বিবাহঃ
হযরত খাদিজা ইন্তেকালের সময় চার কন্যা রেখে যান। দু'জন বিবাহিতা ও দু'জন অবিবাহিতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যাদের লালন-পালনের ব্যাপারেও অতি চিন্তিত হলেন। তাঁর এহেন অবস্থা দেখে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব অনেকেই নানা প্রকার সান্ত্বনার বাণী শুনান। কিন্তু কিছুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মানসিক অবস্থার কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল না।
প্রকাশ যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খালা, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ওসমান ইবনে মাযউনের পত্নী হযরত খাওলাহ বিনতে হাকিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমীপে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার এ মলিন ভাব ও যাতনা আমার অসহ্য লাগছে। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি পুনরায় বিবাহ করে সুখী হতে চেষ্টা করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর করলেন, কিন্তু বিবাহ করব কাকে?
হযরত খাওলাহ উত্তরে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আপনি অনুমতি প্রদান করলে কুমারী অথবা বিধবা যে কোন প্রকারের পাত্রীই আপনার জন্য সংগ্রহ করতে পারব। আপনার মর্জির উপরই সব কিছু নির্ভরশীল।"
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "সে পাত্রী কে? আমার নিকট খুলে বলুন।" খাওলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে পেশ করলেন।
তিনি বললেন, হযরত আবু বকরের কন্যা আয়েশা এখনও ছোট বালিকা। সংসারের কাজ বিশেষ করে আপনার মাতৃহারা কন্যাদের লালন-পালন তাঁর দ্বারা সুচারুরূপে সমাধা হবে না। পক্ষান্তরে সাওদার দ্বারা আপনার এ সমুদয় কাজ অতিশয় সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সমাধা হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করুন।"
ছোকরানের বিধবা স্ত্রী ছিলেন একজন মুহাজের রমণী। অতি কষ্টে তাঁর দিন কাটত। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বিপদের দিনে নবী পরিবারের কিছু সেবা করার জন্য তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে পড়ল। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। কারণ তাঁর হাতে কন্যাদ্বয়ের লালন-পালনের ভার দিয়ে তিনি অনেকটা নিশ্চিত হতে পারবেন। যথাসময়ে সাওদাহর সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিবাহ হয়ে গেল। পারিবারিক কাজ-কর্ম এবং কন্যাদের দেখা-শুনা ঠিকমত চলল। কিন্তু কোথাও যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিসের অভাব অনুভব করছেন। তাঁর মানসিক অবস্থার কোন পরিবর্তন সাধিত হল না। এসব দেখে হযরত খাওলাহ হযরত আবু বকরের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়েশার বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন।
এ প্রস্তাবে হযরত আবু বকর (রা) খুশি হলেও, তৎকালীন সামাজিক অবস্থানের দরুণ একটু চিন্তান্বিত হলেন। কারণ তখনকার সামাজিক প্রথা অনুসারে আপন ভাইদের কন্যার ন্যায় ধর্মীয় ভাইয়ের কন্যাকেও বিবাহ করা অবৈধ ছিল। তাই হযরত আবু বকর (রা) হযরত খাওলাহ (রা) কে বললেন, এটা কি প্রকারে সম্ভব? কেননা আয়েশা তাঁর ভাইয়ের মেয়ে।
হযরত আবু বকর (রা)-এর এ কথা হযরত খাওলাহ (রা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে ব্যক্ত করলেন। হযরত খাওলাহ মুখে হযরত আবু বকর (রা)-এর মনের ভাব জানতে পেরে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন, "ইহা অন্ধকার যুগের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভাইয়ের কন্যা শরীয়ত মোতাবেক বিবাহে নাজায়েযের কিছু নেই।
হযরত আবু বকর (রা) শরীয়তের বিধানে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রা)-এর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিবাহের ফলেই আরবের যে বহু যুগের অন্ধ বিশ্বাসের এবং বড় ধরনের কুসংস্কারের অবসান হলো নিমিষেই। এখানে একটি বিষয় আলোচনা সাপেক্ষ।
হযরত খাওলাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়েশার বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই যুবায়ের বিন মুতয়িমের ছেলে সাথে আয়েশার বিবাহের কথা অনেকটা পাকাপাকি হয়েছিল। তাই হযরত আবু বকর যুবায়েরের সাথে আয়েশার বিবাহের ব্যাপারে তাঁর মতামত শেষবারের মত একটু জানার প্রয়োজন মনে করলেন। তাই হযরত আবু বকর যুবায়েরের নিকট তার পুত্রের সাথে আয়েশার বিবাহের ব্যাপারে তার অভিমত কি জিজ্ঞেস করলেন।
