হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শেষরোগ শয্যায় শায়িত অবস্থায় সামান্য সুস্থবোধ করিলে মসজিদে নবুবীতে সাহাবাদিগকে ডেকে বললেন- আমি তোমাদের মধ্যে অধিককাল ন্যই। তাই আমি তোমাদের নিকট হতে শেষ বিদায় নেওয়ার আগে বলি-যদি আমার নিকট কারও কিছু পাওনা থেকে থাকে, তবে সে যেন এখনই আমার নিকট হতে প্রাপ্য চেয়ে লয়। অথবা, যদি কারও উপর কোনরূপ জুলুম-অত্যাচার করে থাকি, তবে সে যেন এখনই তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। কারণ কিয়ামতের দিন কেহ যেন আমার উপর কোনরূপ দাবী উত্থাপন করতে না পারে। হুজুর মসজিদে নবুবীতে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ওক্কাস নামক এক ব্যক্তি বলল-হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট আমার একটা দাবী আছে।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার নিকট তোমার কি দাবী আছে তা নির্ভয়ে খবলে বল, আমি এখনই তোমার সে দাবী পূরণ করব, যাহাতে 'কয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট তুমি আমার নামে কোন অভিযোগ করতে না পার এবং আমি এজ্জিত না হই। ওকাস বলল-ওহুদের যুদ্ধের সময় আপনি যখন ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করছিলেন, সেই সময় আমি আপনার পাশেই ছিলাম। আপনি আপনার ঘোড়াকে খুব জোরে চাবুকের আঘাত করেছিলেন, কিন্তু সেই আঘাত ঘোড়ার শরীরে না লেগে আমার শরীরে লেগেছিল। আপনি হয়তো তা লক্ষ্য করেন নাই, কিন্তু আমি সে আঘাতের কথা আজও ভুলি নাই এবং কোন দিন ভুলব না। আজ আমি তার প্রতিশোধ নিতে চাই। যদি তার প্রতিশোধ নিতে না পারি তবে কিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই আমি আমার এই দাবী উত্থাপন করব।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন-ভাই ওক্কাস। তোমার উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলাম এই জন্য যে, তুমি লজ্জাবশতঃ গোপন না রেখে অকপটে তোমার দাবী প্রকাশ করেছ। তোমাকে এখনই অশ্বের চাবুক আনাইয়া দিচ্ছি-তুমি আমাকে এখনই চাবুকের দ্বারা আঘাত করে প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তথাপি কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট আমাঃ নামে কোন অভিযোগ উত্থাপন করো না। হযরতের আদেশে তখনই একটা চাবুক আনাইয়া ওক্কাসের হস্তে প্রদান করা হল। ওক্কাস বলল-যখন আপনি আমাকে কোড়া মেড়েছিলেন, তখন আমার শরীরে কোন জামা ছিল না, সুতরাং আমিও আপনার বস্ত্রহীন পৃষ্ঠেই আঘাত করতে চাই।
এক্কাসের এরূপ বেআদবীপূর্ণ দাবী দেখে সাহাবাগণ সকলেই নিতান্ত দুঃখিত হলেন। তারা সকলেই বলতে লাগলেন, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এমনিতেই অসুস্থ। এই অবস্থায় তাকে কোড়ার আঘাত করলে তিনি আরো কাহিল হবেন। অতএব ভাই ওক্কাস, তোমাকে আমরা বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, তুমি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ক্ষমা করে দাও এবং তোমার দাবী উঠিয়ে নাও। ওক্কাস উত্তর করল-আপনাদের অনুরোধে আমি এখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কোড়া মারা হতে ক্ষান্ত থাকতে পারি, কিন্তু আমার দাবী আমি কিছুতেই ত্যাগ করব না। এখন না হলেও কিয়ামতের দিন আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করবই।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন-ভাই ওক্কাস! তুমি কারও কোন কথায় কান দিও না। তোমার হাতে কোড়া দেওয়া হয়েছে, আমি আমার শরীরের জামা খুলে ফেলছি, তুমি একটি আঘাতের পরিবর্তে ইচ্ছা হলে আমাকে দশটি আঘাতও করতে পার, তাতে আমার কোনই আপত্তি নাই। কিন্তু তোমাকে আমার বিশেষ অনুরোধ এই যে, তোমার দাবী তুমি দুনিয়াতেই পূরণ করে লও-আখেরাতে তুমি আমাকে আল্লাহর সামনে লজ্জিত করো না।
ওক্কাস কোড়া হাতে নিয়ে আল্লাহর নবীকে প্রহার করতে উদ্যত হল। সকলেই হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাকে বাধা দিয়ে বললেন-ভাই ওক্কাস। তুমি এত বড় নিষ্ঠুর! যদি তুমি সত্যই তোমার দাবী ত্যাগ না করতে চাও, তবে তুমি আমার শরীরে একশত আঘাত করে তোমার মনের ক্ষোভ মিটাও।
ওক্কাস উত্তর করল-একজনের পরিবর্তে অন্যজনকে আমি আঘাত করে পাপী হতে পারব না এবং তাতে আমার মনের দুঃখ মিটবে না, আমার দাবীও পূরণ হবে না। আপনারা সকলেই যদি আমাকে এভাবে বাধা দিতে থাকেন, তবে আজ থাকুক, আমি কিয়ামতের দিন আমার দাবী আল্লাহর নিকট পেশ করবই-সেদিন তো কেহ আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।
হুজুর (সা) বলেন-ভাই ওক্কাস। তুমি কারও কোন কথায় কর্ণপাত করো না- এখনই তুমি প্রতিশোধ গ্রহণ কর। হুজুর তার দেহের জামা খবলে ফেললেন। ওক্কাস কোড়া হস্তে হযরতের দিকে অগ্রসর হয়ে তার পিঠের দিকে গমন করল। সকলেই আবার হায় হায় করতে লাগল।
কি আশ্চর্য ব্যাপার! ওক্কাস কোড়া হস্তে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিঠের দিকে গমন করেই বসে পড়ল এবং কোড়াটা দূরে নিক্ষেপ করে হযরতের পবিত্র পৃষ্ঠে চুম্বন করল। সকলে বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন, কি আক্কাস। তোমার কি হল, প্রতিশোধ গ্রহণ করলে না? আক্কাস উত্তর করল, করেছি।
সকলে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি খুলে বল।
আমি জানতাম যে, হযরতের পৃষ্ঠদেশে মোহরে নবুয়ত আছে, এবং তাও জানতাম যে, যেই ব্যক্তি উহা দর্শন ও চুম্বন করতে পারবে, তার জন্য দোজখের অগ্নি হারাম। তাই এইরূপ ছল করে আমি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মোহরে নবুয়ত দর্শন ও চুম্বন করে নিজের জীবনকে সার্থক করলাম। হযরতের উপর আমার আর কোন দাবী নাই। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
0 Comments