কুরআনের আদব মনযোগ ও একাগ্রতার সাথে তিলাওয়াত করা

         (৩) মনযোগ ও একাগ্রতার সাথে তিলাওয়াত করাঃ আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, "ইয়। ইয়াহইয়া। খুযিল কিতাবা বিন্তুওয়্যাতিন" অর্থাৎ হে ইয়াহইয়া। কিতাবকে শক্তভাবে ধর।" এ আয়াতের অর্থ করা হয় পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সহকারে কিতাবের অনুসরণ কর। শক্ত করে ধর এর অর্থ কুরআন পাঠ করার সময় তার বিষয়বস্তুর উপর চিন্তা করা। তোমরা যারা কুরআন পাঠ কর, তোমাদের চেষ্টা ও যত্নও তারই দিকে নিয়োগ কর। কোন বুযর্গকে কেউ জিজ্ঞেস করল, যখন তুমি কুরআন পাঠ কর, তখন তোমার মন কার সাথে কথা বলে? বুযর্গ বলল, কুরআন ব্যতীত অন্য কোন কিছুই আমার নিকট অধিক প্রিয় নয়। প্রাচীন কালের এক বুযর্গ বলেছেন, অন্যমনস্ক ভাবে কোন আয়াত পড়ে থাকলে তা' পুনর্বার পাঠ কর। কেননা, তুমি কুরআন ও কুরআনের প্রভুর প্রতি মনে যে সম্মান নিয়ে পাঠ আরম্ভ করেছিলে, তখন তাই আবার ফিরে আসবে। যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে তার সুসংবাদ কামনা করে, তার সাথে প্রীতির সম্পর্ক রাখে এবং তা' থেকে গাফেল না থাকে, সে-ই ইহার সম্মান করে। কুরআনের মধ্যে এমন আয়াত আছে, যা অন্তরে প্রীতি জনন্মায়, যদি কুরআন তিলাওয়াতকারী তার উপযুক্ত হয়। তিলাওয়াত করা কালে যদি তুমি অন্য বিষয় চিন্তা কর, তাহলে কিভাবে তুমি সেই প্রীতি লাভ করবে? কুরআন খোদ বিশ্রামস্থল। যে ব্যক্তি যে আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকে, সে তাছাড়া অন্য বিষয় চিন্তা করে না। বর্ণিত আছে যে, কুরআনে পাকে ময়দান আছে, বাগান আছে, দালান কোঠা আছে। সুন্দরী নববধূ আছে, রেশমী পোশাক আছে এবং প্রমোদকক্ষ আছে। এ ছাড়া আরও অনেক কিছুই আছে। যখন কুরআন পাঠকারী ময়দানে গমন করে উদ্যানে প্রবেশ করে ও তথাকার দালান কোঠায় ঢুকে রেশমী পোশাক পরে, নববধুর দর্শন লাভ করে আর প্রমোদোদ্যানে আমোদ-প্রমোদ করে, নব বধুকে নিয়ে প্রমোদ কক্ষে পরম হর্ষে আনন্দে বসবাস করতে আকে, তখন সে তাতেই মত্ত থাকে, তখন তার অন্য কিছুর দিকেই মনোযোগ থাকে না; বরং তার মন শুধু ঐ আনন্দেই মগ্ন থাকে, অন্য কোন দিকে তার চিন্তাই ধাবিত হয় না।

