বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মর্যাদা

        হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, হারেসা ইবনে সুরাকা ছিল একজন বালক। সে বদর যুদ্ধে শহীদ হয়। তার মা নবী করীম করীম (সঃ)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হারেসা আমার কত আদরের তা আপনি অবশ্যই জানেন। যদি সে জান্নাতবাসী হয়ে থাকে, তা হলে আমি ধৈর্য ধারণ করব এবং তার জন্য সওয়াবের আশা করব। অন্যথায় আপনি দেখতে পাবেন আমি কিরূপ কান্নাকাটি করি।

        এতন্ত্রবণে নবী করীম (সঃ) বললেন, ওহে, তোমার জন্য আফসোস। তুমি কি শোকে পাগল হয়ে যাবে। বেহেশত কি একটি? বেহেশত তো অনেক, আর তোমার পুত্র হারেসা জান্নাতুল ফেরদাউস লাভ করেছে।

        হযরত আলী (রাঃ)-থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে) আমাকে এবং আবূ মারসাদ ও যোবায়রকে 'রওযায়ে খাখ' নামক জায়গায় যাওয়ার আদেশ দিয়ে বললেন, তোমরা সেখানে গিয়ে এক মুশরিক মহিলাকে দেখতে পাবে। তার নিকট মক্কার মুশরিকদের কাছে লিখিত 'হাতেব ইবনে আবী বালতাআর লিখিত একখানাপত্র আছে (পত্র খানা নিয়ে আসবে)।

        হযরত আলী (রাঃ) বলেন, আমরা সবাই ঘোড়ায় আরোহণ করে তাড়াতাড়ি রওয়ানা হলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশিত স্থানে গিয়ে উক্ত মহিলাকে ধরে ফেললাম। সে তখন উটের পিঠে করে পথ চলছিল। আমরা তাকে বললাম, তোমার কাছে যে পত্রখানা আছে তা বের কর। সে বলল, আমার কাছে কোন পত্র নেই। আমরা তখন তার উটটি বসিয়ে তাকে তল্লাশি করতে লাগলাম, কিন্তু তার কাছ থেকে কোন পত্র বের করতে পারলাম না। আমরা তখন বললাম, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কথা মিথ্যা হতে পারে না। সুতরাং তুমি ভাল চাইলে পত্রখানা বের করে দাও। নতুবা আমরা তোমাকে উলঙ্গ করে তল্লাশি চালাব। আমাদের কঠোর মনোভাব লক্ষ্য করে মহিলা তার কোমরের পরিধেয় বস্ত্রের গিট হতে কাপড়ের পুটুলির মধ্য থেকে তা বের করে দিল।

        পত্রখানা নিয়ে আমরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে পৌঁছলাম। সব জেনে শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)।এ তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং মো'মেনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনি অনুমতি দিন, আমি এ পত্র লেখকের গর্দান উড়িয়ে দেই, কিন্তু নবী করীম (সঃ) পত্র লেখক হাতেব বিন আবু বালতা'আ (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে হাতেব! তুমি এরূপ কাজ করলে কেন? তখন হযরত হাতেব বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি এ কাজ এ জন্য করিনি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করি না। বরং এ কাজ করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য মক্কাবাসী কাফেরদের প্রতি কিছু ইহসান করা। যাতে মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে তাদের অনিষ্ট থেকে আমার ধন সম্পদ এবং পরিবার পরিজন রক্ষা পায়।

        আর আপনাদের এবং সাহাবীদের সবারই কোন না কোন গোত্রীয় বা বংশীয় আত্মীয়স্বজন মক্কায় রয়েছে, যাদের মাধ্যমে আল্লাহর মেহেরবানীতে তাদের সম্পদ ও পরিবারবর্গ রক্ষা পাবে। এ সব কিছু শুনে নবী করীম (সঃ) বললেন, হাতেব ঠিকই বলেছে। তোমরা তার বিষয়ে উত্তম কথা ছাড়া আর কিছুই বলবে না। তখনো হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং মো'মেনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। তখন রাসূল (সঃ) হযরত ওমর (রাঃ)-কে বললেন, সে কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি? তার পর বললেন, আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা যেমন ইচ্ছা কর, জান্নাত তোমাদের জন্য অবধারিত। অথবা বলেছেন (বর্ণনাকারীর সন্দেহ), আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এতন্ত্রবণে হযরত ওমরের দু'নয়ন অশ্রুসজল হয়ে উঠে। তিনি বললেন, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-ই সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী।

