অপ্রিয় কার্যের চিন্তার তিনটি বিষয়

        প্রত্যেক অপ্রিয় কার্য সম্বন্ধে চিন্তার তিন প্রকার বিষয় আছে। প্রথম বিষয় এই যে, এই কাজটি আল্লাহর নিকট প্রিয় বা অপ্রিয়। অনেক কাজ আছে, যার দোষ সহজে প্রকাশ পায় না। গভীর চিন্তার সাহায্যে তা' স্থির করতে হয়। দ্বিতীয় বিষয় এই যে, যদি তা' মন্দ হয়, তা' দূর করার উপায় চিন্তা করে ঠিক করা। তৃতীয় বিষয় এই যে, এই অপ্রিয় ব্যাপার কি বর্তমানের সাথে জড়িত যে, তা' ত্যাগ করা উচিত অথবা তা' ভবিষ্যতে যে, তা' থেকে সতর্ক হওয়া উচিত অথবা তা' অতীত হয়ে গেছে যে, তার বিষয় অনুসন্ধান করা উচিত এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করা। তদ্রূপ প্রত্যেক প্রিয় বস্তু এই তিনভাগে বিভক্ত হয়। যখন এসব বিভাগ একত্র হয়, তখন চিন্তার স্রোত এসব বিভাগের মধ্যে শতগুণ বর্দ্ধিত হয়। বান্দা তখন সমস্ত বিষয়ের চিন্তার মধ্যে বা অধিকাংশ বিষয়ের চিন্তার মধ্যে থাকে। এসব বিভাগের মধ্যে প্রত্যেকটি বিভাগের ব্যাখ্যা সুবিস্তৃত।

        চিন্তার বিষয়কে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ (১) পাপ (২) পুণ্য (৩) ধ্বংসকর দোষ এবং (৪) পরিত্রাণকর গুণ। আমরা এর প্রত্যেক বিষয় সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত পেশ করব। যেন ধর্মপথযাত্রী তদ্বারা অনুমান করে নিতে পারে, চিন্তার দ্বার তার নিকট উন্মুক্ত হয় এবং তার জন্য ঐ বিষয়ের বিভিন্ন পন্থা প্রকাশ পায়।

        চিন্তার প্রথম বিষয় পাপঃ মানুষ প্রত্যেক দিন প্রত্যুষে তার সপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিষয়ে, তারপর তার শরীর সম্পর্কিত বিষয়ে অনুসন্ধানে তৎপর হবে, কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোন পাপ করেছে বা করে নি। যদি তার দ্বারা কোন পাপ ঘটে থাকে, তখনই সে তা' পরিত্যাগ করবে। যদি গতকল্য তা' ঘটে থাকে, সে তাওবাহ করে তা ত্যাগ করবার জন্য চেষ্টা করবে এবং তজ্জন্য অনুতাপ করবে, যদি তা' দিবসে করার সম্ভাবনা থাকে, তা' হতে সতর্ক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে ও দূরে থাকবে।

        রসনা সম্পর্কে এরূপ চিন্তা করবে যে, এই রসনা পরনিন্দা, মিথ্যাকথন ইত্যাদি পাপ করতে পারে বা অন্যের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপ বা তার সাথে বিবাদ-বিসম্বাদ বা অনর্থক কথা এবং এরূপ দোষণীয় কার্যে লিপ্ত হতে পারে। প্রথমে নিজের মনের মধ্যে চিন্তা করে নিবে যে, আল্লহর নিকট এসব বিষয় দোষণীয় কার্য এবং কুরআন ও হাদীসে তার কঠিন শাস্তির বিষয় ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর তার অবস্থা এবং কিরূপে তা' সংশোধন করা যায় সে বিষয় চিন্তা করবে। তারপর তা' থেকে কিরূপে রক্ষা পাওয়া যায় সে বিষয়ও ভেবে দেখবে। তাতে জানতে। পারবে যে, নির্জনতা অবলম্বন ব্যতীত তা' সফল হবে না। অথবা ধার্মিক ও পরহেজগারদের সাহচর্য অবলম্বন করবে। যখনই কথোপকথন শুরু করতে যাবে আল্লাহ যে বাক্য অপছন্দ করেছেন তা' মন্দ মনে করবে। অন্যথায় যখন অন্যের সাথে সংসর্গ করবে, তখন মুখের মধ্যে প্রস্তর খণ্ড পুরে রাখবে। এটাই উক্ত মন্দ থেকে রক্ষা পাবার উপায়।

        কর্ণের বিষয়ে এরূপ চিন্তা করবে যে, কর্ণ পরনিন্দা, মিথ্যা কথন, অনর্থক বাক্য, অহেতুক হাস্য-কৌতুক এবং নানাপ্রকার মন্দ বিষয় শ্রবণ করতে পারে; সুতরাং মানুষের বাক্য যাতে কর্ণে না পৌঁছতে পারে তজ্জন্য নির্জনতা অবলম্বন করবে অথবা লোককে মন্দ কথা থেকে বারণ করে আত্মরক্ষা করবে। এ ব্যাপারে কোনস্থলে কিরূপ উপায় অবলম্বন করা যায় তা' চিন্তা করে স্থির করে নিবে।

        উদরের বিষয়ে এরূপ চিন্তা করবে যে, উদর হালাল খাদ্য অতিরিক্ত ভক্ষণ করে আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে। তা' আল্লাহর নিকট অতীব অপছন্দনীয়। অতি ভক্ষণ কামরিপুর শক্তিবর্ধক এবং কামরিপুই আল্লাহর শত্রু শয়তানের অস্ত্র। হারাম খাদ্যের লোভ সম্বন্ধে চিন্তা করবে যে, কোথা থেকে তোমার খাদ্য, পোশাক, আবাসগৃহ এবং ধন-সম্পদ ইত্যাদি আসে? হালাল জীবিকার পন্থা ও উপায় সম্পর্কে চিন্তা করবে। তারপর উপার্জনের কৌশল, পন্থা এবং হারাম থেকে রক্ষা পাবার উপায় সম্বন্ধে চিন্তা করবে এবং নিজেকে লক্ষ্য করে বার বার বলবে, "সমস্ত ইবাদাত হারাম খাদ্য ভক্ষণেই নষ্ট হয়ে যায়। হালাল খাদ্য ভক্ষণই সব ইবাদাতের মূল।" আল্লাহতায়ালা কোন বান্দার নামায কবুল করেন না, যার পরিধানের বস্ত্রের মূল্যের মধ্যে একটি হারাম মুদ্রাও থাকে, এই সম্বন্ধে বহু হাদীস রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে চিন্তা করবে। সংক্ষেপে এই পরিমাণ চিন্তাই যথেষ্ট। যখন এরূপ চিন্তা দ্বারা সত্য পরিচয় জ্ঞান এসব অবস্থার সাথে অর্জিত হয় তখন সমস্ত দিন মুরাকাবায় নিমগ্ন থাকবে যে পর্যন্ত না তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যায় কাজ থেকে রক্ষা পায়।

