আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে চিন্তার ধারা

         প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ যে, আল্লাহ ব্যতীত যত বস্তুর অস্তিত্ব আছে, সবই আল্লাহর শিল্প কার্য ও সৃষ্টি। যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুর মধ্যে প্রাণ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গুণ আছে তার মধ্যে অলৌকিক ও বিস্ময়কর ব্যাপার আছে। আল্লাহর কৌশল, শক্তি, মহত্ব ও গৌরব তদ্বারা প্রকাশ পায়। তার সংখ্যা গণনা করা অসম্ভব। যদি দুনিয়ার যাবতীয় সমুদ্রের পানি কালি হত তাহলে আল্লাহর গুণাবলী লেখা শেষ হবার পূর্বেই সমস্ত কালি নিঃশেষ হয়ে যেত। তবে আমরা তাঁর সম্বন্ধে কিছু কথা উল্লেখ করব। আমরা বলব যে, এই সৃষ্টিজগত দু'ভাগে বিভক্ত। একভাগ যার মূল আমাদের অজ্ঞাত। তার সম্বন্ধে চিন্তা করাও সম্ভব নয়। বহু বস্তু আছে যেগুলো সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, "সুবহানাল্লাযী খালাজ্বাল আযওয়াজ্য কুল্লাহা মিম্মা তুমবিতুল আরস্থ অমিন আনফুসিহিম ওয়া মিম্মা লা ইয়া'লামুন।" অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সমস্ত বন্ধু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। যা ভূমি থেকে উৎপন্ন হয় এবং যা তাদের মধ্য থেকে হয় এবং যা এমন বস্তু থেকে হয় যা তারা জানে না। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, "ওয়া নানশায়াকুম ফীমা লাতা'লামূন।" অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে এমন অবস্থায় উপনীত করব যা তোমরা অবগত নও।

        অন্যভাগ এমন বস্তু, যা জানা যায়; কিন্তু তার বিশ্লেষণ জানা যায় না, তার বিশ্লেষণের বিষয় আমাদের চিন্তা করা সম্ভব। তাও আবার দু'ভাগে বিভক্ত। যেমন (১) আমরা চক্ষু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখি এবং (২) যা আমরা তদ্বারা দেখি না। যে সব বস্তু আমরা দেখি না, তা' হল জ্বিন, ফিরেশতা, শয়তান, আরশ, কুরসী ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চিন্তার ক্ষেত্র আছে। যা আমাদের বুঝের নিকটবর্তী, তাই আমরা বর্ণনা করব। অর্থাৎ চক্ষুর দ্বারা যা দর্শন করা যায়, তা' এই সাত আসমান ও যমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে। আকাশে চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি এবং তাদের গতিবিধি অস্ত উদয় দেখা যাচ্ছে। দুনিয়া তার পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সমুদ্র-মহাসমুদ্র, উদ্ভিদ, ভূচর, খেচর, জলচর অর্থাৎ আকাশ ও যমিনের মধ্যে যে সব বস্তু আছে, তা' সবই দৃষ্ট হয়। মেঘ, বৃষ্টি, শিল, বরফ, বিদ্যুত, মেঘ গর্জন, বায়ু প্রবাহ, বজ্রপাত, রংধনু শূন্যে দেখা যাচ্ছে। আকাশ ও যমিনে এ সব বস্তু দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেক শ্রোণীর বস্তু আবার বিভিন্ন প্রকার এবং প্রত্যেক প্রকারের আবার বিভিন্ন বিভাগ আছে। তার আবার কত শাখা-প্রশাখা আছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ সবই চিন্তার বিষয়। দুনিয়ার মধ্যে খনিজ পদার্থ বা উদ্ভিদ নড়াচড়া করে না, দুনিয়ার সুবিস্তির্ণ যমিন ও আকাশের তারকা রাজিও নড়াচড়া করতে পারে না, যদি আল্লাহ তাদেরকে নাড়াচাড়া না করেন। তাদের গতিবিধিতে শত সহস্র কৌশল বিদ্যমান। এসবই আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং গৌরব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিচ্ছে। এসব আয়াত সম্বন্ধে চিন্তা করার জন্য আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "ইন্না ফী খালকূিস সামাওয়াতি অল আরদ্বি অখতিলাফিল্লাইলি অন্নাহারি লা আয়াতিল লিউলিল আলবাব" অর্থাৎ নিশ্চয়ই আসমান ও যমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং দিবা ও রাত্রির পরিবর্তনের মধ্যে জ্ঞানী লোকদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে। কুরআনে পাকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নির্দশনের উল্লেখ আছে। কোন কোন নিদর্শনের বিষয় চিন্তা সম্পর্কিত বর্ণনা আমরা এখন পেশ করব।