যুবায়ের হযরত আবু বকরকে স্বয়ং কোন জবান না দিয়ে তার স্ত্রীর মতামত জানতে চাইলেন। যুবায়েরের পরিবার তখনও অমুসলিম। তাই তার স্ত্রী পুত্রের জন্য আয়েশাকে পুত্রবধূরূপে ঘরে আনতে অসম্মতি জ্ঞাপন করল। সে ভেবেছে হযরত আয়েশার মত মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনলে পরিণামে পুত্রকেই হারাতে হবে। তাদের মনোভাব পরিষ্কার জানতে পেরে আবু বকর (রা) যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
এদিকে হযরত খাওলাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়েশার বিবাহের ব্যাপারে আগ্রহ সহকারে কথা আদান-প্রদান করতে লাগলেন। তাঁর এ ব্যাপারে যোগ দিলেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নববিবাহিতা পত্নী হযরত সাওদাহ (রা)। তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রস্তাব করলেন যে, আপনি আয়েশাকে বিবাহ করুন। ছহীহ হাদীস বোখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আয়েশা সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নে দেখলেন, ফেরেশতাগণ রেশমী কাপড়ে জড়ান একটি বস্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে পেশ করলেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফেরেশতাগণকে প্রশ্ন করলেন, এটা কি? তারা উত্তর করলেন, 'আপনার মহীয়সী।' রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোড়ক খুলে দেখলেন এতে তাঁর বিবাহের প্রস্তাবিত স্ত্রী আয়েশা (রা) রয়েছেন। এই স্বপ্নের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে হযরত আয়েশাকে বিবাহ করার আগ্রহ দেখা দিল। বিশেষ করে হযরত খাওলাহ (রা) বলেছিলেন, হুজুর! আপনি হযরত আয়েশা (রা)কে বিবাহ করলে সমাজে অতি পুরাতন কুসংস্কার চিরতরে বিলোপ হয়ে যাবে। সমাজ জানতে পারবে, ধর্মীয় ভাইয়ের কন্যা বিবাহ করতে শরীয়তে কোন বাধা-নিষেধ নেই।
এ কথা চিন্তা করে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বাল্য বন্ধু, যৌবনের সাথী, ইসলাম জগতের পহেলা মুসলমান, সুখ-দুঃখে ছায়ার ন্যায় বিরাজকারী, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্জন গুহার একান্ত বিশ্বস্ত সহচর হযরত আবু বকরের কন্যাকে বিবাহ করতে মন স্থির করে ফেললেন।
কিন্তু একটি মানসিক বাধা এসে তাঁর সম্মুখে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করল। তা হল সমাজের সমালোচনা। কারণ লোকে বলবে, হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু বিবাহে আকাঙ্ক্ষী। শেষ পর্যন্ত তা টিকতে পারল না।
বিবাহের আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর নবুওতের দশম সালের ২৫ শে শাওয়াল তোমাবেক ৬২০ সালের মে মাসে পাঁচশত দিরহাম মোহর ধার্য করে আরবের চিরাচরিত প্রথার শিরে কুঠারাঘাত করে বিনা আড়ম্বরে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়েশার বিবাহ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
এ বিবাহ অনুষ্ঠানে তৎকালীন গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আবু কোহাফা, হযরত খাওলাহ (রা)-এর স্বামী, ওসমান ইবনে মাজউন, হযরত আব্বাস (রা), হযরত হামযাহ (রা), হযরত আয়েশার বান্ধবী আতিয়াহ, উম্মে হানী, হযরত খাওলাহ এবং উম্মে রুমান অন্যতম। বিবাহের সময় আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। তিনি পিত্রালয়েই থেকে যান। প্রাকৃতিক প্রভাবে দেখা যায়, উষ্ণ দেশীয় লোকজন শারীরিক দিক দিয়ে নাতিশীতোষ্ণ দেশীয় লোকদের অপেক্ষা অধিক বাড়ন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে যাদের ধী-শক্তি যত প্রখর, তাদের শারীরিক হৃষ্ট-পুষ্টতাও তেমন মানসিক সামঞ্জস্য বজায় রেখে তালে তালে বাড়িয়ে চলে। হযরত আয়েশার শারীরিক গঠনে তার কোন ব্যতিক্রম ছিল না।
ছয় বছর বয়সেই তাঁকে দশ-বারো বছরের বালিকার ন্যায় দেখাত। বিবাহের পর দীর্ঘ তিন বছর পর দশ বছর বয়সে তিনি প্রথম স্বামী গৃহে গমন করেন। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সমালোচক বলে থাকেন, পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়ের সাথে ছয় বছরের একটি বালিকার বিবাহ সত্যিই আপত্তিকর। তাদের জানা দরকার ছিল, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স মাত্র পঁচিশ বছর তখন তাঁর সাথে যেমন চল্লিশ বছর বয়স্কা মহিলার বিবাহ আপত্তিকর কিছু ছিল না, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি।