        বারা' বিন আযেব (রাঃ) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন নবী করীম (সঃ) আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়র (রাঃ)-কে তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন। এ যুদ্ধের দিন কাফেররা আমাদের সত্তর জনকে শহীদ করেছিল। আর বদর যুদ্ধের দিন নবী করীম (সঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ মুশরিকদের একশত চল্লিশ জনকে গ্রেফতার করেছিলেন। তার মধ্য থেকে সত্তর জনকে হত্যা এবং সত্তর জনকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়েছিল। ওহুদের দিন যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান বলল, আজকে বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া হল। আর যুদ্ধ তো কূপ থেকে পানি উঠানোর পাত্রের ন্যায় (অর্থাৎ পানির পাত্র যেমন হাত বদল হতে থাকে, তেমনি যুদ্ধেও সব সময় বিজয় শুধু এক পক্ষের হয় না)।

        আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন সৈনিকদের সারিতে দাঁড়িয়ে আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম, আমার ডানে বামে দু'জন অল্প বয়স্ক বালক দাঁড়িয়ে আছে। পার্শ্বে দু'জন অল্প বয়স্ক বালক থাকায় আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলাম না। এ সময় তাদের একজন অন্যজন থেকে গোপনে গোপনে আমাকে বলতে লাগল, চাচাজান। আধু জাহলকে আমাকে একটু দেখিয়ে দিন তো। আমি তাকে বললাম, হে ভাতুপুত্র। আবু জাহলকে নিয়ে তুমি কি করবে? সে বলল, আমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি, দেখা পেলে আমি তাকে হত্যা করব অথবা নিজেই মৃত্যুবরণ করব। অন্যজনও তার সঙ্গীকে গোপন করে আমাকে একই কথা জিজ্ঞেস করল।

        আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) বলেন, তখন তাদের দু'জনের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হল। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম। আমি দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের পার্শ্বেই আছি। আমি তখন ইশারায় তাদের দু'জনকেই আবু জাহলকে দেখিয়ে দিলাম। তারা তখন শিকারী বাঘের মত তৎক্ষণাৎ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। আর এরা দু'জন ছিল আফবার-দু'পুত্র।

        আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এক সময় আসেম ইবনে ওমর ইবনে খাত্তাবের নানা আসেম ইবনে সাবেত আনসারীর নেতৃত্বে দশ জন সাহাবীরএকটি দলকে গোয়েন্দাগিরির জন্য মক্কার দিকে পাঠান। তাঁরা উদ্‌ফান এবং মক্কার মধ্যবর্তী হান্দাহ নামক স্থানে পৌঁছলে হুয়ায়ল গোত্রের শাখা বনু লেহইয়ানকে তাদের আগমনের কথা জানায়। তারা একশ' জন তীরন্দাজ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাঠালে তারা তাদের পায়ের চিহ্ন ধরে এমন একস্থানে গিয়ে পৌঁছল, যেখানে বসে তাঁরা খেজুর খেয়েছিলেন। উক্ত তীরন্দাজ দল আঁটি দেখে বুঝতে পারল, এ ইয়াসরেবের খেজুরের আঁটি। তাই তারা পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাঁদেরকে খোঁজ করতে লাগল। হয়রত আসেম ও তাঁর সঙ্গীগণ বনু লেহইয়ান গোত্রের। তীরন্দাজদেরকে দেখতে পেয়ে আত্মরক্ষার্থ এক পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিলে এরা সে স্থান ঘিরে ফেলে।

        তারা মুসলমানদেরকে পাহাড় থেকে অবতরণ করে আত্মসমর্পণ করার আহবান জানিয়ে বলল, আমরা তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তোমাদের কাউকে হত্যা করব না। এতন্ত্রবণে দলপতি হযরত আসেম ইবনে সাবেত (রাঃ) বললেন, হে আমার সঙ্গী ভাইয়েরা। আমি কাফেরের নিরাপত্তায় আশ্বস্ত হয়ে অবতরণ করব না। তার পর তিনি বললেন, হে আল্লাহ। আমাদের খবর তোমার নবীকে পৌঁছে দাও। এর পর তারা তীর ছুঁড়ে হযরত আসেমকে শহীদ করলে অবশিষ্ট তিন জন হযরত থোবায়ব, যায়েদ ইবনে দাসেনা এবং অন্য এক ব্যক্তি কাফেরদের ওয়াদায় বিশ্বাস করে পাহাড় চূড়া থেকে নেমে পড়েন। তারা আত্মসমর্পণ করলে কাফেররা নিজেদের ধনুকের রশি খুলে তাদেরকে বেঁধে ফেলে। এ দেখে তৃতীয় জন বলল, এ তল প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। আল্লাহর কসম। আমি তোমাদের সাথে যাব না। আমি আমার সাথীদের সাথেই থাকব, অর্থাৎ মৃত্যু বরণ করব। তারা তাকে বহু টানা হেঁচড়া করল, কিন্তু তিনি তাদের সাথে যেতে অস্বীকার করেন (অবশেষে তারা তাঁকে হত্যা করল)।