        চিন্তার দ্বিতীয় বিষয় পুণ্যঃ প্রথমতঃ, নির্দিষ্ট ফরজ কর্তব্যগুলোর দিকে লক্ষ্য করতে হবে। তা' তুমি কিরূপে আদায় করেছ? কিরূপে তা'হ্রাস ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছ? কিরূপে অধিক নফল ইবাদাত দ্বারা তার ক্ষতি পূরণ করেছ। তারপর এক এক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে আল্লাহর প্রিয় কার্যাবলীর বিষয় চিন্তা করবে। যথাঃ মনে মনে বলবে, আসমান ও যমিনের রাজত্বের দিকে লক্ষ্য করে অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য, আল্লাহর ইবাদাত কার্যে তা' নিযুক্ত করার জন্য এবং আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নত দেখার জন্য চক্ষু সৃষ্টি হয়েছে। আমি চক্ষুকে কুরআন ও হাদীস তিলাওয়াত করার জন্য নিযুক্ত করতে সমর্থ। তবে কেন আমি তা' করব না? আমি অমুক ধার্মিক ব্যক্তির প্রতি সম্মানের চক্ষু দ্বারা তাকাতে সমর্থ এবং তার অন্তরের গুপ্ত বিষয়ে প্রবেশ করতে সক্ষম। আমি অমুক পাপী ব্যক্তির দিকে ঘৃণার চোখে তাকাতে পারি এবং তাকে তার পাপ থেকে বিরত করতে পারি। তবে কেন তা' আমি করব না? তদ্রূপ কর্ণকে বলবে, আমি অনর্থক বাক্য না শুনে বরং জ্ঞানগর্ভ বাক্য শুনে জ্ঞান অর্জন করতে এবং কিরাআত ও যিকির শ্রবণ করতে সমর্থ। তবে কেন তা' আমি অবহেলা করব? আল্লাহতায়ালা আমাকে তাঁর নিয়ামত দিয়েছেন তজ্জন্য আমাকে শোকর করতে হবে। আমার কি হয়েছে যে, আমি অকৃতজ্ঞ হব এবং আল্লাহর নিয়ামতকে নষ্ট করব? তদ্রূপ রসনা সম্বন্ধে চিন্তা করবে এবং বলবে, শিক্ষাদান, ওয়াজ-নছিহতকরণ, ধার্মিক লোকদের হৃদয়ে ভালবাসা প্রদান, দরিদ্রদের অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধান। ধার্মিক লোকদের হৃদয়ে আনন্দ প্রদান ইত্যাদি কার্যগুলো দ্বারা মানুষের হৃদয়ে আনন্দ দান করতঃ আল্লাহর নিকটবর্তী হতে আমি সমর্থ। প্রত্যেক সুন্দর বাক্যই একটি সানের কার্যস্বরূপ। তবে আমি কেন তা' করব না?

        তদ্রূপ ধন-সম্পদের বিষয় চিন্তা করবে এবং বলবে, আমি ধন-সম্পদ দান করতে সমর্থ। কেননা উদ্ধৃত্ত ধন-সম্পদে আমার যখন প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন তা' আল্লাহ আমাকে দান করবেন। যদি বর্তমানে আমার তার প্রয়োজন হয় তবু তা' অন্যের প্রয়োজনের জন্য দান করে আমি অধিক পুণ্য অর্জন করতে পারি। তবে কেন তা' আমি করব না? এরূপে সমস্ত অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, শরীর, ধন-সম্পদ, পশুপক্ষী, দাস-দাসী এবং সন্তান-সন্ততির বিষয়ে অনুসন্ধান করে চিন্তা করবে। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে সমর্থ হলে, সূক্ষ্মচিন্তার দ্বারা ইবাদাতের সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক আবিষ্কার করবে এবং সেই ইবাদাতের দিকে আগ্রহ জন্মাবার উপায় চিন্তা করবে, তৎসম্বন্ধে নিয়ত খালেছ হবার বিষয় চিন্তা করবে এবং তজ্জন্য নিশ্চিত বিশ্বাসের অনুসন্ধান করবে। যে পর্যন্ত তোমার ইবাদাত তদ্বারা পবিত্র না হয় অন্যান্য ইবাদাত কার্যের বিষয়ও এভাবে চিন্তা করবে।

        চিন্তার তৃতীয় বিষয় মনের মধ্যে ধ্বংসকর দোষের অনুসন্ধানঃ ধ্বংসকর দোষগুলোর অধ্যায়ে যা' বর্ণনা করেছি তা' থেকে এর পরিচয় পাবে। অর্থাৎ লোভ, ক্রোধ, কার্পণ্য, অহংকার, আত্মপ্রীতি, সাধুতা প্রদর্শন, হিংসা-বিদ্বেষ, মন্দ ধারণা, আলস্য, মোহ বা ভ্রান্তি, অতি ভোজনের লোভ, প্রবঞ্চনা, ধন-সম্পদের লোভ, মান-সম্মান যশের লোভ ইত্যাদি ধ্বংসকর দোষগুলো প্রবল হলে, তার বিষয় চিন্তা করা। এ দোষগুলি হৃদয় থেকে নির্মূল করতে হবে। যদি তুমি মনে কর যে, তোমার হৃদয় এ দোষগুলো থেকে মুক্ত, তখন তার পরীক্ষার বিশেষ কারণগুলো সম্বন্ধে চিন্তা করবে এবং তার চিহ্নগুলোর প্রমাণ তালাস করবে। কেননা প্রবৃত্তি সর্বদাই মঙ্গলের প্রতিজ্ঞা করে তা' ভঙ্গ করতে থাকে। যদি প্রবৃত্তি বিনয়ের এবং অহংকার থেকে মুক্তির দাবী করে তখন এক বোঝা জ্বালানী কাষ্ঠ, মস্তকে রেখে বাজারে যাবে। যেরূপ প্রাথমিক যুগের ধার্মিক পুরুষগণ করতেন। যদি প্রবৃত্তি সহিষ্ণুতার দাবী করে তবে অন্যের সাথে এমন কথা বলবে যাতে তার ক্রোধ হয় এবং তারপর দেখবে তোমার ক্রোধ হয় কিনা এবং তোমার ধৈর্য্য থাকে কি না। এভাবে প্রত্যেক স্বভাবের বিষয় চিন্তা করবে।

        এই চিন্তার ধারা এই যে, কোন মন্দ স্বভাব তোমার আছে বা নাই। এর চিহ্নগুলো আমরা ধ্বংসকর দোষগুলোর অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। যখন চিহ্ন দ্বারা তার অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যাবে, তখন তার ঐ কারণগুলোর বিষয় চিন্তা করবে। যা' তোমার নিকট মন্দ বলে মনে হয়। পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায় যে, তার কারণ অজ্ঞতা, অমনোযোগিতা এবং কুপ্রবৃত্তি। যদি তোমার মনের মধ্যে তোমার কার্যের দরুন কোন ওজর বা খোদপছন্দী দেখতে পাও তখন চিন্তা করে বলবে, আমার শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্তি ও ইচ্ছার সাথে যে কার্য হয়ে থাকে, তা' আমা থেকে হয় না বরং এটা আমার উপর আল্লাহর সৃষ্টি ও করুণা। তিনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, আমার শক্তি ও ইচ্ছা সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গকে তাঁর কৌশলে চালনা শক্তি দিয়েছেন। তদ্রূপ শক্তি ও ইচ্ছার জন্য আমি কিরূপে আমার কার্যের জন্য আত্মপ্রীতি লাভ করতে পারি? আমি আমার সাহায্যে দাড়াতে পারি না। যখন তোমার মধ্যে অহংকার দেখতে পাও, তখন নিজেকে বলবে, তুমি নির্বোধ, তুমি নিজেকে বড় মনে কর। যে আল্লাহর নিকট বড় সে-ই বড়। মৃত্যুর পর জানা যাবে, কে বড়, কে ছোট। প্রকাশ্যভাবে দেখা যায় যে, বহু কাফির জীবনভর কুফরী করার পর কুফরী ত্যাগ করে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছে এবং বহু মুসলমান মন্দ পরিণামের ফলে মৃত্যুর সময় দুর্ভাগ্যশীল হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেছে। যখন বুঝতে পারলে যে, অহংকার ধ্বংসকর দোষ এবং তার মূল নির্বুদ্ধিতা তখন তা' দূর করার দাওয়াইর বিষয় চিন্তা করবে। অর্থাৎ বিনয়ীদের কার্য অবলম্বন করবে।