বিশেষ করে যে সকল মাহমানবের সাহচর্য লাভ করে অতি জঘন্য মানুষ এ নিমিষে একজন ইতিহাস প্রসিদ্ধ মানুষ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়েছেন, তাদের কথা বা কাজ নিয়ে আমাদের সমালোচনা করা অতি মূর্খতা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে।
হযরত আয়েশা (রা)-এর সখী আতিয়াহ বললেন, যেদিন হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় সেদিনও আয়েশা খেলার সাথীদের নিয়ে খেলায় মগ্ন। তাঁর মা এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যান এবং হযরত আবু বকর তাঁর বিবাহ পড়িয়ে দেন।
হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার যে বিবাহ হয়েছিল আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আমার মা বলতেন, তোমার বিবাহ হয়েছে, বাইরে যাবে না। তখন বুঝতে পারলাম, আমার বিবাহ হয়েছে।
বিবাহের তারিখ ও বয়সঃ
হযরত আয়েশা (রা)-এর বয়স ও বিবাহের তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এর ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত মত প্রকাশ করেছেন। কোন কোন ইতিহাসবেত্তা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সাওদাহকে বিবাহ করার অল্পকাল পরেই নবুওতের দশম সালের শাওয়াল মাসে তাঁর বিবাহ হয়। হযরত মাওলানা ইসমাঈল বোখারী ছিহাহ ছিত্তার অন্যতম গ্রন্থ বোখারী শরীফে বর্ণনা করেছেন, হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহের সময় তাঁর বয়স ছয় বছরই ছিল। কিন্তু রুছমত হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী স্বরচিত বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা আইনী কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, হিজরতের দু বছর পূর্বে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ হয়েছিল।
কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত খাদীজা (রা)-এর ইন্তেকালের তিন বছর পর হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। আবার কোন কোন জীবনীকার লিখেছেন, হযরত খাদীজার ইন্তেকালের বছরই হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ হয়। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক গণের এ সকল মতভেদের দরুন হযরত আয়েশা (রা)-এর বয়স ও বিবাহের তারিখ নির্ণয় করা বেশ কষ্টসাধ্য। তবে সমস্ত ঘটনা ও বর্ণনা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, হযরত সা'দ ইবনে হাজার যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাই নির্ভরযোগ্য। কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন, যখন হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আয়েশার বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় তখন তাঁর বয়স নয় বছর এবং রুছমতের সময় তাঁর বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। এতদসত্ত্বেও অধিক প্রচারিত ও সর্বজন স্বীকৃত বিবাহ তারিখটি হল, হযরত আয়েশার ছয় বছরের শেষের দিকে এবং রুছমত হয়েছিল হিজরতের পর মদিনায় নয় বছরের শেষ পর্যায়ে। তবে এ মতভেদের প্রকৃত মীমাংসায় পৌঁছার একমাত্র পথ ছিল যদি হযরত আয়েশার নিকট হতে কোন একটি সুনির্দিষ্ট হাদীস বর্ণিত হত। কিন্তু তাও পাওয়া যায় নি।
কাজেই তাঁর বর্ণনার উপরও নির্ভর করা যায় না। মনে হয় আয়েশার বর্ণনা উল্লেখ করতে মুহাদ্দিসগণ ভুল করেছেন। কেননা যে বছর হযরত খাদীজা ইন্তেকাল করেন সে বছরই আয়েশার বিবাহ হয়েছে বলে অধিক বর্ণনা রয়েছে।
অন্য একটি ঘটনা সঠিকভাবে জানতে পারলেও হয়রত আয়েশা (রা)-এর বিবাহের তারিখ নির্ণয় করা যেত। তা হল, হযরত খাদিজার ইন্তেকাল। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের তারিখ সম্বন্ধেও সকলে একমত নয়। এক বর্ণনায় আছে, হযরত খাদিজা হিজরতের তিন বছর পূর্বে এবং অন্য বর্ণনায় আছে চার বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন।
যাই হোক অধিক সংখ্যক বর্ণনায় এবং মসনাদে উল্লেখ আছে হযরত খাদীজা (রা) নবুয়াতের দশম বর্ষে রমজান মাসে অর্থাৎ হিজরতের তিন বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। এর পর শাওয়াল মাসে হযরত আয়েশার বিবাহ রেওয়ায়েত রয়েছে।
