লক্ষ্য করা থেকেও অমনোযোগী। তোমার বুদ্ধি পিপীলিকার বুদ্ধির সদৃশ, যে পিপীলিকা রাজপ্রাসাদের অতি উচ্চ কোন এক স্থানের ছিদ্রের মধ্যে বসবাস করে। সেই রাজপ্রাসাদ অতি উচ্চ, বিচিত্র কারুকার্যে পরিপূর্ণ। চাকর-নফর দ্বারা ভরপুর, অমুল্য রত্ন খচিত। পিপীলিকা সেই রাজপ্রাসাদের ছিদ্র থেকে বের হয়ে তার সঙ্গীদের সাথে সাক্ষাত করে বটে। কিন্তু তাদের সাথে রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধে আলোচনা করে না। তাছাড়া অন্য কোন বিষয়ের সংবাদ রাখে না এবং চিন্তাও করে না। সে রাজপ্রাসাদের অবস্থা এবং তার মালিকের প্রবল প্রতাপ সম্বন্ধে কিছুই চিন্তা করে না। যেরূপ পিপীলিকা রাজপ্রাসাদের বিস্তৃত প্রান্তর তার ছাদ, প্রমোদ্যোন এবং শোভা-সৌন্দর্য সম্বন্ধে উদাসীন ও অমনোযোগী। নিজের গৃহ সম্বন্ধেও অমনোযাগী, তুমি তদ্রূপ আল্লাহর গৃহ এবং আসমানবাসী ফিরেশতাদের সম্বন্ধে উদাসীন। পিপীলিকা যেরূপ তোমার গৃহের ছাদের বিষয় জানে না, তুমিও তদ্রুপ আকাশের বিষয় কিছুই অবগত নও। পিপীলিকা যেরূপ তোমাকে এবং তোমার গৃহের অধিকাসী সম্বন্ধে কিছু জানে না, তুমিও তদ্রূপ ফিরেশতা এভং আকাশের অন্যান্য অধিবাসীদের সম্বন্ধে কোন কিছুই জান না। সত্য বটে যে, তোমাকে এবং তোমার রাজপ্রাসাদের অত্যাশ্চর্য বিষয়বস্তুসমূহকে তোমার প্রাসাদের কারুকার্য ও বিচিত্র শোভা সম্পদকে পিপীলিকার জানার কোন উপায় নেই। পক্ষান্তরে তুমি কিন্তু স্বর্গরাজ্য ভ্রমণ করতে পার এবং তার আত্যাশ্চর্য বিষয়-ব্যাপারও জানতে পার। কিন্তু তা' থেকে তুমি উদাসীন।
এখন আমরা এই বিষয়ে আলোচনার লাগাম টেনে ধরৰ, কেননা তা' বহু বিস্তৃত, তার অন্ত নেই। যদি আমরা সে বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনা পেশ করি, তবে আল্লাহ আমাদেরকে যে সামান্য জ্ঞান দিয়েছেন তত্ত্বরা আমরা যথোপযুক্তভাবে তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হব না, আমরা যা' জানি, তা' আলিম ও ফাজিলদের জ্ঞানের তুলনায় অতি সামান্য ও তুচ্ছ। আবার তারাও যা জানে তাও নবী-রাসূলদের জ্ঞানের তুলনায় আঁীত নগণ্য। তারপর নবী-রাসূলগণ যা' জানেন তাও আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)এর জ্ঞানের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। সমস্ত নবী- রাসুলের জ্ঞান নিকটবর্তী ফিরেশতাগণ যথা জিব্রাইল, ইস্রাফিল ইত্যাদি এদের জ্ঞানের তুলনায় অতি সামান্য। তারপর ফিরেশতা এবং মানব-দানবের জ্ঞানকে আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় কোন জ্ঞান বলেই গণ্য করা যায় না; বরং তাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ব্যর্থতা নাম দেয়াই অধিক যক্তিযুক্ত। সুতরাং সেই আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা যিনি তাঁর বান্দাগণকে যতটুকু যা' জানিয়েছেন তা-ই তারা জানতে পারে। এজন্যই আল্লাহতায়ালা সবাইকে সম্বোধন করে বলেছেন, "অমা উতীতুম মিনাল ইলমি ইল্লা কালীলা" অর্থাৎ তোমাদেরকে অতি সামান্য জ্ঞান ব্যতীত দেয়া হয়নি।