        যদি তোমার মধ্যে খাদ্যের লোভ দেখতে পাও তখন চিন্তা করবে এবং বলবে, এটা পশুদের স্বভাব। যদি খাদ্যের লোভ এবং কামরিপু চরিতার্থের মধ্যে পূর্ণতা থাকত তাহলে তা' আল্লাহর ফিরেশতাদের গুণাবলীর অন্তর্গত হত। যেরূপ জ্ঞান ও শক্তি ঐশী গুণাবলীর অন্তর্গত। যদি লোভ তোমার উপর প্রবল হয় তাহলে তুমি পশু সদৃশ হয়ে যাও এবং নিকটবর্তী ফিরেশতাদের দূরবর্তী হও। এই প্রকার ক্রোধের বিষয়ে নিজেকে উপদেশ দেবে এবং তারপর তার প্রতিকারের উপায় সম্বন্ধে চিন্তা করবে। এসব বিষয়ই এই কিতাবে উল্লেখ করেছি। যে ব্যক্তি চিন্তার পন্থা বিস্তৃত করতে চায় এই কিতাবের মধ্যে যা আছে তা' অধ্যয়ন করা তার পক্ষে অত্যাবশ্যক।

        চিন্তার চতুর্থ বিষয়ঃ এটা হল, পরিত্রাণকর গুণাবলী। তুমি দেখবে, পরিত্রাণকর সৎ গুণাবলীর মধ্যে কোনগুলো তোমার মধ্যে নেই এবং তা' কি উপায়ে অর্জন করা যাবে। হিতকর দশটি প্রধান মৌলিক গুণ আছে। যথাঃ (১) তাওবাহ এবং অনুতাপ, (২) বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ, (৩) নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, (৪) ভয়-ভীতি, (৫) আশা-আকাঙ্ক্ষা, (৬) সংসার বৈরাগ্য, (৭) ইখলাছ, (৮) ইবাদাতে সত্যবাদিতা, (৯) আল্লাহর ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শন, তাঁর কার্যাবলীতে সন্তুষ্টি এবং তাঁর প্রতি অনুরক্তি, (১০) বিনয় ও নম্রতা। এ বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ ও চিহ্নও আমরা এই পুস্তকের পরিত্রাণ খণ্ডে বর্ণনা করেছি; সুতরাং দৈনিক মনের মধ্যে এই চিন্তা করবে যে, কোন্ বস্তু তোমাকে এসব গুণ থেকে বিরত করে। অথচ এই গুণগুলো তোমাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে। যখন তন্মধ্যে কোন বস্তুর প্রয়োজন বোধ কর, তখন জেনে নেবে যে, তা' মনের এমন কতগুলো অবস্থা যা' জ্ঞান ব্যতীত অর্জিত হয় না। আবার চিন্তা ব্যতীত জ্ঞানের উদয় হয় না। যদি নিজের জন্য তাওবাহ ও অনুতাপের অবস্থা অর্জন করতে চাও, প্রথমে তোমার পাপরাশির অনুসন্ধান করে সে বিষয় চিন্তা করবে। নিজের উপর তা' সংগ্রহ করে নেবে এবং নিজের মনে তা' বড় বলে জানবে। তারপর তার জন্য যে বাণী ও শাস্তির কথা শরীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে তার বিষয় চিন্তা করবে। মনের মধ্যে নিশ্চিত বিশ্বাস করে নেবে যে, তুমি আল্লাহর ঘৃণার জন্য অগ্রসর হচ্ছ। যে পর্যন্ত অনুতাপের অশ্রু তোমার অবস্থাকে পরিবর্তন না করে। যখন তোমার মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অবস্থা জানতে চাও, তোমার প্রতি আল্লাহর করুণার কথা, তাঁর সাহায্যের কথা এবং তোমার প্রতি তাঁর সৌন্দর্যের পর্দা প্রেরণের কথ্য স্মরণ করবে। তা' আমরা শোকরের অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি।

        যখন তুমি ভালবাসা ও আসক্তির অবস্থা চাও আল্লাহর গৌরব, সৌন্দর্য, মহত্ত্ব এবং ঐশ্বর্যের বিষয় চিন্তা করবে। তাঁর অত্যাশ্চর্য কৌশল এবং তাঁর অভিনব কারুকার্যের দিকে লক্ষ্য করবে। যখন ভয়ের অবস্থা চাও তখন প্রথমে তোমার গুপ্ত ও প্রকাশ্য পাপের দিকে লক্ষ্য করবে। তারপর মৃত্যু ও তার তন্ময়তা এবং তারপর যা' ঘটবে তার দিকে লক্ষ্য করবে। যথাঃ মুনকার নকীরের প্রশ্ন, কবরের আযাব, কবরের সাপ, বিচ্ছু, কীট-পতঙ্গ। তার শিঙ্গার ফুৎকার দেয়ার সময় ভয়ঙ্কর অবস্থা, তারপর এক প্রকাণ্ড ময়দানে সকল সৃষ্টিকে একত্র করার ভয়াবহ অবস্থা, তারপর হিসাব-নিকাশের কড়াকড়ি, পুলসিরাতের কষ্ট ও তার ক্ষুরধার তেজ এবং তার উপরকার ভীষণ অবস্থা। হয় দোযখে পতিত হওয়া অথবা বেহেশতে প্রবেশ করা তারপর কিয়ামতের ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে দোযখের অগ্নির রূপ, ভীষণ অগ্নি দহন, জিঞ্জীর, পুঁতিগন্ধময় পুঁজ রক্ত ও অন্যান্য শাস্তির বিষয় চিন্তা করবে। যখনই তাদের চর্ম, মাংস খসে পড়বে তখনই তাদেরকে অন্য চর্ম, মাংস এনে দেয়া হবে। যখনই তারা তথা থেকে বের হবার ইচ্ছা করবে তখনই তাদেরকে তার অভ্যন্তরে ফিরিয়ে দেয়া হবে। যখন তারা দূরবর্তী স্থান থেকে তা' দেখবে তারা তাদের আর্তনাদ ধ্বনি শুনতে পাবে। এ সম্বন্ধে কুরআনে যা' এসেছে তা' তারা দেখতে পাবে। যখন তুমি আশার অবস্থা পেতে চাও তখন বেহেশত, তার সুখ-সম্পদ, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী, হুর-গেলমান, বিশাল রাজ্য ও রাজত্বের দিকে দৃষ্টিপাত করবে এবং তার বিষয়ে চিন্তা করবে।