স্বামীগৃহে গমনঃ
হিজরতের পর হযরত আয়েশা যখন সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত হয়ে উঠলেন, আবু বকর (রা) স্বীয় স্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী দ্বিতীয় হিজরী সনের ১০ই শাওয়াল কন্যা আয়েশার রুছমতের ব্যবস্থার বিষয়ে ভাবতে লাগলেন। তাই তিনি এ কথা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উত্থাপন করে তাঁর মতামত প্রার্থনা করলেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যদিও এ ব্যাপারে অমত থাকার কথা নহে, কিন্তু অর্থাভাবে তিনি এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে হযরত আবু বকরকে জানালেন, আমি এ সময় সম্পূর্ণ কপর্দক শূন্য। মোহরের পাঁচশত দেরহাম ও আনুষঙ্গিক খরচেরও কোন উপায় দেখছি না। অতএব, তাড়াতাড়ি রুছমত সম্পন্ন করা আমার সাধ্যের বাইরে। টাকা-পয়সার ব্যবস্থা হলেই রুছমত অনুষ্ঠান সমাধা করব। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শুনে আবু বকর আরজ করলেন, 'আপনি প্রয়োজনীয় অর্থ আমার নিকট হতে ধার নিন।'
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। কারণ, তিনি ভাবলেন, যদিও এ সময় আবু বকর অর্থ ধার দেয় কিন্তু পরে তা গ্রহণ না করলে কিছুই করার থাকবে না। তাই তিনি মনস্থ করলেন যে, অপরের নিকট হতে ধার করবেন অথবা কায়িক পরিশ্রম করে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পর রুছমতের কাজ সমাধা করবেন, তবেই আয়েশাকে গৃহে আনবেন।
হযরত আবু বকর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোভাব বুঝে পুনরায় আরজ করলেন, 'আপনি আমার নিকট হতে অর্থ ধার নিন।
সুযোগ মত আপনি পরিশোধ করে দিবেন। আমি তখন তা ফেরত নিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের এ আশ্বাস পেয়ে কর্জ করতে সম্মত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের নিকট হতে বার উকিয়া বাংলাদেশী একশত টাকা ধার নিয়ে মোহর হিসাবে আয়েশার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। আর রুছমতের দিন দ্বিতীয় হিজরির একুশে শাওয়াল ধার্য হল।
মদিনায় উল্লাসের সাড়া পড়ে গেল। আনসার ও মুহাজির রমণীগণ আয়েশাকে নববধূরূপে নিয়ে যাবার জন্য হযরত আবু বকর (রা)-এর গৃহে আগমন করলেন। বরযাত্রীর আগমনে হযরত আবু বকর মহা আনন্দিত হলেন। অভ্যর্থনার মাধ্যমে মেহমানকে বরণ করে তাদের আদর আপ্যায়নের ভিতর দিয়ে ভোজপর্ব সমাধা করলেন।
এদিকে আয়েশা (রা) দোলনায় দোল খাচ্ছিলেন। মায়ের ইঙ্গিতে দৌড়ায়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। মা তাঁকে গোসল করিয়ে আগত মহিলাদের নিকট আনলে তাঁরা বলে উঠলেন, 'আপনার আগমন মঙ্গলময় ও শুভ হোক।' তাঁরা আয়েশাকে সাজাতে শুরু করলেন। সাজাবার কাজ সমাধা হলে হযরত আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহকে অন্তঃপুরে আনলেন। তাঁর আগমনে সকলেই শুভাগমন বলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। আবু বকর (রা)-এর ইঙ্গিতে আয়েশার সাথী আসমা তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পার্শ্বে বসিয়ে দিলেন। মা উম্মে রুমান কন্যার এক হাত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
এ সময় আবু বকর (রা) এক পেয়ালা দুধ মেহমানদের সম্মুখে উপস্থিত করলেন। এ মজলিসে আয়েশার বান্ধবী আসমা বিনতে ইয়াযীদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেয়ালা হতে কিছুটা দুধ পান করে আয়েশার হাতে দিলেন। আয়েশা (রা) লজ্জাজনিত কারণে মাথা নত করে বসে রইলেন।
আমি তখন বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদত্ত বস্তু ফিরাতে নেই। অতঃপর আয়েশা পেয়ালা হতে কিছু দুধ পান করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বললেন, তোমার সখীদিগকে দাও।
আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাদের ক্ষুধা নেই।' হযরত বললেন, 'মিথ্যা বলিও না। কারণ মানবের প্রত্যেক কথাই আমলনামায় লিখা হয়।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বিতীয় স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত সাওদা পতিগৃহে হযরত আয়েশা (রা) কে নববধূবেশে বরণ করলেন। মা উম্মে রুমান আয়েশার সথী আসমাকে তাঁর সাথে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহর প্রিয় রাসূলের এমন দিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে উৎসব করার মত কোন ব্যবস্থাই তাঁর ঘরে ছিল না। অথচ আজ তাঁর জীবনের এক পরম খুশীর দিন। কিছু নেই বিধায় তাঁর মনে কোন আফসোস নেই। তিনি নির্বিকার। কোন এক সাহাবার এক পেয়ালা দুধ দ্বারা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবপত্নী ও তাঁর সখীকে অভ্যর্থনা জানালেন।
হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ, মোহর, মেহমানদারী ও রুছমতের ঘটনা পাঠকমাত্রই লক্ষ্য করেছেন। এমন সহজ ও সরলভাবে বিবাহের কাজ সমাধা হওয়ার নজির অতি বিরল। সেখানে ছিল না কোন প্রকার অপব্যয় ও অপচয়ের বালাই। ছিল না কোন প্রকার আমোদ-উল্লাসের হৈ হুল্লোড়।
বিশেষ করে দেন-মোহরের অনাহুত বাড়ামীও সেখানে স্থান পায় নি। যে মোহর ধার্য হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুছমতের পূর্বেই তা হযরত আয়েশা (রা)-এর নিকট পাঠিয়ে দেন। কেননা তা অবশ্য দেয়, স্ত্রী প্রাপ্য। হযরত আয়েশা (রা)-এর মোহরের বিষয়েও মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম বোখারীর মতে মোহর পাঁচশত দেরহাম। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, মোহর ছিল চারশত দেরহাম। ইমাম ইবনে সা'দ উল্লেখ করেছেন, মেহমান ছিল মাত্র পঞ্চাশ জন। তবে যারা মোহর পাঁচশত দেরহামের কম উল্লেখ করেছেন, হযরত আয়েশার বর্ণনায় তা বাতিল হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রী কাউকেও পাঁচশত দেরহামের কম মোহর প্রদান করেন নি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহের ফলে আরবের প্রাচীন কুপ্রথার মাথায় কুঠারাঘাত পড়ল। অন্ধকার যুগে আরববাসী মুখ-বলা ভাইয়ের মেয়ে বিবাহ করাকে অতি জঘন্য বর্বরতার বলে জানত। এ কুসংস্কারের অবসান কল্পে সফলও হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খালা বিবি খাওলাহ আবু বকরের নিকট এ বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, এ বিবাহ কোন মতেই হতে পারে না। কেননা আয়েশা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাই-জি। আর ভাইয়ের মেয়ে বিবাহ করা জায়েয। হযরত আবু বকরের এ কথার প্রেক্ষিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, 'আপনি আমার ধর্ম ভাই।
তৎকালে আরব দেশে শাওয়াল মাসে বিবাহ উৎসব হত না। এতে তারা কুলক্ষণে ও অমঙ্গলের মাস বলে বিবেচনা করত। তাই এ মাসে বিবাহ শাদী দূরের কথা বিবাহের আলোচনা করাকেও অমঙ্গল মনে করত। হযরত আয়েশা (রা)-এর বিবাহ ও পতিগৃহে গমন শাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হলে আরবের সে কুপ্রথার অবসান ঘটে। যার ফলে তিনি শাওয়াল মাসে বিবাহ-শাদী হওয়াকে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। হযরত আয়েশা হতে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমার বিবাহ ও পতিগৃহে গমন শাওয়াল মাসে হয়েছে, আমার অপেক্ষা সৌভাগ্যশালিনী কে আছে?
আরবের আরও একটি প্রথা ছিল, নববধূ পিতৃগৃহে যাবার সময় সম্মুখ ভাগে একব্যক্তি আগুন নিয়ে পথ চলত। আরোহীতে বসে বর-কনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। আয়েশা (রা)-এর বিবাহের পর এ প্রথা চিরতরে বিলোপ হল। সকলের অবগতির জন্য এ স্থানে একটি বিষয় আলোচনা করা আমরা একান্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। আপনারা উপরে পাঠ করেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা)-এর দেনমোহর ধার্য হয়েছিল মাত্র পাঁচশত দেরহাম অর্থাৎ একশত টাকা আর দেন-মোহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুছমতের পূর্বেই হযরত আয়েশাকে পরিশোধ করে দেন। যে পরিমাণ মোহর আদায় করা ফরজ সে পরিমাণ ধার্য করাই বাঞ্ছনীয়। অধুনা সমাজে অধিক মোহর ধার্য করার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কে কার অপেক্ষা বেশি মোহর ধার্য করতে পারে এটা যেন একটা মহা প্রতিযোগিতা। অথচ স্ত্রীর হক পরিশোধ করার প্রতি কারও খেয়াল মাত্র নেই। তাই সকলেরই রাসূলের পথ অনুসরণ করে প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে এর সমাধানকল্পে বাস্তমুখিতায় ধাবিত হওয়া কর্তব্য।
সাংসারিক জীবনঃ
