দাম্পত্য জীবন
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহের সময় হযরত খাদীজার বয়স ছিল চল্লিশ বছর এবং হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঁচিশ বছর। বিবাহের পনের বছর পরে অর্থাৎ হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। বিবাহের পর হতে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত পনের বছর; আরব দেশের সেই অন্ধকার যুগেও তাঁদের দাম্পত্য প্রেম দর্শন করে প্রত্যেক দম্পতির মনে হিংসার উদ্রেক হত। প্রাক্-ইসলামিক যুগে আরব দেশে দাম্পত্য প্রেমের কোনই মূল্য ছিল না। তথায় বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। কোন পুরুষ একটি বিবাহ করে দু'চার-দিন পরেই তাকে পরিত্যাগ করে আর একটি বিবাহ করত। এভাবে কারও স্ত্রীর সংখ্যা শয়ের কোঠায় গিয়ে পৌঁছত। তখনকার দিনে স্ত্রীর মতামতের কোন মূল্য ছিল না। দাম্পত্য-প্রেম বলেও কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। অথচ সে যুগেও হযরত রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত খাদীজার (রা) দাম্পত্য প্রেমের যে নিদর্শন রয়েছে তা সত্যিই অপূর্ব। বিবাহের অল্পকাল পরেই হযরত খাদীজা (রা) তাঁর অতুল ঐশ্বর্য স্বামীর চরণে ঢেলে দিয়ে তাঁর আনুগত্য প্রকাশই জীবনের একমাত্র শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে গ্রহণ করেছিলেন। হযরত খাদীজা (রা) একেতো ছিলেন বিধবা, তদুপরি তাঁর বয়সও ছিল হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়েও অনেক বেশি, এরূপ স্থলে স্বামী-স্ত্রীর পূর্ণ মনের মিল হওয়াটা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে উঠে। অথচ তাঁদের দাম্পত্য জীবন এত প্রেমময় ও মধুর হয়েছিল যে, হযরত খাদীজা (রা) বর্তমান থাকা পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণের কথা কোনদিন কল্পনাও করেননি। হযরত খাদীজার (রা) ইন্তেকালের পর বহুদিন পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে কোন কথা বলতেই তিনি কেঁদে ফেলতেন।
যখন আরবের প্রত্যেকটি মানুষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ঘোর শত্রুতা করেছিল, যখন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বংশের লোকেরাও তাঁর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করেছিল, যখন তাঁর পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কেউই তাঁর স্বপক্ষে ছিল না। সেই ঘোর দুর্দিনে তিনি নিজের ধন-সম্পত্তি ও জীবন-মন স্বামীর চরণে উৎসর্গ করে স্বামী সেবাকেই জীবনের একমাত্র কর্তব্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। হযরত খাদীজা (রা)-এর তখনকার সক্রিয় সহযোগিতাই যে জীবন সংগ্রামে তাঁকে জয়ী করেছিল, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই মুক্ত কণ্ঠে একথা স্বীকার করেছেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই কঠিন বিপদের সময় হযরত খাদীজা (রা) সর্বদা ছায়ার ন্যায় তাঁর সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী হয়ে সত্যধর্ম প্রচারে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিলেন। একদিকে তাঁর অতুলনীয় স্বামী ভক্তি, সেবা-শুশ্রূষা ও সান্ত্বনা বাক্য হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথা-জর্জরিত প্রাণে সুশীতল শান্তিবারি সেচ করত, অন্যদিকে তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনাপূর্ণ উপদেশ তাঁকে কর্তব্যের পথে এগিয়ে দিত।
সন্তানাদি
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিবাহের পূর্বে হযরত খাদীজা (রা)-এর আরও দুটি বিবাহ হয়েছিল। প্রথম স্বামীর ঔরসে একটি পুত্র ও দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসে একটি কন্যা সন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর প্রথম পাঁচ বছর পর্যন্ত তাঁর তাঁর কোন এ সন্তানাসি জন্মগ্রহণ করেনি। দিবারের পাঁয় সঙ্গে বিবাহের পর বছর পর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঔরসে। হযরত খাদীজার (রা)-এর গর্তে একাধিক্রমে চারটি কন্যা ও দুটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁর প্রথম একটি ভিত হয়। জন্মগ্রহণ করে। পুত্রটির নাম রাখা হয় কাশেম। এ পুত্রটি শিশুকালেই মৃত্যুমুখে পতিত দ্বিতীয়বারে হযরত খাদীজার গর্ভে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কন্যাটির নাম রাব রাখা হয় জয়নব। তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনা গমনের পূর্বেই আবুল আসের সঙ্গে জয়নবের হয়েছিল।
হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত লাভের পূর্বেই হয়রত জয়নবের বিবাহ হয়েছিল। হযরত জয়নবের স্বামী আবুল আস তখন পৌত্তলিক ছিল। কাজেই হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা ত্যাগ করে মদিনাত হিজরত করেন, তখন হযরত জয়নব মক্কায় তাঁর স্বামীর নিকটেই থেকে যান। হযরত রাসূলুল্লাহ হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বদরের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে কাফেররা সম্পূর্ণ পরাজিত হয় ও নব্বই জন কাফের মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। হযরত জয়নবের স্বামী আবুল আসও এ বন্দীদের মধ্যে ছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করলেন চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে প্রত্যেক বন্দী মুক্তিলাভ করতে পারে। ঘোষণা অনুযায়ী হযরত জয়নাব তাঁর স্বামীর মুক্তিপণ হিসাবে মক্কা হতে এক ছড়া হার পাঠিয়ে দেন। এ হার ছড়া হযরত খাদীজার নিজের ব্যবহারের ছিল। তিনি কন্যা জয়নাবের বিবাহের সময় কন্যাকে দিয়েছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জয়নাবের প্রেরিত হার ছাড়া দেখেই বুঝতে পারলেন যে, ইহা হযরত খাদীজার হার ছিল। হার ছড়া দেখে হযরত খাদীজার কথা স্মরণ হওয়ায় তিনি কেঁদে ফেলেন এবং হার ছড়া না রেখেই আবুল আসকে মুক্তি দিয়ে দেন। তবে শর্ত ছিল যে আবুল আস মুক্তি পেয়ে মক্কায় পৌঁছেই হযরত জয়নাবকে মদিনায় তার পিতার নিকটে পাঠিয়ে দেবেন। আবুল আস প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হযরত জয়নাবকে হযরত রাসূলুল্লাহর নিকট পাঠিয়ে দেন। তারপর হতে হযরত জয়নাব পিতার নিকটেই ছিলেন।
তৃতীয় হিজরতে আবুল আস আর একবার মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। এবারও হযরত জয়নাবের অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। দ্বিতীয় বারে মুক্তি লাভ করে জয়নাবের ভালবাসার কথা স্মরণ করে ও ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন। আবুল আসের ইসলাম গ্রহণের অল্পদিন পরেই হযরত জয়নাব ইন্তেকাল করেন।
জয়নাবের পরে হযরত খাদীজা (রা)-এর গর্ভে আর একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই পুত্রটির নাম ছিল আবদুল্লাহ। হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়াত পাওয়ার পর জন্ম হয়। দু'বছর বয়সে আবদুল্লাহ মৃত্যুমুখে পতিত হন।
আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর খাদীজার গর্ভে আর একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় রোকেয়া। আবু লাহাবের পুত্র ওতবার সাথে হযরত রোকেয়ার বিবাহ হয়েছিল। আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল। তারা সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বেড়াত। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তাদের ঘোরতর শত্রু। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শত্রুতাবশে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী তাদের পুত্রকে আদেশ করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা রোকেয়াকে পরিত্যাগ করতে। পিতা-মাতার আদেশ পালনার্থে ওতবা হযরত রোকেয়াকে পরিত্যাগ করেন। তৎপর ওসমান গণি (রা)-এর সাথে রোকেয়ার বিবাহ হয়। হযরত রোকেয়া স্বামীর সাথে মক্কা হতে হিজরত করে মদিনায় যান। মদিনা গমনের দু'বছর পরে হযরত রোকেয়া ইন্তেকাল করেন। হযরত রোকেয়ার পর হযরত খাদীজার আর একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় উম্মে কুলসুম, উতাইবা নামক আবু লাহাবের অন্য এক পুত্রের সাথে হযরত উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয়। পিতা-মাতার আদেশে সেও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা বলে উম্মে কুলসুমকে পরিত্যাগ করে। এ দিকে রোকেয়ার মৃত্যু হওয়ায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওসমানের সঙ্গে উম্মে কুলসুমের পুনঃ বিবাহ দেন। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুটি কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন বলে হযরত ওসমানের উপাধি হয়েছিল জিননূরাইন অর্থাৎ দুটি জ্যোতির অধিকারী। হযরত খাদীজার পুত্র-কন্যাদের মধ্যে হযরত ফাতেমা ছিলেন সকলের ছোট। হযরত খাদীজার ৬০ বছর বয়সে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের ৫ বছর পর হযরত ফাতেমা জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরীতে আবু তালিবের পুত্র হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতেমা জোহরার বিবাহ হয় এবং হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের ছ'মাস পর হযরত ফাতেমা জোহরা (রা) ইন্তেকাল করেন।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কনিষ্ঠা কন্যা হযরত ফাতেমা জোহরা (রা) ছিলেন পিতামাতার সর্বাপেক্ষা স্নেহের পাত্রী। তিনি ছিলেন কন্যাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী, পুণ্যবতী ও রমণীকুলের আদর্শ। মাতা-পিতার যাবতীয় গুণরাশি তাঁর মধ্যে বিরাজিত ছিল। হযরত খাদীজার ইন্তেকালের সময় তাঁর পুত্র-কন্যাদের মধ্যে একমাত্র হযরত ফাতেমাই জীবিত ছিলেন। হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলতে একমাত্র হযরত ফাতেমার বংশধরগণই আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে বর্তমান আছেন।
0 Comments