        এতক্ষণ যা' বর্ণনা করলাম, এগুলোই চিন্তার ধারা। এর মাধ্যমেই নানাবিধ জ্ঞানের অন্বেষণ করতে হবে আর সেই জ্ঞানরাশিই প্রেমাস্পদের দিকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাবে ও মন্দ স্বভাব থেকে বাঁচিয়ে রাখবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক অবস্থা সম্বন্ধেই আমি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উল্লেখ করেছি, যেন তার সাহায্যে চিন্তার বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়; সুতরাং চিন্তার সাথে কুরআন তিলাওয়াত অপেক্ষা অধিক উপকারী পাবে না, কেননা কুরআনে পাকই সমস্ত অবস্থা ও মাকামের সমন্বয়। তার মধ্যে রয়েছে দুনিয়ার সমস্ত ব্যাধির প্রতিকার। তার মধ্যে আছে ভয়, আশা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ভালবাসা, অনুরক্তি এবং অন্যান্য অবস্থা, তার মধ্যে আছে সমস্ত ঘৃণিত কাজের ব্যাখ্যা; সুতরাং মানুষের তা' পাঠ করা এবং যে সব আয়াত চিন্তা করার জন্য আহ্বান করে তা' বার বার অধ্যয়ন করা উচিত, যদিও তা' শতাধিক বারও পাঠ করা হয়। চিন্তার সাথে একটি আয়াত পাঠ করা এবং হৃদয়ঙ্গম করা চিন্তাশূন্য বুঝহীন এক খতম থেকেও উত্তম। এই অবস্থায় চিন্তা করে এক রাত্রির জন্য হলেও নীরব থাকবে। কেননা প্রত্যেক আয়াতের মধ্যে অনেক গুপ্ত তত্ত্ব আছে যার সংখ্যা অসীম। যে পর্যন্ত বিশুদ্ধ হৃদয়ে চিন্তা না করা যায় এবং আমল বিশুদ্ধ না হয়, সে পর্যন্ত তা' জানা যাবে না।

        অদ্রূপ হুযুরে পাক (দঃ) এর হাদীস পাঠ করবে। কেননা তার মধ্যে আছে সব কথার সমন্বয় এবং তাঁর প্রত্যেক কথার মধ্যে আছে হেকমতের সমুদ্র। যদি কোন আলিম উপযুক্তভাবে তার বিষয় চিন্তা করে সে তার সমস্ত জীবনের মধ্যেও আয়ত্ত করতে পারবে না। প্রত্যেক আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যা সুদীর্ঘ। হুযুরে পাক (দঃ) এর নিম্নোক্ত হাদীসের প্রতি লক্ষ্য কর। "ইন্না রূহাল কুদুসি নাফাসা ফী রূহী আহবিব মান আহবাবতা ফাইন্নাকা মুফারিকুহু ওয়া ইশ মা শি'তা ফাইন্নাকা মাইয়্যিতুন আ'মাল মা শি'তা ফাইন্নাকা মুজযিউম্ বিহী" অর্থাৎ পবিত্র আত্মা আমার আত্মার মধ্যে ফুৎকার দিয়ে বলেছেন, যাকে ইচ্ছা ভালবাস কিন্তু তা' থেকে তোমাকে পৃথক হতেই হবে, যতদিন ইচ্ছা জীবিত থাক কিন্তু তোমাকে মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে। যে কার্য ইচ্ছা হয় কর, কিন্তু তার প্রতিফল তোমাকে পেতেই হবে। অত্র হাদীসে বহু কথার সমন্বয় আছে। এতে পূর্বাপর সব জ্ঞানী লোকের কথা আছে। আশাবাদীর জন্য এটাই যথেষ্ট, এতে আছে দীর্ঘ জীবন, যদি এর অর্থের বিষয় চিন্তা করা হয় এবং মনের মধ্যে তা' প্রবলাকার ধারণ করে, তবে তা-ই তাকে নিমজ্জিত করে রাখবে। দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে এটাই তাকে বিরত রাখবে। ব্যবহারিক বিদ্যাসমূহের ব্যাপারে এটাই চিন্তার পন্থা এবং আল্লাহর নিকট কোন বান্দা প্রিয় হওয়ার এটাই উপায়। প্রাথমিক ধর্ম-পথযাত্রীর এসব চিন্তার মধ্যে নিমজ্জিত থাকা উচিত, যে পর্যন্ত তার মন উত্তম গুণাবলী এবং সম্মানিত মাকাম দ্বারা অভ্যস্ত না হয় আর তার অন্তর ও বার অসৎ কার্য থেকে পরিষ্কার ও নির্মল না হয়। তা' সমস্ত ইবাদাত থেকে উত্তম। তার জন্য তা-ই চরম উদ্দেশ্য নয়; বরং তাতে চিরকাল নিমগ্ন থাকা ছিদ্দীকের মুখ্য উদ্দেশ্য থেকে দূরে থাকে। সেই উদ্দেশ্য আল্লাহর সৌন্দর্য ও গৌরবের বিষয়ে চিন্তার সুখ পাওয়া, মনকে নিযুক্ত রাখা, কেননা সে নিজের বিষয়ও তখন ভুলে যায় এবং প্রিয়জনের চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকের ন্যায় ডুবে থাকে। যখন তার সাথে সাক্ষাত হয়, সে তখন নিজের অবস্থা ও স্বভাবের দিকে লক্ষ্য করতে অবসর পায় না; বরং হতভম্ব হয়ে নিজের প্রতি অমনোযোগীর ন্যায় থাকে। এটাই প্রেমিকদের সর্বশেষ আনন্দ। আমরা যা' বর্ণনা করেছি তা' অন্তর বিশুদ্ধিকল্পে চিন্তা করা, যেন নৈকট্য ও মিলন অর্জন করার সহায়তা করা হয়। যখন সে তার সারা জীবন নিজের সংশোধনে নষ্ট করে, তখন নৈকট্যের সঙ্কট কখন সে ভোগ করবে?

