মেরাজের ঐতিহাসিক পটভূমি
এই মেরাজের ঘটনাটি ইসলামের প্রথম যুগে এমন এক স্তরে সংঘটিত হয় যখন নবী করীম (সঃ) তাওহীদের আওয়াজ বুলন্দ করার পর প্রায় বার বৎসর অতীত হয়ে গেছে। বিধর্মীরা তার পথ রোধ করার জন্যে সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। কিন্তু বিধর্মীদের বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নবী করীম (সঃ)-এর ইসলামের দাওয়াত আরবের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। আরব দেশের এমন কোন গোত্র ছিলনা যার দুই চারজন লোক নবী করীম (সঃ)-এর ইসলামের দাওয়াতের প্রভাবে প্রভাবিত হয় নাই। মক্কায় মুষ্টিমেয় নিষ্ঠাবান লোকদের এমন একটি দল তৈরি হয়েছিল যারা এই ইসলামের দাওয়াতের সাফল্যের জন্য জীবনের যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন মদীনায় আওস ও খাজরাজ শক্তিশালী গোত্রদ্বয়ের বিরাট সংখ্যক লোক নবী করীম (সঃ)-এর সাহায্য সহযোগীতাকারী হয়ে পড়েছিলেন। যে সময় এত নিকটবর্তী হয়ে পড়েছিল যখন মহানবী (সঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। এই পরিস্থিতিতে মেরাজ সংঘটিত হয়।
মেরাজের তারিখ
মহানবী (সঃ)-এর জীবনে মেরাজ একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বা মুজিজা। এ মেরাজের ঘটনাটি কখন কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে তা নিয়ে মুহাদ্দেসানে কেয়ারেম, সীরাতকার ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। মিরাজের তারিখ ও সময় নির্ণয়ে অসুবিধা দেখা দিল এই জন্য যে, হিজরতের পূর্বে অর্থাৎ মেরাজ সংঘটিত হবার কালে সন তারিখ নির্ধারণ প্রবর্তিত ছিল না। তবে মেরাজ রাতের বেলা হয়েছিল তা নিশ্চিত। পবিত্র কোরআনের ভাষায়-"আল্লাহ পাক তাঁকে রাতের বেলা নৈশ্য ভ্রমণে নিয়ে গেলেন।" বাক্যটি এবং অন্যান্য হাদীসের ঐক্যমতের বর্ণনা রাতের বেলাকেই সুপ্রমাণিত করে। কিন্তু দিন তারিখ নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। কেননা, সহীহ হাদীসের কোন বর্ণনাতেই মেরাজের তারিখের উপর আলোকপাত ঘটেনি। তবে একথায় সকলে একমত যে ঘটনাটি নবুয়াত প্রাপ্তির ও ওহী লাভের প্রারম্ভকালে এবং হিজরতের পূর্বে মক্কা শরীফে ঘটেছে। মেরাজ কোন মাসে সংঘটিত এ নিয়ে জীবনীকারদের পাঁচটি মতামত পরিলক্ষিত হয়-
(ক) মেরাজ রবিউল আউয়াল মাসে হয়েছে।
(খ) মেরাজ রবিউস সানি মাসে হয়েছে।
(গ) মেরাজ রজব মাসে হয়েছে।
(ঘ) মেরাজ রমজান মাসে হয়েছে।
(ঙ) মেরাজ শওয়াল মাসে হয়েছে।
মেরাজ এর সময় ও তারিখ সম্পর্কে সাহবীদের কাছ থেকে ১০টি মতামত পাওয়া যায়। যেমন-
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন- মেরাজ মদীনায় হিজরতের এক বছর আগে ১৭ই রবিউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।
উপরোক্ত মতামতের সাথে সম্পৃক্ত আরো দুটি মতামত পাওয়া যায় তা হল- হযরত ওম্মে সালমা ও আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন- হিজরতের এক বছর আগে ১৭ই রবিউল আউয়াল মেরাজ সংঘটিত হয়।
হয়রত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত ওম্মে হানী (রাঃ) ও ১৭ রবিউল আউয়ালের কথা ব্যক্ত করেছেন।
২. হযরত মূসা ইবনে ওকবা হতে যুহরী বর্ণনা করেন-মদীনায় হিজরতের এক বৎসর পূর্বে হিজরত সংঘটিত হয়।
৩. হযরত সাইদ ইবনে মুসাইয়্যের হতে যুহরী হিজরতের এক বছর আগে মেরাজ সংঘটিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন।
৪. হযরত কাতাদাহ হিজরতের এক বছর আগে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার কথা বর্ণনা
করেন।
৫. হযরত আয়েশা (রাঃ) ও ইবনে যুবাইর (রাঃ) হিজরতের এক বছর আগেকার কথা বলেছেন।
৬. হযরত ইবনে যরীজ ও হিজরতের এক বছর আগে মিরাজ হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন।
৭. হযরত মাকাতিলও হিজরতের এক বছর আগে মেরাজ হওয়ার কথা বলেছেন।
৮. ইব্রাহীম ইবনে মেজাক আল বেরী হিজরতের এক বছর আগে ২৭শে রবিউল সানি এর কথা উল্লেখ করেন।
৯. আমর ইবনে শুয়াইব আমর ইবনুল আস হতে হিজরতের এক বছর আগে ৭ই রবিউল আউয়ালের কথা বর্ণনা করেছেন।
১০. মুসলিম ইবনে কুতাইশ হিজরতের ১৮ মাস আগের কথা বলেছেন।
সর্বশেষ কথা হল যে, মেরাজের সন তারিখ নিয়ে ওলামায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তা সত্ত্বেও এই শতাব্দির বা তারও আগের শতাব্দির ওলামায়ে কিরামদেরও মিরাজ করেছেন। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ও মতানুযায়ী একাদশ সন মেরাজ সংঘটিত হয়েছে। আর মাস ও তারিখ সম্পর্কে সর্বশেষ প্রসিদ্ধ মতে রজব মাসের ২৭ তারিখ স্থির হয়েছে।
মেরাজের তারিখ সম্পর্কে কবি বলেছেন-
"নবুয়তের নবম বছর হইয়া গেলো পার
খুইল্যা গেলো তার জীবনের আরেক নতুন দ্বার।
বছর ঘুরি আইলো দ্বারে রজব মাসের চান
আল্লাহ বলেন, আমি দিবো দোসতেরে সম্মান
দেখাইবো তারে কিছু মোর মহিমার চিন,
আনবো তারে কাছে আমার আমার খাস আমিন।"
উপরোক্ত মতানুযায়ী আমাদের দেশে বা এই উপমহাদেশে মেরাজ রজনী পালিত হয়। সুতরাং এ মেরাজ এর তারিখ সম্পর্কে তৎপর না হওয়াই ইসলাম ও শরীয়াতে। দিক দিয়ে উত্তম, সাহাবী ও তাবেঈগণ এ ব্যাপারে তৎপর দেখাননি, কারণ, তাতে বিদআ তথা নানা ধরনের কুসংস্কার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং আমাদেরও এ ব্যাপারে মতানৈক্য থেকে বিরত থাকা উত্তম।
0 Comments