পৈত্রিক সূত্রেই হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন একজন ধনবান ব্যক্তি। তাঁর অগাধ আয় ছিল। তাই পিতৃগৃহে আয়েশা কোন সময়ই অভাব-অনটন দেখেন নি। অভাব কাকে বলে সে সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু পতিগৃহে গমন করেই তিনি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন।
পাঠকগণ। আগেই পাঠ করেছেন যে, পতিগৃহে প্রথম দিন আগমন করেই হযরত আয়েশা (রা) জনৈক সাহাবী প্রদত্ত এক পেয়ালা দুধের কিছু অংশ পান করে দিন কাটিয়েছিলেন। শুধু খাওয়া-পরার ব্যাপারেই নয়, সংসার জীবনের সব ক্ষেত্রেই অতি দীনহীনভাবে তাঁকে কালাতিপাত করতে হয়েছে।
হযরত আয়েশা (রা) থাকার জন্য যে গৃহখানা লাভ করেছিলেন তা ছিল ছয় হাত প্রস্থ ও গাত হাত দৈর্ঘ্য। দেয়াল ছিল মাটির তৈরি আর ছাদের আবরণ ছিল খেজুর পাতার। মেঝেতে দাঁড়িয়ে অনায়াসেই এর ছাদের নাগাল পাওয়া যেত। বৃষ্টির দিনে একখানা কম্বল ছাদের উপরে বিছায়ে দিতে হত। বাহির দিকে ঘরের একটি মাত্র দরজা ছিল। একখানা কাঠ দ্বারা দরজার কপাটের কাজ চলত। পর্দা হিসেবে একখানা কম্বল দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হত। ঘরখানা দেখতে মসজিদে নববীর একটি অংশ বলে মনে হত। ঘর হতে মসজিদে যাওয়ার জন্য একটি খিড়কী পথ ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পথে মসজিদে আসা যাওয়া করতেন। ঘরে আসবাবপত্র ছিল না বললেই চলে। ঘরের প্রতি তাকালেই গৃহ মালিকের আর্থিক অবস্থার পুরাপুরি একটি ধারণা সকলের নজরে পড়ত।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশার গৃহে প্রবেশ করে প্রায়ই বলতেন, 'আদম সন্তান অতিশয় ধনের কাঙ্গাল। দুটি ধন-সম্পদের পরিপূর্ণ ময়দান প্রদান করলেও তাদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না। তারা আরও একটি পাওয়ার আশায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র মাটিই তাদের এ লালসার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে। শুধু নামায, যাকাত ও আল্লাহর প্রতি মনোযোগ স্থির রাখার জন্যই ধর্মের প্রয়োজন।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো যথাবিহিত পালন করলে আল্লাহ তা'য়ালা সন্তুষ্ট হন। ধন-সম্পদের প্রতি মানব সন্তানদের যে একটি জন্মগত মোহ আছে তার অসারতা বুঝার জন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপন পরিবার পরিজনদের উদ্দেশ্য করে এ উপদেশবাণী বলতেন।
আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঘরে বসবাস করতেন তা ছিল হযরত আয়েশার ঘর সংলগ্ন অপর একটি পর্ণ কুটির। যাশবারা নামে পরিচিত এ ক্ষুদ্র দ্বিতল গৃহেও সাজ-সরঞ্জাম ও আসবাবপত্রের বাহুল্য ছিল না। ঘরখানায় ছিল একখানা খাট, একখানা চাটাই, একখানা চাদর, খেজুর গাছের বাকলে প্রস্তুত একটি বালিশ, আটা-ময়দা রাখার জন্য দু'টি মটকা, একটি কলসী এবং একটি মাত্র পেয়ালা। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত আয়েশা (রা) যে ঘরে থাকতেন তা ছিল নূরে এলাহীতে পরিপূর্ণ। অথচ রাত্রির অন্ধকার দূর করার জন্য একটি মাটির প্রদীপ জ্বালানোর সামর্থ্যও তাঁদের থাকত না। অন্ধকারেই তাঁরা রাত্রিযাপন করতেন।
যতদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পত্নী হযরত সাওদা ও হযরত আয়েশা এ দু'জনই ছিলেন ততদিন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালাক্রমে তাঁদের ঘরে রাত্রি যাপন করতেন। পরবর্তী পর্যায়ে যখন উন্মুল মুমিনীনদের সংখ্যা বেড়ে গেল তখন হযরত সাওদা আপন বার্ধক্যজনিত কারণে আপন পালা হযরত আয়েশার প্রতি ছেড়ে দিলেন। যার ফলে প্রতি নয় রাত্রির মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু'রাত্রি হযরত আয়েশার গৃহে অবস্থান করতেন।
হযরত আয়েশা (রা) বেশিরভাগ সময়ই একাকিনী বাস করতেন। কেবলমাত্র অল্প কিছুদিন বারীরাহ নাম্নী একজন দাসী তাঁর ঘরে বাস করেছিল। সাংসারিক বিশৃঙ্খলা, কোন শোরগোলের স্থান সেখানে ছিল না। রান্না-বান্না অধিকাংশ সময়ে হত না। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, একাধারে কয়েক মাস আমাদের চুলায় আগুন জ্বলত না। একাদিক্রমে তিনদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবার-পরিজন তৃপ্তি সহকারে পানাহার করেন নি। অনেক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশার ঘরে এসে মধুর ভাষায় জিজ্ঞেস করতেন, হে আয়েশা। খাবার কোন কিছু আছে কি? হযরত আয়েশা (রা) অতি ধীর কণ্ঠে বলতেন, 'হুযুর। খাবার যা ছিল তা শেষ হয়ে গেছে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হযরত আয়েশা অভুক্ত অবস্থায় রাত্রি কাটাতেন। এমন অভাব-অভিযোগের সময়ও যদি সাহাবীদে, বা আত্মীয়-স্বজনের নিকট হতে কোন খাদ্য সামগ্রী পৌছিয়ে দিত, হযরত আয়েশা অকাতরে তা গরীব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিতেন। আর নিজে অনাহারে দিন কাটায়ে দিতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ করতেন না।