        হযরত খাওয়াছ (রহঃ) পর্বতে-প্রান্তরে বিচরণ করতেন। একদা হযরত হোসায়েন ইবনে মনছুর (রহঃ) তার সাথে সাক্ষাত করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ ভাবে দীর্ঘকাল ধরে বনে- জঙ্গলে ও প্রান্তর-পর্বতে ঘুরছেন কেন? তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহর প্রতি ভরসার বিষয়ে আমার অবস্থা সংশোধনের জন্য আমি এভাবে বিচরণ করছি। তখন হযরত হোসায়েন ইবনে মনছুর (রহঃ) বললেন, তবে আপনি এভাবে আপনার সমস্ত জীবন স্বীয় অন্তর পরিষ্কারেই শেষ করবেন? তাওহীদের মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার কাজ আপনি কখন করবেন? তাছাড়া সত্যের মধ্যে মগ্ন হওয়ার-ই বা আপনার সময় কোথায়? মূলতঃ এটিই হল অন্বেষণকারীদের শেষ লক্ষ্য এবং ছিদ্দীকগণের শেষ সম্পদ। ধ্বংসকর দোষাবলী থেকে পবিত্র হওয়া বিবাহের জন্য ইদ্দত থেকে বের হবার ন্যায়, পরিত্রাণকর গুণাবলী ও অন্যান্য ইবাদাতের সাথে সংযুক্ত থাকা কোন রমণী তার স্বামীর জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকার ন্যায়। ঐ রমণী তার স্বামীর সাথে মিলনের জন্য মুখ পরিষ্কার করে, কেশরাজি বিন্যাস করে রাখে, যেন সে স্বামীর সাথে মিলনের উপযুক্ত হতে পারে। যদি সেই রমণী তার সারা জীবনই মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য বিধান ইত্যাদিতে নিমগ্ন থাকে, তবে তা' তার প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাতের পক্ষে পর্দাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের বিষয়কে এরূপ ভাবেই বুঝতে হবে।

        যদি তুমি অসৎ লোকের ন্যায় হও, যে প্রহারের ভয় ব্যতীত এবং পুরস্কারে লোভ ব্যতীত কার্যে রত হয় না? তবে তোমার কথা ভিন্ন। প্রকাশ্য ইবাদাত 'দ্বারা শরীরকে কষ্ট প্রদান করতে হবে, কেননা তোমার হৃদয় মধ্যে পুরু পর্দা পড়ে গেছে, সুতরাং যখন তুমি কর্তব্য কার্য সম্পাদন করবে তখন তুমি জান্নাতবাসী হতে পারবে। কিন্তু সংসর্গের উপযোগী অন্য লোক রয়েছে, যখন তোমার ও প্রভুর মধ্যে ব্যবহারিক বিদ্যা সম্পর্কিত চিন্তা ক্ষেত্রে চিনতে পারলে, তখন তাতে বিচরণ করা তোমাকে অভ্যাস করে নিতে হবে এবং প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তা' আমলে আনবে। সুতরাং তোমার প্রবৃত্তি থেকে এবং যেসব দোষ আল্লাহ থেকে তোমাকে দূরবর্তী করে রাখে তা' থেকে অন্যমনস্ক থেকো না এবং যেসব অবস্থা আল্লাহর নিকটবর্তী করে তা' থেকে অমনোযোগী হয়ো না।

        দোষ ও গুণাবলীর তালিকাঃ প্রত্যেক ধর্ম পথযাত্রীর সাথে একটি তালিকা থাকা উচিত। -যার মধ্যে সব ধ্বংসকর দোষ এবং সব ত্রাণকর গুণ, তাছাড়া সমস্ত পাপ ও পুণ্যের বিষয় লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রত্যেক দিন তার মধ্যে নিম্নোক্ত দশটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করলেই যথেষ্ট হবে। যদি সে ঐ দশটি দোষ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, তবে সে অন্যান্য দোষগুলো থেকে মুক্ত থাকবে। কেননা উক্ত দশটি দোষই সমস্ত দোষের মূল। যথাঃ (১) কৃপণতা (২) অহঙ্কার (৩) খোদপছন্দী বা আত্মপ্রীতি (৪) রিয়া বা সাধুতা প্রদর্শন (৫) হিংসা (৬) অত্যধিক ক্রোধ (৭) অতিরিক্ত ভোজন (৮) অতিরিক্ত সঙ্গম (৯) ধন-সম্পদের লোভ এবং (১০) যশঃ ও খ্যাতির লোভ। পরিত্রাণকর দশটি গুণের তালিকা এই। যথাঃ (১) পাপের জন্য অনুতাপ (২) বিপদে ধৈর্য (৩) তাকদীরে মন্তুষ্টি (৪) সম্পদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ (৫) মধ্যম প্রকৃতির ভয় ও আশা (৬) সংসার বৈরাগ্য (৭) আমলে ইখলাছ (৮) লোকের সাথে সদ্ব্যবহার (৯) আল্লাহর প্রতি ভালবাসা এবং (১০) 'আল্লাহর নিকট বিনম্র হওয়া।

        যার মধ্যে উপরোক্ত মন্দ দোষগুলো আছে সে তন্মধ্য থেকে প্রথম একটি দোষ নির্মূল করার জন্য চিন্তা করতে থাকবে। যদি একটি মন্দ দোষ চলে যায় তাহলে তালিকার মধ্য থেকে সেই দোষটি মুছে যায়। তখন সেই দোষটি সম্বন্ধে চিন্তা ত্যাগ করবে এবং এই নিয়ামতের জন্য হৃদয় থেকে ঐ দোষটি চলে যাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। তার জানতে হবে যে, আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য ব্যতীত একাজ কখনও হতে পারে না। যদি এ ব্যাপারে সে নিজের যোগ্যতার গুরুত্ব দেয় তাহলে তা' অত্যন্ত ভুল হবে। কেননা সে নিজ থেকে একটি ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র বস্তুও দূর করতে পারবে না। এভাবে একটি দোষ নির্মূল হওয়ার পর সে অবশিষ্ট নয়টি দোষের দিকে অগ্রসর হবে এবং একটি একটি করে তার সব দোষ দূর করবে। এই চেষ্টা ততদিন পর্যন্ত চালিয়ে যাবে যত দিনে না তার সম্পূর্ণ দোষ দূরীভূত হয়ে যায়।

        এভাবে দোষমুক্ত হওয়ার পর সে পরিত্রাণকর গুণগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকতে চেষ্টা করবে। যদি সে তন্মধ্যে একটি গুণের সাথেও সংযুক্ত থাকে যেমন তাওবাহ এবং অনতাপ তাহলে তার সেই তালিকায় তা' লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে এং অবশিষ্ট গুণগুলোও একটির পর একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করার জন্য চেষ্টায় রত থাকবে। যে ধর্ম পথযাত্রী তার উন্নতির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে তার জন্য এই পন্থা। ধার্মিক লোকের মধ্যে অধিকাংশ লোকেরই কর্তব্য যে, তাদের দপ্তরের মধ্যে নিজেদের প্রকাশ্য পাপগুলো লিখে রাখে। যথাঃ সন্দেহজনক বস্তু ভক্ষণ করা, পরনিন্দা করা, কূটনামী করা, বিবাদ-বিসম্বাদ করা, আত্মপ্রশংসা করা, শত্রুর সাথে অতিরিক্ত শত্রুতা সাধন করা, মানষের খোশামোদ করা, যেন তারা সৎ কার্যের উপদেশ এবং মন্দ কার্যে নিষেধ ত্যাগ না করে। যে ব্যক্তি ধার্মিকদের অন্যতম বলে নিজেকে গণ্য করে সে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা এসব পাপ কার্য করা থেকে মুক্ত থাকে। যে যে ব্যক্তি এসব পাপ কার্য থেকে তার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গকে পবিত্র করে না তার অন্তর পবিত্র করায় সে নিমগ্ন হয়েছে, সে কথা বলা যায় না। যখন প্রত্যেক সম্প্রদায়ের উপর কোন এক পাপ প্রবল হয় তখন তার অনুসন্ধান করা এবং সে বিষয় চিন্তা করা তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন নিজে সেই সম্প্রদায়ের পাপীদের নিকট থেকে পৃথক থাকলে চলবে না। যদি সে পৃথক থাকে সে ঐ পরত্বেজগার আলিমদের ন্যায় হয়, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের জ্ঞান প্রকাশ এবং যশঃ অন্বেষণ করতে রত থাকে। চাই তা' শিক্ষা দান করার মাধ্যমে হোক বা ওয়াজ-নছীহত দ্বারা হোক। যে ব্যক্তি তা' করে, সে এক এমন ভীষণ বিপদের মধ্যে পতিত হয়, যা' থেকে ছিদ্দীকগণ ব্যতীত অন্য কেউই মুক্ত থাকতে পারে না। যদি তার উপদেশ গ্রহণ করা হয় মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা তার দিকে যায়। এই অবস্থায় উক্ত আলিম আত্মপ্রীতি, অহঙ্কার ও প্রদর্শনেচ্ছা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকে না। এটা ধ্বংসকর দোষরূপে গণ্য।

