ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়


খালিদ বিন ওয়ালীদ ও আমর ইবনুল 'আস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ

        খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ঐ সময় পর্যন্ত প্রতিটি যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন। অধিকাংশ গাযওয়ায়, বিশেষ করে, উহুদের যুদ্ধে শুধু তাঁর কারণেই কাফিরদের নড়বড়ে অবস্থান দৃঢ় ও শক্ত হয় অর্থাৎ পরাজয়ের পরও তারা জয়লাভ করে, কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির পর তিনি নিজেই মুসলমান হওয়ার জন্য হুযুর (সাঃ)-এর নিকট গমন করেন। পথিমধ্যে হযরত আমর ইবনুল 'আস (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত হয়, উভয়েই একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন।

গাযওয়ায়ে খায়বর বা খায়বর যুদ্ধ

        মদীনার ইয়াহুদীদের মধ্যে বনূ নজির যখন খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে, তখন খায়বর ইয়াহুদীদের কেন্দ্র হয়ে গেল। এ সমস্ত লোক চতুর্দিকের আরববাসীকে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে লাগল। ৭ হিজরীর মুহররম বা জমাদিউল আউয়াল মাসে হযরত (সাঃ) ৪ শত পদাতিক এবং ২ শত অশ্বারোহীর সাথে সেখানে জিহাদের জন্য গমন করেন। যুদ্ধে হতাহতের পর মুসলমানদের জয়লাভ হয় এবং ইয়াহুদীদের সমস্ত দুর্গ মুসলমানদের করতলগত হয়। এ যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) সবচেয়ে বেশী পরিমাণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং খায়বর দূর্গের দরজা একাকী নিজের হাতেই খুলে দিয়েছেন। অথচ ৭০ জন লোক একত্রে তা নাড়তেও অপারগ ছিল। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, ঐ দরজাকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

ফিদাক বিজয়

        খায়বর জয় করার পর হযরত (সাঃ) ফিদাকেয় য়াহুদীদের নিকট একটি পত্র পাঠালেন, শর্তানুযায়ী তারা সন্ধি করল। ফিদাক মুসলমানদের হস্তগত হল। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উমরা আদায় করা হয়নি। কুরায়শ কাফিরদের সাথে চুক্তিপত্র হয়েছিল যে, আগামী বৎসর উমরা আদায় করা হবে, তিন দিনের বেশী অবস্থান করবে না। চুক্তি অনুযায়ী এই বৎসর হযরত (সাঃ) সমস্ত সাথীদের নিয়ে বায়তুল্লাহ আগমন করেন এবং চুক্তির শর্তানুযায়ী উমরা আদায় করে ফিরে আসেন।

ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়

         ৮ম হিজরীর রমযান মাসে (জানুয়ারী, ৬৩০ খৃ.) মক্কা বিজয়ের ঘটনা সংঘটিত হয়। এই ঘটনার ঐতিহাসিক পটভূমি এই যে, হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে একটি শর্ত ছিল আরবের যে কোন গোত্র নবী (সাঃ) অথবা কুরাইশ- যে কোন পক্ষের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। সন্ধিপত্রে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর সম্পন্ন হওয়ার পরপরই আরবের খুযাআ গোত্র মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী এবং বানু বাক্স কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী বলে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করল। এভাবে দুই গোত্র দুটি পৃথক দলের বন্ধু হয়ে গেল।

        প্রায় দেড় বছর উভয় পক্ষ সন্ধির শর্ত পূর্ণরূপে মেনে চলল। কিন্তু দেড় বছর পর একটি নতুন ঘটনার উদ্ভব হল। বানু বাক্স ও বানু খুজাআর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ চলছিল, এই মধ্যবর্তী সময়ে যদিও তা বন্ধ ছিল, কিন্তু কোন একটি ঘটনায় তাদের মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধ বেধে গেল। বানু বাক্স এক রাতে মক্কার নিকটবর্তী যানীরাহ নামক স্থানে খুযাআ গোত্রকে আক্রমণ করে বসল। কুরাইশরা তা জানতে পেরে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল যে, রাতের বেলা এই সুযোগে বানু খুযাআকে ইসলামের নবীর বন্ধু হওয়ার স্বাদ গ্রহণ করাতে হবে। মুসলমানরা তাদের থেকে অনেক দূরে আছে। সুতরাং এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। অতএব তারাও বানু বাক্স-এর সংগে একযোগে বানু খুযাআকে হত্যা করতে আরম্ভ করল।

        এই অবস্থায় আমর ইবনে সালিম একটি প্রতিনিধি দলসহ নবী (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হল এবং বানু খুযাআর করুন পরিণতির বর্ণনা দিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করল। মহানবী (সাঃ) বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি যে জিনিস থেকে নিজেকে বাঁচাব তা থেকে তোমাদেরও অবশ্যই রক্ষা করব।

        এদিকে কুরাইশরা একথা জানতে পেরে আতংকিত হল। নিজেদের অযাচিত বাড়াবাড়ির জন্য অনুতপ্ত হল এবং আবু সুফিয়ানকে মদীনায় পাঠিয়ে মুসলমানদের উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করল। তারা তার মাধ্যমে সন্ধির সময়সীমা বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করল। আবু সুফিয়ান মদীনা পৌঁছেই সর্বপ্রথম নিজ কন্যা ও নবী (সাঃ)-এর স্ত্রী উম্মে হাবীবা (রাঃ)-এর ঘরে আশ্রয় দিল। আবু সুফিয়ান যখনই নবী (সাঃ)-এর বিছানার উপর বসতে উদ্যত হলঃ উম্মে হাবীবা (রাঃ) সাথে সাথে তা গুটিয়ে নিয়ে বললেন, পিতা। এটা আল্লাহর নবীর বিছানা। আবু সুফিয়ান বলল, তাতে কি হয়েছে, আমি তো তোমার বাপ। উম্মে হাবীবা (রাঃ) বললেন, একথা সত্য কিন্তু আপনি মুশরিক, আর এটা আল্লাহর রসূলের পবিত্র বিছানা। আবু সুফিয়ান যদিও ঐ সময় দিল বিড়বিড় করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল, কিন্তু এ বিস্ময়কর ঘটনা তার চোখ খুলে দিল এবং সে প্রকৃত অবস্থা কিরূপ তা অনুধাবন করতে পারল।

         আবু সুফিয়ান মহানবী (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে চুক্তিপত্র নবায়নের জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগল। তিনি বললেন, তা নব্যয়নের কি প্রয়োজন আছে, কোন নতুন ঘটনা ঘটেছে কি? আবু সুফিয়ান বলল, না নতুন কিছু ঘটেনি। তখন নবী (সাঃ) বললেন, তোমরা নিশ্চিত থাক আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতির উপর অটল আছি।

         এই উত্তর শুনে আবু সুফিয়ান নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কেননা সে প্রকৃত ব্যাপার গোপন করে মিথ্যা কথা বলেছিল এবং মহানবী (সাঃ)-কে এভাবে ধোঁকা দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। কিন্তু এই পরিষ্কার এবং সঠিক জবাবে তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হতে পারল না। অতঃপর সে আবু বাকর (রাঃ), উমার (রা) ও আলী (রাঃ)-র সাথে পৃথক পৃথক ভাবে আলাপ করল এবং কুরাইশদের অনুকূলে মীমাংসা পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হল না। শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাশ হয়ে মক্কায় ফিরে আসতে হল।

         মহানবী (সাঃ) আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের এবং কুরাইশদের মাঝে তো চুক্তি বহাল রয়েছে। তিনি বললেন: হাঁ, তবে স্বয়ং কুরাইশরাই চুক্তি ভংগ করেছে।

        অতএব জিহাদের প্রস্তুতি চলতে লাগল, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে কেউই জানতে পারল না যে, কোন দিকে অভিযান পরিচালিত হবে। নবী (সাঃ) মদীনার চারদিকে লোক পাঠিয়ে সাধারণ ঘোষণা দিলেন যে, যে ব্যক্তিই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান রাখে সে যেন রমযানের আগেই মদীনা পৌছে যায়। সব সময় এই প্রস্তুতির কথা গোপন রাখার চেষ্টা করা হলঃ যাতে কুরাইশরা তা অবহিত হতে না পারে। নবী (সাঃ)-এর ইচ্ছা ছিল যেন মক্কায় কোনরূপ যুদ্ধ সংঘটিত না হয় এবং কুরাইশরা বাধ্য ও প্রভাবিত হয়ে অনুগত হয়ে যায়। এমনি সময়ে একটি ঘটনা ঘটে গেল।

Post a Comment

0 Comments