হযরত জুয়ায়রিয়া (রাঃ) জীবনী

        উম্মুল মু'মিনীন হযরত জুয়ায়রিয়া (রাঃ) হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর প্রায় পরপরই বিশ্বনবী (সাঃ) এর সহধর্মিণীর মর্যাদা লাভ করেন। সুতরাং, নবী-মহিষীদের ক্রমিক সংখ্যায় হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) এর স্থান সাত জনের পর। এ মহিলার প্রকৃত নাম ছিল বাররাহ। হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) তা পরিবর্তন করে, জুয়ায়রিয়া রেখেছিলেন। হযরত জুয়ায়রিয়া (রাঃ) এর পিতা হারেস ইবনে আবু যিয়ার বা আবি দাররা খুযআ বংশের বনু মুসতালিক গোত্রের সর্দার ছিলেন।

        হারেস সুঠামো স্বাস্থ্যবান একজন পুরুষ ছিলেন। তার দৈহিক গঠনের অনুরূপ শৌর্য-বীর্যেও তিনি খ্যাতিমান পুরুষ ছিলেন। তা ছাড়া তার হৃদয়টি ছিল অতিশয় উদার ও মহৎ। লোকগণ তাকে যারপর নাই ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত।

        এ সর্দার হারেসেরই এক কন্যা সন্তান ছিল। রূপে গুণে এ কন্যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একেতো সদরের কন্যা, তদুপরি রূপে গুণে ছিলেন অদ্বিতীয়, তাই তার পরিচয় ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্রই। এ কন্যাই ছিলেন বাররাহ তথা জুয়ায়রিয়া (রঃ)।

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর প্রথম বিবাহঃ

        বাররাহ যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথেই পিতা হারেস তার বিবাহ দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলেন। সহজেই স্ববংশীয় একটি উত্তম পাত্র পেয়ে গেলেন। এক পাত্রের নাম ছিল মুশাফি ইবনে সাফওয়ান। মুশাফি নানাগুণে গুণবান ছিলেন। হারেস তার কন্যা বররাহকে এ পাত্রের নিকটেই বিবাহ প্রদান করেন। হারেস কন্যাকে অত্যাধিক আদর করতেন বলে তাকে বিবাহ দিবার পরও তার যে কোন আবদার ও দাবী-দাওয়া পুরণ করতেন। পক্ষান্তরে তার স্বামীও তাকে অত্যাধিক ভালবাসতেন বলে তিনি স্বামীকে যখন যা বলতেন তিনি তা সম্পূর্ণরূপে মেনে চলতেন। এভাবে পিতা ও স্বামীর নিকট অত্যাধিক স্নেহ ও প্রীতিলাভ করে জুয়ায়রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা আত্মভিমানী এবং দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে উঠলেন।

        মুরাইসির যুদ্ধঃ

         মুরাইসি এলাকার বনু মুসতালিকের লোকগণ ইসলাম ধর্ম বিরোধী ছিল। বিশেষতঃ গোত্রের সর্দার হারেস এবং জুয়ায়রিয়ার স্বামী মুশাফি উভয়েই বিশ্বনবী (সা) এর সাথে চরম শত্রুতা পোষণ করছিল। যে কোন সুযোগে তারা মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার করতে এতটুকু কসুর করত না। হিজরী পঞ্চম সনে এইরূপ একটি খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, উক্ত গোত্রের বনু মুসতালিকের লোকেরা মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

        এ সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে বিশ্বনবী (সা) তাদের বিরুদ্ধে একদল আনসার সেনা প্রেরণ করলেন। তারা মুরাইসির প্রান্তসীমায় গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। হারেস মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে পারবে না মনে করে আগে ভাগেই আত্মগোপন করলেন। কিন্তু তার অধীনস্থ লোকগণ পিছু হঠল না। মুসলমানদের সাথে তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করল, কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। মুসলিম সেনাগণ সহজেই জয়লাভ করে প্রায় ছয়শত শত্রুসেনা বন্দী করলেন। তা ছাড়া তাদের প্রায় ২০০০ হাজার উট, পাঁচ হাজার বকরী এবং আরও অন্যান্য প্রব্য মুসলিমদের হাতে আসল। বন্দীগণের মধ্যে হারেস দুহিতা জুয়াইরিয়াও ছিলেন।

        ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতে, যুদ্ধবন্দী সকল শত্রুসেনা গোলামরূপে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টিত হল। বণ্টন জুয়ায়রিয়া সাবিত বিন কায়েসের ভাগে পড়লেন। তখন আত্মভিমানী জুয়ায়রিয়া দাসীজীবনের কথা খেয়াল করে শিহরিয়ে উঠলেন এবং মুক্তিপণ আদায় করে মুক্তি লাভের চেষ্ঠা করতে লাগলেন। তিনি সাবিত বিন করয়েসের কাছে এ প্রস্তাব দেওয়ার নয়। আওকিয়া স্বর্ণের বিনিময়ে তিনি তাকে মুক্তিদান করতে পারেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু জুয়ায়রিয়ার নিকট ঐ পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ ছিল না। তাই তিনি উহা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে বিশ্বনবী (সা) এর খেদমতে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তিনি নিজেই প্রয়োজনীয় অর্থ দান করে তাকে মুক্ত করে দিলেন। হযরত জুয়ায়রিয়া বিশ্বনবী (সা) এর এরূপ উদারতা ও মহত্ত্ব দেখে মুগ্ধ হলেন এবং সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করলেন।