         যদি কেউ তার কথা না শুনে, সে ক্রোধ ও হিংসা থেকে মুক্ত থাকে না। যদি ঐ অমান্যকারী অন্যের উপদেশ না শুনে, তাহলে তার উপর ঐ আলিমের তত ক্রোধ হয় না। কেউ তার নিজের কথা না মানলেই তার উপর সে ক্রোধান্বিত হয়। এর কারণ এই যে, শয়তান তাকে প্রবঞ্চনা দেয় এবং বলে, তোমার ক্রোধের কারণ হল যে, সে সত্য অস্বীকার করেছে। যদি সে তার কালাম ও অন্যের কালাম অস্বীকার করায় পার্থক্য দেখতে পায়, সে তখন প্রবঞ্চিত হয় এবং শয়তানের হাসির খোরাক হয়। তারপর যখন লোক তার উপদেশ গ্রহণ করে, তার মন আনন্দিত হয় এবং তার প্রশংসা শুনে তার মন উৎফুল্ল হয়। যখন লোক তাকে না মানে, তখন সে দুঃখিত হয়। লোকদের থেকে প্রশংসা বের করার জন্য সে সুন্দর ও সুমধুর বাক্য দ্বারা তাদেরকে তুষ্ট করে। কিন্তু আল্লাহ এরূপ কাজকে ভালবাসেন না। শয়তান তাকে ভ্রান্ত পথ দেখিয়ে বলে, তোমার সুমধুর বাক্যের উদ্দেশ্য সত্য প্রচার করা এবং জনগণের হৃদয়ের মধ্যে তা' পতিত হওয়া, যেন আল্লাহর ধর্ম উচ্চ হয়।

        যদি তার সুন্দর বাক্যের জন্য এবং তাকে লোক প্রশংসা করার জন্য তার আনন্দ হয়, পক্ষান্তরে যদি তার একজন বন্ধুর প্রশংসা শুনে তার আনন্দ না হয়, তবে সে ভ্রান্ত। সে নাম-যশের ময়দানের চারদিকে ঘুরতে থাকে। অথচ সে ভাবে যে, সে একজন ধর্ম অন্বেষণকারী। যখন তার মনে এভাবের উদয় হয় তার বাইরেও তা' প্রকাশ পায়। এমন কি যদি কেউ তাকে অধিক সম্মান করে বা তার গুণের অধিক বিশ্বাসী হয় বা তার সাথে সাক্ষাতে অধিক আনন্দিত হয় সেই আলিম তাকে ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক সম্মান দেয়, যে ব্যক্তি তাকে তত প্রশংসা করে না; বরং অন্যের সম্মান করে ও বিশ্বাস করে। যদিও অন্য আলিম তার চেয়েও অধিক উপযুক্ত। অনেক সময় আলিমগণের হিংসা এই স্তরে পৌঁছে যায় যে, স্ত্রীলোকদের ন্যায় তারা হিংসা করতে থাকে। তার ফলে তাদের মধ্যে কারও মুরীদ অন্য আলিমের নিকট চলে গেলে তাঁর উপর সে কঠিন ব্যবস্থা অবলম্বন করে। যদিও সে জানে যে, অন্য আলিমের দ্বারা তার উপকার হবে এবং তার ধর্মের সাহায্য হবে। এ সবেরই মূল ধ্বংসকর দোষ যা' হৃদয়ের গুপ্ত স্থলে নিহিত থাকে। সে মনে করে যে, তা-ই তাকে মুক্তি দেবে, সে ভ্রান্ত: সুতরাং আলিমের বিপদ অনেক। সে তোমার বাদশাহ অথবা তোমার অনিষ্টকারী। জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য তার দ্বারা কিছু আশা করা যায় না।

        যে ব্যক্তি তার নিজের মনের মধ্যে এই অবস্থা দেখতে পায়, তার নির্জনে একাকী থাকা, অপরিচিত হয়ে থাকার চেষ্টা পাওয়া এবং ফতোয়া দেয়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। ছাহাবীদের যুগে মসজিদের দিকে লক্ষ্য কর। হুযুরে পাক (সাঃ) এর ছাহাবীগণ সবাই মসজিদে যাতায়াত করতেন এবং তারা সবাই-ই ফতোয়া দানের উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা ফতোয়া দানে বিরত থাকতেন। যার নিকট ফতোয়া চাওয়া হত, অন্য কোন ফতোয়া দাতার নিকট ফতোয়া চাওয়া হোক বলে তিনি ভালবাসতেন। মানব শয়তান থেকে সতর্ক হওয়া উচিত। যখন তারা বলে, এটা করো না ওটা করো না। কেননা যদি এর দুয়ার উন্মুক্ত হয়, লোকের মধ্য থেকে বিদ্যা চলে যাবে; বরং তাদেরকে বলবে, নিশ্চয় ইসলাম ধর্ম আমার মুখাপেক্ষী নয়, আমার পূর্বেই তা' পূর্ণ হয়ে গেছে, আমার পরেও তা-ই থাকবে। আমার মৃত্যুর পরে ইসলামের বিধান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। কেননা ধর্ম আমার মুখাপেক্ষী নয়। যদি লোকজনের কারাগারে আবদ্ধ করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং বলা হয় তুমি যদি বিদ্যা অন্বেষণ কর, তোমাকে অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। তাহলেও প্রভুত্ব ও সম্মান প্রিয়তা তাদেরকে এই শৃঙ্খল ছিন্ন করার জন্য উৎসাহ দেবে এবং কারাগারের প্রাচীর ভঙ্গ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। যেন তা' থেকে বের হয়ে আসতে পারে এবং বিদ্যান্বেষণে নিমগ্ন হতে পারে।