এসবই চিন্তার খোরাক এবং ক্ষেত্র। আল্লাহর সৃষ্টি বৈচিত্র্য সম্বন্ধে' চিন্তাশীলগণ চিন্তা করবে। তারা আল্লাহর জাত বা সত্তা সম্বন্ধে চিন্তা করবে না। আল্লাহর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করলেই তারা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার মারেফত গৌরব, শক্তি ও মহিমা সম্বন্ধে 'জানতে পারবে। যতই আল্লাহর বিচিত্র কারুকার্য ও পরিচয় তোমার নিকট বৃদ্ধি পাবে, ততই আল্লাহর গৌরব ও প্রভাব সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে ও পূর্ণ হবে। যেরূপ তুমি একজন আলিমের বিদ্যার বিষয় জানলে এবং তার কবিতা, রচনা ও কিতাবের আশ্চর্য বিষয় সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে থাকলে তার পরিচয় বৃদ্ধি পায়। তার স্বভাব-সৌন্দর্য সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান তত বেড়ে যায়। এমন কি তার প্রত্যেক কথা, তার কবিতা বা রচনার প্রত্যেক বাক্য তোমার হৃদয়ে আসন পেতে বসে। তার ফলে তোমার মনে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধাও বৃদ্ধি পায়। তদ্রূপ আল্লাহর সৃষ্টি, তাঁর কারুকার্য, কলা-কৌশল এবং তাঁর সৃষ্টি নৈপুণ্যের বিষয় চিন্তা করতে থাক। আল্লাহর সৃষ্টি ও রচনা কৌশল যা' বিদ্যমান রয়েছে তদসম্বন্ধে চিন্তায় রত থাক। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তন্মধ্যে থেকে যে পরিমাণ চিন্তার ভাগ দেয়া হয়েছে সে সেই পরিমাণ চিন্তা করতে থাকবে।
এখন আমরা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় সংক্ষেপ করব। তারপর শোকরের অধ্যায়ে আমরা এ সম্বন্ধে আরও আলোচনা করব। আল্লাহর কুরআনকে আমরা আল্লাহর কারুকার্য হিসাবেই ধরে নেব। আল্লাহর কুরআন আমাদের উপর পরম অনুগ্রহ এবং অমূল্য নিয়ামত। আমরা যতই তার দিকে লক্ষ্য করি, আমাদের স্বাভাবিক প্রকৃতি তার দিকে আরও লক্ষ্য করতে বলে। কারও লক্ষ্য বা দৃষ্টিপাত পথভ্রষ্টতা ও দুর্ভাগ্যের কারণ হয়, আবার কারও লক্ষ্য বা দৃষ্টিপাত হেদায়েত ও সৌভাগ্যের কারণ হয়। আসমান ও যমিনে এমন একটি ধূলিকণাও নেই যদ্ধারা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন। যে ব্যক্তি এসব ব্যাপারের দিকে আল্লাহর কার্য ও কৌশল বলে দৃষ্টিপাত করে সে আল্লাহর গৌরব ও প্রতাপের পরিচয়জ্ঞান অর্জন করার উপকার পায় এবং হেদায়েত লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তার দিকে ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে এবং সব কারণের কারকের দিকে এসব কার্য আরোপ না করে, সে দুর্ভাগা এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত। আমরা এই পথভ্রষ্টতা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আমরা প্রার্থনা করি, তিনি যেন মূর্খদের অজ্ঞতার পদস্খলন থেকে তাঁর অপার করুণা, দয়া ও রহমতের গুণে আমাদেরকে রক্ষা করেন।
0 Comments