        অতঃপর হযরত সোবায়ব ও যায়েদ ইবনে দাসেনা (রাঃ)-কে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। এটা ছিল বদর যুদ্ধের পরের ঘটনা। বনী হারেস ইবনে আমের ইবনে নওফেল হযরত গোবায়বকে খরিদ করে। কারণ বদর যুদ্ধে তিনিই হারেস ইবনে আমেরকে হত্যা করেছিলেন। হযরত খোবায়ব (রাঃ) তাদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটাতে লাগলেন। পরে তারা হযরত খোবায়ব (রাঃ)-কে হত্যা করতে মনস্থ করে। এ খবর জানতে পেরে হযরত খোব্যয়ব (রাঃ) হারেসের কোন এক কন্যার নিকট থেকে ক্ষৌরকর্মের জন্য একখানা ক্ষুর চেয়ে নিলেন। ইতোমধ্যে (হারেসের কন্যার) অসতর্ক অবস্থায় তার এক ছোট বাচ্চা হযরত খোবায়বের কাছে গিয়ে পৌঁছে। হারেসের কন্যা দেখতে পেল, খোবায়ব (রাঃ) তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রানের উপর বসিয়ে ক্ষুরখানা হাতে ধরে আছে। হারেসের কন্যা বর্ণনা করে, আমি তখন খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়লে হযরত খোবায়ব (রাঃ) তা বুঝতে পারেন। তিনি মহিলাকে বললেন, আমি তাকে হত্যা করব বলে তুমি কি ভয় পেয়েছ? তুমি জেনে রেখ, আমি কখনো তা করব না।

        সে (হারেসের কন্যা) বর্ণনা করেন, আল্লাহর শপথ, আমি হযরত খোবায়ব (রাঃ)-এর মত এত উত্তম কয়েদী আর কখনো দেখিনি। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একদিন আমি তাঁর হাতে আঙ্গুরের ছড়া দেখতে পেয়েছি, সে তা হতে খাচ্ছে। অথচ সে লোহার শিকলে আবদ্ধ ছিল। আর সে সময় মক্কায় কোন ফল ছিল না। পরবর্তীকালে হারেসের কন্যা বলত, এ আঙ্গুর আল্লাহর তরফ থেকে হযরত খোবায়বের জন্য রিযিক হিসেবে এসেছিল।

        পরে কাফেররা হযরত খোবায়ব (রাঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশে যখন হেরেমের বাইরে নিয়ে চলল, তখন তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা আমাকে দু'রাকআত নামায পড়তে দাও। কাফেররা সুযোগ দিলে তিনি দু'রাকআত নামায পড়ে বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি তোমরা এ কথা মনে না করলে আমি নামায আরো দীর্ঘায়িত করতাম।

         এর পর তিনি এ বলে দোআ করলেন, হে আল্লাহ! তুমি তাদেরকে ধ্বংস করে দাও। তাদেরকে বিক্ষিপ্তভাবে হত্যা করো। একজনকেও জীবিত রেখো না। তার পর তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন- আমি যখন মুসলমানরূপে নিহত হচ্ছি, তখন মোটেই পরওয়া করছি না, মৃত্যুর মুহূর্তে কোন পার্শ্বে ঢলে পড়ব।

        আমার এ কোরবানী যেহেতু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, তাই তিনি ইচ্ছা করলে প্রতিটি কর্তিত অঙ্গের বিনিময়ে বরকত প্রদান করবেন। এর পর হারেসের পুত্র আবূ সারওয়া ওকবা হযরত খোবায়ব (রাঃ)-কে শহীদ করে। আর এভাবেই হযরত খোবায়ব (রাঃ) সে সকল মুসলমানের জন্য দু'রাকআত নামায (সুন্নত হিসেবে) চালু করলেন, যারা অসহায় অবস্থায় ধৈর্যের সাথে শত্রুর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।

        এদিকে নবী করীম করীম (সঃ) সে দিনই সাহাবীদেরকে হযরত আসেম ও তাঁর বন্ধুদের শাহাদাত লাভের কথা অবহিত করেন। কোরায়শদের কাছে হযরত আসেমের নিহত হওয়ার খবর পৌঁছলে তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আসেমের শরীরের কোন অঙ্গ কেটে আনার জন্য লোক পাঠায়। কেননা বদর যুদ্ধে হযরত আসেম (রাঃ) তাদের এক বড় নেতাকে হত্যা করেছিলেন, কিন্তু তারা হযরত আসেমের কোন অঙ্গ কেটে নিতে সক্ষম হল না। আল্লাহ তা'আলা এক ঝাঁক বিষাক্ত মৌমাছি বা ভীমরুল পাঠিয়ে কুরাইশদের হাত থেকে হযরত আসেমের দেহ রক্ষা করেন, যাতে তারা তাঁর দেহের কোন অঙ্গ কেটে নিতে না পারে।

Post a Comment

0 Comments