যুদ্ধ-বন্ধীরা যখন মদীনায় পৌছে, তখন হুযুর (সাঃ) দু-দু চার চার জন করে বন্দী সাহাবায়ে কিরাম-এর মাঝে বণ্টন করে দিলেন এবং সবাইকে নির্দেশ দিলেন যেন তাঁদেরকে আরামে রাখে। এর ফল হলো এই যে, সাহাবিগণ তাঁদেরকে সযত্নে আহার করাতেন এবং নিজেরা শুধু খেজুর খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হযরত মুস'আব বিন উমায়র (রাঃ)-এর ভাই আবু আযীযও ঐ বন্দীদের মধ্যে ছিল। তার বর্ণনা এই যে, আমাকে এক আনসারের নিকট সোপর্দ করা হয়। যখন আহারে বসতেন, তখন তিনি আমার সামনে রুটি রেখে দিতেন এবং নিজে শুধুমাত্র খেজুরের উপর নির্ভর করতেন।
যুদ্ধ-বন্দীদের সম্পর্কে সাহাবীদের সাথে পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ফিয়া বা মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হবে। সুতরাং চার হাজার দিরহাম নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
ইসলামী সাম্য নীতি
এ সমস্ত বন্দীর মধ্যে হযরত (সাঃ)-এর চাচা হযরত আব্বাসও ছিলেন (যিনি পরে মুসলমান হন)। হযরত আব্বাস (রাঃ) রাতে বন্দীত্বের যন্ত্রণায় উহ্ আহ্ করছিলেন। তাঁর শব্দ হযুর (সাঃ)-এর কানে এসে পৌঁছে। ফলে হযরত (সাঃ)-এর নিদ্রা দূর হয়ে যায়। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার কেন নিদ্রা আসেনি? তিনি ইরশাদ করলেন, আমি কিভাবে নিদ্রা যেতে পারি, যেখানে আমার সম্মানিত চাচার যন্ত্রণার আওয়াজ আমার কানে এসে পৌছুচ্ছে।
এ ঘটনা সত্ত্বেও ইসলামী সাম্য এ অনুমতি দেয়নি যে, স্বীয় বয়োবৃদ্ধ সম্মানিত চাচাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেয়। যেভাবে সবার নিকট থেকে ফিদয়া নিয়ে মুক্তি দেয়া হয়েছে, তেমনি তাঁর থেকেও নেয়া হয়েছে। বরং সাধারণ বন্দীদের থেকে কিছুটা বেশী। কেননা সাধারণ বন্দীদের থেকে চার হাজার এবং সর্দারদের নিকট থেকে কিছু বেশী নেয়া হয়েছিল। হযরত আব্বাস (রাঃ)ও ধনী ছিলেন। তাঁকে চার হাজারের বেশী দিতে হয়।
আনসারগণ হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর ফিদয়া মার্জনা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামী সাম্যে আত্মীয়-অনাত্মীয়, শত্রু-মিত্র সবাই সমান। আনসারদের অনুরোধ সত্ত্বেও তা গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে হযরত (সাঃ)-এর জামাতা আবুল 'আস (রাঃ) যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিলেন। তাঁর ফিদয়া দেওয়ার মত কোন সম্পদ ছিল না। তাই তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ হুযুর (সাঃ)-এর কন্যা হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে (যিনি মক্কায় অবস্থান করছিলেন) বলা হলো যে, ফিদয়ার টাকা যেন পাঠিয়ে দেন। তাঁর গলায় একটি হার ছিল, যা তাঁর আত্মা হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর বিবাহে উপঢৌকন দিয়েছিলেন, তিনি তা গলা থেকে খুলে পাঠিয়ে দিলেন। এই হার দেখে হুযুর (সাঃ)-এর চোখ থেকে অশ্রু বের হয়ে আসলো। তিনি সাহাবীদের নিকট বললেন, যদি তোমরা সম্মত হও, তাহলে যয়নাবের নিকট তার মা-এর এ স্মৃতিচিহ্নটি ফেরত পাঠানো যেতে পারে। সাহাবিগণ সানন্দে এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং হার ফেরত পাঠালেন। আবুল 'আসকে বলা হলো, যেন হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে মদীনায় ফেরত পাঠানো হয়।
