যয়নাব (রা)-এর ডাকনাম ছিল উম্মে হাকাম। তাঁর পিতা ছিলেন বনু খুযায়মা গোত্রের জাহাশ ইবনে রাবাব আল আসাদী এবং মাতা রাসূলুল্লাহর (সা) আপন ফুফাতো বোন। যয়নাবের (রা) দুই ভাই- 'উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও আবু আহমাদ ইবনে জাহাশ আবু সুফইয়ানের (রা) দুই মেয়ে যথাক্রমে উম্মে হাবীবা ও ফারি'আকে বিয়ে করেন। তাঁর অপর ভাই 'আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা) উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ এবং অন্য সকল ভাই-বোন প্রথম যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর সবাই হাবশায় হিজরত করেন। সেখানে ভাই 'উবায়দুল্লাহ খ্রিস্টান হয়ে যান এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে হাবীবা (রা) ইসলামের উপর অটল থাকেন।
রাসূলে কারীম (সা) স্বীয় আযাদকৃত দাস ও পালিত পুত্র যায়িদ ইবনে হারিসার সাথে তাঁর বিয়ে দেন। যয়নাবের (রা) বিয়ের ঘটনাটি ছিল সাম্য ও সমতার বাস্তব শিক্ষার ভিত্তি। ইসলাম সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করে তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতিকে এবং যে কোন ধরনের গর্ব, আভিজাত্য ও কৌলিন্য জাহিলিয়াতের প্রতীক। এই ভিত্তিতে হযরত যায়েদ যদিও দৃশ্যত একজন দাস ছিলেন, তবুও যেহেতু ইসলাম তাঁর দ্বারা সীমাহীন শক্তি লাভ করে, এ কারণে হাজার হাজার স্বাধীন ব্যক্তি থেকেও তাঁকে শ্রেষ্ঠতর গণ্য করা হতো। ইসলামী সাম্যের বাস্তব শিক্ষাদান ছাড়া এই বিয়ের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল।
কুরাইশরা বংশের গর্ব করতো। বংশ নিয়ে তাদের গৌরবের অন্ত ছিলনা। কিন্তু রাসূল (সা) যয়নাব বিনতে জাহাশের বিয়ে দিলেন যায়িদ ইবনে হারিসার সাথে। যায়িদ ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) প্রীতিভাজন ব্যক্তি। খাদীজা (রা) ও আবু বকর (রা) যে সময়ে মুসলমান হন, যায়িদও সে সময় মুসলমান হন। অধিকাংশ অভিযানে রাসূল (সা) কুরাইশ নেতাদের উপর তাঁকে পরিচালক নিয়োগ করতেন। যায়িদ রাসূলুল্লাহর (সা) এত কাছের মানুষ হয়ে যান যে, এক সময় তিনি যায়িদ ইবনে মুহাম্মাদ হিসেবে প্রসিদ্ধি পান। তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহর (সা) বিশেষ অনুগ্রহ ছিল। এতসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দাস। আর যয়নাবের ছিল বংশ কৌলিন্য। প্রথম থেকেই এ বিয়েতে যয়নাবের মত ছিলনা। তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) সরাসরি বলে দিয়েছিলেন-
তাকে আমি নিজের জন্য পছন্দ করিনে। কিন্তু অবশেষে রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে রাজী হন। তখন নাজিল হয়: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দান করেন তখন কোন মুমিন নারী পুরুষের কোন প্রকার ইখতিয়ার থাকে না। (সূরা আহযাব)
বিয়ের পর এক বছর দুইজন একসাথে থাকেন কিন্তু প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলো না। দিন দিন সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে উঠলো। যায়িদ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে অভিযোগ করলেন এবং তালাক দানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) যায়িদকে তালাক দান থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কুরআন পাকে বলা হয়েছে: যখন আপনি সেই ব্যক্তিকে যার প্রতি আল্লাহ ও আপনি অনুগ্রহ করেছেন, বলছিলেন যে, তোমার স্ত্রীকে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর।
রাসূলুল্লাহর (সা) শত চেষ্টা সত্ত্বেও যয়নাব ও যায়িদের (রা) বিবাহ টিকলো না। যায়িদ (রা) তাঁকে তালাক দিয়ে দিলেন।