        (৪) কুরআনের বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করাঃ এটা হুযুরী কালব অর্থাৎ মনোযোগ এবং একাগ্রতা ছাড়া সম্ভব নয়। এজন্যই কুরআনে পাক ধীরে ধীরে তিলাওয়াতের বিধান রয়েছে। কখনও কখনও কুরআন পাঠকারী অন্য চিন্তা অবশ্য করে না কিন্তু সে শুধু মুখে তিলাওয়াত করে কিন্তু তার অর্থ লক্ষ্য করে না। অথচ তিলাওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল, কি পড়ছে তার অর্থ বুঝা ও সে সম্পর্কে চিন্তা ফিকির করা। এজন্যই কুরআন বীরে-সুস্থে পড়ার কথা বলা হয়েছে, যাতে করে তার অর্থ বুঝে আসে। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, যে ইবাদাতে তার মর্মবোধ থাকে। না. তাতে কোন বরকত বা মঙ্গল নেই। তাই যে ব্যক্তি কালামুল্লাহ দুবার তিলাওয়াত ব্যতিরেকে তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পারে, তার উচিত হবে একবার ভিলাভাতের পর পুনর্বার পাঠ করা। তবে যদি কেউ ইমামের পিছনে থাকে এবং ইমামের পঠিত আয়াতের মর্ম চিন্তা করে, পক্ষান্তরে ইমাম অন্য আয়াতের পাঠ শুরু করে, তবে এ অবস্থা বাঞ্ছিত নয়। এটা ঠিক এরূপ গটনার মত হবে, যেমন কেউ কারও কথা শুনতে গিয়ে তার একটি কথা শ্রবণ করেই আশ্চর্য হয়ে যায় এবং তা' নিয়েই ভাবনামগ্ন হয়; কিন্তু বক্তার অন্যান্য কথাগুলোর দিকে মনোযোগই দেয় না। ইমাম হয়তো বহু আয়াত পড়ে ফেলেছেন, এ দিকে মুক্তাদী ইমাম পঠিত সেই প্রথম আয়াত নিয়ে তখনও ভাবতে থাকে। এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নয়। বরং নিয়ম হল, ইমাম যে রোকন আদায় করে ও যা কিছু পাঠ করে, মুক্তাদী যেন সে বিষয় নিয়েই চিন্তা করে, তা' রেখে দিয়ে অন্য বিষয় চিন্তা করা নফসের প্রতারণা। আমর বিন আবদে কায়েস বলেছেন, নামাযের মধ্যে কুমন্ত্রণা আমার অনুসরণ করে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তা কি পার্থিব বিষয় বস্তু? তিনি বললেন, না পার্থিব বিষয় বস্তুর কুমন্ত্রণা হতে আমি আমার বুকে ধারাল ছুরি প্রবেশ করিয়ে দেয়া সুখকর মনে করি। আমার অবস্থ্য এরূপ হয় যে, আমার মনে আল্লাহর চিন্তা আসে। পাঠক চিন্তা করুন, এটাকেও তিনি কুমন্ত্রণা মনে করতেন। এর কারণ হল, তিনি যখন যা পাঠ করতেন বা যে রোকনে পৌছতেন, তখন সে বিষয় চিন্তা না করে অন্য বিষয় চিন্তা করা তাঁর কাছে অবান্তর মনে হত। তাঁর এ বিষয়টি যখন হযরত হাসান বছরীর (রহঃ) কর্ণগোচর হল, তিনি সংবাদদাতাকে বললেন, তাঁর সম্বন্ধে তোমার কথা যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ তাঁকে যে অনুগ্রহ করেছেন, আমাদেরকে তা' করেন নি। 

        বর্ণিত রয়েছে, একবার হুযুরে পাক (দঃ) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করলেন। তিনি তা' বিশবার পড়লেন। অর্থাৎ এ কালামটির অর্থের দিকে চিন্তা করে তিনি এভাবে বার বার পড়লেন। হযরত আবু যর (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) একরাতে আমাদের নিয়ে নামায পড়তেছিলেন। নামাযে একটি আয়াত তিনি বার বার পড়তে লাগলেন। আয়াতটির অর্থ হল যদি তুমি তাদেরকে শাস্তি দাও, তারা তোমার দাস মাত্র, আর যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন কর, তুমি নিশ্চয় ক্ষমাশীল, কৃপাময়। একদা মহাত্মা তামীমদারী "আম হাসিবাল্লাযীনাযতারাহ-" আয়াতটি বার বার পড়ে সারা রাত নামাযে কাটিয়ে দিলেন। হযরত সাঈদ বিন জোবায়ের এক রাতে অমতাজুল ইয়াওমা আইয়্যুহাল মুজরিমুন আয়াতটি নামাযের মধ্যে পুনঃ পুনঃ পাঠ করলেন। কোন এক বুযর্গ বলেছেন, আমি এক এক সূরা তিলাওয়াত শরু করে তার কোন কোন আয়াত এত বেশীবার পাঠ করি যে, ফজর পর্যন্ত আমি বিরত হই না। কিন্তু তাতেও আমার আকাঙ্খা প্রশমিত হয় না। অন্য এক বুযর্গ বলেছেন, যেসব আয়াত আমার অবোধগম্য, আমার হৃদয়ে তাতে শান্তি আসে না। আমি তা' ছওয়াবের জন্য বার বার তিলাওয়াত করি না।

        হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেন, আমি একটি আয়াত পাঠ করে চার বা পাঁচ রাত ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি তার চিন্তা থেকে অব্যাহতি লাভ না করা পর্যন্ত আমার দ্বিতীয় আয়াতের পালা আসে না। পূর্বযুগীয় এক বুযর্গ বলেছিলেন যে, একবার শুধু সূরা হুদ পাঠ করে করে তিনি একাধারে ছমাস কাটিয়েছিলেন। তিনি তা' পুনঃ পুনঃ পাঠ করতেন আর তদ্বিষয়ে চিন্তায় রত থাকতেন।

        এক আরিফবিল্লাহ বর্ণনা করেছেন, আমার কুরআন খতম হয় প্রতি জুমআতে একবার, প্রতি মাসে একবার এবং প্রতি বছরে একবার; কিন্তু তারপর গত ত্রিশ বছর ধরে আমি কুরআন পাঠ করছি। কিন্তু এখনও তা' শেষ করতে পারি নি। এসব খতম আমার চিন্তা ও অনুসন্ধানের পরিমাণ অনুসারে হয়েছে। ঐ ব্যক্তি এরূপ বলেছেন যে, আমি নিজেকে এরূপ মজদুর রূপে গণ্য করেছি, যে কোন কাজ এক সপ্তাহে শেষ করে দেয় আবার কখনও বহু বছরেও শেষ করতে পারে না।

Post a Comment

0 Comments