আবুল আস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ
আবুল 'আস (রাঃ) মুক্তি পেয়ে মক্কা পৌঁছেন এবং শর্তানুযায়ী হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। আবুল 'আস (রাঃ) একজন বিরাট ব্যবসায়ী ছিলেন। শাম দেশ থেকে মালামাল নিয়ে আসার পথে ঘটনাক্রমে তিনি দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন। এবারও পূর্বের মতই। তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এবার মুক্তি পেয়ে তিনি মক্কা আসলেন এবং কুরায়শ নেতাদের অবাক করে দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। লোকদের নিকট বলতে লাগলেন যে, আমি এখানে এসে এজন্য মুসলমান হলাম যেন মানুষ এটা বলতে না পারে যে, আমাদের মালামাল রক্ষার জন্য আমি মুসলমান হয়েছি অথবা বাধ্য করে আমাকে মুসলমান করা হয়েছে।
বদর যুদ্ধের বন্দীদের নিকট কাপড় ছিল না। হুযুর (সাঃ) সবাইকে কাপড় দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন; কিন্তু হযরত আব্বাস (রাঃ)-এত দীর্ঘকায় ছিলেন যে, কারো জামা তাঁর গায়ে লাগেনি। তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই (মুনাফিক সর্দার) তাঁকে তার নিজের জামা দিয়েছিলেন।
শিক্ষার উন্নয়নে যুদ্ধ-বন্দীগণ
যুদ্ধ-বন্দীদের মধ্যে যারা ফিদয়া বা মুক্তিপণ আদায় করতে সক্ষম ছিল না, তাদের মধ্যে যারা লেখাপড়া জানতো, তাদেরকে বলা হলো যে তোমরা দশ দশটি শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। এটাই তোমাদের ফিয়া। হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) এভাবে লেখাপড়া শিখেছিলেন।
কয়েকটি ঘটনা
যুদ্ধ শেষে যখন হযরত (সাঃ) বদর প্রান্তর হতে ফিরে আসেন, তখন লোকেরা হযরতের কন্যা হযরত রুকাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে হাত মুছছিলেন। এ বৎসরই বদর যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর সর্বপ্রথম ঈদুল ফিত্রের নামায পড়া হয়। রমযানের রোযা, সদকাতুল ফিতর এবং যাকাত এ বৎসর ওয়াজিব হয়। ঈদুল আযহার নামায এবং কুরবানীও এ বৎসর ওয়াজিব হয়। এ বৎসরের যিলহজ্জ মাসে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
গাযওয়ায়ে গাতফান
৩ হিজরীতে দু'সুর বিন হারিস মুহারিবী ৪৫০ জন সৈন্য নিয়ে পবিত্র মদীনা আক্রমণ করার জন্য রওয়ানা হল। হযরত (সাঃ) আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসলেন। তখন সবাই পলায়ন করে পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। নবী করীম (সঃ) নিরাপদে ময়দান থেকে ফিরে আসেন। ঐ সময় ঘটনাক্রমে বৃষ্টিতে হযরত (সাঃ)-এর কাপড় ভিজে যায়। তিনি এগুলো শুকাবার জন্য একটি, বৃক্ষের উপর বিছিয়ে দিলেন এবং নিজে ঐ বৃক্ষের নীচে শুয়ে পড়লেন। এদিকে পাহাড়ের উপর থেকে দু'সুর দেখছিল। যখন সে দেখে যে, হুযুর (সাঃ) নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছেন, তখন সোজা হুযুর (সাঃ)-এর পবিত্র মাথার নিকট এসে উপস্থিত হলো এবং তলোয়ার উঁচু করে সামনে এসে বললো, "বলো এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে?" কিন্তু বিপরীতে ছিলেন আল্লাহ্ তা'আলার রাসূল। কোন ভয়-ভীতি'বা আশঙ্কা ছাড়াই তিনি জবাব