যয়নাব ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) আত্মীয়। রাসূলুল্লাহই (সা) তাকে লালন পালন করেন। তাই যখন তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, তখন রাসূল (সা) তাঁকে খুশী করার জন্য নিজেই বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করতে লাগলেন। কিন্তু যেহেতু তখনও পর্যন্ত মুসলিমদের মন-মানসে জাহিলী যুগের প্রথা ও কুসংস্কারের প্রভাব কিছুটা বিদ্যমান ছিল, এ কারণে তিনি নিজের মনের ইচ্ছা চেপে রাখেন। কারণ, যায়িদ ছিলেন তাঁর পালিত পুত্র। আর জাহিলী সমাজ আপন ঔরসজাত পুত্র ও পালিত পুত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য করতো না। যয়নাব ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) পালিত পুত্র যায়িদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী। পালিত পুত্রের বিচ্ছেদপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে না করার প্রথাটি ছিল একটি জাহিলী কুসংস্কার মাত্র, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) ইচ্ছা ছিল তার মূলোৎপাটন করা, এ কারণে আল্লাহ্ পাক রাসূলুল্লাহর (সা) সে সময়ে মনের ইচ্ছাটি প্রকাশ
করে দেন, 'আপনি আপনার অন্তরে এমন কথা গোপন করে রাখছেন যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিচ্ছেন। আর আপনি মানুষকে ভয় করছেন, অথচ আল্লাহকে ভয় করা আপনার জন্য অধিকতর সঙ্গত'।
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: যয়নাবের (রা) 'ইদ্দত' কাল শেষ হলে রাসুলুল্লাহ (সা) যায়িদকেই তাঁর কাছে এই বলে পাঠালেন যে, তুমি তার কাছে আমার বিয়ের পয়গাম নিয়ে যাও। যায়েদ (রা) যেয়ে দেখেন যয়নাব (রা) আটা চটকাচ্ছেন। যায়েদ বলছেন, তাঁর প্রতি চোখ তুলে তাকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলি। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা) তাঁকে বিয়ের পয়গাম পাঠিয়েছেন। আমি একটু পেছনে সরে আসি। অন্য বর্ণনায় এসেছে, যায়েদ (রা) যয়নাবের (রা) ঘরের দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, যয়নাব। আমি রাসূলুল্লাহর (সা) পক্ষ থেকে বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছি। যয়নাব জবাব দিলেন, 'এখন আমি কাজ করছি। আল্লাহর কাছে ইসতিখারা ব্যতীত কিছু বলতে পারিনে।' এ কথা বলে তিনি মসজিদের দিকে যেতে শুরু করেন। এদিকে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করেন: পরে যায়েদ যখন তার নিকট হতে নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করে নিল তখন আমরা তাকে (তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে) তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। যেন নিজেদের মুখ-ডাকা পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মুমিন লোকদের কোন অসুবিধে না থাকে-যখন তারা তাদের নিকট হতে নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করে নেয়। আল্লাহর আদেশ তো বাস্তবায়ন হতেই হবে। এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, যয়নাবের সাথে তোমার বিয়ের কাজটি আমিই সমাধা করে দিলাম।
আল্লাহ ত'আলা তাঁর নবীর দ্বারা এ কাজটি করিয়েছেন একটি বিশেষ প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে। যা এ পন্থা ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে অর্জিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না। আরবে মুখ-ডাকা আত্মীয়দের সম্পর্কে অত্যন্ত মারাত্মক ধরনের ভূল প্রথা প্রচলিত হয়েছিল এবং যুগ যুগ ধরে অব্যাহতভাবে তা চলে আসছিল পূর্ণ দাপটের সাথে। তা উৎখাত করার একটি মাত্র উপায় কার্যকর ও সফল হতে পারতো। আর তা হলো আল্লাহর রাসূল (সা) নিজেই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তা শিকড়সহ উপড়ে ফেলবেন। অতিশয় প্রয়োজনীয় কাজের লক্ষ্যেই তিনি তা করেছিলে। যয়নাবের (রা) সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) বিয়ে হয়ে গেলে ইসলামের দুশমনরা বলতে লাগল যে, মুহাম্মাদ (সা) তাঁর পুত্র-বধুকে বিয়ে করেছেন, অথচ তাঁর নিজের শরীয়াতের আইনেও পুত্র বধুকে বিয়ে করা পিতার জন্য হারাম করা হয়েছে। এর জবাবে আল্লাহ পাক নাযিল করেন, (হে জনগণ) মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারও পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী মাত্র। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞানী। (সূরা আহযাব)
'মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারও পিতা নয়।' অর্থাৎ যে ব্যক্তির পরিত্যক্ত স্ত্রীকে
মুহাম্মাদ (সা) বিয়ে করেছেন সে তো রাসূলের (সা) পুত্রই ছিল না। কাজেই তার পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা রাসূলের (সা) জন্য কখনও হারাম ছিল না। তোমরা নিজেরাই জান যে, নবী কারীমের (সা) বাস্তবিকই কোন পুত্র সন্তান বর্তমান নেই। বিরুদ্ধ বাদীদের দ্বিতীয় প্রশ্ন এই ছিল যে, মুখ-ডাকা পুত্র যদি প্রকৃত ঔরসজাত পুত্র না-ও হয়, তবুও তার পরিত্যক্তা স্ত্রীকে বিয়ে করতেই হবে এমন কোন প্রয়োজন তো ছিল না। এর জবাবে বলা হয়েছে। যে কারণে শুধু শুধুই হারাম বিবেচিত হয়ে আসছে, সে বিষয়ে সকল ভুল-ভ্রান্তির মূলোৎপাটন করে দেওয়া রাসূল হওয়ার কারণেই হযরত মুহাম্মাদের (সা) কর্তব্য। তাছাড়া তিনি সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন রাসূল আসবেন না। কাজেই তাঁর জীবনকালে কোন আইন ও সমাজের কোন সংশোধনী যদি অকার্যকর ও অবাস্তবায়িত থেকে যায়, তবে তা পরবর্তী কোন নবীর দ্বারা সম্পন্ন হওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। কাজেই এই জাহিলী কু-প্রথা বিলুপ্ত করা তাঁর নিজের পক্ষেই একান্ত কর্তব্য হয়ে দেখা দিয়েছে। গুরুত্ব আরোপের জন্য বলা হয়েছে: 'আল্লাহ সর্ববিষয়েই জ্ঞানী।' অর্থাৎ আল্লাহ ভালো করেই জানেন যে, এখনই শেষ নবীর দ্বারা এ কু-প্রথা বিলোপ করে দেওয়া একান্ত জরুরী। তা না হলে তার পরে এমন কোন ব্যক্তি দুনিয়ায় থাকবে না যার দ্বারা কু-প্রথা দূর করা সম্ভব হবে।
যয়নাবের (রা) বিয়ের মধ্যে এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা আর কোথায়ও পাওয়া যায় না। যেমন-
১। পালিত ও ধর্মপুত্রকে যে ঔরসজাত পুত্রের সমান জ্ঞান করা হতো, সেই ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়।
২। দাস ও স্বাধীন ব্যক্তির মধ্যে মর্যাদার যে পর্বত পরিমাণ ব্যবধান ছিল তা দূর করে ইসলামী সাম্যের বাস্তব দৃষ্টান্ত এ বিয়েতে প্রতিষ্ঠিত হয়। দাস যায়িদকে আরবের সর্বশ্রেষ্ঠা ও সর্বাধিক অভিজাত বংশ বনু হাশিমের সম-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
৩। এ বিয়েকে কেন্দ্র করে পর্দার হুকুম নাযিল হয় অথবা বলা চলে এ বিয়ে ছিল পর্দার হুকুম নাযিলের পটভূমি।
৪। এ বিয়ের জন্য ওহী নাযিল হয়।
৫। এ বিয়ের ওলীমা হয় জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে।
এসবের কারণেই যয়নাব (রা) তাঁর অন্য সতীনদের সামনে গর্ব করতেন। একদিন তো তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলেই বসলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)। আমি আপন। অন্য কোন বিবির মত নই। তাঁদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাঁর বিয়ে তাঁর পিতা, ভাই, অথবা খান্দানের কোন অভিভাবক দেননি। একমাত্র আমি-যার বিয়ে আল্লাহ তা'আলা আসমান থেকে আপনার সাথে সম্পন্ন করেছেন।