    বিশ্বনবী (সা) এর সাথে বিবাহঃ

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) যখন বন্দীমুক্ত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন তিনি মাত্র বিশ বছরের যুবতী। আল্লাহপাক তাকে অমূল্য নেয়ামত রূপ ও সৌন্দর্য দান করেছিলেন। তাই ধর্মান্তরের সাথে সাথে তাকে নিয়ে এক জটিল সমস্যা দেখা দিল। কেননা জুয়ায়রিয়া এখন পিতা-মাতা, ভ্রাতা, আত্মীয়-স্বজন সকলের সাথেই সম্পর্কহীন। অতএব, এখন তিনি কার আশ্রয়ে ও কিভাবে জীবন যাপন করবেন এবং নিজের ইজ্জত ও মান-সম্মান রক্ষা করবেন? এ সময় মুসলমানদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যে গুটিকতক পুরুষ মুসলমান ছিলেন, তারা প্রায় সকলেই আর্থিক সঙ্কটাপন্ন। নিজ নিজ ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করে চলা মুশকিল। এমতাবস্থায় একজন নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা বা আশ্রয় দিয়ে তার সকল দায়িত্ব মাথায় লওয়া তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। সমস্যার জটিলতায় বিশ্বনবী (সা) ও ভাবনায় পড়লেন। সহসাই তিনি কর্তব্য-স্থির করে নিজের পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করলেন।

        বিশ্বনবী (সা) এর পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব প্রাপ্ত হয়ে জুয়ায়রিয়া আল্লাহপাকের দরবারে অশেষ শোকর জ্ঞাপন করলেন। আনন্দে তার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অতি আনন্দের সাথে তিনি এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করলেন। খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বনবী (সা) এর সাথে হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।

        বন্দীমুক্তি ঘটনাঃ

        বিশ্বনবী (সা) এর সাথে যখন হযরত জুয়াইরিয়া (রা) এর বিবাহের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেল, তখন কিন্তু জুয়ায়রিয়া গোত্রের ছয়শত বন্দী দাসরূপে মুসলিম সেনাদের মাঝে বন্টিত হয়ে গেছে। এমনি অবস্থায় মুসলিম সেনাগণ ভাবলেন, যে বংশে বিশ্বনবী (সা) বিবাহ করবেন সে বংশের কোন গোলাম হিসেবে রাখা উচিত হবে না। কেননা এটা আল্লাহপাকের নবীর মর্যাদার প্রতি অসম্মান দেখানোর নামান্তর। অতএব তারা সকলেই আপনাপন গোলামকে তক্ষুণি আজাদ করে দিলেন।

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর সাথে বিশ্বনবী (সা) এর বিবাহের উসিলায় আল্লাহপাকের রহমতে বনি মুসতালিক গোত্রের ছয়শত বন্দী গোলাম এভাবে মুক্ত হয়ে গেল। এটা জুয়ায়রিয়া (রা) এর পবিত্র বরকতেই সম্ভব হয়েছিল। এ কারণেই হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) কে উল্লিখিত বরকতময় বা কল্যাণকর রমণী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

        উত্তম চরিত্র ও গুণাবলীঃ

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর চরিত্র অতিশয় উত্তম ছিল। তিনি সকলের সাথে দিপ্ত হাস্যে ও মধুর বচনে কথা-বার্তা বলতেন। তার ব্যবহারে যে কোন লোক মুগ্ধ না হয়ে পারত না। সত্য, সততা, বিনয়, ন্যায়-নিষ্ঠা, পরোপকার ও দান-দক্ষিণা তার চরিত্রের অত্যতম বৈশিষ্ট্য।

        তিনি অত্যাধিক ধর্মনিষ্ঠা ও ইবাদতগুজার মহিলা ছিলেন। আল্লাহপাকের দরবারে অত্যাধিক রোনাজারী করা তার নিত্যকার অভ্যাস ছিল। একদা ভোরে তিনি মসজিদে বসে দোয়ায় রত হলেন। এ সময় বিশ্বনবী (সা) মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে তাকে ঐ অবস্থায় দেখে গেলেন। দ্বি-প্রহরে ফেরার সময়ও তিনি তাকে সে একই অবস্থায় দোয়ায় মগ্ন দেখতে পেলেন।

        উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) বলেন, হযরত জুয়ারিয়া (রা) অত্যন্ত মধুর ভষিণী এবং শিষ্টাচারিণী ছিলেন। তার চেহারায় এমন এক উজ্জল সৌন্দর্য ও মধুর কান্তি ফুটন্ত ছিল যে, তাকে দেখা মাত্র লোকের মন শ্রদ্ধায় ভরে যেত।

        তিনি আরও বলেন যে, হযরত জুয়ারিয়া (রা) তাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, আদর করতেন এবং নান ব্যাপারে সাহায্য করতেন। আমাকে বিষন্ন বদনে দেখলে আমার মুখে হাসি ফুটাবার জন্য নানাভাবে চেষ্ঠা করতেন। হযরত আয়েশা (রা) আরও বলেন, হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) অনেক সময় আমাকে তার পূর্ণ জীবনের কাহিনী বলতেন।

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর হাদীস বর্ণনাঃ

        উন্মুল মুমিনীন হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) মাত্র কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা), জাবের (রা), আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা), ওবায়দা বিন আসবাক (রা), এবং কারীর (রা) প্রমুখ ব্যক্তিগণ তার নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ করেছিলেন।

        হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) এর ইন্তিকালঃ

        উম্মুল মুমিনীন হযরত জুয়ায়রিয়া (রা) হিজরী ৫৬ সনের রবিউল আউয়াল মাসে ৭১ বছর বয়ঃক্রমকালে ইনতেকাল করেন। মদিনার গভর্ণর মারওয়ান তার জানাযার নামাযের ইমামতি করেছিলেন এবং মদিনার বিখ্যাত কবরস্থান জান্নাতুল বাকীতে তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন।

Post a Comment

0 Comments