        আল্লাহর নিদর্শনঃ তুমি মানুষ একটি ক্ষুদ্র শুক্রকীট দ্বারা সৃষ্ট। তোমার শরীরই তোমার অধিক নিকবর্তী। তোমার মধ্যে এমন বিস্ময়কর বস্তু আছে, যা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়। সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা বা গবেষণা করতে গিয়ে তোমার কয়েক পুরুষ কাটিয়ে দিলেও এবং এজন্য বহু মানুষের প্রাণ নষ্ট করে চেষ্টা চালালেও কোন হদিস পাবে না। তুমি এ কথার প্রতি বিশ্বাস রাখলেও তুমি তার প্রতি উদাসীন ও অজ্ঞ। অনেক সময়ে তুমি অন্যের পরিচয় জানতে চাও, যখন আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাবে তোমাকে তোমার নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করতে বলেছেন? আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "অফী আনফুসিকুম আফালা তুবছিরূন" অর্থাৎ তোমাদের নিজেদের মধ্যে কি তোমরা লক্ষ্য করছ না? আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তুমি এক বিন্দু অপবিত্র শুক্র দ্বারা সৃষ্ট। আল্লাহ বলেন, হতভাগ্য মানুষ, সেকি অপবিত্র। কোন বন্ধুদ্বারা আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন? এক বিন্দু শুক্র দ্বারা তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর ঠিক অনুপাতে তাকে গঠন করেছেন, তারপর তিনি তার পথকে সহজ করেছেন। তারপর তিনি মৃত্যু সাধন করতঃ তাকে কবরস্থ করেন। তারপর যখন তিনি ইচ্ছা করবেন, তাকে পুনরুত্থান করবেন। আল্লাহ বলেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদেরকে মৃত্তিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তারপর তোমরা মানুষ রূপে চলাফেরা করছ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তুমি কি শুক্র থেকে সৃষ্টি নোৎফা ছিলে না? তারপর কি রক্তখন্ড ছিলে না? তারপর তিনি আকৃতি দান করলেন এবং সমান অনুপাতে গঠন করলেন। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছেঃ "আলাম ইয়াকু নুত্বফাতাম মিম্ মানিয়্যিই ইয়ুমনা-ছুম্মা কানা আলাক্বাতাব ফাখালাক্বা ফাসাওয়্যা"। আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেনঃ "আলাম নাখলুকু কুম মিম্ মায়িম মাহীন, ফাজাআলনাহু ফী কারারিম্ মাকীনিন ইলা কাদারিম মা'লুম" অর্থাৎ আমি কি তোমাদেরকে ঘৃণিত শুক্র হতে সৃষ্টি করি নি? তারপর নির্দিষ্ট স্থানে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে স্থাপন করি নি? আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেনঃ আওয়ালাম ইয়ারাল ইনসানু আন্না খালাকুনাহু মিন নুত্বফাতিন ফাইযা হুয়া খাছীমুম্ মুবীন" অর্থাৎ আমি মানুষকে মিলিত রক্তবিন্দু দ্বারা সৃষ্টি করেছি। তারপর তিনি উল্লেখ করলেন, কিরূপে তিনি এই নোফাকে জমাট রক্তবিন্দুতে পরিণত করলেন। এই রক্তপিন্ড আবার মাংসপিন্ড এবং এই মাংস পিণ্ডকে হাড়ে পরিণত করেছেন। আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে শুষ্ক ঠনঠনে মৃত্তিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছি। তারপর একটি বিশ্রাম স্থলে তাকে নোতফার আকৃতিতে স্থাপন করেছি। তারপর নোতফাকে রক্তপিন্ড আয়াত-----

        নোতফার উল্লেখের উদ্দেশ্যঃ মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে নোতফা শব্দটির বার বার উল্লেখের উদ্দেশ্য শুধু শব্দোচ্চারণ করা নয় এবং তদসম্বন্ধে চিন্তা ত্যাগ করা নয়। 'নোতফা' বস্তুটির দিকে লক্ষ্য কর। তা' একটি অপবিত্র পানির বিন্দু। যদি তুমি তাকে কিছু সময় পর্যন্ত শূন্যস্থলে রেখে দাও তা পচে নষ্ট হয়ে যাবে। এখন লক্ষ্য কর, কিরূপে মহাপ্রভু পুরুষের পৃষ্ঠদেশ এবং রমণীর বক্ষদেশ থেকে নোতফা বের করে মিশ্রিত করেছেন, কিরূপে তিনি পুরুষ ও নারীকে একত্র করেছেন এবং তাদের মনে প্রীতি ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন। তারপর এই ভালবাসা ও কামভাবকে তাদের মধ্যে উত্তেজিত করে তাদেরকে সঙ্গম করিয়েছেন এবং এই সঙ্গমের ফলে নোতফা পুরুষের পৃষ্ঠদেশ হতে বের করেছেন এবং কিরূপে তিনি তার সাথে রমণীর ঋতু রক্ত বিন্দু মিলিত করে তা' ডিম্বকোষে স্থাপন করছেন। তারপর কিরূপে তিনি নোতফা থেকে এই ভ্রূণ সৃষ্টি করে তাকে ঋতুর রস পান করিয়ে তার জীবিকার সংস্থান করেছেন এবং তাকে বর্দ্ধিত করেছেন। তিনি নোতফাকে উজ্জ্বল শুদ্র পদার্থ এবং রক্তপিও করেছেন। তারপর তিনি রক্তপিণ্ডকে মাংসে পরিণত করেছেন। তারপর কিরূপে তিনি এই নোতফার বিভিন্ন অংশ পৃথক পৃথক করে দিয়েছেন। তা' থেকে মাংস, চর্ম, শীরা, স্নায়ু, অস্থি প্রস্তুত করেছেন। তারপর কিরূপে তিনি এসব বস্তু থেকে মস্তক, কর্ণ, চক্ষু, নাসিকা, মুখ এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি কিরূপে হস্ত ও পদ বিস্তৃত করে দিয়েছেন এবং তার অগ্রভাগ অঙ্গুলী দ্বারা সুশোভিত করছেন আর অঙ্গুলীর অগ্রভাগে নখর দিয়েছেন। তা' ছাড়া তিনি অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েছেন। হৃদয়, পাকস্থলী, যকৃত, হৃদপিণ্ড, রক্তাধার, ফুসফুস, প্লিহা, বাচ্চাদানী, মূত্রকোষ ও নাড়িভুড়ি ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটিরই বিশেষ আকৃতি ও পরিমাণ আছে এবং পৃথক পৃথক বিভিন্ন কাজের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আবার এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে তিনি কিরূপে অন্য রূপ ভাগ ভাগ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments