পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, মানুষ সাধারণতঃ নির্জনে একাকী অথবা লোকসমাজে মানুষের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে। তবে নির্জনে একাকী বসবাস করা তার জন্য কঠিন বিধায় মানুষের মধ্যে সমশ্রেণীর লোকদের সংসর্গে বসবাস করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এজন্যই মানুষের সাথে সংসর্গ ও মেলামেশা করে চলবার রীতিনীতি অবগত হওয়া অতি প্রয়োজন। যে ব্যক্তি সমাজে বসবাস করে, তার জন্য সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী চলবার নিয়ম-কানুন পালন করা কর্তব্য হয়। ঘনিষ্টতার বিভিন্ন শ্রেণীর মান অনুযায়ী তাদের প্রতি কর্তব্য নিরূপিত হয়। আত্মীয়তার বন্ধনের জন্য কতগুলো হক দেখা দেয়। শুধু ইসলামিক ভাতৃত্ব সৃষ্টির জন্যও। কতিপয় হক উপস্থিত হয়। তবে সে ব্যাপারে বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং ভালবাসাজনিত কারণে যে কর্তব্য দেখা দেয়, তা' আমি ইতোপূর্বেই বর্ণনা করেছি। তাছাড়া প্রতিবেশির হক, ভ্রমণে সঙ্গীর হক এবং শিক্ষার্থী জীবনে সহপাঠিরও হক আছে। তবে তন্মধ্যে প্রত্যেকটি সম্পর্ক বা বন্ধনের মধ্যে বিভিন্ন স্তর আছে। আত্মীয়তার হক আছে কিন্তু ঘনিষ্ট আত্মায়তার হক অধিকতর এবং অনেক দৃঢ়। ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে হক সর্বাপেক্ষা দঢ় এবং অনেক বেশী। এভাবে প্রতিবেশীর হক আছে কিন্তু গৃহের নৈকট্য ও দূরত্বভেদে তাদের হকেরও প্রভেদ রয়েছে। মোটকথা সম্পর্ক এবং বন্ধনের তারতম্যে হক এবং দাবী-দাওয়ার ব্যবধান হয়।
বিদেশী বা দূরদেশী লোক একই শহরে বা গ্রামে বসবাসের কারণে, নিকটবর্তী প্রতিবেশী হতে পারে। একইভাবে জানাশুনা বা পচিয়ের পরিমাণ অনুসারে ইসলামিক বন্ধনের হক দৃঢ় অথবা শিথিল হয়ে থাকে। সুতরাং পরিচয় ও জান্য শুন্যরও স্তরভেদ রয়েছে। দেখা সাক্ষাতের ফলে যার সাথে পরিচয় হয়, তার হক ঐ ব্যক্তর হক অপেক্ষা অধিক, যার সাথে শুধু তার কথা শ্রবণের মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর তার সাথে মেলামেশা হলে, তার হক আরও মজবুত হয়। এভাবে সংসর্গ ও সাহচর্যেরও বিভিন্ন স্তর আছে। বিদ্যালয় বা স্কুল-সহাপাঠির যে হক, তা' সফর বা ভ্রমণসঙ্গীর হক অপেক্ষা অনেক বেশী। এরূপ বন্ধুত্বের পরিমাণ অনুযায়ী বন্ধুর হকেরও ব্যবধান হয়। যখন বন্ধুত্ব গভীর হয় তখন ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মজবুত হয়। যখন ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মজবুত হয় তখন ভালবাসাও স্নেহ-প্রীতি জন্মে। এই ভালবাসা বা স্নেহ-প্রীতি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে তখন প্রেমের উৎপত্তি হয়। আর সর্বস্বীকৃত যে, বন্ধুর চেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু (খলীল) অধিক নিকটবর্তী। ভালসাবা বা স্নেহ প্রীতি হৃদয়ের অন্তঃস্থলে থাকে এবং প্রেম-পরশ থাকে হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে। প্রত্যক অন্তরঙ্গ বন্ধু বা খলীলই হাবীব বা বন্ধুও (প্রিয়জন) কিন্তু হাবীব বা বন্ধু মাত্রই অন্তরঙ্গ বন্ধু বা খলীল নয়। প্রত্যেক্ষ দর্শন ও অভিজ্ঞতার আলোকে বন্ধুত্বের এই স্তর পার্থক্য উপলব্ধি করা যায়। অন্তরঙ্গ কন্ধুত্বের স্তর ভ্রাতৃত্বের উপরে। এ কথার মর্ম এই যে, অন্তরঙ্গ বন্ধত্ব ভ্রাতৃত্ব থেকেও অধিকপরিপূর্ণ। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "লাওকুনতু মুত্তাখিযান খালীলান লাআত্তাখাযতু আবাবাকরিন খালীলান অলা কিননা ছাহিবুকুম খালীলুল্লাহি" অর্থাৎ আমি যদি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু (খলীল) হিসাবে গ্রহণ করতাম তা' হলে আবুবকরকে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তোমাদের সঙ্গী আল্লাহার খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু।
খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধুর হৃদয়ের বহির্ভাগ এবং অন্তঃস্থলের সর্বস্থান জুড়ে ভালবাসা বা প্রেমে পরিপূর্ণ থাকে। আল্লাহর ভালবাসা ব্যতীত হুযুরে পাক (দঃ) এর হৃদয়মধ্যে অন্য কোন ভালবাসার স্থান ছিল না। আর এই ভালবাসা ও প্রেমের মধ্যে অন্য কোন অংশীদারও ছিল না। হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আলী (রাঃ)কে নিজ ভ্রাতারূপে গ্রহণ করে বলেছিলেন, হযরত মূসা (আঃ) এর নিকট হযরত হারুন (আঃ) এর যে মর্যাদা, নবুওত ব্যতীত আমার নিকট আলীরও তদ্রূপ মর্যাদা। তিনি হযরত আলী (রাঃ) কে নবুওত থেকে পৃথক রেখেছেন। যেরূপ তিনি হযরত আবুবকর (রাঃ) কে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব থেকে পৃথক রেখেছেন। হররত আবুবকর (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মধ্যে শরীক করেছিলেন এবং এর উপরও তিনি তাঁকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণের অতি নিকটবর্তী হয়েছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) ও তা' পাবার যোগ্য ছিলেন। তিনি তাঁকে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু বলেন নি। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) এর বাক্যইএরূপ ছিল যে, আমি আবুবকরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। হুযুরে পাক (দঃ) আল্লাহতায়ালার হাবীব ও খলীল দু'টোই ছিলেন। যেমন বর্ণিত আছে। একদা হযরত রাসূলে করীম (দঃ) প্রফুল্লচিত্তে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। যেরূপ তিনি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। আমি আল্লাহর হাবীব অর্থাৎ বন্ধু, আমি আল্লাহর খলীল অর্থাৎ অন্তরঙ্গ বন্ধু।
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, পরিচয়ের পূর্বে বন্ধুত্বের বন্ধন নেই এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের পরে বন্ধুত্বের কোন স্তর নেই। এই পরিচয় এবং অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের মাঝে বিভিন্ন স্তর রয়েছে। আমি সংসর্গ ও ভ্রাতৃত্বের হক বা দাবী-দাওয়ার বিষয় পূর্বেই বর্ণনা করেছি। তার সাথে সাথে যে ভালবাসা ও প্রেম আছে তা' সংসর্গ ও ভ্রাতৃত্বের মধ্যে এসে যায়। উক্ত হকসমূহের মধ্যে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের তারতম্য অনুসারে তার স্তরেরও ব্যবধান হয়। এমনকি তার সর্বশেষ প্রান্তের ধন-প্রাণ সম্বন্ধে 'ইছার' অর্থাৎ উৎসর্গ করা হয় বা অন্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নিজের প্রয়োজন ত্যাগ করা হয়। যেরূপ হযরত আবুবকর (রাঃ) হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং যেরূপ হযরত তালহা (রাঃ) তাঁর শরীরের মাধ্যমে উৎসর্গ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি জিহাদের ময়দানে হুযুরে পাক (দঃ) এর দৈহিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিজ দেহ তাঁর দেহের সামনে ঢালস্বরূপ পেতে রেখেছিলেন।
0 Comments