দিলেন, "হ্যাঁ, আল্লাহ্ তা'আলাই আমাকে রক্ষা করবেন।" এ কথা শুনেই দু'সুরের শরীরে কম্পন শুরু হয়ে গেল এবং তলোয়ার তার হাত থেকে পড়ে গেল। তখন নবী করীম (সাঃ) তলোয়ার উঠিয়ে বললেন, "তুমি এখন বলো, তোমাকে কে রক্ষা করবে?" "কেউ নেই। "এছাড়া তার কাছে আর কি জওয়াব থাকতে পারে। তার অসহায় অবস্থা দেখে হুযূর (সাঃ)-এর করুণা হলো। তিনি তাকে মার্জনা করে মুক্তি দিয়ে দিলেন। দু'সুর এখান থেকে উঠলেন এবং এ প্রতিক্রিয়া নিয়ে উঠলেন যে, তিনি শুধু মুসলমানই হলেন না; বরং নিজের গোত্রের মাঝে গিয়ে ইসলামের একজন বিরাট প্রচারকে পরিণত হলেন।
হাফসা ও যয়নাব (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ
৩ হিজরীর শাবান মাসে উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রাঃ) এবং রমযান মাসে হযরত যয়নাব বিনতে খুজায়মার সাথে হযরত (সাঃ)-এর শাদী মুবারক সংঘটিত হয়।
গাযওয়ায়ে উহুদ বা উহুদ যুদ্ধ
উহুদ মদীনার একটি পাহাড়ের নাম, মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে দুই মাইলের দূরত্বে অবস্থিত। এই পাহাড়ের পাদদেশেই তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে (জানুয়ারী, ৬২৬ খৃ.) মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যে সত্য-মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই পাহাড়ের নামানুসারে এই যুদ্ধের নামকরণ করা হয়েছে উহুদের যুদ্ধ।
বদর যুদ্ধে পরাজিত মুশরিকরা বৎসর শেষে যখন কিছুটা সুস্থ অবস্থায় ফিরে এল, তখন তাদের মধ্যে প্রতিশোধের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠলো। এবার তারা একান্ত প্রস্তুতির সাথে মদীনা আক্রমণ করার ইচ্ছা করলো। এ উদ্দেশ্যে ৩ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী পরিপূর্ণ রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হলো, যাদের সাথে ৭ শত হাতিয়ার, ২ শত ঘোড়া, ৩ হাজার উট ছিল। সাথে ১৪ জন রমণী এ উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, যেন পুরুষদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে আর যদি পলায়ন করে, তবে ভর্ৎসনা করে লজ্জা দেবে।
একদিকে হযরত (সাঃ)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ), যিনি ঐ সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তখনো মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি সমুদয় ঘটনা ও অবস্থা লিখে একজন দ্রুতগামী দূতের মাধ্যমে হযরত (সাঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হযরত (সাঃ) খবর পাওয়ার পর দুই ব্যক্তিকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য পূর্বাহ্নে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা এসে খবর দিলেন যে, কুরায়শ বাহিনী মদীনা পৌঁছেছে। শহরের উপর আক্রমণের আশংকা হেতু চতুর্দিকে পাহারার ব্যবস্থা করা হলো। সকালে সাহাবায়ে কিরাম-এর সাথে পরামর্শের পর এক হাজার সাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে মদীনার বাহিরে আগমন করলেন। এদের সাথে মুনাফিক আবদুল্লাহ বিন উবাই এবং তার ৩ শত সমমনা মুনাফিক ছিল; কিন্তু এদের সবাই পথিমধ্যেই ফিরে গেলো। এখন মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র সাত শত অবশিষ্ট রইল।
0 Comments