হিজরতের পর তাঁদের এ অবস্থাতেই দিন কাটতে লাগল। এমনকি, সমগ্র আরব দেশ বিজয়ের পরও তাঁদের আর্থিক অবস্থার কোনই পরিবর্তন হয় নি।
হযরত আয়েশা (রা) আপন হাতেই আটা বা যব পিষতেন। একদিন আটা পিষতে পিষতে তিনি তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন। এদিকে প্রতিবেশীর বকরী ঢুকে সমুদয় আটা খেয়ে চলে যায়।
অন্য একদিন তিনি নিজ হাতে রুটি তৈরি করে স্বামীর অপেক্ষা করতেছিলেন। ক্রমে রাত্রি অধিক হয়ে গেল। নিদ্রার শীতল পরশ তাঁকে অভিভূত করে তুলল। কোন সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন তা টেরও করতে পারলেন না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে আগমন করে নামাযে রত হলেন। এ অবস্থায় আজও প্রতিবেশির বকরী এসে সমুদয় রুটি খেয়ে গেল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জীবনে সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্র হতে তাঁর দরবারে সদা-সর্বদা নানা প্রকার খাদ্য সামগ্রী ও মূল্যবান উপঢৌকন তাঁর খেদমতে পেশ হতে লাগল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা আপন প্রয়োজনে ব্যয় না করে এ সমুদয় উপঢৌকন বাইতুল মালে (রাজ ভাণ্ডার) জমা করে দিতেন।
প্রিয়তম স্বামীর ইচ্ছাকৃত অভাব ও ধনের প্রতি অনীহা দেখে হযরত আয়েশা (রা) বিন্দুমাত্রও মনোক্ষুণ্ণ হতেন না, বরং হাসিমুখে তা বরণ করে নিতেন। কারণ মানব জাতিকে যিনি উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাবার ব্রত গ্রহণ করেছেন, যাঁর ধ্যান-ধারণা এ সংকীর্ণ জীবন সীমার মধ্যে আবদ্ধ না হয়ে অনন্ত সুখের আশায় উন্মুখ হয়ে রয়েছে, তিনি এ সামান্য ধরনের মোহে আকৃষ্ট হবেন কেন?
নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিলাস প্রিয়। কত সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে অনেক বিলাস দ্রব্য বহু রাজা-বাদশাহর নিকট হতে উপঢৌকন হিসেবে আসত, হযরত আয়েশা (রা) ক্ষণিকের তরেও ঐ সকল দ্রব্যের মোহে আকৃষ্ট হন নি। এমনকি তা ব্যবহার করার বাসনাও মুহূর্তের জন্য তাঁর চিত্তে দোলা দিতে পারে নি।
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিবিগণ একমত হলেন যে, এবার তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গৃহসজ্জা, অলঙ্কার, সচ্ছল জীবন ধারণে উপযোগী জিনিসের জন্য প্রার্থনা করবেন।
একথা শুনে হযরত আবু বকর (রা) ও হযরত ওমর (রা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গৃহে আগমন করলেন। হযরত আবু বকর স্বীয় কন্যা হযরত আয়েশা (রা) এবং হযরত ওমর (রা) তদীয় কন্যা হযরত হাফসা (রা)কে ডেকে বললেন, তোমরা কোন কিছু চেয়ে হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিরক্ত করো না। তোমাদের কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমরা তার ব্যবস্থা করে দিব। তারা উভয়েই পিতার উপদেশে গুলিও জান্ত রইলেন, কিন্তু অপর বিধিগণ তাঁদের সংকল্পে অনড় রইলেন। যার ফলে নদী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব মনোক্ষুন্ন হলেন।
স্বামী সোহাগ নারীর অমূল্য ধন। আর মাতৃজেহ নারী চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত আয়েশা (রা)-এর কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না, কাজেই তাঁর নিকট হতে আমরা মাতৃয়েহ সকল মুসলমানের উপরই সমভাবে বেষ্টিত। হযরত আয়েশা বয়সে হযরত ফাতেমা (রা) অপেক্ষা ছোট। কিন্তু এ ছোট বয়সে তিনি মাতৃস্নেহের যে নজীর স্থাপন করেছেন তার তুলনা অতি বিরল।
মারিয়া কিবতিয়ার গভ্রজাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ইব্রাহীমের জন্মের সামান্য কয়দিন পরই তাঁকে তিনি আদর-যত্নে লালন-পালন করতে থাকেন। অভাল মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইব্রাহীম তাঁর ক্রোড়ে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদার যুগান্তর আমীর মাবিয়া রাজতন্ত্র কায়েম করেন। তিনি রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্নেহের দুলালী হযরত ফাতেমা (রা)-এর নয়ন মণি হযরত হাসানের নিকট দূত পাঠালেন এ বলে যে, তাঁকে আমীর মাবিয়ার হাতে বয়াৎ হতে হবে, অন্যথায় কারাবাস অবধারিত।