যয়নাবের (রা) এ দাবীর পেছসে যৌক্তিকতাও ছিল। কারণ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফাতো বোন এবং রূপ ও সৌন্দর্যের অধিকারী। রাসূলুল্লাহও (সা) সব সময় তাঁকে খুশী রাখতে চাইতেন। যয়নাবের (রা) চরিত্রে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা খুব কম নারীর মধ্যেই পাওয়া যেত। রাসূলুল্লাহর (সা) নৈকট্য লাভের ব্যাপারে হযরত আয়েশা (রা) ও তাঁর মধ্যে ভিতরে ভিতরে একটি প্রতিযোগিতার মনোভাব কাজ করতো। রাসূলে পাকের (সা) পবিত্র সুহবতের বরকতে তাঁরা এত উদার ও মহানুভব হয়ে গিয়েছিলেন যে, একজন অপরজনের ভালো গুণগুলি অকপটে স্বীকার করেছেন। আমরণ মানুষের কাছে তা প্রচার করে গেছেন। এ কাজ কেবল বড় মাপের মানুষেরাই করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে 'ইল্ফ-এর ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। হযরত 'আয়েশার (রা) প্রতি কলঙ্ক আরোপের ঘটনা হলো 'ইফক'-এর ঘটনা। এই ষড়যন্ত্রের সাথে হযরত যয়নাবের (রা) বোন হামনা বিনতে জাহাশও জড়িয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন, এই সুযোগে বোন যয়নাবের (রা) সতীন ও প্রতিদ্বন্দী 'আয়েশাকে (রা) কাবু করতে পারলে বোন যয়নাব অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে যাবেন। বোনের শুভ চিন্তায় তিনি এই নোংরা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় যয়নাবের (রা) ভূমিকা কি ছিল। প্রতিদ্বন্দী সতীনকে ঘায়েল করার চমৎকার এক সুযোগ। এ জাতীয় মোক্ষম সুযোগ জগতের কোন সতীন হাতছাড়া করেছে বলে জানা যায়না। কিন্তু হযরত যয়নাব (রা) নৈতিকতা ও অধ্যাত্মিকতার যে স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন তাতে তাঁর মত লোকের পক্ষে এমন নোংরা ষড়যন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন তা কল্পনা করা যায় না। 'আয়েশার (রা) সে দুর্যোগের দিনে একদিন রাসূলুল্লাহ (রা) 'আয়েশা (রা) সম্পর্কে যয়নাবের (রা) মতামত জানতে চাইলে যয়নাব (রা) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বললেন,
আমি তাঁর মধ্যে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানিনে। পরে হযরত আয়েশার (রা) পবিত্রতা সত্যবাদিতা ও উন্নত নৈতিকতাও প্রমাণিত হয়। 'আয়েশা (রা) আজীবন হযরত যয়নাবের (রা) এ ঋণ মনে রেখেছেন। সারা জীবন তিনি মানুষের কাছে সে কথা বলেছেন। যয়নাবের (রা) মধ্যে যত গুণাবলী তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, অকপটে তা মানুষকে জানিয়েছেন।
আয়েশা (রা) 'ইফক'-এর ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত যয়নাবের (রা) ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। 'আয়েশার (রা) মত প্রখর বুদ্ধিমতী, বিদূষী ও মহিয়সী নারী যখন হযরত যয়নাবের (রা) প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন তাঁর মর্যাদা ও স্থান যে কোন্ স্তরে তা অনুমান করতে আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ হযরত 'আয়েশা (রা) তাঁর খোদাপ্রদত্ত ও তীক্ষ্ণ মেধা দিয়ে গভীরভাবে অতি নিকট থেকে যয়নাবকে (রা) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
আয়েশা (রা) বলেন: 'আমি যয়নাবের (রা) চেয়ে কোন মহিলাকে বেশী পরহেযগার, বেশী অত্যল্পাভাষী, বেশী উদার, দানশীল, সৎকর্মশীল এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে, বেশী তৎপর দেখিনি।
আয়েশা (রা) আরও বলেছেন: 'রাসূল (সা) পরকালে তাঁর সাথে সর্বপ্রথম মিলিত হওয়ার এবং জান্নাতে তাঁর স্ত্রী হওয়ার সুসংবাদ দান করে গেছেন।
উম্মে সালামা (রা) তাঁর সম্পর্কে বলেছেনঃ তিনি ছিলেন খুব বেশী সৎকর্মশীলা, বেশী সওম পালনকারিনী ও বেশী বেশী সালাম প্রদানকারিনী।
আয়েশা (রা) থেকে আরেকটি বর্ণনায় দেখা যায় যয়নাব (রা) হাতে সূতা কেটে রাসূলুল্লাহর (সা) যুদ্ধবন্দীদেরকে দিতেন। আর তারা কাপড় বুনতো। রাসূলুল্লাহ (সা) যুদ্ধের কাজে তা ব্যবহার করতেন। তাঁর দানের হাত এমন ছিল যে, খলীফা 'উমর (রা) তাঁর জন্য বাৎসরিক বার হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করে দেয়; কিন্তু তিনি কখনও তা গ্রহণ করেননি। একবার উমর (রা) তাঁর এক বছরের ভাতা পাঠালেন। যয়নাব (রাঃ) দিরহামগুলি একখানা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর বাযরাহ ইবনে রাফে'কে নির্দেশ দেন দিরহামগুলো আত্মীয়-স্বজন ও গরীব মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করার জন্য। বাযরাহ বলেন, এতে আমাদেরও কি কিছু অধিকার আছে? তিনি বললেন কাপড়ের নীচে যেগুলি আছে সেগুলি তোমার। সেগুলি কুড়িয়ে গুণে দেখা গেল পঁচাশি দিরহাম। সব দিরহাম বণ্টন করার পর তিনি দু'আ করেন এই বলে: 'হে আল্লাহ। আগামীতে এই অর্থ যেন আমাকে আর না পাঠায়। কারণ, এ এক পরীক্ষা।' এ খবর হযরত উমরের (রা) কানে গেল, তিনি মন্তব্য করলেন: 'এ এমন মহিলা যার থেকে শুধু ভালো আশা করা যায়। তারপর হযরত উমর (রা) কিছুক্ষণ তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং সালাম বলে পাঠান। তিনি যয়নাবকে (রা) বলেন, আপনি যা কিছু করেছেন সবই আমি জেনেগেছি। ফিরে গিয়ে তিনি আরও এক হাজার দিরহাম তাঁর খরচের জন্য পাঠান। তিনি সেগুলিও আগের মত খরচ করে ফেলেন। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, হযরত যয়নাবের (রা) উপরোক্ত দু'আ কবুল হয় এবং তিনি সে বছরই ইনতিকাল করেন।
ইন্তিকালঃ
খলীফা হযরত উমর (রা) এর খিলাফতকালে হিজরী ২০ সনে যয়নাব (রা) ইনতিকাল করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর দানের স্বভাব বিদ্যমান ছিল। নিজের কাফনের ব্যবস্থা নিজেই করে যান। তবে তিনি আপনজনদের বলে যান, আমার মৃত্যুর পর 'উমর (রা) কাফনের কাপড় পাঠাতে পারেন, যদি এমন হয় তাহলে দুইটির যে কোন একটি কাফন গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিবে। উমর (রা) পাঁচখানা কাপড় পাঠান এবং তাই দিয়ে কাফন দেওয়া হয় আর যয়নাব (রা) যে কাপড় রেখে গিয়েছিলেন তাঁর বোন হাফসা তা দান করে দেন। রাসূলুল্লাহকে (সা) যে খাটিয়াতে করে কবরের কাছে নেওয়া হয়েছিল, তাঁকেও সেই খাটিয়াতে উঠানো হয়। তিনিই প্রথম মহিলা যাঁকে হযরত আবু বকরের (রা) পরে এই খাটিয়ায় ওঠানো হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) অন্যান্য বিবিগণ তাঁকে গোসল দেন। 'উমর (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়।
যয়নাবের (রা) মৃত্যুতে 'আয়েশা (রা) অত্যন্ত শোকাভিভূত হন। তিনি তাঁর সেই সময়ের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন-তিনি প্রশংসিত ও অতুলনীয় অবস্থায় চলে গেলেন। ইয়াতীম ও বিধবাদের অস্থির করে রেখে গেলেন। যয়নাব (রা) খুব কম হাদীস বর্ণনা করতেন। হাদীসের গ্রন্থাবলীতে তাঁর বর্ণিত মাত্র এগারোটি হাদীস সংকলিত হয়েছে।
রাসূলে কারীম (সা) ওফাতের পূর্বে একবার তাঁর বিবিগণের কাছে বলেন, তোমাদের মধ্যে খুব দ্রুত সে-ই আমার সাথে মিলিত হবে যার হাত সবচেয়ে বেশী লম্বা। তিনি হাত লম্বা দ্বারা রূপক অর্থে দানশীলতা বুঝিয়েছেন। কিন্তু সম্মানিত বিবিগণ শব্দগত অর্থ বুঝেছিলেন। এ কারণে তাঁরা একত্র হলে পরস্পর পরস্পরের হাত মেপে দেখতেন যে, কার হাত বেশী লম্বা। যয়নাব (রা) ছিলেন ছোট খাট মানুষ। যয়নাব বিনতে জাহাশের (রা) ইনতিকাল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা এমন করতেন। কিন্তু তিনি যখন সবার আগে মারা গেলেন তখন গভীরভাবে চিন্তা করে তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা) কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেন। তাই হযরত আয়েশা (রা) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন: আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা হাতের অধিকারিণী ছিলেন যয়নাব। কারণ, তিনি নিজের হাতে কাজ করে উপার্জন করতেন এবং তা দান করতেন।
0 Comments