        যে পর্যন্ত শয়তান লোকের নিকট প্রভুত্বকে প্রিয় করে রাখে, সে পর্যন্ত বিদ্যার বিলোপ হবে না। শয়তান কিয়ামত পর্যন্ত তার কার্য থেকে বিরত হবে না; বরং একদল লোক বিদ্যা বিস্তার করার জন্য উত্থিত হবে, যদিও তাদের আখেরাতের কোন অংশ থাকবে না, যেরূপ হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "ইন্নাল্লাহা লাইয়ুয়াইয়্যিদু হাযাল্লাযীনা বি আকুওয়ামিন লা খালাক্কা লাহুম ফীহি" অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা এই ধর্মকে একজন পাপী লোক দ্বারা সাহায্য করবেন; সুতরাং এসব প্রবঞ্চনার দ্বারা আলিমের প্রবঞ্চিত হয়ে জনসমাজে মেলা-মেশা করে নিজের মনে প্রশংসা ও সম্মান প্রীতি জন্মানো উচিত নয়। কেননা তাতে মুনাফিকী বিস্তার লাভ করে।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যশঃ ও ধন-সম্পত্তির লালসাহৃদয়ে মুনাফিকী উৎপাদন করে। যেরূপ বারিধারা লতা-পাতা জন্মায়। তিনি আরও বলেছেন, দুটো ক্ষুধার্ত হিংস্র পশুকে মেষ পালের মধ্যে পাঠিয়ে দিলে তারা যে ধ্বংসাত্মক দৌরাত্ম্য শুরু করে তা' কোন মুসলমানের ধর্মের মধ্যে যশঃ ও ধন-সম্পদ লোভের অনিষ্টের চেয়ে অধিক গুরুতর নয়। মানুষ যে পর্যন্ত জন সমাজ থেকে পৃথক না হয়ে যায়, তাদের সাথে মেলা-মেশা থেকে পলায়ন না করে, যে সব উপকরণ তাদের মনে যশঃ লিন্দা বৃদ্ধি করে তা' ত্যাগ না করে, সে পর্যন্ত যশঃপ্রিয়তা তার হৃদয় থেকে নির্মূল করা যাবে না। সুতরাং এসব গুপ্ত স্বভাব থেকে মনকে মুক্ত করা এবং মুক্তি লাভের উপায় উদ্ভাবন করা ধর্মভীরু আলিমের কর্তব্য।

        আমাদের ক্ষেত্রে যে সব বিষয় হিসাবের দিনের উপর ঈমান মজবুত করে, সে সব বিষয়ে চিন্তা করা উচিত। কেননা যদি পূর্ববর্তী নেক বান্দাগণ আমাদেরকে দেখতে পেতেন, তারা নিশ্চয় সরাসরি বলে ফেলতেন, এ সব লোক রোজ কিয়ামত বিশ্বাস করে না, যারা বেহেশত ও দোযখ বিশ্বাস করত তাদের কার্যের তুলনায় আমাদের কার্য কোথায়? কোন ব্যক্তি কোন কিছুকে ভয় করলে সে তা' থেকে পলায়ন করে এবং কোন ব্যক্তি কোন কিছুর আশা করলে সে তার অনুসন্ধান করে। আমরা জানি যে, সন্দেহজনক বস্তু, হারাম বিষয় এবং পাপ কার্য ত্যাগ করলেই দোযখ থেকে পলায়ন করা হয়। অথচ আমরা ঠিক তার মধ্যেই বসে আছি। আমরা জানি যে, অধিক নফল ইবাদাত করলে বেহেশত অন্বেষণ করা হয়, কিন্তু নফল ইবাদাত দূরের কথা আমরা ফরজ কার্যেও ত্রুটি করে চলেছি। বিদ্যা অর্জন করে আমাদের কোন লাভ হয়নি; বরং তা' আমাদেরকে সংসারের লোভ অনুসরণ করতে শিক্ষা দিয়েছে, মানুষ বলে যে, যদি বিদ্যার্জন না করা নিন্দনীয় হত, আলিমগণ আমাদের চেয়ে ত্যাগ করার নিশ্চয়ই অধিক উপযুক্ত হত। আমাদের জন্য আক্ষেপ যে, আমরা সাধারণ লোকদের ন্যায়। যখন আমাদের মৃত্যু হবে, আমাদের সাথে সমস্ত পাপেরও মৃত্যু হবে। যদি আমরা চিন্তা করি আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ রয়েছে। আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সংশোধন করেন এবং আমাদের সাথে তাদেরকে সৎ করেন, আমাদের মৃত্যুর পূর্বে আমাদেরকে তাওবাহর তাওফীক প্রদান করেন। তিনি করুণাময়, সূক্ষ্ম বিচারক এবং আমাদের উপর কৃপা বর্ষণকারী।

        এতক্ষণ যা' বলে এলাম তা-ই আলিম এবং সৎ বান্দাদের ব্যবহারিক বিদ্যার মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্র, যদি তারা তা' থেকে অবসর পায় তারা নিজেদের দিকে দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর গৌরব ও মহত্ত্বের বিষয় হৃদয়ের চোখ দ্বারা দর্শন করে চিন্তা করতে থাকবে। এটা সম্পূর্ণ হবে না যে পর্যন্ত না সব ধ্বংসকর দোষ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় এবং পরিত্রাণকর গুণাবলী অর্জন করা যায়। এর পূর্বে যদি তা' থেকে কোন কিছু প্রকাশ পায়, তা' ত্রুটিপূর্ণ থাকবে, তা' আকর্ষণকারী বিদ্যুতের ন্যায় দুর্বল হবে, তা' স্থির থাকবে না এবং স্থায়ী হবে না। সে ঐ প্রেমিকের ন্যায় হবে, যে তার প্রিয়জনের সাথে নির্জনে অবস্থান করে, অথচ তার বস্ত্রের মধ্যে সর্প ও বিচ্ছু থেকে অনবরত দংশন করতে থাকে। এর ফলে দর্শনের আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয়। এই সর্প ও বিচ্ছু বস্ত্র মধ্য থেকে বের করে না দিলে তার আনন্দ সম্পূর্ণ হবে না। মন্দ দোষগুলি এই সর্প ও বিচ্ছু স্বরূপ। তা-ই ভীষণ অনিষ্টকর। কবরের মধ্যে এই সর্প ও বিচ্ছু দংশন যন্ত্রণা ইহলোকে তাদের দংশন যন্ত্রণা থেকে অধিক তীব্র এবং যন্ত্রণাদায়ক হবে। সতর্কতার জন্য এই পরিমাণ উপদেশই যথেষ্ট।

        দ্বিতীয় প্রকার চিন্তা আল্লাহর গৌরব, ঐশ্বর্য, মহত্ব ও প্রতাপ সম্বন্ধে চিন্তা। তার দুটি মাকাম আছে। উচ্চ মাকাম আল্লাহর জাত বা অস্তিত্ব, গুণাবলী এবং নামসমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করা। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করা নিষিদ্ধ। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা কর, আল্লাহর জাত বা অস্তিত্বের চিন্তা করো না। তার কারণ তাতে বৃদ্ধি বিভ্রান্ত হয়ে যায়। দ্বিদীকগণ ব্যতীত তাকে এই পার্থিব চক্ষুদ্বারা কারও দর্শন করা সম্ভব নয়। সূর্য অনবরত দেখা সম্ভব নয়; বরং আল্লাহর প্রতাপের তুলনায় সমস্ত সৃষ্টির অবস্থা সূর্যের প্রখর জ্যোতির সম্মুখে কিছুই দেখতে পায় না; বরং তা' দিবাভাগে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যাবেলা পূর্যাস্তকালীন যে সামান্য একটু আলো অবশিষ্ট থাকে, তার সাহায্যে তা' দেখতে পায়। ছিদ্দীকগণের অবস্থা ঐ লোকের অবস্থার ন্যায় যে সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে, সে সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারে বটে, কিন্তু তা' স্থায়ী হয় না; বরং সে দীর্ঘ সময় দৃষ্টিপাত করে থাকলে তার চক্ষু নষ্ট হবার ভয় থাকে। হঠাৎ তার চোখে অন্ধতার বিপদ ঘটে যেতে পারে।