হযরত আয়েশা আমীর মাবিয়ার এ হীনমন্যতার কথা শুনে শাবকহারা সিংহীর ন্যায় গর্জিয়ে উঠলেন। মাতৃস্নেহ তাঁর সকল শিরায় উথলিয়ে উঠল। তিনি আমীর মাবিয়াকে ডেকে এসে হুঁশিয়ার করে দিলেন-হযরত হাসান আজ মাতা-পিতা ও নানাহারা। আমি আয়েশা নানী হিসেবে আজও বেঁচে আছি। হাসানের প্রতি অসহনীয় ব্যবহার করলে হাড়-মাংস ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে হবে।
হযরত আয়েশা (রা)-এর মাতৃসুলভ হুঙ্কার ও সাবধান বাণী শুনে আমীর মাবিয়া স্বীয় সংকল্প পরিত্যাগ করলেন। কেবল যে তিনি নবী পরিবারের জন্যই এমন প্রতিবাদ করেছিলেন তা নহে, সকল নিপীড়িত ও দুঃস্থ মানব সন্তানের জন্যই তাঁর মাতৃ হহৃদয় কেঁদে উঠত।
কথিত আছে, ঈদের দিন হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ইয়াহুদী শিশুকে রাস্তার ধারে ক্রন্দনরত দেখতে পেলেন। দয়ার সাগর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তর শিশুর ক্রন্দনে স্থির থাকতে পারল না। তিনি শিশুটির নিকট গমন করে তাকে কোলে নিলেন। অতি স্নেহের সাথে তাকে তার কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শিশু নবীজির স্নেহের পরশ পেয়ে কান্না বন্ধ করে দিল এবং বলল, খয়বর যুদ্ধে তার পিতা-মাতা নিহত হয়েছে। দুনিয়ায় আপন বলতে তার আর কেউ নেই। বালকটির এ দুঃখপূর্ণ কাহিনী শুনে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বালকটিকে বললেন, তুমি আয়েশা (বা)-এর মত মা এবং হয়রত ফাতেমা (রা)-এর মত বোন এবং আমার মত পিতা পেলে কি তাদিগকে পছন্দ করবে।
বালকটি কাল বিলম্ব না করে জানিয়ে দিল, আমি খুব খুশি হব। নবী করীম তৎক্ষণাৎ বালকটিকে বাড়ি নিয়ে আসলেন এবং হযরত আয়েশা (রা) কে ডেকে বললেন, আয়েশা। তোমার জন্য একটি ছেলে সন্তান এনেছি, তাকে অতি যত্নের সাথে প্রতিপালন করিও।
এ বালকটিকে লালন-পালন করে বড় করার পর হযরত আয়েশা (রা) তাকে বিবাহ-শাদী করিয়েছিলেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। নিঃসন্তান উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) নিঃসন্তান হওয়া সত্ত্বেও মাতৃস্নেহের কয়েকটি নমুনা আমরা উল্লেখ করেছি, যা কিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
তিনি আরও কতিপয় বালক-বালিকাকে আপন জননীর ন্যায় লালন-পালন করেছেন। তাদের কয়েকজনের নাম এখানে বর্ণিত হল। হযরত আয়েশা বিনতে আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াজীদ, হযরত ওমর বিন আব্দুর রহমান আনসারী, হযরত আরওয়া ইবনে জুবাইর ও হযরত মাসরূক ইবনে আকদা প্রমুখ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকরের খেলাফতকালে উম্মল মুমিনীনগণের জন্য খয়বর হতে পূর্ব নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা হত। হযরত ওমর (রা) খলিফা নিযুক্ত হলে হযরত আয়েশা (রা) বার হাজার দেরহাম এবং অপর উম্মুল মুমিনীনগণ দশ হাজার দেরহাম করে বার্ষিক ভাতা পেতেন। কারও মতে, হযরত ওমর তাঁদিগকে জমিন অথবা শস্য গ্রহণ করার অধিকার প্রদান করেছিলেন। হযরত আয়েশা (রা) জমিন গ্রহণ করেছেন। জমিনে সমুদয় উৎপাদন তিনি গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। হযরত ওসমান (রা) ও হযরত আলী (রা)-এর খেলাফত কালে এবং আমীর মাবিয়ার রাজত্বকালে এ প্রথাই বলবৎ ছিল বলে প্রকাশ। আমীর মাবিয়া একবার হযরত আয়েশা (রা)-এর খেদমতে এক লক্ষ দেরহাম নজরানা পাঠিয়েছিলেন।
সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি এ অর্থ লোকজনকে বাটওয়ারা করে দেন। পরিচারিকা এসে আরজ করল, আম্মা। ইফতারের জন্য কিছু রাখার প্রয়োজন ছিল। তিনি উত্তর করলেন, একখা তোমার আম্মাকে পূর্বেই বলা উচিত ছিল। আমীর মাবিয়ার রাজত্বকালে তাঁর বোনের হেলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর হেজাজ প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি আপন এলা হযরত আয়েশার যাবতীয় ব্যয়ভার নিজ পক্ষ হতে বহন করতেন। কিন্তু যেদিন বাইতুল মাল হতে টাকা-কড়ি আসত সেদিন তিনি তা আপন প্রয়োজনে খরচ না করে গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়ে নিজে অনাহারে থাকতেন।
0 Comments