        আল্লার সত্তার প্রতি দৃষ্টিও অদ্রূপ দৃষ্টিপাতকারীকে হয়রান ও পরিশ্রান্ত করে এবং তার বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত ও বিপর্যন্ত করে; সুতরাং আল্লাহতায়ালার সত্তা সম্বন্ধে চিন্তা করা ঠিক নয়, কেননা প্রায় সব বুদ্ধিমানগণই তার ধকল সামলাতে অসমর্থ হয়; বরং কোন কোন আলিম বলেছেন যে, আল্লাহতায়ালা স্থান-কাল-পাত্রের আওতার বাইরে। তিনি দিক থেকে পবিত্র। তিনি দুনিয়ার মধ্যেও নন বরং দুনিয়ার সাথে সংযুক্তও নন, আবার দুনিয়া থেকে পৃথকও নন। মানুষের বুদ্ধি তাঁর সম্বন্ধে চিন্তা করতে গিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে। তার ফলে তখন সে এমন কি আল্লাহকে অস্বীকার করে বসে, যখন সে তাকে জানতে অক্ষম হয়। একদল লোক এটা ধারণাই করতে পারবে না, যখন তাদেরকে বলা হয়, তিনি মহান ও গরীয়ান। তার কোন মস্তক, হস্তপদ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা বা অন্যান্য কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর কোন দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বা ওজন নেই। তারা তা' অস্বীকার করে বলবে যে, এটা আল্লাহর গৌরব ও মহত্বের পক্ষে একটি ত্রুটি। কোন কোন লোক বলবে যে, আল্লাহর এসব বস্তুর অভাব কি করে হয়? তারা মনে করে যে, মহত্ব ও গৌরব এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যেই নিহিত। এরা নিজেদের প্রয়োজন ব্যতীত আর কিছুই জানে না। নিজেদের চেয়ে আর কাউকে বড় মনে করে না। যে বস্তুই তার গুণের সমকক্ষ নয় তার মধ্যে কোন মহত্ব আছে বলে তারা স্বীকার করে না। এরা নিজেদের সামনে পার্থিব সম্রাটের গৌরব দেখতে পায়। সম্রাট উচ্চ সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকেন আর তাঁর সম্মুখে সাধারণ লোকগণ করজোড়ে দণ্ডায়মান থাকে। আল্লাহর সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিও তদ্রূপ। যদি মানুষের ন্যায় মক্ষিকারও বুদ্ধি থাকতো সেও মনে করত যে, আমাদের কর্তা আল্লাহরও পালক। তার হন্ত-পদ এবং উড়বার শক্তি আছে। তা' না থাকলে আমাদের সৃষ্টিকর্তার ত্রুটি আছে। যখন আমার এসব বস্তু আছে, আমার সৃষ্টিকর্তার কি এসব না থেকে পারে? অথচ সে আমার সৃষ্টিকর্তা। অনেক জীবের বুদ্ধি এরূপ বুদ্ধির নিকটবর্তী। মানুষ নিশ্চয়ই অধিক অজ্ঞ, অত্যাচারী এবং অকৃতজ্ঞ। এজন্যই আল্লাহতায়ালা তাঁর কোন নবীর প্রতি অহী অবতীর্ণ করেছিলেন যে, আমার দাসগণের সামনে আমার স্বভাব খুলে বল না। কেননা তা' শুনে তারা অবিশ্বাস করতে পারে। তারা যেরূপ বুঝে তাদের সাথে তদ্রূপ কথা বল। আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তার সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করা যখন এজন্য নিষিদ্ধ তখন তার বিষয়ে চিন্তা করাও উচিত নয়।

        দ্বিতীয় স্তরঃ আল্লাহর সৃষ্টিজগতের বিস্ময়কর ব্যাপার চিন্তা করা। অর্থাৎ আল্লাহর কারুকার্য, ক্ষমতা, বিচিত্র কার্যাবালী ও সৃষ্টি নৈপুণ্য সম্বন্ধে চিন্তা করা। তা-ই তাঁর গৌরব, প্রতাপ, পবিত্রতা ও মহত্ব প্রদর্শন করবে এবং তাতে তার পূর্ণ জ্ঞান ও হেকমত দেখা যাবে। তাঁর গুণাবলীর প্রভাব থেকে-ই তাঁর গুণাবলীর দিকে লক্ষ্য করতে হবে। (কেননা আমরা তাঁর স্বভাবের দিকে লক্ষ্য করতে পারি না)। যেরূপ সূর্যের জ্যোতিতে দুনিয়া উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে তখন তার দিকে লক্ষ্য করতে পারি না। চন্দ্রের বিমল জ্যোৎস্না এবং তারকা রাজির আলোর তুলনায় আমরা সূর্যের জ্যোতির প্রখরতা উপলব্ধি করতে পারি, কেননা দুনিয়ার আলো সূর্যের জ্যোতিরই প্রতিচ্ছায়া। ফলের প্রতি দৃষ্টিপাতই ফলের আধারের দিকে পথ দেখিয়ে দেয়। তদ্রূপ দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তার অস্তিত্ব আল্লাহর শক্তির ফল এবং অস্তিত্বের নূরের একটি কলক মাত্র। সেই নূরের অনস্তিত্বের ন্যায় ভীষণ অন্ধকার আর নেই। তাঁর নূরের অস্তিত্বের ন্যায় আর কোন নূর বা আলো তত প্রকাশ্য নয়। প্রত্যেক জিনিসের অস্তিত্ব তাঁর নূরেরই ফল। কেননা সব জিনিসের জীবন ও প্রতিপালন তাঁরই উপর ন্যস্ত। যেরূপ সূর্যের জ্যোতি কোন বস্তুর আলোকে রক্ষা করে, তদ্রূপ আল্লাহ নিজেই নিজেকে রক্ষা করেন। সূর্যের একটি অংশ গ্রহণ হলে, যদি তুমি একটি সলিল পূর্ণ পেয়ালার মধ্যে সূর্যকে দেখ, তার মধ্যে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে এবং তাতে দৃষ্টিপাত করা সম্ভব হবে। সুতরাং সূর্যের জ্যোতি আংশিক বন্ধ করার জন্য সলিলের মাধ্যমে তা' করতে করতে হয়। তদ্রূপ তাঁর কারুকার্যের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার গুণ বা স্বভাব দেখা যায়। তাঁর অস্তিত্বের জ্যোতিতে আমরা তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাই না তাঁর কার্যাবলীর মাধ্যমে আমরা দূরে সরে যাই না। এটাই হুযুরে পাক (দঃ)-এর এই বাণীর গূঢ় তত্ত্ব। "আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে চিন্তা কর। আল্লাহর সত্তা বা অস্তিত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করো না।"

Post a Comment

0 Comments